পাতাপ্রকাশ প্রতিবেদক >>
আজ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৪তম প্রয়াণ দিবস। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র (১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট) ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (তৎকালীন পিজি হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন অবস্থায় কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিণী সৃষ্টি করে বাংলা সংগীতজগৎকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অনন্য রূপকার। তিনি এসেছিলেন জ্যৈষ্ঠে, বিদায় নিয়েছেন ভাদ্রে। যেন ধ্রুবতারার মতোই ছিল তার আবির্ভাব।
চোখ মেলেই তিনি যে সমাজ আর রাষ্ট্র দেখলেন, তা ছিল শ্বাপদসংকুল। স্বভাবতই তাকে বিদ্রোহের পথে যেতে হয়েছে। শোষিত-নিপীড়িত মানুষের বঞ্চনার ক্ষোভ দীপ্ত শিখার মতো জ্বলে উঠেছিল তার কণ্ঠে। তার সেই যুদ্ধটা ছিল দূর্গম ও দীর্ঘ।
সাম্প্রদায়িকতার বিষকে দূর করে অন্ধকারে ছড়িয়েছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতা আর মানবতার আলো। এতে তিনি রক্তাক্ত হয়েছেন। তবে স্থির প্রত্যয়ী উচ্চারণে দ্বিধা করেননি এতটুকু। আবার তিনিই কোমল সুকুমার হৃদয়ানুভবে আবেগে থরথর।
মাত্র ২২ বছর শিল্প সৃষ্টিতে সক্রিয় থাকতে পেরেছিলেন। এই স্বল্প সময়ে পৌনঃপুনিকভাবে তিনি মানুষের মুক্তির কথাই বলেছেন। তাই এক হাতে বাঁশের বাশরি, আর হাতে রণ-তুর্য- এই যুগলবন্ধী যেন অবধারিত ছিল।
দ্রোহ আর প্রেম সত্তার নিবিড় যোগ নজরুল কাব্যে স্বতন্ত্র মাত্রা যোগ করেছে। মানবতা, প্রেম, দ্রোহ, চেতনার কবি তিনি। নিজের ক্ষুরধার লেখনীর আঁচড়ে স্থান করে নিয়েছেন বিশ্বসাহিত্যে। গদ্য, পদ্য, উপন্যাস, সঙ্গীত- সব শাখায় তার আগমন ছিল ধূমকেতুর মতো।
বাংলা সাহিত্যে তার আগমন প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের এক গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন ‘আয় চলে আয়রে ধূমকেতু/আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’
কবি কাজী নজরুল ইসলাম আজীবন ছিলেন আপসহীন। সত্যকে সত্য বলেছেন, মিথ্যাকে মিথ্যা। দৃঢ়কণ্ঠে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। তার সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারকে উৎখাতের আন্দোলনে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে মুখে মুখে। একসময় কবিকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯২৩ সালের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দি হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে এক জবানবন্দি দেন। চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে দেয়া ওই জবানবন্দি বাংলা সাহিত্যে রাজবন্দির জবানবন্দি নামে বিশেষ সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করেছে।
সেই জবানবন্দিতে নজরুল বলেছেন, ‘আমার ওপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত। … আমি কবি, আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। ১৬ জানুয়ারি বিচারের পর নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। তাকে আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। নজরুল যখন এখানে বন্দি ছিলেন, তখন (১৯২৩ সালের ২২ জানুয়ারি) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার বসন্ত গীতিনাট্য গ্রন্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। এ আনন্দে জেলে বসে নজরুল ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ কবিতাটি রচনা করেন। তাই এ সৃষ্টির উল্লাস চলে অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত।
কবির জীবনকাল ৭৭ বছরের। ১৯৪২ সালে অসুস্থ হয়ে বাকশক্তি হারানোর আগ পর্যন্ত তিনি সৃষ্টিশীল ছিলেন। এ সময়ের মধ্যে কবি শিল্প-সাহিত্যকে যা দিয়েছেন, তা বাংলা তথা বিশ্বপরিমণ্ডলে অমূল্য এক সম্পদ। তাই কাজী নজরুল ইসলাম এখনও প্রাসঙ্গিক। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক। দারিদ্র্যের কারণে মাত্র ১০ বছর বয়সেই পরিবারের ভার বহন করতে হয়েছে তাকে। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি পেশা হিসেবে বেছে নেন সাংবাদিকতা।
কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন, বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশন ও বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৭তম প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে বাংলা একাডেমি বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
Leave a Reply