বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৪:৪৯ পূর্বাহ্ন

ভাষায় আঞ্চলিক ভাষার গুরুত্ব-জাহিদ হোসেন

ভাষায় আঞ্চলিক ভাষার গুরুত্ব-জাহিদ হোসেন

অবিভক্ত বঙ্গীয় জনপদে অনেকগুলো আঞ্চলিক ও উপভাষার প্রচলন আছে। প্রতিটি বৃহত্তর জেলায় নির্দিষ্ট মৌখিক ভাষা চলে। বরিশাল, খুলনা, সিলেট, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, কুমিল্লা, রাজশাহী, যশোর, ফরিদপুর, দিনাজপুর, কলকাতা, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, শান্তিপুর ইত্যাদি প্রতিটি অঞ্চলে নির্দিষ্ট মৌখিক কথার প্রচলন রয়েছে। এছাড়াও উপজাতীয় ভাষা আছে। এদের কয়েকটি ভাষায় নিজস্ব বর্ণমালা পর্যন্ত আছে। বস্তুত বিশ্বব্যাপী সমস্ত ভাষায়ই এলাকাভিত্তিক কথ্যভাষার (Colloquial Language) সরব উপস্থিতি রয়েছে। এলাকাভিত্তিক কথ্যভাষার অপর নাম আঞ্চলিক (Native Language) ভাষা। একটি কথ্য, আঞ্চলিক বা উপভাষা ব্যবহারকারীদের ভৌগোলিক সীমা খুববেশি বিস্তৃত হয় না। তদুপরি একটি ভাষার নিজস্ব শব্দকোষ (vocabulary) ব্যুৎপন্নের পিছনে অঞ্চলভিত্তিক শব্দগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দুনিয়ার প্রতিটি ভাষাই মূলত পাশাপাশি কতোগুলো অঞ্চলে ব্যবহৃত কথ্যভাষার শব্দসমষ্টি নির্ভর।

কথায় আঞ্চলিক প্রভাব বনাম প্রমিত ভাষা : পৃথিবীর প্রতিটি ভাষায় অঞ্চলভিত্তিক কথ্য (colloquial) ও প্রমিত (Received Pronunciation-RP) উভয়রূপই থাকে। কথার সামাজিক পরিসর যতো কম, ভাষায় পোশাকিভাব বা প্রমিতরূপ ততো কম হয়। মানুষ নিকটজনের সাথে আলাপচারিতায় প্রমিত কথা কম বলে। মানে ঘরে বসে যে যার কথ্যভাষাই বেশি ব্যবহার করে। লোকসমাবেশে বক্তব্য বা লিখিত বিষয়াদির ক্ষেত্রে ভাষার প্রমিতরূপ বেশি চলে। মৌখিক কথায় কেউ নিয়ম মানে না বলে এক ভাষাভাষী সবাই প্রমিত কথা বলে না। তাই আঞ্চলিক কথ্যভাষামুক্ত কোনও ভাষা হয় না। এমনকি প্রমিত বলতে যা বুঝায়, তাও একটি অঞ্চলের কথ্যভাষা; যেমন: বাঙলার প্রমিতরূপ নদীয়া ও শান্তিপুর অঞ্চলবাসীর কথ্যভাষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পক্ষান্তরে আঞ্চলিক শব্দগুলো ভাষা সহজবোধ্য ও গতিশীল করে। তাতে ভাষার ব্যাপ্তি বাড়ে। অতঃপর কথ্যভাষার শব্দচয়ন ও বাক্যবিন্যাশ প্রমিত ভাষায় মিশে মূলভাষাকে সমৃদ্ধশালী করে। মোটকথা অনেকগুলো আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণেই নির্দিষ্ট একটি ভাষার উৎপত্তি হয়। দুনিয়ায় বর্তমানে প্রচলিত প্রতিটি ভাষা অতীতে হাজার হাজার বছর ধরে চলা অনেকগুলো পাশাপাশি অঞ্চলের কথ্যভাষার সংমিশ্রণ, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ধারার বর্তমান রূপ।

অঞ্চলিক ভাষায় ভিন্নতার মানচিত্র : প্রতি আটমাইলে কথ্যভাষা ক্রমশ সংখ্যাগত স্বল্পপরিবর্তন হয়। এই স্বল্পপরিবর্তনগুলো দূরবর্তী ভৌগোলিক সীমায় পৌঁছে কথ্যভাষায় গুণগত পরিবর্তন আনে। নতুন অরেকটি আঞ্চলিকভাষার রূপ ধারণ করে। কিন্তু সবগুলোর শব্দ ও বাক্যের গাঠনিক মিল প্রায় একশতভাগ অটুট থাকে। এইরূপ অনেকগুলো আঞ্চলিকভাষার সমন্বয়ে একটি জাতির নির্দিষ্ট মাতৃভাষা তৈরি হয়। পূর্ব-দক্ষিণে বার্মা; পূর্বে ত্রিপুরা, মিজোরাম, আসাম; উত্তরে মেঘালয়; উত্তর-পশ্চিমে সিকিম; পশ্চিমে বিহার ও ঝাড়খণ্ড এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে ওড়িশা রাজ্যগুলোর সীমান্ত পর্যন্ত বাঙলাভাষার বিস্তৃতি। এতোবড় ভূখণ্ডের প্রতিটি অঞ্চলেই স্থানীয় কথ্যভাষার প্রচলন আছে। অঞ্চলভিত্তিক এই কথ্যভাষাগুলোর সমন্বিতরূপ হলো আমাদের মাতৃভাষা বাঙলা। আর প্রতি আট মাইলে ঘটা পরিবর্তনের প্রতিটি পর্যায় একেকটি আঞ্চলিক ভাষা; যেমন : বরিশালের পর খুলনার, এরপর সাতক্ষিরার, এরপর কলকাতার কথ্যভাষা। এর শেষ সীমান্তে বিহারি ও হিন্দি ভাষা। এভাবেই আঞ্চলিক ভাষাগুলো প্রতি আট মাইলে পরিবর্তিত হতে হতে সবশেষে অন্য একটি ভাষার সীমান্তে এসে শেষ হয়।

আঞ্চলিকভাষা পরিবর্তনের কারণ কী : ভাষা মূলত পরিবর্তনশীল। কথ্যভাষা পরিবর্তনের পরিণতিস্বরূপ মূলভাষায় পরিবর্তন ঘটে। এর কারণ হলো নিকটবর্তী অন্যান্য আঞ্চলিক বা ভিন্ন ভাষার প্রভাব। এসব পরিবর্তনের ক্রমধারা হাজার এমনকি শত মাইল বা তারও কম দুরত্ব অতিক্রম করার পর ভাষার শক্তি ক্ষয় হয়ে যায়। অতঃপর চতুর্দিকে থাকা ভিন্ন ভাষাগুলোর সংস্পর্শে এসে হারিয়ে যায়। এই প্রক্রিয়া প্রতিটি ভাষার ক্ষেত্রেই ঘটে। অন্যদিকে ভৌগোলিকভাবে অবস্থানরত পাশাপাশি দুটো ভাষার শব্দ ও বাক্য গঠনে প্রায়শ বেশ মিল থাকে। উদাহরণস্বরূপ পশ্চিমবঙ্গের বিহার সীমান্তবর্তী অঞ্চলবাসীদের কথায় বিহারি বা হিন্দি ভাষার ছাপ স্পষ্ট। কেননা বিহার ওই অঞ্চলের লোকদের পাশের রাজ্য। বিহারের কথ্যভাষা বিহারি হিন্দি। এভাবে পূর্বদিকে ফিরতে থাকলে হিন্দি বা বিহারি ভাষার সাথে বাঙলার গাঠনিক যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। তাই একজন বাঙালি যতো সহজে হিন্দি বা বিহারি ভাষা বুঝতে বা বলতে পারবে, ততো সহজে গুজরাটি বা কানাড়া ভাষা পারবে না। তদ্রূপ একজন ইংরেজ খুব সহজেই আইরিস, স্কটিস, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ বলতে পারবে। কিন্তু ইটালিয়ান, রাশিয়ান জার্মান তার জন্য ততোটা সহজ নয়। আফ্রিকা মহাদেশে দেখা যায়, সুদানিস ভাষা আরবির মতোই, যার সাথে উগান্ডার স্থানীয় কথ্যভাষার যথেষ্ট মিল আছে। মূলত পাশাপাশি ভাষাগুলোর মাঝে এরকম দীর্ঘ যোগসূত্র থাকে। বস্তুত আঞ্চলিক কথ্যভাষাগুলো যেমন পাশাপাশি দুটো ভাষার মধ্যে যোগসূত্র ঘটায়, তেমনই দুটো স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষার মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয়। এছাড়া উপনিবেশিক শাসনও একটি স্থানীয় ভাষায় অনেক পরিবর্তন ঘটাতে পারে। অনাদিকাল থেকে ভাষাগুলোর এইরূপ সংমিশ্রণজনিত পরিবর্তন সর্বব্যাপী চলার ফলে যেমন নতুন ভাষা জন্মে, তেমনই পুরাতন কিছু ভাষা ব্যবহারশূন্য হয়ে পড়ে।

