রাতে কালু চোর ধরা পড়েছে। থানায় নেয়া হয়েছে তাকে। তাকে নিয়ে যাওয়ার সময় গ্রামের ফ্যাদলু মিয়ার রসিক মুখে কুতকুতে আওয়াজ ‘কালুর কী ভাগ্য রে ভাই, পুলিশি পাহাড়ায় চলে গেল। এমন ভাব নিলো মনে হয় বিশাল বড় নেতা!’
জনতার মার খেয়ে বেশ আক্ষেপ করছিল কালু ‘আমি তো ভাই চোর হয়ে জন্মিনি। সমাজ আমাকে চোর বানিয়েছে। কেউ সমাজের দোষ ধরে না। শুধু আমাকে দোষে।’
একজন কালুর গালে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বলল ‘আরে, চোরের মায়ের বড় গলা। ব্যাটা দেখি নীতি কথাও জানে!’
কালু দ্রুত বলে ওঠে ‘আমার মরা মাকে নিয়ে এমন কথা বলবেন না। আমি চোর, কিন্তু আমাকে বলার সুযোগ দেন!’
মুরব্বি ধরনের একজন সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল ‘কালুকে বলতে দাও। শুনি ও কী বলে?’
কালু বলেই চলল ‘ভাই, এই যে আমি চুরি করতে আসি তো আমাকে ধরা পড়ার ভয়ে থাকতে হয়; ঘুম হারাম করে রাত জাগতে হয়; অন্ধকারে মশার কামড় সহ্য করতে হয়;
তবু সাবধান থাকতে হয় যাতে যারা কেউ টের না পায়। এ রকম কত ব্যাপার আছে না?’
মুরব্বি বলল ‘তা ঠিক, কিন্তু তুমি এর দ্বারা কী বোঝাতে চাও- বলো।’
কালু এবার ফেটে যাওয়া ঠোঁটের রক্ত মুছে নিলো ‘ভাই, যারা কলমের ফাঁকে চুরি করে তারা বেশ আভিজাত্যে চুরি করে, ওদের কোনো ভয় করতে হয় না; ওদের কষ্ট করে শীতে খালি গায়ে রাত জাগতে হয় না; ওরা সম্মানের সাথে আরামে চুরি করে আরামে খায়। তবু ওরা বড় বড় অনুষ্ঠানে সভাপতির আসন পায়। ওরা অনেকে চুরির টাকায় হজ্জ করে হাজি সাজে! ওরা চুরির টাকা দান করে দানবীর হয়। ওদেরকে সবাই সম্মান করে আর আমারে অপমান করে! আল্লায় এর বিচার করবে না?’
একজন বলল ‘কালুর কথাটা মূল্যবান। চোর বলে কি সে মানুষ নয়? এর চেয়ে বড় চোর আছে সমাজে।’
আরেকজন বলল ‘ঠিক তো, কালু গোপনে চুরি করে। আর যারা প্রকাশ্যে চুরি করছে, তাদের কোনো শাস্তি হয় না। কলমের ফাঁকে চুরি ছাড়াও পরের জমির আল কেটে কেউ নিজের জমি বাড়ায়! এরা সবাই কি চোর নয়?
কালুর ফেটে যাওয়া ঠোঁটে রক্ত ঝরা থেমে গিয়ে এখন ফুলে উঠেছে সেটা। কালু থানায় বসে ভাবছে তার অতীত ইতিহাস। তার বাবার যথেষ্ট সম্পদ ছিল। তার বাবা বদর আলি বন্ধুদের সাথে মেলামেশায় নেশা থেকে জুয়ার লাইনে চলে যায়। ধীরে ধীরে পতন সূচনা কালুর বাবার। কালুর খুব মনে পড়ে একবার বাবার পাওনাদারের সামনে কালু তার বাবার শেখানো বুলিতে উত্তর দিলে জীবন বদলে যায় তার।
কালুর বাবা কালুকে বলতে বলেছিল এভাবে ‘বাইরে যে লোক এসেছে তাকে বল আমি বাড়িতে নেই।’ কালু বাইরে এসে তার বাবার পাওনাদারকে বলল ‘চাচা, বাবা বলল বাবা বাড়িতে নেই।’ কালু সত্য কথাই বলেছিল। কিন্তু কালুর সত্য কথায় তার বাবা সেদিন পাওনাদারের কাছে ধরা খেয়ে অপমান হয়েছিল বেশ। সে কারণে কালুর বাবা সেদিন প্রচুর মারধর করেছিল কালুকে। তারপর থেকে কালু মিথ্যে বলা শিখে গেছে। মায়ের অকাল মৃত্যু আর নেশার ব্যাধিতে বাবার চিরবিদায়ে অসহায় কালু মানুষের কাছে আশ্রয় পায়নি। জীবনের অশান্ত গতিতে আজ সে চোর, কুখ্যাত চোর। অনেকে কালুকে বিখ্যাত চোরও বলে। তবে তার নামের সামনে বিখ্যাত চোর যোগ করলে কালু বেশ তৃপ্ত হয়। তার গর্ব হয় এই ভেবে যে, চোরেরাও বিখ্যাত!
চোর হলেও কালুর সম্পদের অভাব নেই আজ। সোনা-দানা, টাকা পয়সা, বাড়ি, গাড়ি- সব আছে তার। নিজের অস্বস্তি এড়াতে তবুও কালু চুরি করে, যদিও তার সমাজের অনেক অসহায় মানুষের কাছে সে বেশ মান্যবরও মানুষ হিসেবে গণ্য! কালু থানায় বসে ফিক করে হেসে ওঠে ‘কী মজার ব্যাপার! নষ্ট সমাজের কেউ কেউ চোরদেরও সম্মান করা শিখে গেছে!’
কালুকে কোর্টে চালান করা হলে তার চার বিবি হাজির হয়েছে আইনজীবীর চেম্বারে। চার বিবিকে খুব ভালোবাসে কালু। কালুর প্রতিও তাদের ভালোবাসার একটুও কমতি নেই। বউ পরিচালনায় কালুর দক্ষতায় চার বিবিতে কোনো বিবাদের লেশমাত্র নেই। কালুর প্রতি কোনো অভিযোগেরও বালাই নেই তাদের। সবাই যেন রাজরানীর মতো কালুর প্রাসাদে স্বর্ণে সজ্জিত- খায় দায় আর রাজত্ব করে। বিবিদের প্রশ্নে আইনজীবীর সহকারি মনু মিয়া বলল ‘ও আপনারা কালুর কেসের জন্য এসেছেন?’
কালুর বড় বিবি কমলার মেজাজে জৈষ্ঠ্যের রোদ ‘ওই মিয়া, কালু কী হে? কালুকে সম্মান দিয়ে কথা বলো।’
দ্বিতীয় বিবি আহিলা স্বভাবে শান্ত হলেও জ্বলজ্বলে কয়লার স্ফুলিঙ্গ তার চোখে-মুখে ‘কেন রে, কালুকে স্যার বললে তোর খুব প্রেস্টিজে লাগে নাকি?’
তৃতীয় বিবি নন্দিনী এবার মুখে পান ঢুকিয়ে চুন মেশালো। গালে চিবানো পানের অবস্থার মতো থেতলানো কথা তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো ‘তোর উকিলকে ডাক! কেম্নে কালুর জেল হয় দেখি? তুই মামলার ধারা বুঝিস?’
ছোট বিবি উম্মে রানী বড় তিন বিবিকে আশ্বাস দিয়ে বলল ‘বুবু, তোমরা সবাই থামো। আমি দেখছি। ও মনে হয় নতুন তো তাই অত কিছু বোঝে না। ধীরে ধীরে জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা বাড়বে ওর।’
তার পর মনু মিয়ার প্রতি সম্মাহনী দৃষ্টিতে তাকায় ছোট বিবি ‘শোনো সহকারি, তুমি এ কেসের ধারা বুঝবে না। সামান্য চুরিতে জেল জরিমানার সুযোগ নেই। আর একটা কথা তোমারে বলি শোনো। আইনের ফাঁকফোকর আছে, কিন্তু আমাদের টাকার ফাঁকফোকর নেই। উকিল টাকা নেবে, জামিনের জন্য লড়াই করবে। উকিল সাবকে ফোন লাগাও।’
আইনজীবীর সহকারি মনু মিয়ার চোখে অস্বস্তির ছাপ। সে মাথা চুলকিয়ে বলল ‘স্যরি, ম্যাডাম। আমার ভুল হয়ে গেছে। আপনারা কালু স্যারের লোক। আপনারা একটু বসেন। আমি আসছি মানে চা পাঠাচ্ছি। আপনারা চা খেতে থাকেন। এর মধ্যেই উকিল সাব চলে আসবেন।’
বড় বিবি কমলা চট করে বলে উঠল ‘এই শোনো, চা খাওয়া আমাদের অভ্যাসে নেই, খুঁজে দেখো আশপাশে কফি আছে কি না?’
Leave a Reply