শান্তি বিপ্রতীপ যুদ্ধ শুধুই ধ্বংস ধ্বংস খেলা। যুদ্ধ মানে মানুষের প্রতি মানুষেরই অবহেলা। যুদ্ধ প্রাণহানী আর সম্পদ ধ্বংসের অপকৌশল ছাড়া আরকিছু নয়। তাই যুদ্ধের ইতিহাস শুধুই ধ্বংসের ইতিবৃত্ত। কিন্তু মানুষ তো কেবল শান্তি চায়। যুদ্ধ এড়াতে না পারলে শান্তি আসে না। এই সহজ কথা মেনে চলার মানুষের সংখ্যা কম! অথচ যুদ্ধ কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয় যে এড়ানো যায় না। বাস্তব দুনিয়ায় সর্বদা যুদ্ধংদেহি পরিবেশ বিরাজ করে—যেন যুদ্ধপ্রস্তুতি ছাড়া মানুষের আর কোনও কাজ নেই! টিকে থাকার কৌশল হিসাবে মানুষ শুধু লড়াই প্রয়োজন ভাবলেও সংঘাত এড়াতে শেখেনি বলে এমন হয়! নইলে বিজ্ঞানের যাবতীয় উদ্ভাবন মুখ্যত যুদ্ধপ্রস্তুতির কাজে বেশি ব্যবহৃত হতো না। ধ্বংসযজ্ঞ এড়াতে যুদ্ধকে না-বলা দরকার, তা নিশ্চয়ই কারও অজানা নয়। তবুও মানুষ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্তু যুদ্ধ জয়োৎসব ক্ষণিকের ও একপাক্ষিক। এর ফলে আরও যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করে। তদুপরি যুদ্ধ এড়াতে এর প্রস্তুতি বন্ধ করা সবাই অলীক মনে করে। কেননা আমাদের পরিবেশে সর্বদা সংঘাত লেগে থাকে। তাই যুদ্ধংদেহি অবস্থা দুনিয়া থেকে দূর হয় না :
যুদ্ধ কেন হয়?
প্রধানত পুঁজিবাদী স্বার্থের দ্বন্দ্ব যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করে। আর এই দ্বন্দ্বের সাথে নৈতিক মূল্যবোধ যোগ করেই যুগ যুগ ধরে মানবসমাজে আদর্শের বীজ বপন করা হয়ে থাকে। একটা দেশ বা জাতি নিজস্ব স্বার্থের প্রয়োজনে অন্যদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে—একটা অননুভবনীয় সত্য। এই ঐতিহাসিক সত্যের নাম যুদ্ধ। একটি দেশের নেতারা জাতীয় স্বার্থ রক্ষার নামে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। সাধারণ মানুষও তাতে উদ্বুদ্ধ হয়। যার সাথে নৈতিক মূল্যবোধও যোগ করা হয়! কিন্তু অন্যদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার মূল উদ্দেশ্য নৈতিক ব্যাপার হয় কীভাবে? তথাপি দুনিয়ার তাবৎ সম্পদ গ্রাস করা এবং অন্যজাতির সাথে এ নিয়ে লড়াই করে জয়লাভ করাই যেন একটা রাষ্ট্রের মূলনীতি। যা শুধু জাতীয়তাবাদী সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়তে সহায়তা করে। বস্তুত প্রতিটি যুদ্ধের নেপথ্যের ইতিহাস ঘাঁটলে শুধু পুঁজিবাদীদের আদর্শগত দ্বন্দ্ব পাওয়া যায়। জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ রাষ্ট্রগুলো এই ধারণায় বিশ্বাসী বলে যুদ্ধ মানবজাতির পিছু ছাড়ে না!পুঁজিবাদের বুনিয়াদ :
মানুষের আর্থিক কাজে স্বভাবতই ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধ থাকে। এর গুরুত্ব অনুধাবনের মাঝেই পুঁজিবাদের ভিত্তি রচিত হয়। তবে যুগ-পরিক্রমায় পুঁজিবাদের স্বরূপ পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তনগুলো কালের প্রয়োজনে ঘটলেও পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অপরিবর্তিত থাকে। পুঁজিবাদ ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধের সমষ্টি হিসাবে আবির্ভূত হয়। যা শুধু একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ করে। এর অর্থ হলো যেকোনও উপায় একটি জাতি বা গোষ্ঠীর সম্পদ উপার্জন ও পুঞ্জিভূত করা। যার মাঝে মানবজাতির সার্বিক পরার্থবোধ সম্পূর্ণভাবে অনিশ্চিত থাকে। ক্ষুদ্রস্বার্থ সংরক্ষণের এই চরমব্যবস্থা পুঁজিবাদের প্রকৃতি। যা অনিবার্য ব্যবস্থা হিসাবে সর্বযুগে বিবেচিত হয়ে থাকে। এর ফলে মানবসমাজে আর্থিক শ্রেণি তৈরি হয়।পুঁজিবাদের ইতিহাস :
যোগাযোগ অত্যন্ত প্রাথমিক পর্যায় ছিলো বলে মানুষ আদিমযুগে নিজেদের সাচ্ছন্দের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি গঠন করতো—এটা যাযাবর যুগের পরের ইতিহাস। মানে আধুনিক মানুষের প্রাথমিক যুগে পৃথিবীর সব মহাদেশে সেইসব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সূচনা হয়। পরবর্তীতে উক্ত জাতিগুলোই সারা দুনিয়ায় রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি গঠন করে। সেই রাষ্ট্রে স্থানীয় ভিত্তিতে নির্দিষ্ট ভাষা ও আর্থিক নিয়মনীতি প্রতিষ্ঠা হতো। এই আর্থিক নিয়মগুলো একপর্যায় পুঁজিবাদের পরিকাঠামোরূপে (In-frastructure) প্রতিটি রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে গ্রথিত হয়ে যায়। মূলত উক্ত পরিকাঠামোগুলো সমাজপতি বা রাজা-মহারাজাদের সর্বোচ্চ স্বার্থে গঠন করা হতো। কেননা তাদের প্রয়োজনেই দেশের আইন-কানুন তৈরি হতো। সেইসব আইনের মূল প্রেরণা ছিলো এমন রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে সম্পদের চুড়ান্ত অধিকার শুধুই সমাজপতিদের। এর জন্য তারা কিছু প্রথা জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতো। জনগণ কর্তৃক সেসব প্রথা মেনে নেওয়াই ছিলো আদর্শ। প্রকৃত অর্থে এটা ছিলো পুঁজিবাদের আদিম রূপরেখা। অতঃপর যুগের পরিবর্তনে পুঁজিবাদ বর্তমান রূপ লাভ করেছে। তবে এই আদর্শ যদি রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের আর্থিক নিরাপত্তা সমানভাবে বিধান করতো, তবেই সেটা মানবিক আদর্শ হতো। কিন্তু কোনও কালেই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরার্থবাদের অস্তিত্ব ছিলো না। কেননা পুঁজিবাদ গড়ে উঠেছে শুধুই সমাজের উপরতলার স্বার্থের প্রয়োজনে। তাই এই ব্যবস্থায় স্বজাতি বা বিজাতি কারও জন্যই সম্পদের সমবণ্টনব্যবস্থার বিধান নাই। অথচ পুঁজিবাদীব্যবস্থা বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দগুলো হলো : সমবণ্টন, পরার্থবাদ এবং মানবতা। অধিকন্তু পুঁজিবাদ এসব রক্ষার জন্য যুদ্ধই একমাত্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বানিয়েছে—বিশ দিয়ে রসগোল্লা বানানোর মতো ব্যাপার!পুঁজিবাদের হোতাদের নিয়ে মানবেতিহাস রচিত হয় :
নৃপতি বা নেতৃস্থানীয়রা ক্ষুদ্রস্বার্থের চূড়ান্ত পর্যায় অবস্থান করে। এরাই ক্ষুদ্রস্বার্থ রক্ষার জন্য পুঁজিবাদী আদর্শ বা প্রথা গড়ে তোলে। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে একটি ব্যাপার স্পষ্ট হয় : সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ জনগণের দোহাই দিয়ে ক্ষমতায় বসে। আগে রাজন্যবর্গ দেশের সমৃদ্ধির নামে আশেপাশের রাজ্যগুলো আক্রমণ করতো। অতঃপর দখলকৃত রাজ্যে ব্যপক লুটপাট চালিয়ে স্বীয় রাজকোষ সমৃদ্ধশালী করতো। এই কাজে তাদের অনেকেই কোনও একটি আদর্শের আশ্রয় গ্রহণ করতো। যে আদর্শের মূলে ছিলো পুঁজিবাদী চিন্তা। এসব আদর্শ কতিপয় আপাতমধুর নীতিবাক্যে সাজিয়ে পরার্থবাদ বা মুক্তির প্রকৃত পথের দিশা বলে প্রচার করা হতো। কিন্তু দিনান্তে সব আদর্শই শুধু ক্ষমতাবানদের আরও সম্পদশালী করার কাজে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে মাত্র। ফলে মানবসমাজে ধনাঢ্য ও সর্বহারা নামে দুটি শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং বলতে দ্বিধা নেই যে, কোনও আদর্শই বিশ্বমানবতার আর্থিক মুক্তি ও সমতা স্থাপনের সফল হয়নি। বরং ক্ষুদ্রস্বার্থ প্রতিষ্ঠার কাজেই বেশি ক্রিয়াশীল! ইতিহাস প্রতিক্রিয়াশীল পুঁজিবাদী হোতাদের কর্মকাণ্ড এবং তাতে নিষ্পেষিত জনতা নিয়েই রচিত হয়েছে। যার প্রকৃত চিত্র শুধুই শ্রেণিসংঘাতের পরিণাম স্বরূপ যুদ্ধ।সমতা স্থাপনে কার্যকর ব্যবস্থার রূপরেখা আসলে কী হওয়া উচিত?
মানবহিতৈষী সার্বিক আদর্শগত নিয়মনীতি প্রকৃতির মতো সর্বজনীন হওয়া উচিত; যেমন : সৌরালোক বা অক্সিজেন প্রাণী মাত্রই সমানভাবে গ্রহণ করতে পারে। যে আদর্শ অনুরূপ নয় কিংবা মুষ্টিমেয় স্বার্থ রক্ষার জন্য গঠিত, সেটা সর্বজনীন মানবিক আদর্শ হতে পারে না। যদি রাষ্ট্রব্যবস্থার ইতিহাস চার/পাঁচ হাজার বছর হয়, তবে শুরু থেকে আজ অবধি তাতে পুঁজিবাদ ছাড়া আরকিছু দেখা যায় না। এর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী জাতিগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র অসমতা ও জাতীয়তাবাদী চেতনা তৈরি হয়েছে—একটি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রে বিশ্বব্যাপী জনগণের সার্বিক সৌহার্দ ও ভ্রাতৃত্ববোধের বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব নয়। বস্তুত পুঁজিবাদী আদর্শ সমস্ত ক্ষুদ্রস্বার্থের জোটবদ্ধরূপ, যা এক পর্যায় জাতীয়তাবাদ রূপে আবর্তিত হয়। মূলত পুঁজিবাদই জাতীয়বাদী চেতনার জন্ম দেয়। যা কার্যত এক জাতির স্বার্থে গড়া পুঁজিবাদী আদর্শ। সেটা স্বভাবতই অন্যজাতির স্বার্থ সংরক্ষণে কোনো ভূমিকা পালন করে না। বরং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে—উপনিবেশিক শাসনকাল এর প্রকৃত উদাহরণ।জাতীয়তাবাদের ভিত্তি পুঁজিবাদ :
পুঁজিবাদের সর্বগ্রাসী মনোভাব প্রকাশিত হয় জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকে। যদিও প্রাকৃতিক সম্পদ কোনও জাতির একক পরিশ্রমের ফসল নয়, বরং এই গ্রহের সম্পদ। অথচ জাতীয়তাবাদ খনিজ সম্পদের মতো প্রাকৃতিক পণ্যগুলো একটি জাতির নিজস্ব সম্পদে পরিণত করার শিক্ষা দেয়! ফলে এক জাতির থাকে অঢেল সম্পদ আর অন্যরা থাকে বঞ্চিত। এক্ষেত্রে মানবিক আদর্শের মূল্যবোধ কোনও কাজ করে না। উদাহরণ স্বরূপ আরব দেশগুলো প্রচুর তেল সম্পদের মালিক। কিন্তু অনেক মুসলিম দেশ আছে যারা প্রতিনিয়ত জ্বালানি স্বল্পতায় ভোগে। যাদের জ্বালান খরচ মোট জাতীয় আয়ের প্রায় তিরিশ শতাংশ। কিন্তু মুসলিম হিসাবে তেলের মূল্যে কোনও ছাড় নাই! কার্যত আরবদের এরকম আর্থিক ব্যবস্থা পুঁজিবাদেরই নামান্তর। অথচ আরব দেশ থেকেই ইসলামি আদর্শের পরার্থবাদী ভাবধারা প্রচার করা হয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে ইসলামিকরণের দ্বারা পুঁজিবাদ আরববিশ্বের রাষ্ট্রীয় নীতি হয়। আসলে পুঁজিবাদীরা মানবিক আদর্শের ছদ্মবেশ ধারণ করে। মানবিক আদর্শের রূপরেখা তারা পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে গড়ে তোলে।পুঁজিবাদী ব্যবস্থাগুলো ঐক্যবদ্ধ নীতি নয় বলে দুনিয়ায় যুদ্ধংদেহি অবস্থা দূর হয় না :
পুঁজিবাদী আদর্শ এ দুনিয়ায় শতধা ভাগে বিভক্ত। একটা অন্যটার প্রতি সহনভূতিশীল নয়। কোনোটা গণতান্ত্রিক, কোনোটা আধ্যাত্মবাদী গণতান্ত্রিক, পুঁজিবাদ বিরোধী মানবতাবাদী কোনোটাই না! এরা পারস্পরিক বিপরীতপন্থা অবলম্বন করে। এসব আসলে আদর্শের নামে পুঁজিবাদের তাণ্ডবলীলা। পারস্পরিক দ্বান্দ্বিক মনোভাব, ঘৃণা এবং উদ্বাহু জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ চেতনা জাগ্রত করে। এতে পরার্থবাদের মুখোস ছাড়া কল্যাণকর কিছু নেই। কেননা চরম জাতিস্বার্থ ও পুঁজিবাদ চুম্বকের বিপরীত মেরুর মতো একে অপরের দিকে টানে। জাতিস্বার্থ হলো ব্যক্তিস্বার্থের সমন্বিত রূপ। সর্বোপরি প্রতিটি পুঁজিবাদী আদর্শের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়ার দাবী থাকে। ফলে প্রতিটি আদর্শের অনুসারীরা স্বীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য সর্বদা ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিপক্ষে যুদ্ধংদেহি মনোভাবাপন্ন হয়ে থাকে। যার শেষ পরিণতির নামই যুদ্ধ! পুঁজিবাদ স্বীয় আদর্শ রক্ষায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানায়। সুতরাং বলতে দ্বিধা নেই যে, পুঁজিবাদী আদর্শ বা প্রথাগুলোই যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করে।প্রতিষ্ঠিত আদর্শের বাস্তবতা কী? :
প্রতিটি আদর্শের মৌলিক চিন্তা এক পর্যায় মানুষ পুঁজিবাদের আদলে গড়ে তোলে। এই প্রথার ধারাবাহিকতা পূর্ণতা পায় পূর্বপুরুষের প্রথা ধরে রাখার মাধ্যমে। ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় প্রতিটি পর্বেই এই প্রথা চলমান। দুনিয়ায় অপরিমিত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও চিরকাল তা নিয়ে কাড়াকাড়ি চলে। সমবণ্টনব্যবস্থার বিপরীত পুঁজিবাদ পৃথিবীর সমস্ত সম্পদের ওপর একচ্ছত্র অধিকার বজায় রেখেছে। সম্পদ লাভের প্রতিযোগিতায় যে যতোটুকু কৃতকার্য, তার ততোটুকুই সম্পদ লাভের অধিকার আছে। তাই দুনিয়াজুড়ে মানবজাতি সর্বদাই দুই শ্রেণি হয়ে যায় : একদলের আছে এবং অন্যদলের নেই! অর্থাৎ পুঁজিবাদী মাপকাঠিতেই মানবজাতির মধ্যে বিভেদ তৈরি হয়! এমন বৈষম্যের সর্বশেষ পরিণতি শ্রেণিসংগ্রাম, যুদ্ধই যার নিশ্চিত পরিণাম। কাজেই সাম্যবাদী চিন্তা পুঁজিবাদের বাস্তবতা নয় বরং অসবর্ণ, আদর্শহীন বা আপাঙ্ক্তেয়!মানবজাতির ইতিহাস যুদ্ধের হলেও এর ফলাফল নিয়ে গবেষণা নেই :
কোনও একটি আদর্শের নামে চরম জাতিয়তাবাদী ভাবধারা প্রচার। জাতিগত শুদ্ধিকরণের নামে মানুষে মানুষে বিভক্তি। এসব নিয়ে দেশে দেশে যুদ্ধংদেহি অবস্থা তৈরি হওয়া বা যুদ্ধ লেগে যাওয়াই মানবজাতির প্রকৃত ইতিহাস। এর বাইরে গঠনমূলক ইতিহাস নগণ্য! মানবজাতি এই সত্য বারবার প্রত্যক্ষ করলেও অনুভূতি নাই! প্রকৃতপক্ষে কে হারে আর কে জেতে, তারচেয়ে বড় কথা যুদ্ধের সুদূরপ্রসারি ফলাফল কী? কিন্তু গবেষণা তো দূরে থাক, এভাবে কোনও রাষ্ট্র চিন্তাও করে না। কেননা সকল রাষ্ট্রের কর্তারা খুব ভালো করে জানে যে, যুদ্ধকে না-বললে তাদের পুঁজিবাদী কার্যক্রম শেষ হয়ে যাবে এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদে সমবণ্টন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। তাই এ নিয়ে গবেষণা করতে দেওয়া হয় না! এর বদলে দুনিয়াজুড়ে নেতৃস্থানীয় লোকেরা সর্বদা শান্তির জন্য যুদ্ধ অনিবার্য করে রেখেছে। যুদ্ধে বাহ্যত একপক্ষের জয় হলেও মানবজাতির সুদূরপ্রসারী পরাজয় ঘটে।ক্ষমতাসীনদের দক্ষতা, অর্জন ও পরম্পরা রক্ষার ভিত্তি :
বেশিরভাগ পুঁজিবাদের কারিগর তাদের সামসময়িক যুগে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকে। সম্পদ ক্ষমতার পাশেই আবর্তিত হয়। ক্ষমতাসীনরা আদর্শের ছদ্মাবরণে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার কাজে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ব্যয় করে। যতোবেশি মানুষ তাদের আদর্শের পতাকা তলে আশ্রয় নেয়, ততোবেশি তারা ক্ষমতাবান হয়। বেশি ক্ষমতাই বেশি পুঁজি অর্জনের সহায়ক। মৃত্যুর পরও তাদের আদর্শের ধারাবাহিকতা ও সুনাম হাজার হাজার বছর ধরে টিকে থাকে। পাছে আদর্শের নামে ক্ষমতা বেহাত হয়, সেজন্য তারা আদর্শ প্রতিষ্ঠা এবং রক্ষার জন্য যুদ্ধ অবধারিত নিয়ম করে রাখে। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম উক্ত আদর্শের ধারক ও বাহক হয়ে পূর্বপ্রজন্মের ন্যায় ক্ষমতাবান হয়। অতঃপর পূর্বপুরুষদের সমস্ত ধারা অক্ষুণ্ণ রাখতে তারা প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালায়। এইভাবে প্রজন্মগুলোর হাতে একটি আদর্শ বা রাজত্বের পরম্পরা চলতে থাকে। তবে দুর্বলতার কারণে ক্ষমতা ও পুঁজি উভয়ই নতুন প্রজন্মের হাতে ক্রমশ শিথিল হয়ে পড়ে। ঔরংগজেবের পর আরও নয়জন মুঘল সম্রাট দিল্লির সিংহাসনে বসেছিলেন। কিন্তু শাসনকার্যে দুর্বলতার কারণে তারা কেউই পূর্বপুরুষদের মতো প্রতাপশালী হতে পারেনি। বরং তারা ধীরে ধীরে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ে। এমনকি তাদের রাজত্ব বহিরাগত শত্রুর হাত থেকে রক্ষার দায়িত্ব পড়ে মূঘলদের এক সময়ের চরম শত্রু মারাঠাদের হাতে। অতঃপর সবশেষ মুঘল সম্রাট ২য় বাহাদুর শাহ্কে ব্রিটিশরা সিপাহী বিপ্লবের নেতৃত্ব দানের অজুহাতে রেঙ্গুনে নির্বাসন দেয়।
প্রসঙ্গত সম্রাট অশোকের উদাহরণও স্মর্তব্য। কলিঙ্গ যুদ্ধের রক্তবন্যা তাঁকে একজন নীতিবান ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। বুদ্ধের মানবিক শিক্ষায় দীক্ষিত হয়ে তিনি চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোক নামে পরিচিতি লাভ করেন। বস্তুত চণ্ডাল চরিত্রের মূলে ছিলো তাঁর চরম জাতীয়তাবাদী ও পুঁজিবাদী ভাবধারা। কোলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতায় ব্যথিত অশোক মানবিক হওয়া সত্ত্বেও রাজত্ব ত্যাগ করেননি। বরং সাম্রাজ্যের ভিত্তি আরও শক্তিশালী করতে বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করেন। মানে তিনি মৌর্যবংশের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তাই বলতে হয় শান্তি নয়, যুদ্ধই ছিলো তাঁর সবশেষ অভিপ্রায়! অন্যথায় নিশ্চয়ই তিনি গৌতম বুদ্ধের ন্যায় দরবার ত্যাগ করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মননিবেশ করতেন। আসলে পুঁজিবাদী প্রবণতা কাউকে প্রকৃত মানবিক মানুষ হতে দেয় না।দিগ্বিজয়ীদের ইতিহাস :
ইতিহাসে কোনও দিগ্বিজয়ী বাদশাহ যুদ্ধ নয় শান্তি চেয়েছেন দেখা যায় না! উল্টো দিগ্বিজয়ীরা চরম পাষাণ প্রকৃতির ছিলো। আলেকজান্ডার, তৈমুর লং, চেংগিস খান, সুলেমান, বায়জিদ, নেপোলিয়ন, বাবর প্রমুখ ছিলেন দিগ্বিজয়ী রাজা। এদের সবার হাতই মানুষের রক্তে রঞ্জিত ছিলো! গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডারের যুদ্ধ জয়ের ইতিহাস আজও সবার মুখে মুখে। পৃথিবীর প্রধান তিনটি ধর্মগ্রন্থেও তাঁর মহিমার কথা উল্লেখ আছে! কিন্তু তাঁর এই দিগ্বিজয়ের বলি কতো লক্ষ মানুষ, এর ইতিহাস নাই। তদ্রূপ মুঘল সম্রাট বাবর ইব্রাহিম লোদিকে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে পরাভূত করে দিল্লির সিংহাসনে বসেন। এই যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদিসহ কমপক্ষে ষাট হাজার মানুষ একযোগে নিহত হয়। মধ্যযুগে এমন বৃহৎ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা খুব কমই ঘটেছে। বাবর তাঁর নিজ গ্রন্থ বাবরনামায় এই যুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। চেংগিস খান, তৈমুর লং এরা ছিলো মূলত মানবতার জন্য সাক্ষাৎ যমদূত। তৈমুর লং মুলতানে পাঁচ লক্ষাধিক মানবমুণ্ডু দ্বারা পিরামিড বানিয়েছিলো। চেঙ্গিস ও হালাকু খানের যুদ্ধজয়ের ইতিহাস আরও ভয়াবহ!সামসময়িক যুগের সামরিক ব্যয় এবং যুদ্ধের আয়োজন :
যুদ্ধ কোনও যুক্তিতে মানবজাতির উপকারে আসে না। বর্তমানযুগে ইরান-ইরাক, আফগান যুদ্ধ এই কথা আরেকবার প্রমাণ করেছে। আর শান্তির জন্য যুদ্ধ—সবচেয়ে বড় মিথ্যা এবং ক্ষুদ্র পুঁজিপতিদের প্রতারণার সবিষ পরিকল্পনা মাত্র। ইতিহাস একথা বারবার প্রমাণ করলেও বিশ্বব্যাপী আজও সবচেয়ে বেশি খরচ হয় সামরিক খাতে! আজকাল এমনসব ধ্বংসাত্মক ওয়ারহেড প্রস্তুত রয়েছে, যেগুলো একযোগে বিস্ফোরিত হলে এই পৃথিবী গ্রহের পরিবেশ আর জীববৈচিত্র একযোগে শেষ হয়ে যাবে। অর্থাৎ পৃথিবী এর পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে—পৃথিবীর পরিবেশ শুক্র বা মঙ্গল গ্রহের মতো প্রাণিজগতের প্রতিকূলে চলে যাবে!ভবিষ্যত ইতিহাস কি যুদ্ধের না শান্তির?
এই প্রশ্নের সদুত্তর সম্পূর্ণরূপে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিশ্বের নেতৃস্থানীয় লোকদের সদিচ্ছা নির্ভর। তবে বলতে হয় যে, আপাতত এর উত্তর নাই। নইলে সমরাস্ত্র প্রতিযোগিতা ঘটিয়ে অস্ত্র বিক্রয়ের মহোৎসব মানবজাতির পিছু ছাড়ছে না কেন? এ প্রসঙ্গে আবারও সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদের কথা চলে আসে। আদর্শ যে পুঁজিবাদের ছদ্মবেশ তা বর্তমানে প্রতিটি দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে স্পষ্ট হচ্ছে। নইলে ইরান বার্মা জান্তা সরকারের কাছে সমরাস্ত্র বিক্রয় করতো না! বার্মার মতো একটি অনুন্নত দেশ এতো অস্ত্রের মজুত কেন ঘটাচ্ছে? নিশ্চয়ই বাংলদেশ, ভারত, থাইল্যান্ডের সাথে যুদ্ধ লাগাতে। মূলত যুদ্ধ দুনিয়ায় সমপ্রতিক্রিয়াধারা (Chain Reaction) তৈরি করেছে! সুতরাং ভবিষ্যতের ইতিহাস যুদ্ধের না শান্তির একটি বাহুল্যধর্মী প্রশ্ন! বিশ্বশান্তির একমাত্র নিয়ামক হতে পারে সম্পদের সমবণ্টন ব্যবস্থা। তদুপরি সমবণ্টনের নামে দলীয় স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা লাভ করলে তা হয় প্রচলিত পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার চেয়েও ভয়াবহ। সোভিয়েত রাশিয়ায় যে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা চালু হয়েছিলো, তা আসলে ছিলো মার্ক্সবাদের ওপর ভর করে লেনিনবাদ প্রতিষ্ঠা। ফলে প্রকৃত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বদলে সেখানে দলীয় স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যে আদর্শ এক পর্যায় মুখ থুবড়ে পড়ে।যুদ্ধের কি বিকল্প নাই?
আমরা যুদ্ধের পরিবেশে বসবাস করি বলে এর বিকল্প ভাবতে পারি না। কোনও রাষ্ট্রই যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য সমরাস্ত্র সংগ্রহ না করে পারে না। আর একাজে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সবচে’ বেশি দরকার। ফলে বিশ্বব্যাপী ভয়ংকর মারণাস্ত্র এতোটা সমৃদ্ধশালী হয়েছে! উল্লেখ্য দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক কর্মকাণ্ড শেষমেশ বোমা তৈরির কাজে ব্যবহার হয়। সেই প্রকল্পের দায়িত্ব বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমারের হাতে দেওয়া হয়। কিন্তু হিরোশিমা ও নাগাসাকির ওপর আনবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞ দেখে তিনি ব্যথিত হন। অতঃপর যুক্তরাষ্ট্র সরকার হাইড্রোজেন বোমা প্রকল্পের দায়িত্বও তাকে দিতে চাইলে, তিনি নিতে অস্বীকার করেন। কিন্তু এই অস্বীকৃতির জন্য তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন তার সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স কেড়ে নেয়। অতঃপর তার বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রীদের গুপ্তচর এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে আনা হয়। অতঃপর তাকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। মূলত যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। তারা দুনিয়ায় তাদের সমতুল্য কোনো শক্তির অস্তিত্ব দেখতে রাজি নয়। তাদের কূটচালেই মূলত সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। অতঃপর সারাবিশ্ব একমুখি পরাশক্তি দ্বারা শাসিত হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়, যা আজও চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রকল্প হচ্ছে রাশিয়ার শক্তি খর্ব করা। আর তাই ইউক্রেন যুদ্ধ কৌশলে লাগিয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য বিশ্বজুড়ে একমাত্র পরাশক্তি হিসাবে টিকে থাকা। যাতে বিশ্বের সমগ্র প্রাকৃতিক সম্পদ তাদের কব্জায় আসে। অর্থাৎ চরম পুঁজিবাদী ভাবাপন্ন একটি দেশের যা করা উচিৎ তাই করে যাচ্ছে। বর্তমানে ইউক্রেন যুদ্ধ হয়তো পরিস্থিত পালটে দেবে। অতঃপর তৃতীয় মহাযুদ্ধ না হলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো আরও কয়েকটি দেশ চরম পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটাবে। রাশিয়া, চীন, সৌদি আরব, ইরান, ফ্রান্স এই তালিকার শীর্ষে থাকবে বলা যায়। এর ফলে পারমাণবিক সমরাস্ত্র প্রতিযোগিতা আরও বাড়বে। তাই সার্বিক মানবতার কল্যাণে পুঁজিবাদের বিকল্প আপাতত হচ্ছে না। সম্ভবত আরেকটি মহাযুদ্ধের পরিণতি না দেখে মানবজাতির সম্বিৎ ফিরবে না। সুতরাং যুদ্ধের বিকল্প মানবতার জন্য বিশ্বব্যবস্থা আসতে সময় নেবে।উপসংহার :
পরিশেষে বলা যায় যে, মানুষ নিজেকে যতোটা মহান ভাবে, সে আসলে ততোটা নয়। অধিক সম্পদ আত্মস্থ করার প্রবণতার ফলে সে লোভী হয়েছে। লোভই তাকে পুঁজিবাদের দিকে ঠেলে দেয়। যার পরিণতি যুদ্ধতে গিয়ে থামে। কিন্তু একটা যুদ্ধ সমপ্রতিক্রিয়াধারা তৈরি করে। তদুপরি মানুষের সবশেষ কামনায় শান্তি শব্দটি বেশি ব্যবহৃত হয়। তাই বিজ্ঞানের সর্বশেষ সংযোজন শুধু মানবতা রক্ষার উদ্দেশ্যেই একদিন ব্যবহৃত হবে। ভবিষ্যৎ সেদিন পৃথিবীর সমস্ত মানুষ যুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে দুশ্চিন্তা করবে। যুদ্ধের উৎস পুঁজিবাদী চিন্তা, মানুষ নিশ্চয়ই তা উপলব্ধি করবে। আশা করা যায় তখন নৈতিকতার নামে যুদ্ধের প্রতি উস্কানিমূলক সমস্ত আদর্শ দুনিয়া থেকে মুছে যাবে। মানবতা রক্ষার জন্যই যুদ্ধ নিষিদ্ধ হবে। আর তাই হবে মানুষের বস্তুগত ইউটোপিয়া বা আদর্শ রাষ্ট্র।
Leave a Reply