স্থানের দূরত্ব ভাষায় পরিবর্তন আনে : দুটো ভাষার মাঝে ভৌগোলিক দূরত্ব যতো বাড়বে, তা ততো কঠিন হবে। কেননা ভৌগোলিক দূরত্ব দুটি ভাষার মধ্যে শব্দ ও বাক্য গঠনগত বড় ধরনের অমিল গড়ে দেয়। বোঝার ক্ষেত্রে যা অনেক বড় ব্যবধান। অবশ্য এর ব্যতিক্রমও উপনিবেশিক শাসনের কারণে ঘটার ইতিহাস আছে! আফ্রিকা মহাদেশের কয়েকটি দেশে এর নজির লক্ষণীয়। সেখানের কয়েকটি দেশে ইংলিশ ও ফ্রেন্স লিংগুয়া-ফ্রাংকা—উপনিবেশিক শাসকরা নিজস্ব ভাষা সেখানের স্থানীয়দের মধ্যে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। প্রকাশ থাকে যে, Lingua-Franca ইতালিয় ও ফ্রেন্স ভাষার সংমিশ্রিত (Phrase) বাক্যাংশ। এর অর্থ এমন একটি ভাষা যা একটি ভূখণ্ডের নানানভাষাভাষীদের যোগাযোগের জন্য বাহক ভাষারূপে কাজ করে—যেমন হিন্দি ভারতের লিংগুয়া-ফ্রাংকা। স্পানিস ফিলিপাইনের লিংগুয়া-ফ্রাংকা।

ভাষার বিবর্তন : সংমিশ্রণের প্রভাবে দুই/চারশ’ বছরে প্রচলিত ভাষাগুলোর মাঝে অনেক পরিবর্তন ঘটে। তবে স্বয়ংসম্পূর্ণ নতুন একটি ভাষা জন্মলাভ করতে দুই থেকে তিন হাজার বছর প্রয়োজন। কবি কাহ্নপা, বরুচণ্ডিদাস, আলাওল, কালিদাস, আব্দুল হাকিম, এমনকি ভারত চন্দ্রের আমলের বাঙলা আজকাল অনেকটাই পার্থক্য হয়ে গেছে। এই পরিবর্তনের পর্যায়গুলো সংমিশ্রণগত শতাধিক বছরের পরম্পরার ফসল। ভাষায় স্বল্পসংখ্যাগত পরিবর্তনকে একটি পর্যায়কাল ধরা যায়। অতঃপর কয়েক সহস্রাব্দের ব্যবধানে উক্ত সংখ্যাগত পরিবর্তনগুলো মূল ভাষায় গুণগত পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলে। এটাই হচ্ছে ভাষার বিবর্তন। উল্লেখ্য বর্তমান বাঙলাভাষা যেমন আছে, ২/৩-সহস্র বছর পর এমন আর ব্যবহৃত হবে না। বরং বহুশতাব্দীব্যাপী স্বল্পসংখ্যক পরিবর্তনের পরম্পরা বিভিন্ন পর্যায় পার করে বাঙলাভাষা একসময় প্রাকৃত মাগধীর মতো বিবর্তিত হয়ে অন্য এক বা একাধিক ভাষায় রূপান্তরিত হবে। মূলত বাঙলা একটি নবীন ভাষা। ড. শহীদুলাহ্‌র মতে খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী এভাষার উৎপত্তিকাল। প্রাকৃত মাগধীর প্রাচ্যতর রূপ গৌড় প্রাকৃত থেকে বাঙলাভাষার উদ্ভব হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এরকম পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়ার মধ্যেই দুনিয়ার প্রতিটি ভাষা জন্ম হয়েছে। ভাষা হলো অভিযানসদৃশ (Journey), যা পর্যায়ক্রমে নতুন নতুন গলি পেড়িয়ে অবশেষে স্বীয় চলার সমাপ্তি টানে। তদ্রূপ সংমিশ্রণজনিত পরিবর্তন দ্বারা কেবলমাত্র নতুন ভাষারই জন্ম দেয় না, বরং একটি ভাষার ব্যবহারিক দিকের চির অবসান ঘটাতে পারে—ইউরোপের দাপুটে ল্যাটিন, ভারতের সংস্কৃত, বাইবেলযুগের হিব্রু ভাষা এর বাস্তব নমুনা। তবে ভাষায় যে পরিবর্তনই হোক, সেটা মূলত আঞ্চলিক কথ্য ভাষায় আগে সৃষ্টি হয়।

আঞ্চলিকতার প্রভাবে পাশাপাশি নবীন ভাষাগুলোর মধ্যে বেশি মিল থাকে : পার্শ্ববর্তী দেশের ভিন্ন একটি ভাষা বুঝতে সহজ হওয়ার ব্যাপারটি নবীন ভাষাগুলোর ক্ষেত্রেই বেশি ঘটে। কেননা নবীন ভাষাগুলো স্বতঃস্ফূর্ত ও সাহজিক। যা আঞ্চলিকভাষায় সমৃদ্ধশালী কিংবা পাশের অন্যভাষা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। কিন্তু তিন/চার হাজার বছর পুরানো একটি ভাষার সাথে আশেপাশের ভাষার সংমিশ্রণ কমই হয়। কেননা পুরানো ভাষার প্রমিতরূপ একপর্যায়ে উক্ত ভাষাভাষী সবাই আয়ত্ব করে ফেলে। সুতরাং যে ভাষা যতো পুরাতন, সেই ভাষা ততোই অনমনীয়। যা অন্যভাষীদের পক্ষে বোঝা বা আয়ত্ব করা সহজসাধ্য নয়। এক্ষেত্রে উল্লেখিত ভৌগোলিক দূরত্ব কার্যকর নয়। তামিল ভাষা এক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক। ২৩০০-বছর পুরানো ভারতিয় ভাষা হলেও তামিলভাষা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের (ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা) লোকদের পক্ষে বোঝা বা শেখা, হিন্দি বা বাঙলার মতো, সহজসাধ্য নয়। চীনা ও কোরিয়ান ভাষাও এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। চীনা ভাষা (৬-হাজার বছর) বর্তমানে দুনিয়ার সবচে’ পুরানো ভাষা। কোরিয়ান ভাষার বয়স ২১০০-বছর। ভৌগোলিক অবস্থান কাছাকাছি অথবা এদের লিপি দেখতে একরকম মনে হলেও ভাষা দুটো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ফলে চীনা ভাষা জানলে কোরিয়ান শেখা সহজ হবে ব্যাপারটি তেমন নয়।

ভাষার পদ্ধতিগত ভিন্নতার কারণ শব্দকোষ ও বর্ণমালা : বস্তুত যেকোনও ভাষায় নির্দিষ্ট শব্দসম্ভার ও বর্ণমালা আছে। তবে মূল পার্থক্য হয় শব্দের ভিন্নতায়। একধরনের বর্ণমালা কয়েকটি ভাষায় ব্যবহৃত হলেও ভাষাভেদে কিছুটা ভিন্নতা থাকে। আর এভাবেই দুনিয়াব্যাপী ভাষাগুলো একটা থেকে অন্যটার প্রকৃতি আলাদা হয়েছে। পদের (Parts of Speech) ব্যবহার সমস্ত ভাষায় থাকলেও পদ্ধতিগত অমিল রয়েছে। উল্লেখ্য শব্দগঠন কী করে হয়, সেটা ভাষাবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়। তবে সহজে বললে, শব্দগঠনের ভিত্তিমূলে রয়েছে নির্দিষ্ট একটি জনপদের প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে সেখানের অধিবাসীদের মিথস্ক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় অঞ্চল ভিত্তিক কথ্যভাষা তৈরি হয়েছে। স্থানীয় কথ্যভাষাবিহীন কোনও ভাষার অস্তিত্ব নাই। স্মর্তব্য ভাষা মৌখিকভাবে প্রকাশের জন্য শব্দকোষ ছাড়া সম্ভব নয়। তারপর আসে ভাষা লিপিবদ্ধ করার জন্য বর্ণমালা ব্যবহার। মানুষ শব্দকোষ ব্যবহার করে কথ্য ভাষা কবে শিখেছে, এর সঠিক ইতিহাস নাই। তবে আনুমানিক পাঁচ হাজার বছর আগে মিশরে ভাষা লিপিবদ্ধ করার প্রচলন ঘটে বলে জানা যায়। বাঙলা বর্ণমালা এসেছে প্রাচীন “ব্রহ্মীলিপি” থেকে।

ভাষার শুদ্ধতায় ব্যাকরণ গ্রহণযোগ্য প্রণালি হলেও অবিশ্যম্ভাবী নয় : পক্ষান্তরে ভাষা থেকেই ব্যাকরণের (Grammar) উদ্ভব হয়েছে। কতোগুলো শব্দ যদৃচ্ছাক্রমে (Randomly) বসালেই অর্থবোধক বাক্য হয় না। মনের ভাব প্রকাশে শব্দের নির্দিষ্ট ব্যবহারবিধি থাকে। আর এই বিধির অপর নাম ব্যাকরণ—এই রীতির উদ্ভাবক কেউ নয়—ভাষা ব্যবহারের উপজাত হিসাবে এসেছে। তবে ব্যাকরণের ব্যবহারবিধিগুলো পরিবর্ধনে অনেকেই ভূমিকা রাখে। ব্যাকরণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, পৃথিবীর প্রতিটি ভাষায়ই বাক্যগঠনের জন্য পদের বিশেষ কতোগুলো নিয়ম আছে—এসব প্রাকৃতিক নিয়মের মতো স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা—বিশেষ্য, ক্রিয়া, কাল, বচন, লিঙ্গ, সর্বনাম, অব্যয়, বিশেষণ, ক্রিয়া-বিশেষণ ইত্যাদি। এছাড়াও শব্দ প্রকরণ, বাক্যপ্রকরণ, উচ্চারণ বিন্যাশ ও কাব্যপ্রকরণ ইত্যাদি বিশ্বের প্রতিটি ভাষায়ই ব্যাকরণের শাখা হিসাবে রয়েছে। ব্যাকরণের রীতিগুলো প্রতিটি ভাষার প্রমিতরূপ বজায় রাখার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব ব্যবহার না করে ভাষার বিশুদ্ধতা বা নিজস্বতা বজায় রাখা কঠিন। তবে ভাষা যোগাযোগের মাধ্যম। ব্যাকরণ যোগাযোগের জন্য অনিবার্যভাবে লাগবে, এমন কোনও কথা নেই। কার্যত ব্যাকরণ না জেনেও শুনে শুনে ভাষা আয়ত্ব করা যায়—প্রবাসীরা এর উদাহরণ।

আঞ্চলিক কথার গুরুত্ব এবং প্রমিত ভাষার তাৎপর্য : সব ভাষায় আঞ্চলিকতার প্রভাবজনিত জগাখিচুরি অবস্থা নিরসনকল্পে প্রমিত ভাষার প্রচলন করা হয়েছে। আঞ্চলিক ভাষাগুলোর মধ্যে তুলনামূলক সুশ্রাব্য ও সুশোভিত একটি কথ্যভাষা প্রমিত ভাষারূপে গ্রহণীয় হয়ে থাকে। তবে আঞ্চলিক কথ্যভাষা নিকৃষ্ট কিছু নয়। কিংবা একটার চেয়ে অন্যটা সেরা নয়। আঞ্চলিক কথা বলা অন্যায্য কিছু নয়। বরং আঞ্চলিক কথা একজনের জাতীয় পরিচয়ের গুরুত্ব বহন করে। তবে আঞ্চলিক টানে প্রমিতভাষা বলার চেষ্টা শোভনীয় নয়। বিশেষ করে জাতীয় পর্যায়ে এটা বড়ই বেমানান। এদেশের জাতীয় সংসদে বক্তৃতা দিতে উঠে কতিপয় সাংসদ এমন প্রমিত বাঙলা বলে, যা শুনলে হাসি থামানো যায় না। আসলে এরকম পণ্ডশ্রমে বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্য বিনষ্ট হয়—নিজ প্রকাশভঙ্গি স্বতঃস্ফূর্ত হয় না—তোতলামো চলে আসে। অথচ নিজ আঞ্চলিক কথায় সবাই সাবলীল হয়ে থাকে। মাতৃভাষা প্রমিতভাষার ব্যবহার না-পারা হলো শিক্ষা সমস্যা। স্কুল পর্যায়ে প্রমিতভাষা শিক্ষা কার্যক্রমে আবশ্যিক বিষয় রাখা প্রয়োজন। বৃহত্তর পরিসরে প্রমিতভাষার ব্যবহার খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা এক এলাকার কথা অন্য এলাকায় দুর্বোধ্য হতে পারে।

আঞ্চলিকভঙ্গি কথায় চলে আসলে কেউ ছোট হয়ে যায় না : বাংলাদেশের ভদ্দর লোকদের আড্ডাস্থলে আঞ্চলিক কথায় অনেকের আপত্তি আছে। কেউ তা বলে ফেললে, জিজ্ঞেস করা হয়, “ভাই আপনার দেশ কোথায়?” এই প্রশ্নে থাকে তাচ্ছিল্যভাব! কিন্তু আঞ্চলিক কথ্যভাষা একটি এলাকার মানুষের মাতৃভাষা। আর মায়ের ভাষায় কথা বলে কেউ ছোট হয়ে যায় না। বরং এনিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হীনমন্যতার পরিচয়। এদের জ্ঞাতার্থে জানানো দরকার যে, আঞ্চলিক কথ্যভাষা থেকেই বিশ্বের প্রতিটি ভাষার উদ্‌ভব হয়েছে।

আঞ্চলিক ভাষাই মাতৃভাষা : একটি দেশে জন্মলাভ করা যে কেউ আঞ্চলিকতা মুক্ত হয় না। যে শিশু যে স্থানে জন্মগ্রহণ করে এবং স্থায়ী হয়, উক্ত স্থানের কথ্যভাষাই তার মাতৃভাষা হয়ে যায়। কেউ শত চেষ্টা করেও স্বীয় অঞ্চলের ভাষাগত স্বরধ্বনি ত্যাগ করতে পারে না। তবে ইচ্ছা করলে সবাই নিজ ভাষার সর্বজনস্বীকৃত প্রমিতরূপ আয়ত্ব করতে পারে। যেমন : একজন বাঙলাভাষী একটু চেষ্টা করলেই বাঙলার প্রমিতকথা আত্মস্থ করতে পারে। প্রবাসের ভাষা শেখা যায়; যেমন : অনেক বাঙালি আজকাল প্রবাসের স্থানীয় কথা বলতে পারে। কিন্তু প্রবাসের ভাষায় মাতৃভাষার মতো দক্ষতা লাভ করা সম্ভব না। তবে কেউ প্রবাসে স্থায়ী হয়ে গেলে তার পরবর্তী প্রজন্ম সেখানকার ভাষাভাষী হয়ে যায়। লন্ডন প্রবাসী সিলেটি লোকদের পরবর্তী প্রজন্মের কথা শুনলে ব্রিটিশ মনে হয়। তদ্রূপ লণ্ডন প্রবাসী বাঙালি যুবকরা অনেকেই ইংরেজ মেয়ে বিয়ে করে বাঙলা কথা শেখায়। কিন্তু সেই মেয়েদের উচ্চারণে ইংলিশ স্বরভঙ্গি থাকে। কারণ জন্মের পর থেকে যে শিশু যে অঞ্চলে ১২-বছর বয়স পর্যন্ত বেড়ে ওঠে, উক্ত অঞ্চলের কথ্যভাষার স্বরভঙ্গি (Intonation) তার কণ্ঠধ্বনির সাথে বসে যায়। যা আর ত্যাগ করা যায় না। মানে উক্ত আঞ্চলের ভাষাই তার মাতৃভাষা।

উপসংহার : মানবসমাজে ব্যবহৃত অঞ্চলভিত্তিক শব্দগুলোই ভাষা গঠন করে। যা দেশ ও কালের ব্যবধানে ভিন্নতর হয়ে থাকে। যেকোনও ভাষা নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলবাসীর প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সামাজিক বন্ধনে মিথস্ক্রিয়ার জন্য ব্যবহৃত ধ্বনিগুলোর সামষ্টিক পরিশীলিতরূপ। আর একটি ভূখণ্ডে অবস্থিত সমস্ত কথ্যভাষার মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে প্রমিতভাষা এবং ব্যাকরণের রীতিনীতি যুক্ত করা হয়েছে। ব্যাকরণ ও প্রমিতধারা কর্মশক্তিপূর্ণ (dynamic) ও ধারাবাহিক ঘটনশীল (Perpetual) হলে একটি ভাষা কয়েকশ’ বছর ধরে অবিকৃত থাকে এবং গতি সুদৃঢ় হয়। ফলে ভাষাটি দু’চার হাজার বছরে বিলুপ্ত হয় না। তাই বর্তমান দুনিয়ার নবীন ভাষাগুলো আরও কতোশ’ বছর টিকে থাকবে, তা নির্ভর করছে এগুলোর ব্যাকরণ ও প্রমিতরীতির গতিময়তা ও বহুমুখিতার (versatility) ওপর। তদুপরি সাত/আট হাজার বছরের ব্যবধানে একটি ভাষার পরিবর্তন ব্যাকরণ দ্বারা ঠেকানো যায় না। তাইলে চীনাভাষার চেয়ে পুরানো দু’একটি ভাষা আজও পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই টিকে থাকতো। মূলত ভাষার মূলশক্তি হলো প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল অঞ্চলভিত্তিক মৌখিক কথা, যার মধ্যে প্রমিতভঙ্গি কমই থাকে। আর ব্যাকরণ ভাষাকে প্রমিতকরণের জন্য ব্যবহৃত হয়। আসলে বিশ্বব্যাপী প্রতিটি ভাষা গঠনের পিছনে আঞ্চলিক ভাষাগুলোর সবচে’ বড় ভূমিকা রয়েছে। অর্থাৎ কোনও ভাষার প্রমিতরূপ বিকৃত হয়ে আঞ্চলিকভাষা হয়নি। বরং প্রমিত বলে পরিচিত ভাষাগুলোও আঞ্চলিক কথ্যভাষা।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge