জাকির আহমদ >>
‘বাল্য বন্ধু, ক্লাসের বন্ধু, স্কুলের বন্ধু, কলেজের বন্ধু, বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু, মেসের বন্ধু, সংগঠনের বন্ধু, লেখক বন্ধু, কবি বন্ধু ছেলে বন্ধু, মেয়ে বন্ধু- এসব বিশেষণ থেকে বেরিয়ে এসে শুধুই ‘বন্ধু’ যে- সেইতো বন্ধু।’
আজ বিশ্ব বন্ধু দিবস। বন্ধু দিবস বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন তারিখে পালন করা হয়। তবে এখনও বাংলাদেশ-ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আগষ্টের প্রথম রোববারই বন্ধু দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এ বছর সেই মতো ৬ আগস্ট দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে বন্ধু দিবস। বন্ধুত্বের দিন তো প্রতিদিনই। তবুও বন্ধুদের জন্য একটা দিন বিশেষভাবে পালন করা যেতেই পারে।
২০১১ সালের ২৭ জুলাই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৩০ জুলাইকে ‘বিশ্ব বন্ধু দিবস’ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, ধর্ম ইত্যাদি নির্বিশেষে বিভিন্ন দেশের মানুষের বন্ধুত্বের একটি শক্তিশালী বন্ধন তৈরি করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব দিবস ঘোষণা করে।
ঠিক কবে এর সূচনা হয় তা অবশ্য তর্কাতীত। নানা তথ্য নানা সময়ের বা ঘটনার কথা বলে থাকে।
ঘটনা-১: ১৯৩৫ সালে আমেরিকার সরকার এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল। দিনটি ছিল আগস্টের প্রথম শনিবার। তার প্রতিবাদে পরদিন ওই ব্যক্তির এক বন্ধু আত্মহত্যা করেন। এরপর থেকে জীবনের নানা ক্ষেত্রে বন্ধুদের অবদানের প্রতি সম্মান জানাতে আমেরিকান কংগ্রেসে ১৯৩৫ সালে আগস্টের প্রথম রোববারকে বন্ধু দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।
তথ্য-২: ডাক্তার রামন আর্টেমিও ব্রাকোই প্রথম ১৯৫৮ সালের ৩০ জুলাই প্রস্তাব রাখেন ওয়ার্ল্ড ফ্রেন্ডশিপ ক্রুসেডে। সেদিন থেকেই ৩০ জুলাইকে আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব দিবস হিসাবে পালন করা হয়।
তথ্য-৩: বন্ধুত্ব দিবসটির সূচনা হয়েছিল ১৯৩০ সালের ২ আগস্ট হলমার্ক কার্ডের প্রতিষ্ঠাতা জয়েস হলের মাধ্যমে। যখন লোকেরা তাদের বন্ধুত্ব দিবসটি ছুটির মধ্য দিয়ে উদযাপন করত।
বন্ধু ছাড়া বেঁচে থাকা যেন নিঃসঙ্গতাকে বেছে নেয়া। সময়ের বিবর্তনে বন্ধুত্বের ধরনে পরিবর্তন এলেও জীবনে বন্ধু মেলেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন।
কবির সুমন গানে গানে বলেছেন, তোমায় আমি গড়তে চাই না, পড়তে চাই না/কাড়তে চাই না, নাড়তে চাই না/ফুলের মতো পাড়ত চাই না/চাইছি তোমার বন্ধুতা…।
আপনিও আজ, বিশেষ করে আজ চাইতে পারেন বন্ধু। জড়াতে পারেন বন্ধুতায়। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, কে আসলে বন্ধু? বন্ধুতা কাকে বলে? না, এর নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। হয় না। এ প্রসঙ্গে বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় একটি গানের কথা স্মরণ করা যেতে পারে, যেখানে বলা হচ্ছে, ‘একটাই কথা আছে বাংলাতে,/মুখ আর বুক বলে একসাথে,/সে হলো বন্ধু, বন্ধু আমার।’ এখানে বন্ধুর একটা সংজ্ঞা পাওয়া যায় বৈকি। বন্ধুত্বের জন্য থাকা চাই উদার দৃষ্টিভঙ্গি। গানে সে কথাটিও পরিষ্কার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘কে গরিব কে আমির সে বুঝে না,/জাতির বিচার করা সে জানে না।/সে হলো বন্ধু, বন্ধু আমার।’
আরও গভীরে যেতে চাইলে বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনকে লেখা নজরুলের সেই চিঠিটি পাঠ করতে হবে। দ্রোহ ও প্রেমের কবি বন্ধুর প্রয়োজন ভীষণভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, বন্ধু, তুমি আমার চোখের জলের ‘মতিহার’। বাদল রাতের বুকের বন্ধু। যেদিন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর আর সবাই আমায় ভুলে যাবে, সেদিন অন্তত তোমার বুক বিঁধে উঠবে।’
কবিগুরুর মতে, ‘বন্ধুত্ব নাড়াচাড়া টানাছেঁড়া তোলাপাড়া সয়, কিন্তু ভালোবাসা তাহা সয় না। আমাদের ভালোবাসার পাত্র হীন প্রমোদে লিপ্ত হইলে আমাদের প্রাণে বাজে, কিন্তু বন্ধুর সম্বন্ধে তাহা খাটে না; এমন-কি, আমরা যখন বিলাসপ্রমোদে মত্ত হইয়াছি তখন আমরা চাই যে, আমাদের বন্ধুও তাহাতে যোগ দিক! প্রেমের পাত্র আমাদের সৌন্দর্যের আদর্শ হইয়া থাক্এই আমাদের ইচ্ছা- আর, বন্ধু আমাদেরই মতো দোষেণে জড়িত মর্ত্যরে মানুষ হইয়া থাক্এই আমাদের আবশ্যক। আমাদের ডান হাতে বাম হাতে বন্ধুত্ব। আমরা বন্ধুর নিকট হইতে মমতা চাই, সমবেদনা চাই, সাহায্য চাই ও সেই জন্যই বন্ধুকে চাই।’
একই প্রসঙ্গে কবিগুরু লিখেছেন, ‘অনেকে বলিয়া থাকেন বন্ধুত্ব ক্রমশ পরিবর্তিত হইয়া ভালোবাসায় উপনীত হইতে পারে, কিন্তু ভালোবাসা নামিয়া অবশেষে বন্ধুত্বে আসিয়া ঠেকিতে পারে না। একবার যাহাকে ভালোবাসিয়াছি, হয় তাহাকে ভালোবাসিব নয় ভালোবাসিব না; কিন্তু একবার যাহার সঙ্গে বন্ধুত্ব হইয়াছে, ক্রমে তাহার সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপিত হইতে আটক নাই। অর্থাৎ বন্ধুত্বের উঠিবার নামিবার স্থান আছে। কারণ, সে সমস্ত স্থান আটক করিয়া থাকে না। কিন্তু ভালোবাসার উন্নতি অবনতির স্থান নাই। যখন সে থাকে তখন সে সমস্ত স্থান জুড়িয়া থাকে, নয় সে থাকে না।’
কবিগুরুর এমন চমৎকার বিশ্লেষণের পর আর কোনো কথা বলা বৃথা। বরং এসব বিশ্লেষণের নিরিখে বন্ধু নির্বাচন করুন। জীবনে একটা ভালো বন্ধু হলেও দিব্যি চলে যাবে!
বন্ধু যেমন জীবনে যোগায় প্রেরণা, তেমনি নিয়ে যেতে পারে বিপথেও। তাই নতুন বন্ধুর ডাকে সাড়া দেয়ার আগে তার মানসিকতা ভালোভাবে জেনে নেয়ার পরামর্শ মনোবিজ্ঞানীদের।
Leave a Reply