বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৫:৩৩ পূর্বাহ্ন

ইলিশ অথবা আত্মতৃপ্তির গল্প-রানা মাসুদ

ইলিশ অথবা আত্মতৃপ্তির গল্প-রানা মাসুদ

হোসেন সাহেবের মনটা বেশ উৎফুল্ল। শুধু উৎফুল্ল বললে ভুল হবে তিনি আসলে আনন্দিত। অতি আনন্দিত। আনন্দিত হবার কারণটা অনেকের কাছে খুব সাধারণ হলেও হোসেন সাহেব ও তার পরিবারের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তার আনন্দ পরিবারের সদস্যদের মাঝে মানে বিশেষ করে তার সহধর্মিনী, তার বৃদ্ধা মা এবং ছোট মেয়েটার মাঝে বেশি সংক্রমিত হয়েছে। ওরাও ওদের বডি ল্যাংগুয়েজ দিয়ে নানান ভাবে সে আনন্দ প্রকাশের চেষ্টা করছেন। এই এখন যেমন হঠাৎই হেসে হেসে মিসেস হোসেন কাজের মেয়েটাকে বলছেন- কিরে চেংরি বিয়া বাড়ির জন্য পেঁয়াজ বাটছিস নাকি?
হ্যাঁ গৃহ সহকর্মী মেয়েটা যাকে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় মিসেস হোসেন চেংরি বললেন তার নাম কুলসুন। কুলসুনও মহা খুশি। খুশির চোটে সে কিছু কাজ অতিরিক্ত করে ফেলছে। এই এখন যেমন রান্না ঘরের সিলিন্ডার গ্যাসের চুলাটা আরেকবার মুছতে মুছতে বললো- চাচিম্মা দ্যাখছেন কী সোন্দর বাসনা বেড়াইছে চুলাত না তুলতেই?
-‘কইগো তোমাদের আয়োজন কতদূর?’ হোসেন সাহেব গলা খাকারি দিয়ে রান্না ঘরের দরজায় উঁকি দেন। তারপর বলতে থাকেন-‘ কি গো তোমার কোনও প্রশ্ন নাই কেন?’
-‘ ওমা কীসের জন্য প্রশ্ন থাকবে’? মিসেস হোসেনের উত্তর।
– ‘ আরে তোমাকে তো ঘটনা বলাই হয়নি। আমাদের অফিসের আজিজ সাহেব আছে না উনিই প্রথম ঝোঁক তুললেন। বললেন হোসেন সাহেব চলেন বাজারে যাই। আজকাল বাজারে যেতেও তো ভয় লাগে।’ আমি বললাম, ‘ভাই আমার বেতন পাবার পর বাড়িতে মাসিক বাজার করে দেই। মাঝে মধ্যে হঠাৎ মঠাৎ রাতের দিকে বাজারে যাই। একটু কমে চাষের ছোট পাঙ্গাস, তেলাপিয়া, কার্পু, সিলভার কাপ কিংবা সব্জি টব্জি কিনি। আমার বাজারে যেয়ে কাজ নাই, আপনি যান।’
– ‘ আহা ভাই অতো হিসেব করে জীবন চলে না। জীবনের জন্য শখ- আহ্লাদ থাকবে। চলেন চলেন…’
-‘ ভাই শখ আহ্লাদ করতে টাকা লাগে। আমার হিসেবের টাকা। এই বেসরকারি ব্যাংকের চাকরির বেতনে শখ আহ্লাদ চলে না।’
-‘ হোসেন ভাই শোনেন আমিও তো আপনার রেঞ্জেই বেতন পাই। আমাদের তো কোনও বাড়তি কামাই নাই। আমার চেয়ে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা আর কে বুঝবে? লোকে ভাবে পরিপাটি ফর্মাল পোশাকে টাই, সু পরে বাবু সাহেব হয়ে বেড়াই বলে নিশ্চয়ই অনেক টাকা আমাদের। আসলে বাইরে দেখে কে কারটা বোঝে?’
– ‘ ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনার খরচ ধাই ধাই করে বেড়েছে। জিনিস পত্রের দাম আসমান ছুঁয়েছে। এক ইউক্রেন- রাশিয়ার যুদ্ধ আমাদের বারোটা বাজিয়ে দিল।’
– ‘ক্যান আমাদের দেশী মাছ, সব্জি এসব কি ইউক্রেন না রাশিয়া থেকে আসে’?
– ‘ তা আসে না। জিম্মি তো আমরা নানান খানেই। থাক ভাই আমার গিয়ে কাজ নেই আপনি যান।’– আমার এসব কথার পর আজিজ সাহেব কি বললেন জানো?
হোসেন সাহেবের কথা শুনে তার স্ত্রী বেশ মজাই পাচ্ছে। লোকটা খুব আনন্দিত। আনন্দের চোটে মুখে খৈ ফোটার মতো কথা ফুটছে। এমনিতেই তিনি মানে হোসেন সাহেব খুব মেপে কথা বলেন। তারপর অফিস থেকে ফেরার পর তো আর কথাই বলেন না তেমন। একদম দুই চারটা কথা মেপে বলেন। মিসেস হোসেন বললেন- তা আজিজ সাহেব কি বললেন তার আমি কীভাবে বলবো!’
– ‘আজিজ সাহেব বললেন বুঝলে লোভ ধরানো কথা’।
-‘ খুব ভনিতা হচ্ছে দেখছি’?
– ‘আরে শোনই না, আজিজ সাহেব খুব একটা ভাব নিয়ে বললেন, হোসেন সাহেব বাজারে শুনলাম বেশ ইলিশ উঠেছে। আমি বললাম, উঠলে উঠেছে। তাতে আমার কি! আমি তো আর দুই হাজার কিংবা চব্বিশ শো টাকা কেজি দামে ইলিশ কিনতে পারবো না। সেই সামর্থ্য নাই, সেই আগ্রহও নাই। ইলিশ কিনেছিলাম আমাদের ছোটকালে আব্বার সাথে গিয়ে। তখন কেজির হিসেব ছিল না। ইলিশের সের ছিল মাত্র চল্লিশ,পঞ্চাশ টাকা। ভাবতে পারো? আবার বাজারে যেদিন বেশি চালান আসতো সেদিন মাইকিং করে ইলিশ মাছ বিক্রি হতো ডিসকাউন্ট রেটে। আমি তখন হাই স্কুলের ছাত্র। কতদিন ডিসকাউন্টে ইলিশ বিক্রির মাইকিং শুনেছিলাম ক্লাসে বসে থেকেই।
– ‘তারপর কি হলো তাই বলো শুনি ‘।
-‘ তারপর আজিজ সাহেব বললেন, ইলিশের দাম অনেক কমেছে সাহেব। এখন নয়শো গ্রাম থেকে কেজি সাইজের ইলিশ বারো থেকে চোদ্দশো টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এ সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। বাঙালির পাতে ইলিশ বছরে একদিনের জন্যেও আসবে না তা হতে পারে না। আবার অপেক্ষাও করা ঠিক হবে না। দাদারা বেশি দাম দিলে সব আবার ওপারে চলে যাবে তখন আবার বাজার চড়বে।’
-‘ আহ্ ইলিশ! শুনে আমার জিভে জল চলে এসেছিল। বুঝলে গো, আজিজ সাহেবকে বললাম আমার মা’কে দেখেছিলাম বাড়িতে দুই কেজি সাইজের নিচে ইলিশ আব্বা নিয়ে এলে মায়ের পছন্দই হতো না।’
-‘ হয়েছে হয়েছে আর অতীত হাস্তাতে হবে না। দুই কেজির ইলিশ তো দূরের কথা এক কেজি সাইজের ইলিশ তুমি আমাদের বিয়ের এতো বছরে কয়টা এনেছো বলো?’
-‘ আচ্ছা হোক। যার যা সাধ্যা। তারপর তো আজিজ সাহেবের কথায় আমারও মনটা নেচে উঠলো। বছরে অন্তত দু একদিন সপরিবারে ইলিশ খাবো না তা তো হতে পারে না। মানিব্যাগ হাতড়ে দেখলাম মাত্র ছয়শো টাকা সেখানে। তখন মনে পড়লো সিগারেট টানা ছেড়ে দেবার জন্য বেশ কিছুদিন ধরে যে রেশনিং করছি তাতে করে প্রতিদিন ওই সিগারেটের টাকা ড্রয়ারে একটা খামে রেখে দেই। ওটা বের করলাম। দেখি দুই হাজার টাকার মতো জমেছে। আমার বুদ্ধি দেখলে। সিগারেটের বিষ খাবার চেয়ে সে টাকা জমিয়ে ইলিশ কেনা অনেক ভালো নিশ্চয়ই। আমি আজিজ সাহেবের সাথে গেলাম সিটি বাজারে। এলাহি কাণ্ড! বাজার ভর্তি অপূর্ব রূপালী ঝলক। মনটা ভরে গেল-আমাদের জাতীয় মাছ বলে কথা। তবে মন ভালো বেশিক্ষণ থাকলো না। দাম শুনে আর মাছের সাইজ দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। বুঝলে গো ইলিশ কেনা অতো সহজ না। তুমি বাজার গেলে দেখবে দোকানের সব লিচু দিনাজপুরের, সব আম রাজশাহীর আর সব ইলিশ পদ্মার। হা হা হা। আমি হচ্ছি একজন ছোট খাটো ইলিশ বিশেষজ্ঞ। ইলিশ কিনতে হয় প্রথমে মুখ দেখে। সরু মুখের ইলিশের স্বাদ হয় সেরা। তারপর আঙুল দিয়ে ইলিশের গা টিপে দেখতে হয়। বেশি তুলতুলে হলে বুঝবে ভ্যাজাল আছে। মাছ দোকানদার ইলিশের কানকো তোমাকে দেখাবে। আমাকে অতো বোকা মনে করে। আরে দোকানদার ইলিশের কানকোতে যে রং লাগিয়ে রাখবে না তার গ্যারান্টি আছে?’
-‘ খালুজান আরেকনা কন তো আর কি কি দেখি ইলিশ কেনা নাগে।’
-‘ ওই চ্যাংরি তুই বাজার যাইস নাকি? শোন কানকো না দেখে চোখ দেখবি। ইলিশের চোখ যদি দেখিস স্বচ্ছ বা নীল ধরনের হয় তাইলে ঠিক আছে। ঘোলা বা ভেতরে ঢোকা চোখের ইলিশ হলেই বুঝবি কেস খারাপ। সবচে বড় কথা ইলিশ কিনতে হবে চকচকে রূপালি দেখে। নদীর ইলিশ চকচকে রূপালি হয়।’
-‘ এই তুমি রান্না ঘর থেকে যাও তো। তোমার ইলিশ লেকচারে মাথা ধরে গেল।’ হাসতে হাসতে বললেন মিসেস হোসেন। তার কথা তেমন একটা গায়ে মাখলেন না হোসেন সাহেব। তিনি ইলিশ নিয়ে তার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেই থাকলেন। ‘ তারপর শোনোই না পরের ঘটনা। দেখি এক কেজির নিচের সাইজের ইলিশের দাম চোদ্দশো টাকা কেজি আর কেজির ওপর একটু বড় সাইজের হলো আঠারোশো টাকা কেজি। আজিজ সাহেব তো ওই চোদ্দশো টাকার ছোট সাইজের ইলিশ নিলেন দুইটা। আমি তো আগেই বলেছি,আমাদের বাড়িতে আগে দুই আড়াই সেরের সাইজের নিচে ইলিশ আসতো না। ভালো জিনিস অল্প খাওয়া ভালো, কি বলো? আমি করলাম আঠারোশো টাকা কেজি দামের একটা দেড় কেজি ওজনের বিশাল ইলিশ নিলাম চব্বিশশো টাকা দিয়ে। ইয়া বড় একটা মাছ। আহ্ কী সুন্দর গোবদা সাইজের মাছ! গোটাল মাছটা আনতে চেয়েছিলাম সবাইকে দেখাবো বলে কিন্তু এই সন্ধ্যার টাইমে তোমাদের মাছ কাটতে কষ্ট হবে বলে কেটেই আনলাম। শোনো বউ আমি বুদ্ধি করে তিন ভাগ করে এনেছি। আজ তুমি এক ভাগ রান্না করবে ঝোল ইলিশ। ইলিশ রানতে তো তেমন ঝামেলার কিছু নেই। খালি পেঁয়াজ বাটাটা পরিমাণ মতো হলেই হলো। সাথে দুই চারটা পটল চার ফালি করে দিও। কাল রাতে রান্না করবে সরষে ইলিশ। আমি বাজার থেকে টাকটা সরষে কিনে এনেছি, একটা ছোট ঠোঙায় আছে। আর শেষের দিন করবে ইলিশ ভাজি। ফ্রিজে ইলিশ রেখে খেলে ভাজি খেতে হয় শেষের দিকে। তখন মাছ একটু হার্ড হওয়া শুরু করে। হার্ড হওয়া ইলিশের ভাজা খেতে অসুবিধা নাই শুধু চামড়ার অংশে যেন মসলা ঠিকঠাক ঢোকে তা খেয়াল রাখতে হয়।’
মিসেস হোসেন মিটি মিটি হেসেই চলছেন। হোসেন সাহেবের বকবকানি তিনি উপভোগ করছেন। এ উপভোগে একটা আলাদা সুখ আছে। যাদের অনেক আছে তারা জীবনের এরকম ছোট ছোট আনন্দ জানেন না। জীবনে এরকম ছোট ছোট আনন্দ আছে বলেই জীবন উপভোগ্য হয়। এমন সময় কলিং বেলের শব্দ শোনা গেল। কেউ এসেছেন নিশ্চয়ই। হোসেন সাহেব মেইন দরজার দিকে এগোন।
হোসেন সাহেবের ফ্ল্যাটটা মোটামুটি ধরনের। বাবার রেখে যাওয়া আট শতাংশ জমিতে ডেভলপারের কল্যাণে তারা চার ভাই তিন বোন সাড়ে সতেরোশো স্কোয়ার ফিটের তিন বেডের একটি করে ফ্ল্যাট পেয়েছেন। এতেই তাদের দিনগুজরান চলছে। রান্নাঘর থেকে বের হয়ে ড্রইং ডাইনিংয়ের স্পেসটা পার হয়ে তিনি ফ্ল্যাটের মেইন দরজা খোলেন। তারপর আনন্দিত হয়ে বলে ওঠেন আরে তোরা? আয় আয়,ভেতরে আয়।’ হোসেন সাহেব আনন্দিত গলায় জোরে বলে ওঠেন-‘কইগো দেখো কে এসেছে।’ ভেতরে ঢোকেন হোসেন সাহেবের ছোট বোন মিতা, মিতার জামাই শরিফ আর দুই ছেলে। ওরা ড্রইং রুমে বসে। মিতা ভেতরে যায় আগে মায়ের সাথে দেখা করতে। তাদের মা হোসেন সাহেবের কাছেই থাকেন। হোসেন সাহেব চট করে রান্না ঘরে যান। স্ত্রীকে বলেন-‘মাছের পিস বাড়ায় দাও। মিতা জামাই, ভাগ্নাদের নিয়ে আসছে। ওদের তো না খাইয়ে যেতে দেয়া ঠিক না। বুঝলে গো এর নাম রিজিক। আল্লাহপাক ওদের ভালো দিনেই এনেছেন। ঘরে ইলিশ আছে, জামাইকে খাইয়ে শান্তি পাবো।’
– ‘ঠিক আছে। তবে তুমি আরেকটা কাজ করতে পারো একটু দৈ নিয়ে আসতে পারো। মিতার বাচ্চাদের বৈশাখীর দৈ খুব পছন্দের। ‘
-‘ দেখি তাহলে। আচ্ছা আরেকটা কাজ করবো নাকি-উপর থেকে রাশেদদেরকেও ডাকি ? ওরাও আসুক। সবাই মিলে একটু গল্প গুজব করি। কি বলো?’
-ওমা আমি আবার কী বলবো? তোমার ছোট ভাই, ভাইয়ের বৌ, বাচ্চা আসবে তাতে আমার আবার কী সমস্যা! আমি কি ওপার বাংলার সিরিয়ালের খান্নাস টাইপের ভাবি?’
-‘ ছিঃ ছিঃ তাই বলেছি কখনও। আমার পরিবারে থুক্কু আমার চোদ্দ গুষ্টির কাছে তুমি হলে সেরা বৌ। তোমার ইমেজ আমার চাইতেও তিন গুণ বেশি ভালো। তাহলে ওদেরকেও ডাকি। কি আছে দুনিয়ায় মাছ আসবে মাছ যাবে। এক কাজ করো সবটাই রান্না করে ফেলো। আরেকদিন আল্লাহ চাইলে সরষে ইলিশ আর ভাজা খাওয়া যাবে। যাই বলো মিতা আর জামাই ভালো দিনে এসেছে। আর হ্যাঁ শোনো একটা পিস গার্ডটার জন্য রেখো। সে ডেভলপারের গার্ড হলেও আমরাও তো সার্ভিস পাই। দিও ওকেও এক পিস মাছ দিও। দেখো বড় মাছ, আমি আবার পেট ও পিঠ একসাথেই করে বড় বড় পিস করে এনেছি। তোমার এসিটেন্টকে সাবধানে নাড়তে বলিও। নাহলে ভেঙে সব একেকার করে ফেলবে। এই ফাঁকে আমি রাশেদদের বলে তারপর দৈ নিয়ে আসি।’ হোসেন সাহেব চলে গেলেন।
খাবার ঘরটায় মোটামুটি একটা উৎসব উৎসব পরিবেশ বিবাজ করছে। হোসেন সাহেবের এক বোন আর এক ভাই এই শহরে থাকেন। বাকিরা বাইরে, ঢাকা ও খুলনায়। তাই এই তিন ভাই বোনের মিলনটাও অনেক আনন্দের কেননা নানাবিধ ব্যস্ততার জন্য এক শহরে থেকেও তারা অনেক দূরে থাকেন যেন। হোসেন সাহেব তো একটু দিলখোলা আর আমুদে মানুষ। তিনি খাবার টেবিলের পরিবেশ জমিয়ে রাখলেন। সকলের অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি খেতে বসেননি। তার কথা আগে অতিথিরা খাবেন তারপর তিনি আর তার সহধর্মিণী একসাথে খাবেন। পরিবারের সকলেই জানেন হোসেন সাহেব রাতে স্ত্রী, সন্তানসহ খেতে পছন্দ করেন। এছাড়াও ডাইনিং টেবিলের স্পেস ও চেয়ারের সংখ্যাও একটা সমস্যা। সকলকে তিনি ও তার স্ত্রী দুজনে মিলে খাবার তুলে দিলেন। হোসেন সাহেব কাজের মেয়েটাকে দিয়ে গার্ডের জন্য এক পিস মাছ পাঠালেন। মেয়েটাকেও আগে খাওয়ার দিলেন মিসেস হোসেন। জামাইয়ের ইলিশের রান্না খুব পছন্দ হয়েছে। সে একাই তিন পিস খেয়েছে। জামাই বলে কথা। হোসেন সাহেব নিজেই তিন নম্বর পিসটা জামাইয়ের পাতে তুলে দিয়ে ছোট বোনের দিকে সস্নেহে তাকান। চোখের ভাষায় বলেন, আরে পাগলি জামাইটাকে তেমন খাতির যত্ন করতে পারি না। খাউক একটু আজ বেশি। বাচ্চারা ইলিশের ডিম পেয়ে মহা খুশি। মিসেস হোসেনের মজাদার রান্নার স্বাদ তারাও উপভোগ করে। এমনকি হোসেন সাহেবের বৃদ্ধা মাও এই রাতের বেলা লাইটের স্বল্প আলোতে কাঁটা বেছে বেছে ইলিশের স্বাদ মজা করেই উপভোগ করেন।
সবাই বসার ঘরে যেটা একদম খাবার ঘর লাগোয়া ওখানে বসে দৈ, ড্রিংস মানে কোকের গ্লাসে চুমুক দিতে থাকেন। হোসেন সাহেব এবার স্ত্রীকে তাড়া দেন খেতে বসার জন্য। হোসেন সাহেবের স্ত্রী বলেন-‘ তুমি বসো আমার খেতে ইচ্ছে করছে না ‘
-‘ ওমা ওটা কোনও কথা হলো? আসো আসো খুব খিদে পেয়েছে। আসো। ‘ হোসেন সাহেব স্ত্রীর হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেন। প্লেট এগিয়ে দেন দুজনের জন্য। ভাতও তিনি তুলে দেন। হঠাৎই কী যেন হয়। মিসেস হোসেন খুব উদাস হয়ে প্লেটের ভাত নাড়া চাড়া করতে থাকেন। হোসেন সাহেব বলেন-‘ দাওতো ইলিশের বাটিটা এগিয়ে…’
মিসেস হোসেন ঢাকনি দেয়া মেলামাইনের বাটিটা হোসেন সাহেবের দিকে এগিয়ে দেন। হোসেন সাহেব বাটির ঢাকনিটা খুলে মিসেস হোসেনের দিকে তাকান। ‘ আরে দেখো দেখি কাণ্ড বাটির সব মাছ শেষ। যাও দেখি রান্নাঘরের পাতিল থেকে মাছ নিয়ে আসো।’
মিসেস হোসেন কিছু বলেন না। খালি বাটিটা হোসেন সাহেবের দিকে এগিয়ে দেন। হোসেন সাহেব সেই বাটিটা নিয়ে রান্নাঘরে যান। কিছুক্ষণ পর খালি হাতে ফিরে এসে স্ত্রীর কাঁধে হাত রাখেন-‘ দেখো দেখি আমার কাণ্ড! সব ইলিশের পিস অতিথিদের দিয়ে দিয়েছি। আচ্ছা হোক। সর্বদেবময়োহতিথি। অতিথি গুরুর মতই পূজনীয়, তুলনীয়। ওরা খেয়ে শান্তি পেয়েছে ওতেই আমার সুখ। আসো আমরা ইলিশের একটু ঝোল আছে ওটা দিয়েই খাই।’
মিসেস হোসেন কিছু বলেন না। চোখের পানি আড়াল করার জন্য তিনি হাত ধোয়ার ছল করে খাবার টেবিল থেকে উঠে বেসিনের দিকে এগোন।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge