বিগত একশ’ বছরে পৃথিবীর বিজ্ঞান অচিন্তনীয় গতিতে এগিয়েছে। আর আগামী একশ’ বছরে এই পরিবর্তনের ধারা জ্যামিতিকহারে গতি লাভ করার সম্ভাবনা জেগেছে। তবে এই অগ্রগতি কারও পছন্দ বা অপন্দ নির্ভর নয় বরং সময়ের প্রয়োজনীতা। অনেকের মনে হতে পারে যে, এরচে’ অতীতকালই ভালো ছিলো—তাদের ভাবনায় অতীত ছিলো শুদ্ধ ও সরলতর। কিন্তু ইতিহাসের বাস্তবতা ভিন্ন—অতীতকাল তেমন চমকপ্রদ কিছু ছিলো না। যদিও সুবিধাভোগী মহলের পক্ষে পুরানো যুগটা অতো মন্দ ছিলো না। আর জনগণের সংখ্যাগুরু অংশের অতীতজীবন ছিলো অরণ্যচারীসম পশ্চাৎপদ ও স্বল্পস্থায়ী। তখন শ্রেণি নির্বিশেষে সবমানুষই সঠিক চিকিৎসা বঞ্চিত ছিলো। সেকালে মেয়ে সন্তান জন্ম ছিলো বিপজ্জনক এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলো অতিশয় শ্লথ। ঝড় বৃষ্টির মতো মামুলি প্রাকৃতিক দুর্যোগেও মানুষ হয়ে পড়তো অন্যান্য প্রাণীর ন্যায় অসহায়। তাই দুনিয়ায় টিকে থাকার জন্য সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করা বা মোকাবিলা করার পূর্বপ্রস্তুতি রাখা মানুষের প্রয়োজন ছিলো। মূলত টিকে থাকার প্রয়োজন থেকেই বিজ্ঞানের যাত্রা শুরু হয়। তবে বিজ্ঞান শুরুর ইতিহাস ২৬০০ থেকে ৩০০০ বছরের বেশি নয়। যা পরবর্তীতে মানবসমাজের প্রবণতা হয়ে যায়। অতঃপর এই প্রবণতায় উদ্বুদ্ধ মানুষ প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর গতিপ্রকৃতির ধারণা লাভ ও মূল্য নিরূপণের চেষ্টা করে চলছে। আর আদি কালব্যাপী এই চেষ্টার ফলেই বিজ্ঞান আজ এই পর্যায় এসেছে।
বিজ্ঞান এগিয়ে যায়, ফেরানো যায় না :
বিজ্ঞান বা প্রযুক্তিবিদ্যা মানুষের জন্য টিকে থাকার মোক্ষম ব্যবস্থা। তাই কোনও শক্তি মানুষের মন থেকে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসু চিন্তা মুছে দিতে পারে না। বৈজ্ঞানিক চিন্তার জন্য অর্থযোগের সম্ভাবনা না থাকলেও তা চলতে থাকে। আর ভবিষ্যতের বৃহত্তর বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি কারও ইচ্ছানুগামী নয়। এমনকি গবেষণার জন্য প্রদত্ত সমস্ত সরকারি অর্থদান বন্ধ করা হলেও (আধুনিকযুগের অনেক সরকারই বিজ্ঞান গবেষণায় বরাদ্দ কমাতে চায়) প্রতিযোগিতার শক্তি বিজ্ঞান গবেষণা ও প্রযুক্তিবিদ্যা সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। দুনিয়ায় হীরক রাজের মতো স্বৈর-সরকারের অস্তিত্ব সবকালেই থাকে। এদের ভাবনায় থাকে, “যতো জানে ততো কম মানে”, “জানার কোনও শেষ নাই জানার চিন্তা বৃথা তাই”। এরা মুক্তচিন্তার গতি স্তিমিত করতে চায়। তদুপরি এমন স্বৈরশাসক বিজ্ঞান গবেষকের সাহায্য ছাড়া বিজ্ঞানের গবেষণা নিবৃত করতে পারে না। অর্থাৎ মুক্তচিন্তা চর্চা তাদের অপন্দ, পাছে জনগণের চোখ খুলে গিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়। এরা পরিবর্তনমূলক নতুন জ্ঞানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রাখে। তদুপরি মানবিক উদ্যাম ও উদ্ভাবনী শক্তি এমনই ব্যাপার যে কোনও স্বৈরশাসক তা দমন করতে পারে না। তবে তারা শুধুমাত্র পরিবর্তনের ভলিউমটা কিঞ্চিৎ কমাতে পারে।
প্রাকৃতিক বিশৃঙ্খলা ও বিজ্ঞান :
প্রাকৃতিক নিয়মগুলো আসলে (Entropy) বিশৃঙ্খলাপরায়ণ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার দ্বারা এই গতি ঠেকানো যায় না। তবে অন্ততপক্ষে এর অভিমুখ সঠিক করার চেষ্টা নিঃসন্দেহে করা যায়। বিজ্ঞান প্রাকৃতিক পরিবর্তনগুলো মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করতে পারে। এর গতি প্রকৃতি গবেষণা দ্বারা বের করতে পারে। ফলে টিকে থাকা সহজ হয়। তাই একটি গণতান্ত্রিক সমাজে বিজ্ঞান সম্পর্কে মূলগত বোধ জনসাধারণের থাকা উচিত। তাতে জনগণ সঠিক সংবাদের ভিত্তিতে নিজেদের মঙ্গলের জন্য বিজ্ঞান কাজে লাগানোর মতো যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অন্তত জগতসংক্রান্ত সমুদয় বাস্তব ঘটনা অদৃষ্ট নয় ভেবে সচেতন হতে পারে। সবকিছু বিশেষজ্ঞদের ওপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিত বসে থাকবে না—বিশেষজ্ঞরা এসে কারও রান্নাঘরের নোংরা ছাফ করে দেবে না। মূলত বৃহত্তর জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া এজগতে কিছুই প্রতিষ্ঠা হয় না।
বিজ্ঞানে সাধারণ মানুষের প্রবণতার ধরন :
বস্তুত বিজ্ঞান সম্পর্কে বর্তমান জনগণের দুটি বিপরীতমুখী প্রবণতা রয়েছে। তারা একদিকে চাচ্ছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যেভাবে মানবজীবনের মানোন্নয়ন করে চলছে তা অক্ষুণ্ণ থাকুক। অন্যদিকে বিজ্ঞানে তাদের আস্থা নাই—এর কারণ সাধারণ জনগণ বিজ্ঞান বোঝে না। একজন উম্মাদ বৈজ্ঞানিক ল্যাবে একটা ফ্রাংস্টাইন তৈরি করছে—এরকম কার্টুন ছবির ওপর জনগণের আগ্রহ সে অনাস্থা আরও বেগবান হচ্ছে! তবে সবাই জেনে গেছে যে, বিজ্ঞান ছাড়া সবুজ আন্দোলন অসম্ভব। এছাড়াও নিজেদের বিশ্বাস যৌক্তিক করতে আজকাল বিজ্ঞানের আশ্রয় নেওয়ার প্রবণতা বেশ লক্ষণীয়। অবশ্য এছাড়া তাদের উপায়ও নেই। তাই বিজ্ঞানের মানোন্নয়নের পক্ষে জনসমর্থন কম নয়। অন্যদিকে জনগণের মধ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি বিরাট আকর্ষণ রয়েছে। কেননা মানুষমাত্রই মহাকাশের বিশালতা দেখে বিস্মিত হয় এবং এ সংক্রান্ত জ্ঞান লাভ করতে চায়! মহাবিশ্ব কিংবা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীমূলক সিনেমায় (Science Fiction) দর্শকদের বিরাট সংখ্যা এর জন্যই সৃষ্টি হয়েছে।
সাধারণ মানুষের বিজ্ঞান প্রবণতা যাই হোক কাজে লাগতে হবে :
বস্তুত সাধারণ মানুষের এই আকর্ষণ কী করে কাজে লাগানো যায়? কী করে নিরপেক্ষ সংবাদের ভিত্তিতে জনগণের ভিতর অল্মবৃষ্টি (Acid Rain), গ্রিনহাউস অভিক্রিয়া (Greenhouse effect), পারমাণবিক অস্ত্র (Nuclear Weapons), বংশগতি সম্পর্কীয় প্রযুক্তিবিদ্যা (Genetic Engineering) ইত্যাদি বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো বৈজ্ঞানিক পশ্চাৎপট (Background) সৃষ্টি করা যায়? এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে কাজ করার সময় এখন এসেছে। আর এজন্য সবার আগে অদৃষ্টবাদী চেতনা দূর করা প্রয়োজন। চেষ্টা ও গবেষণার বাইরে কিছু হয় না—জনগণের মধ্যে এই বৈজ্ঞানিক চেতনার উন্মেষ ঘটানো দরকার। অবশ্যই এর ভিত্তি হতে হবে স্কুলের শিক্ষা।
স্কুল পর্যায়ের বিজ্ঞান শিক্ষার হাল :
স্কুলে বিজ্ঞান বিষয়গুলো নীরস ও আকর্ষণহীনরূপে উপস্থিত করা হয়। উপরন্তু বিজ্ঞান শিক্ষকদের ভয়াবহ বিজ্ঞানবিরোধী মনোভাব এবং অতিশয় অদৃষ্টবাদী চিন্তা শিক্ষার্থীদের কচি মননশীলতা সংক্রামিত করে। ফলে শিক্ষার্থীদের মনে বিজ্ঞানের প্রতি বিতৃষ্ণা তৈরি হয়! এজন্যই ছাত্রছাত্রীরা শুধু পরীক্ষায় পাশ করার জন্য বিজ্ঞান মুখস্ত করে। যদিও তাতে তাদের গণিতে সাধারণ দক্ষতা বাড়ে—যা শুধুই ব্যক্তিজীবন উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখে! কিন্তু বিশ্বপ্রকৃতির বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণে গণিতের যে প্রাসঙ্গিকতা আছে, তারা তা থেকে বঞ্চিত থাকে। মূলত বিজ্ঞান প্রয়োগে স্কুলে অদৃষ্টবাদের দীক্ষা দেওয়া হয়। কেননা বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষকের সংখ্যা কম। মেধাবী হলেই বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়া যায়। কিন্তু বিজ্ঞানমনস্ক হয় না। একজন শিক্ষার্থী স্কুলেই বিজ্ঞানমনস্কতার দীক্ষা পায়—প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণে মেলে—এমন দীক্ষা স্কুল পর্যায় শিক্ষার্থীরা পায় না!
বিজ্ঞানে সমীকরণের ব্যবহার :
বিজ্ঞান অনেকটাই সমীকরণের সাহায্যে শেখানো হয়। উক্ত সমীকরণগুলো গাণিতিক চিন্তন বোঝানোর সবচেয়ে নির্ভুল ও সংক্ষিপ্ত উপায়। তবুও অধিকাংশ লোকই সমীকরণ দেখলে ভয় পায়। স্টিফেন হকিং সাধারণ মানুষের বোধযোগ্য একটি বৈজ্ঞানিক বই লিখেছিলেন। পাণ্ডলিপি হাতে পেয়ে প্রকাশকের প্রতিক্রিয়া ছিলো : বইটিতে সমীকরণ থাকলে প্রতিটি সমীকরণের জন্য বিক্রি অর্ধেক করে কমবে। অতঃপর লেখক কাটাছাঁট করে শুধুই আইনেস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ E=Mc2 সন্নিবিশিত করেন। এরপরও প্রকাশক বলে, “এটি না থাকলে হয়তো বইয়ের বিক্রি দ্বিগুণ হতো!” সাধারণত বৈজ্ঞানিক ও এঞ্জিনিয়ারগণ তাদের চিন্তাধারা সমীকরণের অবয়বে প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। এর কারণ তাঁদের পরিমাণগত মূল্যগুলি নির্ভুলভাবে জানা প্রয়োজন। কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারাগুলোর শুধু গুণগত ধারণা তৈরি হওয়াই যথেষ্ট। আর এইসব ধারণা ভাষা ও ছবির সাহায্যে প্রকাশ করা যায়—সমীকরণ লাগে না।
পঠিত বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা :
শ্রেণিকক্ষে শেখানো হয় শুধু বিজ্ঞানের মূলগত কাঠামো। কিন্তু বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রার হার অনেক দ্রুত। ফলে দেখা যায় যে : মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বের হওয়ার পর বিজ্ঞানের ছাত্রদের কিছু নতুন বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন অজানা রয়ে যায়। সেগুলো নতুনভাবে শিখতে হয়। স্টিফেন হকিং বলেন যে, ছাত্রজীবনে তাঁর কখনও আণবিক জীববিদ্যা (Molecular biology) বা ট্রানজিস্টার সম্পর্কে কিছু শেখা হয়নি। কিন্তু কর্মজীবনে এসে তিনি বংশগতি প্রকৌশল বিদ্যা (Genetic Engineering) এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মতো দুটি বিষয়ের বিস্ময়কর অগ্রগতি দেখেন। কার্যত এই দুটো বিষয়ের বিকাশের ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে,আমাদের দেশে বিজ্ঞানশিক্ষা এতোটাই পিছে যে, এখনও একদল বিজ্ঞানের ছাত্র ইথারের অস্তিত্ব বিশ্বাস করে। অথবা ভাবে যে, দুনিয়া যেমন দেখা যায় এভাবেই অনন্তকাল ধরে আছে এবং এমনই থাকবে! অথচ এইসব চিন্তা অন্তত একশ’ বছর আগে শেষ হয়ে গেছে।
বিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যম ও বর্তমান ব্যবস্থা :
সাধারণের জন্য লেখা বই ও পত্র-পত্রিকায় লেখা বিজ্ঞান সম্পর্কিত প্রবন্ধ বিজ্ঞানের নতুন বিকাশগুলো প্রচারে সহায়তা করে। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য লেখা বিজ্ঞান বইয়ের পাঠকও জনসাধারণের ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র। টেলিভিশন জনগণের কাছে বেশি পৌঁছায়। তবে আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জনতার হাত হাতে। এতে বিজ্ঞান সংক্রান্ত লেখালেখি অনেক হয়। প্রচুর বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রুপ আছে। তাতে অসংখ্য লোক সংযুক্ত থাকে। টেলিভিশনে বিজ্ঞান সংক্রান্ত বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম থাকে। তবে তার মধ্যে কিছু প্রোগ্রাম আছে, যাতে বৈজ্ঞানিক বিস্ময়গুলো যাদু টোনার মতো দেখানো হয়। অতঃপর সেগুলোর ব্যাখ্যা করা হয় অদৃষ্টবাদী সাধারণ বিশ্বাসের সাথে সঙ্গতি রেখে! পাছে স্পন্সর ও দর্শক কমে যায়। কিন্তু বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার সাথে উক্ত বিস্ময়ের কী রকম গরমিল আছে, তা দেখানো হয় না। এক্ষেত্রে বলতে হয় : এইসব অনুষ্ঠান নির্মাতাদের বোঝা উচিৎ যে, জনগণের জন্য শুধু আনন্দের ব্যবস্থা করাই তাদের একমাত্র কাজ নয়—জনগণের মধ্যে বিজ্ঞানশিক্ষা সচেতনতা তৈরি করাও তাদের কর্তব্যের অংশ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞান শিক্ষা :
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞান সম্পর্কিত যেসব লেখা দেখা যায়, সেগুলোর মধ্যে দুই ধরনের পোস্ট আছে। বিজ্ঞানমনস্ক এবং বিজ্ঞানের আলোকে স্বীয় আদর্শের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো। তবে আমার মুখপঞ্জির বন্ধু তালিকায় কয়েকজন বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান লেখক আছেন। যারা নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানমনস্ক। ওনাদের কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ—বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে তাঁরা প্রায়ই লেখা দিয়ে থাকেন। আবার কয়েকজন আছে যাদের বিজ্ঞানের প্রাথমিক ধারণাও নেই। অথচ বিজ্ঞান নিয়ে দাপাদাপি করে শুধু স্বীয় আদর্শ প্রচারক হিসাবে নিজের নাম ফাটাতে! তদুপরি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জনসাধারণের মধ্যে বিজ্ঞানচর্চায় বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে।
আমাদের ছাত্রাবস্থায় বিজ্ঞানের যেসব বিষয় নিয়ে চিন্তাও করি নাই বা জানার আগ্রহ থাকলেও সহায়ক তথ্যের অভাবে শেখার উপায় ছিলো না। আজকাল গুগল ঘাটলে সেগুলো সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ কোয়ান্টাম মেকানিক্স সম্পর্কে ছাত্রাবস্থায় আমার কোনও ধারণা ছিলো না। বিভিন্ন বিজ্ঞান বিষয়ক বই বা সাময়িকী পড়ে চিরায়ত বলবিদ্যা, অপেক্ষবাদ এবং নক্ষত্র, গ্যালাক্সি, ব্লাক হোল, কোয়েজার ইত্যাদি বড় বস্তুগুলো সম্পর্কে ধারণা হতো। মহাজগৎ যে চতুর্মাত্রিক এই ধারণা আমার হয়েছিলো। কিন্তু কণাবাদী ব্যাখ্যা ব্যতীত জগতের প্রাথমিক ধারণা হয় না, সে চিন্তা কখনও আসেনি! কিন্তু আজকাল গুগল ঘাঁটলে মহাজগতের কণাবাদী ব্যাখ্যা মোটামুটি পাওয়া যায়। এমনকি এসংক্রান্ত নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বৈজ্ঞানিকদের লেখা বইয়ের বঙ্গানুবাদ পিডিএফ কপি পাওয়া যায়।
সাধারণ মানুষের কর্তব্য :
বস্তুত নিকট ভবিষ্যতে বিজ্ঞান-সংক্রান্ত কোন কোন বিষয়ের ওপর জনসাধারণকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে? এরমধ্যে সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হলো বৈশ্বিকভাবে পারমাণবিক অস্ত্র সংকোচন নীতিমালা তৈরি করা। খাদ্য সরবরাহের ঘাটতি কিংবা গ্রিনহাউস অভিক্রিয়া ইত্যাদি সমস্যার সমাধান করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্র বন্ধ করা ততটা ধীরগতির নয়। মানুষ ইচ্ছে করলে কয়েকদিনের মধ্যেই পৃথিবী থেকে এর প্রতিযোগিতা রোধ করতে পারে। অতএব পৃথিবীর প্রতিটি নাগরিককেই পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতা সম্পর্কে পূর্বজ্ঞান অর্জন করতে হবে। যদিও ঠান্ডা লড়াই বন্ধ হওয়ার পরে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা কিছুটা হলেও কমেছিলো। কিন্তু বর্তমান শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে এই সমস্যা আবার কমবেশি বিভিন্ন মহাদেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে!
পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার সীমিত করণ :
পাকিস্তান, ইরান, ইসরাইল, ভারত, উত্তর কোরিয়া ইতোমধ্যে নিউক্লিয়ার যুদ্ধাস্ত্র বানিয়ে ফেলেছে। এছাড়াও আজারবাইজান ও বার্মার মতো কিছু দেশ এই অস্ত্র বানানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। আসলে কে এই অস্ত্রের সম্ভার ঘটালো সেটা বড় কথা নয়। আসল সমস্যা হলো এমন দুটি মাঝারি বা অনুন্নত দেশ নিজেদের তৈরি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে যুদ্ধ শুরু করে দিলে, সে যুদ্ধ শুধু তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং পরাশক্তিগুলোও তাতে জড়িয়ে পড়বে। ফলে তৃতীয় মহাযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে!
ইউক্রেন যুদ্ধ কি পরমাণু যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে :
বর্তমানে রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমণ তৃতীয় মহাযুদ্ধের হাতছানি কি-না, পৃথিবীবাসী সে প্রশ্নের সম্মুখীন! এই যুদ্ধ ক্রমান্বয়ে প্রলম্বিত হচ্ছে। তাই ভয় হয়, অনতিবিলম্বে নিউক্লিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় কিনা! কেননা ইউক্রেনের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র না থাকলেও রাশিয়াকে কাবু করার জন্য ইউএস ও ইইউ যথাসময়ে পরমাণু অস্ত্র সরবরাহ করতে দ্বিধান্বিত হবে না! ১৯৯৬-সাল পর্যন্ত ইউক্রেন তৃতীয় পারমানবিক শক্তি ছিলো। সেই সময়ের বৈজ্ঞানিক তথ্যাদি জেলোনস্কি সরকারের হাতে অবশ্যই আছে। সুতরাং পারমাণবিক যুদ্ধ সংক্রান্ত বর্তমান খবরাখবর এই গ্রহের পক্ষে মোটেই সুবিধাজনক নয়।
বিজ্ঞানের অপব্যবহার রোধে বিশ্ববাসীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে :
বিশ্বের তাবৎ জনগণের সময়োচিত ও যুগপৎ প্রয়াস বিজ্ঞানের অপব্যবহার থেকে দুনিয়া রক্ষা পেতে পারে। কিন্তু সেজন্য তাদের বিজ্ঞানমনস্কতা ভীষণ প্রয়োজন। বিজ্ঞান কেন ও কী উদ্দেশ্যে সেটা জানতে হলে এর অপব্যবহারের দিকটিও দেখতে হবে। বিজ্ঞানমনস্ক না হলে মানুষের মন উদার হয় না। বিজ্ঞানহীন মানসিক অবস্থা মানুষকে সংকীর্ণমনা করে তুলে। একটি জাতি এফ ফলে চরম জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়। চরম জাতীয়তাবাদ বিগত শতাব্দীর দুটি মহাযুদ্ধের মূল কারণ ছিলো। যার চুড়ান্তাবস্থায় পারমাণবিক যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধও এই একই কারণে হবে। কেননা বর্তমান দুনিয়ার মানুষ বিজ্ঞানের অপব্যবহারে আরও দক্ষ হয়েছে। ২য় মহাযুদ্ধ হিরোশিমার চেয়ে বর্তমান পরমাণু বোমা হাজার গুণ বেশি ধ্বংস করতে সক্ষম। ৩য় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মানুষের অস্তিত্ব এ গ্রহে টিকে থাকলেও পৃথিবীর বুকে তারা চরম খাদ্য ও পানীয় জল সংকটে নিপতিত হবে। সেই বাস্তবতা ইন্টারস্টেলর মুভিতে দেখানো ভবিষ্যৎবাণীর অনুরূপ কিছু!
বিশ্বব্যাপী সামরিক খাতে ব্যয়হ্রাস এখন সময়ের দাবী :
জনসাধারণের এটা বুঝতে পারা এবং যুদ্ধখাতে ব্যয় হ্রাস করার জন্য প্রতিটি সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের গুরুত্ব অপরিসীম। পারমাণবিক অস্ত্র হয়তো সম্পূর্ণ দূর করা কার্যক্ষেত্রে সম্ভব নয়। কিন্তু এই অস্ত্রের সংখ্যা হ্রাস করে মানুষ নিজের বিপদ কমাতে পারে। কেননা এইসব মানব বিধ্বংসী অস্ত্র থাকাই পৃথিবীর জন্য হুমকি স্বরূপ। তার ওপর যদি প্রতিযোগিতার ফলে এই অস্ত্রের কার্যকরিতা ক্রমশ বাড়তেই থাকে, তবে মানুষ কখনও নিরাপদে থাকার কথা ভাবতে পারে না। কার্যত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে প্রয়োজন শুধু পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত রাষ্ট্রপ্রধানদের নির্দেশ। কিংবা এই অস্ত্রগুলো পরিচালনার দায়িত্ব যাদের রয়েছে, তাদের কয়েকজনের বিদ্রোহ!
পরিশেষে, আমরা পারমাণবিক যুদ্ধ যদি এড়াতে পারি, তবুও এমন অনেক বিপদ আছে যা আমাদের সবাইকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এতাবৎ বর্ণনায় একটি কথা স্পষ্ট যে, দলগত সামাজিক বসবাসের মতো যুগপৎ আত্মহত্যাও মানুষের জন্মগত প্রবণতা। একটা মন্দ রসভাস আছে : অন্য গ্রহের কোনও সভ্যতা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি কারণ পৃথিবীর বর্তমান উন্নতির স্তরে পৌঁছে তারা আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে গেছে। তাই তাদের অস্তিত্ব এখন আর নেই! টিকে থাকলেও জীবন ধারণের প্রাথমিক অবস্থার সংগ্রামেই তাদের সময় কেটে যায়। অনুরূপভাবে সভ্যতার জন্য বিজ্ঞানের অগ্রগতি কি পৃথিবীর মানুষকেও আত্মহত্যা প্রবণ করে তুলছে না-তো? কথাটা রসিকতা মনে হলেও সত্যতা অস্বীকার করার উপায় নাই। কেননা আমরা এমুহূর্তে একটি বড় যুদ্ধের মধ্যে আছি। কিন্তু সাধারণ মানুষের সদিচ্ছার ওপর আমাদের বিশ্বাস রাখা উচিত। তাতে হয়তো আমাদের আত্মঘাতি মনোভাব বন্ধ হবে।
স্টিফেন হকিং-এর ভাবানুবাদে প্রবন্ধটি লেখা।
Leave a Reply