বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৩:৩২ পূর্বাহ্ন

ডায়েরি : ছবি আঁকার গল্প – কাজী সালমান শীশ

ডায়েরি : ছবি আঁকার গল্প – কাজী সালমান শীশ

[ লেখাটা আমার ডায়েরি থেকে নেয়া। রচনাটি সত্য ও ব্যক্তিগত সত্য বিশ্বাস থেকে লেখা। ]
আমার জন্ম ১৯৮২ সালে। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় শিশু অবস্থায় আমার আঁকাআঁকি শুরু। আম্মার কাছ থেকে শোনা- তিনি তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়ার গাইনোকজিস্ট। অপারেশনের কল আসলে তাঁকে হাসপাতালে যেতে হত সকাল, দুপুর, রাতে যে কোনো সময়ে। একদিন বিকালে বুয়ার ( ‍গৃহপরিচারিকা) হাতে আমাকে রেখে চলে যান অপারেশন করতে; আর আমার হাতে দিয়ে যান রং পেন্সিল। ঘন্টা দুয়েক পর ফিরে এসে দেখেন আমি তখনো ছবি আঁকছি! আমি এঁকেছিলাম- মায়ের কোলে ছোট্ট একটা বাচ্চা শুয়ে আছে। আম্মা অভিভূত হয়। তাঁর মনে হয়, ‘আমার তিন বছরের বাচ্চাটার কতই না মায়ের কথা মনে পড়েছে, তাই এই ছবিটা এঁকেছে!’ সমস্তটাই শোনা কথা, আমার স্মৃতিতে নেই বলাই বাহুল্য।

ছবি আঁকার দিকে ঝোঁক দেখে আমার আব্বা-আম্মা বিশ্বজিৎ স্যারকে দায়িত্ব দেন যেন উনি সপ্তাহে একদিন বাসায় এসে আমাকে আঁকা শেখান। তখন আমার বয়স হবে ৬-৭, লালবাগে ওয়াসার কোয়ার্টারে থাকি। দীর্ঘদিন আমি তাঁর কাছে আঁকা শিখি খেলার ছলে। উনিই প্রথম ক্যামেল পোস্টার কালারের বোতল এনে দেন। আমি মহানন্দে রং করি। যা খুশি মনের মত আঁকি। তখন কুয়েত দখল নিয়ে ইরাক-আমেরিকা যুদ্ধ শুরু হয়েছে ১৯৯০-এ। সেসময় আমি খাতার পর খাতা যুদ্ধের ছবি আঁকি। কামান, পতাকা, বন্দুক, সাদ্দাম, বুশ, যুদ্ধ-বিমান ইত্যাদি। খাতাগুলো সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে গেছে। লুবনা আপা ছিলেন আমার ছবি আঁকার দ্বিতীয় প্রশিক্ষক। তিনিও বাসায় এসে আঁকা শেখাতেন এবং খুব আদর করতেন। আমি ইচ্ছা মত আঁকতাম যথারীতি। অজান্তেই মনে গেঁথে যায়- ছবি আঁকা খুব স্বাধীন একটা বিষয়।

আঁকা শেখা যে স্বাধীন ব্যাপার না তা বুঝলাম আরো পরে। লুবনা আপা কোথায় যেন চাকরি নিয়ে চলে গেলেন। আরেকজন নতুন শিক্ষক এলেন (নাম মনে নেই) চারুকলা থেকে পাশ করা ছাত্র। তিনি আমাকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ছবি আঁকার কথা বললেন, যা সারসংক্ষেপে অনেকেটা এরকম- ‘মন থেকে ছবি আঁকা যাবে না। ছবি আঁকতে হবে দেখে দেখে। দীর্ঘকাল দেখে দেখে ছবি আঁকা শিখে তারপর মন থেকে ছবি আঁকতে হয়। এটাই নিয়ম।’

আমার শিশু মন কিছুটা আহত হল। আমি আর মন থেকে গাছ, কুঁড়ে ঘর, খড়ের গাদা, নৌকা, নদী, হাতি, খেজুর গাছ, পাহাড়, যুদ্ধ আঁকতে পারবো না! আসলেই তাই হলো। উনি একটা ট্রান্সপারেন্ট হুইস্কির খালি বোতল এনে দিলেন স্টিল লাইফ আঁকার জন্য। অবহেলার সাথে শুরু করলেও একসময় এঁকে ফেলতে পারলাম, শিখলাম কিভাবে ভাগ ভাগ স্ট্রাকচার করে ছবি আঁকতে হয়। একটু পারদর্শী হওয়ার পর আমার দাদা প্রখ্যাত সাংবাদিক কাজী মোহাম্মদ ইদরিসের একটা ছবি স্কেচ করে পরিবারের সকলের কাছে প্রশংসিত হলাম। দাদী, আব্বা, বড় ফুপু… আমার দাদী কাজী আজিজা ইদরিস সেই আমলে (১৯৯৭ সাল) আমাকে ৫০০ টাকা দিয়েছিলেন ছবিটার জন্য। ছবিটা এখনো আমাদের ড্রইংরুমের দেয়ালে বাঁধানো আছে।

সবকিছু ঠিক আছে কিন্তু গদবাঁধা আঁকায় আমার ধৈর্য থাকত না। পাবলো পিকাসোর আঁকা ‘The Weeping Woman’/ ‘ক্রন্দনরত নারী’ (১৯৩৭) বই থেকে দেখে দেখে আঁকতে দিয়েছিল আমার স্যার। আমি সব ঠিক করে এঁকেছিলাম কিন্তু শেষে ধৈর্য হারিয়ে ফেলে মেয়েটার চুলগুলোতে নীল রং দিয়ে লম্বা দাগ দেই। এতে স্যার আমার ওপর ভীষণ রেগে যায়। সিদ্ধান্ত নেয় আমাকে আর আঁকা শেখাবেন না। সেখানেই আমার প্রাতিষ্ঠানিক অংকন শিক্ষার ইতি।

আবার লম্বা বিরতি।
২০০২ সালে একটি মেয়ের প্রেমে পড়ি (সঙ্গত কারণেই নাম প্রকাশ করছি না)। সে আমাকে উৎসাহ দেয় আবার ছবি আঁকার জন্য। কাগজ, ২বি পেন্সিল, জার্মান স্টেডলার ইংক পেন কিনে দেয়। আমি আবার একটু একটু করে স্কেচ করতে থাকি। নিজের মনের মত আঁকি। প্রায় ৭০টার মত ছবি এঁকেছিলাম কাগজে, আর অল্প কিছু ছবি ক্যানভাসে। একবার তার সাথে কঠিন ঝগড়ার পর প্রায় সব ছবি ছিঁড়ে ফেলি! ক্যানভাসে আঁকা ছবিগুলো ব্লেড দিয়ে কাটি! মানুষ সাধারণত অভিমান করে গ্লাস, মোবাইল, টেলিভিশন ভাঙ্গে, আর আমি ধ্বংস করেছিলাম সবচেয়ে প্রিয় জিনিসগুলো- আমার ছবি। এই ধ্বংসটাকে অনেকটা আত্মহননের বিকল্প আমি বলব। আব্বা-আম্মা রাতে বাসায় এসে দেখে পুরো ঘর কাগজের টুকরায় ভরে আছে। চিন্তিত হয়ে আম্মা আমাকে মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে পাঠায়। উল্লেখ্য ছেঁড়া ছবিগুলো যতগুলো পেরেছি আঠা, টেপ ও কাগজ দিয়ে একভাবে রক্ষা করেছিলাম। ছবিগুলো এখনো আমার আলমারিতে গুছিয়ে রাখা আছে। খুব অন্ধকারাচ্ছন্ন দিন কেটেছে ২০০২ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত।

ছবি আঁকা বন্ধ হয়ে যায়। আবার পুরোপুরি বন্ধও হয় না কারণ আমার আব্বা, বড়ভাই, আম্মা ও কাছের পরিচিত মানুষ বই ছাপালে প্রচ্ছদ আঁকার দায়ভার বর্তাত আমার ওপর। তাই প্রয়োজনে বছরে ২-১টা বইয়ের কভার ডিজাইন করে এসেছি। অন্যরা সরে গেলেও আমার আব্বা এখনো আমাকে দিয়ে তাঁর বইয়ের প্রচ্ছদ করান। আব্বার রচিত ১৮টা বইয়ের মধ্যে ১৪টা বইয়ের প্রচ্ছদই আমার করা। এছাড়া আব্বা বারিধারার ফ্ল্যাটের সদর দরজার ডিজাইনও আমাকে দিয়ে করান।

২০১৭ সালে আবার ছবি আঁকা শুরু করলেও, বড় আকারে আঁকা হয় ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে; যখন আমি জার্মানিতে করোনার কারণে বন্দী। এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্মমেকিং এর ওপর শর্ট কোর্স করতে যাই মেট ফিল্ম স্কুল বার্লিনে। দুই সপ্তাহ ক্লাসের পর, ২৭ মার্চ ২০২০-এ জার্মানিতে করোনাভাইরাসের জন্য লকডাউন ঘোষণা করা হয়। আমি একা একা বার্লিনের ছোট্ট একটা ঘরে দিন কাটাই। জার্মান (ডয়েচ) ভাষাও আমার জানা নেই। শুরু হলো দিনরাত ল্যাপটপ নিয়ে পড়ে থাকা। করোনা পরিস্থিতি একটু কমলে, আমার ফ্ল্যাটমেট মাইকেলকে জিজ্ঞেস করে ৩-৪ স্টেশন দূরে কার্ল মার্ক্স স্ট্রিটে সন্ধান পাই ছবি আঁকার সরঞ্জাম কেনার দোকানের মেটালিক কালার কিনে আঁকা শুরু করে দিলাম। এবার আর কোনো বাধা নেই। নিজের ইচ্ছা মত ছবি আঁকতে থাকলাম প্রতিদিন। মেটালিক কালার, ওয়াটার কালার পেন্সিল ও অয়েল প্যাস্টেল (মোম রং) দিয়ে প্রতিদিন অন্তত একটা ছবি আঁকতাম। ঈদের পরের দিন দেশ থেকে এক বন্ধু ফোন করে জিজ্ঞেস করল, ‘কি করেছিস ঈদের দিন?’ বললাম, ‘কিছু না, তিনটা ছবি এঁকেছি।’ একদিনে তিনটা ছবি আমার কাজের গতি অনুযায়ী অনেক বেশি।

বিমূর্ত সেই ছবিগুলোর বিষয়াদী ছিল সরীসৃপ, প্রকৃতি, নারী, অন্ধকার, অতীত, ভবিষ্যৎ, আদি-বিশ্ব ও সমুদ্রতল। তবে সবচেয়ে বেশি ছবি আঁকা হয়েছে- অসীমতা (স্পেস), সময় (টাইম) নিয়ে। সব মিলিয়ে প্রায় তিনশর মত ছবি আমি বার্লিনে বসে এঁকেছি। ছবিগুলোর নাম ইংরেজিতে দেয়া। কেন মাতৃভূমিসম মাতৃভাষা বাদ দিয়ে ইংরেজিতে নামকরণ করেছিলাম, সে কথা অন্যসময় লেখা যাবে। ছবিগুলো নিরাপদে আমার কাছে রয়েছে। আব্বা একবার বলেছিল কাজগুলো থেকে বেছে একটা বই বের করে দিবে। একপাশে ছবি থাকল, আরেকপাশে ছবি সম্পর্কে কয়েকটা লাইন। শেষ পর্যন্ত আমার উদ্যোগের অভাবেই কাজটা হয়ে ওঠেনি। হয়ত ভবিষ্যতে হবে। শ’খানেক ছবি বাঁধিয়ে একটা প্রদর্শনী করার ইচ্ছা আছে। সেক্ষেত্রে ছবিগুলো কিছুটা হলেও মুক্ত হবে। কিছুটা হলেও প্রায়শ্চিত্ত হবে ছোটবেলায় ছবি ছিঁড়ে ফেলার অপরাধের।

দিনলিপি : কাজী সালমান শীশ
ইস্কাটন, ঢাকা
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২
পরিমার্জন : ২৯ আগস্ট ২০২৩

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge