বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৫:৪১ পূর্বাহ্ন

‘আমি নিজেকেও আন্ডররেটেড মনেকরি-এটা আত্মবিশ্বাস থেকে বলা’-মজনুর রহমান

‘আমি নিজেকেও আন্ডররেটেড মনেকরি-এটা আত্মবিশ্বাস থেকে বলা’-মজনুর রহমান

আজ মজনুর রহমান এর জন্মদিন! তার জন্মদিনে কবিকে জানুন পাতাপ্রকাশ এর জন্য শিস খন্দকার এর নেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে…
মজনুর রহমান-মূলত কবি হিসেবেই পরিচিত সমসাময়িক সাহিত্যাঙ্গণে। রংপুর অঞ্চলের সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে ‘জাতকবি’ হিসেবে যাঁরা বিবেচিত, তাঁদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
শিস খন্দকার : কেমন আছেন? এবারের গ্রীষ্মকাল কেমন কাটছে?
মজনুর রহমান : আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। গ্রীষ্মকাল…না-বর্তমান ঋতু ধরতে হবে ‘করোনাকাল’। জিজ্ঞেস করতে হবে, ‘করোনাকাল কেমন কাটছে?’
শিস খন্দকার : তো করোনাকালে আপনার লেখালেখি কেমন চলছে?
মজনুর রহমান : লেখালেখি? এমন একটা সময় এখন যে সবকিছু হঠাৎ হঠাৎ কেমন অস্বাভাবিক হয়ে যায়। লেখালেখি থেকে শুরু করে পুরো জীবনযাত্রাই এরকম। হঠাৎ হঠাৎ কিছুই লিখতে ইচ্ছে করে না; আবার মাঝেমাঝে বেশকিছু লিখতে ইচ্ছে করে। মাঝখানে ছোটছোট দুটি গল্প আর গোটা চার-পাঁচেক কবিতা লিখেছি। এই আরকি!
শিস খন্দকার : এই বৈশ্বিক মহামারিতে প্রায় দুমাস ধরে আমরা বাংলাদেশিরা কার্যত লকডাউনে আছি। বলা চলে আমাদের সবধরণের কাজই বন্ধ। এমতবস্থায় আমাদের লেখালেখিটা আগের চেয়ে তুলনামূলক বেশি হওয়ার কথা, কিন্তু কেন হচ্ছে না?
মজনুর রহমান : ঐতো একটু আগেই যা বললাম। এটা একধরণের মানসিক চাপ। এই ঘটনাটি আমাদের কাছে আকস্মিক। ধরুন যে ডিসেম্বর থেকে শুরু। কিন্তু এই ঘটনা আমাদের কাছে আতঙ্ক হয়ে দাঁড়াচ্ছে কখন থেকে? আমরা ভয় পেতে শুরু কররাম কখন থেকে? খুব বেশি হলে জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি। অলমোস্ট ফেব্রুয়ারি আরকি। তারপর থেকেই মানুষের মনের মধ্যে যে চাপটা, এটাকে একেকজন একেকভাবে নিচ্ছেন। যার ফলে কেউ লিখতে পারবেন, কেউ পারবেন না। এমনকি মানুষের অন্যান্য স্বাভাবিক জীবনযাত্রাও এখানে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সবার রুটিনে চেঞ্জ, সবার লাইফস্টাইল চেঞ্জ। যার ফলে একেকজনের একেকরকম প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। ফলে কেউ লিখতে পারছেন, কেউ পারছেন না। আবার কেউ কিছুক্ষণ পারছেন, কিছুক্ষণ পারছেন না-যেটা আমার ক্ষেত্রে হচ্ছে।
শিস খন্দকার : বাংলাদেশ তথা বিশ্বের প্রতিটি সংকট মোকাবেলার নেপথ্যে আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে শিল্প একধরণের বড় অবদান রেখেছে। আমরা জানি যে শিল্প মনুষ্যত্বের জয়গান গায়, পৃথিবীর দুঃখের অবসান চায়। বিগত পৃথিবীর মোড়লদের এইসব শিল্প নানভাবে প্রভাবিত করেছে। চলমান পৃথিবীর শিল্পীদের হাতেও প্রতিনিয়ত শিল্পের নির্মাণ অব্যহত। কিন্ত তা কি বিশ্ব মোড়লদের কোনোভাবে প্রভাবিত করতে পেরেছে বা করছে?
মজনুর রহমান : আমার মতে, করতে পারেনি। বর্তমান যে মহামারি চলছে এবং তা যেভাবে প্রভাবিত করছে, এর ওপর দিয়ে কোনো শিল্পই প্রভাবিত করতে পারেনি। এর প্রভাব এতোটাই। সবাই এখন বিপদে আছে, যার ফলে অন্য কোনো মাধ্যম বা আর্ট মানুষের মনে প্রভাব ফেলবে-বিশেষ করে বিশ্ব মোড়লদের ওপর প্রভাব ফেলবে, প্রভাব ফেলে ভালো কিছু হবে-এটা আমার কাছে মনে হয় না। কারণ বিশ্ব মোড়লদের একজনকে ইতোমধ্যে দেখা গেছে যে তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে তহবিল প্রত্যাহার করবেন। এর আগে তিনিই জলবায়ু প্রকল্প হতে তহবিল প্রত্যাহার করেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এরূপ সংকটে বিশ্ববাসীর জন্য যতটুকুই করে, এতে তাদের তহবিল প্রায় পনেরো পার্সেন্ট। এই পনেরো পার্সেন্ট যদি তারা প্রত্যাহার করেন, এটি অবশ্যই বিশাল একটি ক্ষতি। অন্যকোনো কাজের মাধ্যমে ওনার মনোভাবের পরিবর্তন হবে বলে আমি মনে করি না।
শিস খন্দকার : আপনি সম্ভবত ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা বলছেন। কিন্তু দিনশেষে তিনিও তো একজন মানুষ। শিল্প তো মানুষকেই ছুঁয়ে যায়। ওনাকে কি বব মার্লে, বব ডিলানরা ছুঁয়ে যায় না?
মজনুর রহমান : এটা তো মানুষের নিজের ওপর নির্ভর করে। উনি মানুষ হলেও আমরা হয়তো ওনাকে ছুঁয়ে যাবার মতো শিল্প করতে পারিনি, কেউই হয়তো পারেননি।
শিস খন্দকার : এক্ষেত্রে কি আমাদের শিল্পই ব্যর্থ? নাকি তাঁদের দিক থেকে মানবিক বোধের সংকট?
মজনুর রহমান : শিল্পের সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করে ব্যক্তি এটাকে কীভাবে গ্রহণ করবেন তার ওপর। যে শিল্প ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে ব্যর্থ, সেই শিল্পই ভøাদিমির পুতিনের কাছে ব্যর্থ হতে পারে, আবার সেই শিল্পই শি জিম পিংয়ের কাছে ব্যর্থ হতে পারে। অর্থাৎ শিল্পের সফলতা কিংবা ব্যর্থতা আপেক্ষিক। এক আপনি চূড়ান্তভাবে বলতে পারবেন না।
শিস খন্দকার : আচ্ছা, এবার আপনার লেখালেখির দিকটায় আসি। আপনার লেখালেখির শুরুর গল্পটা শুনতে চাই।
মজনুর রহমান : আমার লেখালেখির শুরু অনেকটা আকস্মিকভাবে। আমি যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি, তখন কিশোরগঞ্জে (নীলফামারি), আমার উপজেলা আরকি। কিছু লেখালেখির লোকজন ছিলেন, যাদের সাথে আমার পরিচয় হয় এবং হঠাৎ করেই বিষয়টির দিকে আমি অনুপ্রাণিত হই। আমার পারিবারিকভাবে লেখালেখির করেন যদিও এমন কেউ নেই, তারপরেও নিজের থেকেই কিছু অভ্যাস গড়ে ওঠে- গান শোনা, বই পড়া ইত্যাদি। কিশোরগঞ্জেই একটি সংগঠন ছিলো, রাজনৈতিক সংগঠন, সেটার সাথে আমি জড়িত হই। এটি একটি ছাত্র সংগঠন। আমি এখানে বলে রাখি যে সেটি ইসলামী ছাত্র শিবির নয়; অন্য একটি ইসলামী ছাত্র সংগঠন। তাদের কিছু সৃজনশীল কাজের মধ্যে একটি ছিলো পত্রিকা বের করা। আমি তো ধর্মীয় লেখা লিখতাম না। গল্প, কবিতা, রম্য এরকম লেখা আরকি।
শিস খন্দকার : সাহিত্য ঘরনার লেখা আরকি…
মজনুর রহমান : হ্যাঁ হ্যাঁ। সাহিত্য ঘরনার বিভিন্ন মননশীল লেখা। আমিতো ইসলামী তো আমার সাইট না, সেটা আমি করতে পারতাম না। আমার এসব লেখাই ছাপা হতো। এটাই ছিলো মূল উৎসাহ-এটা স্বীকার করতে হবে। যদিও তাদের সঙ্গে আমার এখন সেভাবে যোগাযোগ নেই বললেই চলে। তবে তারা আমার সব লেখা ছেপেছিলো। গল্প, কবিতা-যা দিয়েছি তাই ছেপেছে। এভাবেই উৎসাহটা পাই। এরপর রংপুরের যুগের আলোতে ছাপা হয়, লিখতে থাকি। এসএসসির পরে তো রংপুরেই চলে আসি। এসে ধীরেধীরে সবাইকে পেতে পেতে একটা আলাদা প্লাটফর্ম চলে এলো, আলাদা একটা জগৎ। এভাবেই এখন পর্যন্ত চলছে আরকি।
শিস খন্দকার : আমরা জানি, আপনি মূলত একজন কবি। ইতোমধ্যে আপনার একটি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে ২০১৭তে-‘বেমানান বয়োস্কোপ’। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্ত্বিক ঘটক বলেছিলেন, তাঁর নিজের বক্তব্য মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য যদি চলচ্চিত্রের চেয়ে ভালো কোনো মাধ্যম তিনি পেতেন-তবে সেই মাধ্যমকেই তিনি বেছে নিতেন। সাহিত্যের ক্ষেত্রে আপনি কি কবিতাকে এরূপ ভাবেন?
মজনুর রহমান : নিজেকে প্রকাশ? নিজেকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে ভাবি না ওনার মতো করে। কারণ হলো, নিজেকে প্রকাশের যত মাধ্যমেই আমি থাকি না কেনো নিজেকে পুরোপুরি প্রকাশ করা যায় না আসলে। তবে নিজের অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে আমি কবিতাকেই সবচেয়ে ভালো-সবচেয়ে আনন্দদায়ক মাধ্যম হিসেবে মনে করি আমার জায়গা থেকে।
শিস খন্দকার : কবি না হলে সাহিত্যের কোন মাধ্যমকে বেছে নিতেন?
মজনুর রহমান : গল্পকার।
শিস খন্দকার : ছোটবেলায় আপনার জীবনের লক্ষ্য কী ছিলো? সেটি কী হতে পেরেছেন?
মজনুর রহমান : না, হতে পারিনি। আমার লক্ষ্য বারবার পরিবর্তিত হয়েছে। জীবনে প্রথম হতে চেয়েছিলাম, কারের ড্রাইভার। কার চালিয়ে পরিশ্রম ছাড়াই বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া যায়-খুব ছোটবেলার লক্ষ্য। তারপর হতে চেয়েছিলাম পাইলট। বাস্তবতার সাথে সঙ্গতি রেখে পড়তে চেয়েছিলাম ডাক্তারি-সেগুলোর একটিও হওয়া হয়নি। তবে একটা সময় থেকে কবি হতে চেয়েছি এবং এখন পর্যন্ত শুধু এই লক্ষ্যটি আমি পূরণ করতে পেরেছি।
শিস খন্দকার : আপনার কাছে কবিতা কী? আপনি কবিতাকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন?
মজনুর রহমান : আমার মতে কবিতা হলো-মানবমণ্ডলির অভিন্ন অনুভূতি প্রকাশের এক অনন্য মাধ্যম।
শিস খন্দকার : আপনার মাথায় কবিতার ইমেজ কীভাবে আসে?
মজনুর রহমান : আমার মাথায় কবিতার ইমেজ আগে আসে না; আগে কবিতার শব্দ আসে। শব্দ আসে, বাক্য আসে-তারপর ধীরেধীরে একটি ইমেজ তৈরী হয়। আমার কাছে এরকম হয় আরকি।
শিস খন্দকার : ক্রমান্বয়ে ফ্রেমে বেঁধে ফেলেন…
মজনুর রহমান : ক্রমান্বয়ে বাঁধার চেষ্টা করি।
শিস খন্দকার : সমকালীন কবিদের কবিতা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী? কাদের লেখা বেশি ভালোলাগে?
মজনুর রহমান : সমকালীনদের মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে ভালোলাগে ইমতিয়াজ মাহমুদ, এরপর তানিম কবির, হাসান রোবায়েত। এরপর…আরো বলতে হবে? না থাক। বেশি লিস্ট করলে অনেকে বাদ যাবেন!
শিস খন্দকার : সমকালীনদের কবিতা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানতে চেয়েছিলাম।
মজনুর রহমান : ও আচ্ছা, মন্তব্য। আমি যে ধরণের কবিতা পছন্দ করি, যে ধরণের লিখতে চাই বা পড়তেও পছন্দ করি-এর দুটি ধরণ রয়েছে। সত্য কথা বলছি, কার কাছে কেমন লাগবে জানি না। ধরণ দুটি হলো, এক-সহজ-স্বাভাবিক কথা, যেকোনো ধরণের ইমেজ তৈরি করা। এটা আমার সবচেয়ে পছন্দের ধরণ-যেটা ইমতিয়াজ মাহমুদ এবং তানিম কবিরের কবিতায় পাওয়া যায়। আরেকটি হলো-আমি সব কথা বুঝবো না, কিন্তু প্রচণ্ড একধরণের ভালোলাগা কাজ করবে-এটি হাসান রোবায়েতের কবিতায় পাই আমি। এই দুই ধরণের কবিতার মধ্যেই মূলত এখনকার সময়ের কবিতার বৈশিষ্ট্য নিহিত। এই সময়ে এধরণের কবিতাই লেখা হচ্ছে, যেটাকে অনেকে পোস্টমডার্ন বা উত্তর-আধুনিক কবিতা বলেন।
শিস খন্দকার : সমকালে যে উত্তর-আধুনিক কবিতা হচ্ছে, তা কি আমাদের বিগত সময়ের কবিতাকে অতিক্রম করেছে বা করতে পারবে বলে আপনার মনে হয়?
মজনুর রহমান : সেটা আমার মনে হয় না। মনে হয় না এ কারণেই-আমার কাছে মধ্যযুগের ভারতচন্দ্র রায়গুণাকারের এমন কিছু কবিতা রয়েছে, যেগুলোর কাছে বর্তমানে আর কারো কবিতা তার সাপেক্ষে ভালো মনে হয় না। পরবর্তী সময়ে জীবনানন্দ দাশের কবিতা, এমনকি রবীন্দ্রনাথের এমন কিছু কবিতা রয়েছে-এখনকার সময়ের কবিতা সেগুলোর ধারেকাছেও যেতে পারে না। বিষয় হচ্ছে যে, সময়ে সময়ে কবিতে এবং কবিতে আলাদা। কেউ কাউকে অতিক্রম করবে, এটা আমার কখনই মনে হয় না। আমি মনে করি না। অনেকে মনে করেন, অতিক্রম করে যাবে বা অতিক্রম করা দরকার, অতিক্রম করে যাওয়া উচিৎ, ভাঙা উচিৎ-এগুলো আমার কাছে হাস্যকর কথাবার্তা মনে হয়। ভালো করে পড়লেই বোঝা যায়-এটি অতিক্রম করার জিনিস না।
শিস খন্দকার : ২০২০-এক মহামানবের জন্মশতবর্ষ। তাঁকে নিয়ে একটু প্রশ্ন করি।
মজনুর রহমান : অবশ্যই।
শিস খন্দকার : বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন একজন মানুষ, যাকে আমরা কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী বা দলের ফ্রেমে আবদ্ধ করতে পারি না। তিনি সর্বজনীন-অন্তত আমাদের বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে একথাটি সত্য। তবে কি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশেরই সমার্থক?
মজনুর রহমান : অবশ্যই। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সমার্থক-এর সংক্ষেপে ব্যাখ্যা এরকম-প্রত্যেক জাতিরই একজন মহান নেতা থাকেন। কত বড় মহান তা সে জাতির সাপেক্ষেই নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির সাপেক্ষে তিনি এতো বড় যে তাঁকে বাংলাদেশের সমার্থক না করে পারা যায় না। ওনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে কত মহান হতেন বা আদৌ হতেন কি না-সেটা বলার উপায় নেই। কিন্তু ওনার ব্যক্তিত্ব, ওনার নেতৃত্বের সাপেক্ষে বলতে হবে-বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সমার্থক। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ-এভাবেও বলা যায়। তবে তাঁকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা বা পরিচয় করিয়ে দেওয়া ভিন্ন বিষয়, সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।
শিস খন্দকার : আপনি জেনে থাকবেন, বিবিসির শ্রোতা জরিপে বিশজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচন করা হয়েছিলো। সেক্ষেত্রে তিনিই প্রথম। এটাকে কীভাবে দেখেন?
মজনুর রহমান : জরিপের বাইরেও আমার কাছে তিনি বাঙালি হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে নিঃসন্দেহে প্রথম। বরং ঐক্ষেত্রে ‘বাঙালি’র স্থানে যদি ‘বাংলাদেশি’ ব্যবহার করা হতো, তবে আমি আরোও বেশি গর্ববোধ করতে পারতাম বলে মনে করি। তখন আরোও নিজের অর্থাৎ আমার বা আমাদের মনে করা সহজ হতো।
শিস খন্দকার : আমরা একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। কবিরা তো প্রেমিক মানুষ। কবিরা উপুর্যপরি প্রেমে পড়তেই থাকেন, তাদের জীবনে প্রেম আসেই। আমি নারী প্রেমের কথা বলছি। এ প্রসঙ্গে আপনার জীবনের পটভূমিটা যদি বলতেন।
মজনুর রহমান : তাই বলে বাসায় বসে (হাসি)! নারী প্রেমের পটভূমি শুধু কবিদের জীবনেই না, যেকোন জীবনেই থাকে এবং অধিকাংশক্ষেত্রেই তারা একাধিকবার প্রেমে পড়ে। এটা কোন অস্বাভাবিক বিষয় নয়। তবে কবিদের ক্ষেত্রে হয়তো বিষয়টি এভাবে আলোচিত হয় যে কবিরা বেশি প্রেমে পড়েন, কবিরা বারবার প্রেমে পড়েন। কিন্তু কবিদের বাইরেও বিশ্বের বড়বড় রাজনীতিবিদদের আমরা একাধিকবার প্রেমে পড়তে দেখিনি? দেখেছি। তারা কিন্তু কবি নন। অনেক বড়বড় কেলেঙ্কারি, যেগুলো আমরা জানি। কবিরা একাধিকবার প্রেমে পড়বে, অন্য সাধারণ আর দশজনের মতো কবিও যেহেতু মানুষ-পড়তেই পারে। বিষয় হচ্ছে সে ব্যক্তিত্বের জায়গায় নিজেকে কতটা অটল রাখতে পেরেছে। একাধিক প্রেমে পড়া দোষের না; দোষের হচ্ছে নিজেকে অসৎ করা। আরো বেশি কিছু কি শুনতে চেয়েছেন?
শিস খন্দকার : না…না (হাসি)। তবে এমন কি কোনো নারী ছিলেন বা আছেন-যিনি আপনার লেখাকে প্রভাবিত করেছেন?
মজনুর রহমান : না। নারীরা আমার জীবনে লেখাকে খুব বেশি প্রভাবিত করতে পারেনি। কিন্তু প্রেমে যে পড়লাম, এই ঘটনার প্রেক্ষিতে হয়তো কিছু লিখেছিলাম। যেগুলো হয়তো এখন বস্তাবন্দি অবস্থায় হারিয়ে গেছে বা পুড়ে গেছে। কিন্তু নারীটির কারণে লিখেছি-এরকম মনে হয় না। বিষয়টি বোঝাতে পারলাম কি না-জানি না। ঘটনার কারণে লিখেছি; নারীর কারণে না।
শিস খন্দকার : আচ্ছা। আপনার কাছে সমকালীনদের কিছু নাম শুনেছি, যাদের লেখা আপনি পড়েন। সর্বসময়ের বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে আপনি কাদের বেশি পড়েন?
মজনুর রহমান : সর্বসময়ে? এই প্রশ্নটি আমি নিজেও নিজেকে করেছি। এর উত্তর দুরকম আসে। আমার সবচেয়ে প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ, তারপরে আল মাহামুদ। রবীন্দ্রনাথ? রবীন্দ্রনাথ সবকিছুর ওপরে, কিন্তু তিনি সবচেয়ে প্রিয় কবি নন। আর জীবিতদের মধ্যে আমি তিনজনের কথা বলেছি-ইমতিয়াজ মাহমুদ, তানিম কবির এবং হাসান রোবায়েত। আরও অনেককেই ভালো লাগে। কিন্তু এই ভালোলাগাগুলো ঘুরেফিরে। আর এনারা ফিক্সড হয়ে গেছেন, বলা যায়। ঘুরেফিরে বলতে যেমন-মোহাম্মদ জসীম নামে একজন কবি আছেন, ওনার কবিতা খুবই ভালো লাগে। তারপর শাহেদুজ্জামান লিংকন-তিনি কবিতা কম লেখেন, কিন্তু যা লেখেন চমৎকার! তারপর শিস খন্দকার-জবাব নেই! এই ভালোলাগাগুলো ঘুরেফিরে। তারপর রংপুর অঞ্চলে আরও আছেন দুজন-আহমেদ মওদুদ ও সাম্য রাইয়ান। তারপর হলেন নাদিয়া জান্নাত। এই অঞ্চলভিত্তিকও কিছু বললাম আরকি। অঞ্চলভিত্তিক বলাতে ওনারা যে কী মনে করবেন। অঞ্চলের গণ্ডি হয়তো ওনাদের পুরোপুরি পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি, একজন আছেন-বাদল রহমান। অসম্ভব ভালো কবিতা লেখেন, পড়লেই বুঝতে পারবেন। তারপর শহীন মোমতাজ আছেন, ওনাকে সবাই অবশ্য জানেন। ভালো লাগে। তারপর হোসেন রওশনের কবিতা ভালো লাগে।
শিস খন্দকার : ভাবলে হয়তো এরকম আরও কিছু নাম চলে আসবে।
মজনুর রহমান : হ্যাঁ, সেটাই।
শিস খন্দকার : আমরা এ পর্যন্ত আপনার একটিমাত্র বই পেয়েছি। আপনার কবিতার তো পাঠক রয়েছেন, যারা নিয়মিত আপনাকে পড়তে চান, বিশেষত রংপুর অঞ্চলে। আপনার কি মনে হয় না আরও কিছু নিয়ে আসা উচিৎ? আরও কিছু বই?
মজনুর রহমান : বই অবশ্যই দরকার। কবিতার ক্ষেত্রে এখানে বাস্তবতা হলো, আমরা রংপুরকে অতিক্রম করতে পারি না। এর কারণ আমরা রংপুরে থাকি; ঢাকায় থাকি না। এরূপ বাস্তবতায় যা হয়, কবিতার বই আমাদেরকে টাকা দিয়ে বের করতে হয়। আমার প্রথম বইটি যদিও প্রকাশক করে দিয়েছিলেন। কিন্ত সেবার তার যে লসটা হয়েছে, তাতে বোঝাই যায় যে তিনি আর সে ঝুঁকি নিবেন না। কবিতার বই থাকা উচিৎ অবশ্যই। কারণ মানুষ চলে যাবেন, কিন্তু তার বইটি থাকবেই। সেই বই আমি এখন টাকা দিয়ে বের করার অবস্থায় নেই অথবা আমি ইচ্ছুক নই।
শিস খন্দকার : আপনার কথার সূত্র ধরেই একটি প্রশ্ন করি। বললেন, যদি ঢাকায় থাকতেন। তবে কি বর্তমানে লেখক হিসেবে উঠে আসার ক্ষেত্রে ঢাকাকেন্দ্রীক হওয়া আবশ্যক?
মজনুর রহমান : এটা তো বাস্তবতা। যদি কেউ প্রতিষ্ঠিত হতে চান ঐ অর্থে, যে অর্থে প্রশ্নটি করেছেন। সেই অর্থে তাকে ঢাকাকেন্দ্রীক হতে হবে। ঢাকার বাইরে থেকে কয়জনের বই প্রকাশকরা নিজের থেকে বের করেন, এটা আপনি হাতে গুনেগুনে বলে দিতে পারবেন। আর ঢাকায় থেকেথেকে কীভাবে হচ্ছে, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। কারণ প্রকাশনার মাধ্যম, প্রকাশক, পত্র-পত্রিকা সবই ঢাকাকেন্দ্রীক। কাস্টমার বা বইয়ের গ্রাহক-পাঠকও ঢাকাকেন্দ্রীক! এমনকি বইমেলা-যে জাতীয় বইমেলা হয়, সেটিও ঢাকাকেন্দ্রীক। এভাবেই সবই প্রায় ঢাকাকেন্দ্রীক হচ্ছে।
শিস খন্দকার : এতে আমাদের কবিতা কতটা উপকৃত হচ্ছে? এতে কি আমাদের কবিতারই ক্ষতি না?
মজনুর রহমান : এতে কবিতার ক্ষতি না। তবে ক্ষতিটা যেখানে হচ্ছে, তা হলো-বিকেন্দ্রীকরণ না হওয়াতে। ওনারা যা করছেন, তা তো বাস্তবতার কারণেই করছেন। আমার একটি লক্ষ্য পূরণে বা বই বিক্রি করতে যদি ঢাকায় যেতে হয়, তবে অবশ্যই আমাকে ঢাকায় থাকা উচিৎ। কিন্তু সাহিত্যের ক্ষতি যেটা হচ্ছে, বলা যায় যে সেটা হাতে ধরে কেউ করছেন না। কিন্তু ক্ষতি হচ্ছেই। তবে এখন অঞ্চলভিত্তিক বেশকিছু বইমেলা হচ্ছে, অঞ্চলভিত্তিক প্রকাশনা সংস্থা গড়ে উঠছে। সেক্ষেত্রে আমি অনুরোধ করবো এই অঞ্চলের প্রকাশকদের, বইগুলো যদি সারাদেশে তারা বাজারজাত করতে না পারেন তবে ক্ষতিটা আরও বেশি হবে, যে ক্ষতির কথা আপনি বলছেন।
শিস খন্দকার : তাহলে যেসকল সম্ভাবনাময় লেখক আড়ালে-আবডালে কিংবা মফস্বলে লোকচক্ষুর আড়ালে রয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী হবে? সামাজিক মাধ্যম তথা ফেসবুকে ঢুকলে কিন্তু এরকম অনেককে চোখে পড়ে।
মজনুর রহমান : হ্যাঁ, পড়ে। কিন্তু আমার পরামর্শ তাদের জন্য না। আমার অনুরোধ বা পরামর্শ সরকারি মহলের প্রতি। বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় রয়েছে, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র রয়েছে, বাংলা একাডেমি রয়েছে-এরা এই কাজগুলো করতে পারে। এরা যদি উদ্যোগ নেয় সরকারিভাবে প্রতিবছর সাতটি বা আটটি বিভাগ হতে বা বিভাগীয় শহর হতে-চল্লিশ বছরের নিচে যেসব তরুণ লিখছেন তাদের মধ্য থেকে তিনটি করে কবিতার বই, তিনটি করে গল্পের বই, তিনটি করে উপন্যাস বের হবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়। এগুলো বাংলা একাডেমিতে রাখা হবে, বাংলা একাডেমির বইমেলায় বিপণন হবে। সরকারের জন্য এটি খুব বড় কিছু না। কিন্তু এই কাজটি যদি হয়, তাহলে সারাদেশের সাহিত্য বিকেন্দ্রীকরণ হবে, আড়ালে-আবডালে যারা রয়েছেন-তাদের উপকার হবে, আন্ডাররেটেড যারা রয়েছেন-তারা উঠে আসবেন। দিনশেষে এটা বাঙালি জাতির জন্যই ভালো হবে। কারণ এমন ভালোভালো লেখা আছে, যেগুলো তারা পাচ্ছেন না। আবার এমন এমন কিছু অপসাহিত্য হচ্ছে, যেগুলো তাদের গিলতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। তাই সরকারকে এক্ষেত্রে এগিয়ে আসা বিশেষ দরকার।
শিস খন্দকার : এই যে বললেন, আন্ডাররেটেড। সমকালীনদের মধ্যে আপনার মতে কবি হিসেবে ওভাররেটেড কারা আর আন্ডাররেটেড কারা?
মজনুর রহমান : ওভাররেটেড বলা আমার ঠিক হবে না, তবে আন্ডাররেটেডদের নাম বলাই যায়। ওভাররেটেডদের নাম বললে বিতর্কের সৃষ্টি হয় আরকি। এমন অনেক ভালো কবি রয়েছেন, যারা ফুরিয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁরা জোর করে লিখছেন। এরকম নাম অনেক বলা যাবে, কিন্তু বিতর্ক হবে, তাই বলতে চাই না। আন্ডররেটেড কবি-আমি রংপুর অঞ্চলের যে কয়জনের কথা বলেছি, এদের বেশিরভাগই আন্ডাররেটেড। যেমন-শিস খন্দকার। আমি নিজেকেও আন্ডাররেটেড মনেকরি-এটা আত্মবিশ্বাস থেকে বলা। আপনার নাদিয়া জান্নাত বলুন, হোসেন রওশন বলুন-এরা সবাই আন্ডাররেটেড। এদের আরও গুরত্ব পাওয়া উচিৎ ছিলো, আরও বেশি প্রচার হওয়া উচিৎ ছিলো। সেটা হয়নি আঞ্চলিকতার কারণে। অন্য অঞ্চলে কে কে আছেন, আমি সবার কথা বলতে পারবো না। কিন্তু এরকম হচ্ছে।
শিস খন্দকার : আপনার একমাত্র বই ‘বেমানান বায়োস্কোপ’ নিয়ে উপলব্ধি কী?
মজনুর রহমান : বইটি প্রকাশের পরপরই আমার উপলব্ধি শেষ হয়ে গেছে। রংপুর বইমেলায় বই নিয়ে যতটুকু সাড়াশব্দ-তাতে মনে হয়েছে এতো তাড়াতাড়ি বই করা উচিৎ হয়নি। কবিতা যাচাই-বাছাই, গেটাপ-মেকাপেও তাড়াহুড়ো হয়েছিলো। মনে হয়, আরও সময় নিয়ে কাজটি করা যেত।
শিস খন্দকার : শেষ প্রশ্ন। কথা আর না-বাড়াই। লেখক হিসেবে আপনার চূড়ান্ত লক্ষ্যটা জানতে চাই।
মজনুর রহমান : লেখক হিসেবে চূড়ান্ত লক্ষ্য-বাংলাদেশের অর্ধেক মানুষ আমার কবিতা বা লেখা পড়বেন। এটি অনেক আগে থেকেই ছিলো, কিন্তু আমি একটু অলস প্রকৃতির মানুষ হওয়ায় সেভাবে পরিশ্রম করতে পারি না বা করি না। আমার দুটি সমস্যা-প্রথমত, অলসতা আর দ্বিতীয়ত, আমি মুখচোরা। যেভাবে মানুষ এক্ষেত্রে আগান, আমি সেসব পদ্ধতি অবলম্বন করতে চাই না। এটা আমার স্বভাব।
শিস খন্দকার : এই সংকটকালে সপরিবারে ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন। আমাদের সময় দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
মজনুর রহমান : আপনিও ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge