বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৫:১১ পূর্বাহ্ন

গ্রন্থ আলোচনা: অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা ‘নারীসত্তার অন্বেষণে’-জাহিদ হোসাইন

গ্রন্থ আলোচনা: অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা ‘নারীসত্তার অন্বেষণে’-জাহিদ হোসাইন

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান (Anthropology) বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা ‘নারীসত্তার অন্বেষণে’ শিরনামে একখানি গবেষণাধর্মী গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি ২০১০ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এখান থেকেই তিনি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। অতঃপর নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি থেকে এ বিষয়ে পিএইচডি অর্জন করেন।
তিনি একজন নৃবিজ্ঞানী। লিঙ্গ বৈচিত্র, শরীর, যৌনতা, পুরুষ ও পুরুষত্বসহ সামাজিক নৃতত্ত্বগত অন্যান্য বিষয় নিয়ে তাঁর লেখা প্রবন্ধ দেশে-বিদেশের বিভিন্ন গবেষণা জার্নালে বিভিন্ন সময় প্রকাশিত হয়েছে। এ সমাজে নারীর অবস্থান ও পরিচয়ের বাস্তব অবস্থা উপলক্ষ্য করে “নারীসত্তার অন্বেষণে” শিরনামের বইখানি রচনা করেন। এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। প্রধানত এটি একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ। ‘নারীসত্তা অন্বেষণে’ শিরনামেই গবেষণার উপলব্ধি গ্রথিত থাকলেও বইটি সহজবোধ্য ও সুপাঠ্য।

যাদের উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থ:
এই বইয়ের বিষয়বস্তুর মধ্য দিয়ে কার্যত তিনি তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছেন। সুতরাং নৃবিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের গবেষণা কাজের সহায়ক (Reference) হতে পারে এই বইখানি। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে গবেষণামূলক কাজ কম হয়। মেধাবীরা হয় বিদেশে চলে যায়, নয়তো বড় আমলা হয় — গবেষক হয় নগণ্য। সাধারণে বোধগম্য করে রচিত নৃবিজ্ঞানের ওপর মৌলিক গবেষণামূলক বাঙলা বই খুব কম দেখা যায় এদেশে। যা আছে তার বেশিরভাগই ভারতীয়দের লেখা। অথবা বিদেশি লেখার বঙ্গানুবাদ। আমাদের সমাজের বাস্তবতার আলোকে মৌলিক গবেষণামূলক প্রকাশনা এদেশে অনেক বিষয়ের মতো নৃবিজ্ঞানেও অনুপস্থিত বললে ভুল হয় না। সুতরাং এই প্রকাশনা শিক্ষার্থীদের গবেষণার কাজে রসদ যোগাবে। অন্যদিকে নৃবিজ্ঞানের মতো একটি উন্নত বিষয় এদেশের জনগণের মধ্যে খুববেশি পরিচিত নয়। তবে যতোটা সম্ভব এর বিষয়বস্তুর সাথে নৃতত্ত্বের সঙ্গতি ঘটিয়ে সবার পক্ষে বোধগম্য করে বইখানি লেখা হয়েছে।

বইটির মধ্যে সাধারণ পাঠকের জন্য কী আছে?
মূলত নারীর প্রতি প্রচলিত বৈষম্যমূলক আচরণ, নিপীড়ন, অধিকারহীনতা, কাজের প্রকৃত মূল্য অপ্রাপ্তি ইত্যকার দৈন্য এসমাজে ঘটমান বাস্তবতা। এতোকিছু অতিক্রম করে নারী কী করে স্বীয় প্রচেষ্টায় ঘুরে দাঁড়াতে পারে, লেখক তা সহজভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা করেছেন। এসব হলো শৈশব থেকে বৈষম্যের শিকার নারীর গল্প: কীভাবে একজন নববিবাহিত নারী নিজেকে নতুন সম্পর্কে খুঁজে পান; কীভাবে একজন তালাকপ্রাপ্তা নারী তার জীবন পুনর্গঠন করেন ইত্যাদি। এর আরেকটি অনন্য দিক হলো অন্যের কল্পনা ও পরিভাষায় নয়, বরং নারীকে তার নিজের অভিজ্ঞতায় নিজের চিন্তা করতে হবে। অতঃপর এর ওপর নিজের মুক্তির পথ খুঁজে বের করতে হবে। মূলত আমাদের মতো সমাজে নারীর ভালোমন্দের চিন্তা বিয়ের আগে বাপের এবং বিয়ের পর স্বামীর। তালাকপ্রাপ্তা বা বিধবা নারীর অবস্থান খুবই নাজুক এই সমাজে। তাদের হয় বাপ কিংবা ভাই, নয়তো নিজের পুত্র কন্যাই একমাত্র ভরসা। এসব আসলে সামাজিক প্রথা। আর সামাজিক প্রথাগুলো সবই পরম্পরাগত। সামাজিক এই বাতাবরণ ভেঙে বের হওয়ার উপলক্ষ্য নারীর জন্য অনুপস্থিত এদেশে।

নারী নিপীড়নের ইতিকথা:
এ সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা নারী বৈষম্য, নিপীড়ন প্রসঙ্গ পত্রপত্রিকায় ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সর্বদা দেখা যায়। অথবা এগুলো বিষয়বস্তু বানিয়ে বড়মাপের নাটক, প্রবন্ধ কিংবা গল্প কবিতার বই একুশের বইমেলায় মোড়ক উন্মোচন করা হয়। কিন্তু এর কারণগুলোর নেপথ্যের বাস্তব সমস্যা তুলে ধরার মতো প্রকাশনা খুব কমই ঠোঙামুক্ত হয়। একই বিষয়ের ওপর গতানুগতিক কিংবা ভাব চুরি করে লেখার অভাব নেই এদেশে। কিন্তু যেকোনও বিষয় লেখা দ্বারা বাস্তব সমস্যা ফুটিয়ে তুলতে হলে গবেষণা দরকার হয় আগে। আর গবেষণার কাজ সামান্যীকরণের (Universal/General) জন্য বাস্তব অভিজ্ঞতার বিকল্প নেই। কীভাবে আমাদের সমাজে নারীর শরীর, যৌনতা, মাতৃত্ব, শিক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, সামাজিক, সংস্কৃতিক সম্পর্কগুলো নারীসত্তা গঠনে প্রভাবিত করে, এ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা নিজের অর্থ, সময়, শ্রম ব্যয়ে করে, বিশেষ করে ঢাকার মধ্যবিত্ত নারীদের সান্নিধ্যে গিয়ে খুব কাছ থেকে এইসব বাস্তব ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। স্বচক্ষে দেখা অভিজ্ঞতার আলোকেই তিনি ‘নারীসত্তা অন্বেষণে’ গ্রন্থ রচনা করেন। এর সাথে নৃবিজ্ঞানের বিষয়গত নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।

নারীর প্রতি সামজিক চিন্তার হেত্বাভাস (Fallacy):
লেখক এই বইয়ে সুচিন্তিত লিখনি দ্বারা নারী সত্তার বাস্তবতা নিয়ে সামাজিক ভাবধারায় খচিত (Embedded) হেত্বাভাস স্পষ্ট ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি তার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ও প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত নারীর সত্তা এবং আত্মসচেতনতাবোধ হলো সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিসরে নির্মিত এক ধরনের প্রথা। যেখানে নারী তার বাস্তবতার নিরিখে নিজ সত্তার রূপায়ণ দানে সর্বদা সক্রিয় থাকে। অতঃপর উদ্ভূত পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় তার নিজস্ব সত্তা নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণে উদ্যোগী হয়। মধ্যবিত্ত নারীর নানাবিধ প্রেক্ষিত বিশ্লেষণে নারীর সত্তা নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ প্রেক্ষাপট উপস্থাপন এই গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য।
তিনি লিঙ্গগত সম্পর্ক নির্ধারণে নারীর অবস্থান তুলে ধরেছেন। অর্থাৎ শুধু পুরুষের সাথে প্রতিস্থাপন করে নয়; বরং কীভাবে লৈঙ্গিক সম্পর্ক নারীসত্তা নির্মাণে ও পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখে, তিনি তা দেখিয়েছেন। লেখকের মূল যুক্তি হল, নারীর আত্ম-গঠন একটি জটিলতর প্রক্রিয়া। যা সামাজিক চলমান প্রবণতা, নিয়ম এবং প্রত্যাশা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে। নারীর পরিচয় গঠন একমুখি নয়, বরং অকীর্তিকরভাবে ক্রমাগত পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া। অথচ এর মধ্যে নারীর নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন থাকে না!

আমাদের সমাজে নারীর পরিচয় কী?
আমাদের সমাজে একজন নারী তার স্বীয় পরিচয় কী দেবে, এর গঠন প্রকৃতি কী হবে এবং তার মনন ও চিন্তা জগতের কল্পনা কোন পর্যন্ত বিস্তৃত করা যাবে ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই পুরুষ অভিভাবকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ছাপ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আর এই সূত্র ধরেই নারী তার লিঙ্গগত সম্পর্কের ক্ষমতাচর্চা করে থাকে। অথচ এই একই সমাজে পুরুষের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ পুরুষ মানেই ক্ষমতাবানের পরিচয়; ক্ষমতা যেন পুরুষের জন্যই সংরক্ষিত; নারীর জন্য অসঙ্গত।

মাতৃত্বের বাইরে নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র নেই:
মাতৃত্বকে নারীর সাথে এমনভাবে যুক্ত করা হয়, যেন এতদ্ভিন্ন নারীর আলাদা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র থাকতে নেই। নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধ কেবল দৃষ্টির আড়ালে রাখার চেষ্টাই এ সমাজের অলঙ্ঘনীয় (Taboo) প্রথা। এরই ফলশ্রুতিস্বরূপ সমাজে নারীর নানাপ্রকার বৈশিষ্ট প্রকাশ করা হয়। যা নারীকে ভিন্ন প্রজাতির বা শুধুই ‘মেয়ে-মানুষ’ পরিচয় দানে বাধ্য করে — ‘মমতাময়ী, স্নেহপরায়ণ, দুর্বল, ক্ষণভঙ্গুর মানসিকতা ও ধৈর্যশীল মায়ের জাত’ বলা এর আসল উদ্দেশ্য।

বিশিষ্ট এইসব বিশেষণ নারীর জন্য কতোটুকু সম্মানজনক?
পক্ষান্তরে মাতৃত্ব নারীকে কখনও অধস্তন, কখনও আবার বাহ্যত সম্মানিত করে। তাই নারী হয়ে উঠে ‘দাসতুল্য’, আবার কখনো পুজনীয়। একই মানুষের দুই পরিচয় একার্থবোধক নয়, বরং রহস্যপূর্ণ। যদি নারীর মাতৃত্বকে কতোগুলো বিশেষণ দ্বারা সম্মাননীয় করে আবার নিগৃহীত করা হয়, তবে এসব কখনোই গৌরবজনক নয়। বরং দুর্বল ও ক্ষণভঙ্গুর পরিচয় দিয়ে নারীকে নরাধমের কাতারে ফালানোর দুরভিসন্ধি বলা যায়!
সর্বোপরি শৈশব ও বয়ঃসন্ধিকালে জৈবিক পরিবর্তন থেকে শুরু করে বৈষম্যের শিকার ছোট্ট একটি মেয়ে থেকে পর্যায়ক্রমে দাপিত ও নিগৃহীত একজন অবিবাহিত, বিবাহিত, তালাকপ্রাপ্তা, চাকুরীজীবী নারী কীভাবে বৈষম্যের বেড়াজাল ও নানারূপ প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে স্বীয় নারীসত্তা গঠনে সক্রিয় হয়, এর সমুদয় ক্ষুদ্র তথ্য সংগ্রহ করে লেখক নিজের চিন্তাশীল ও বিশদ বিশ্লেষণের মাধ্যমে “নারীসত্তার অন্বেষণ” বইতে দারুণভাবে উপস্থাপন করেছেন।

আমার ব্যক্তিগত অভিমত:
আমি নিশ্চিত যে বাংলাদেশে এরকম বইয়ের প্রচুর পাঠক রয়েছে। বাঙলা ভাষায় এই বিষয়ের ওপর লেখা খুববেশি না হলেও লেখকের সহজবোধ্য অথচ গবেষণাধর্মী এই বই সাধারণ পাঠকের মনে নতুন ভাবনা তৈরি করবে। ড. স্নিগ্ধার লেখা বেশ সহজ ও আকর্ষণীয়। তাঁর বিশ্লেষণ উপলব্ধিমূলক, যা পাঠকের চিন্তায় নতুনমাত্রা যোগ করে। যদিও কয়েকবার মনে হয়েছে যে, সাধারণ পাঠকদের জন্য নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আরেকটু কম হলে হয়তো সহজ হতো। কেননা এবিষয়ে এদেশের সাধারণ মানুষ ধারণা কম। তবে বইখানি পুরোটা পড়লে একটি ব্যাপার স্পষ্ট হয় যে, নারীর সত্তা উদ্ঘাটনে নৃবিজ্ঞানের ভূমিকা অনেক। অর্থাৎ নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দ্বারা এ বিষয়ের সামান্যীকরণ তুলনামূলক সহজ। সুতরাং এই বইটি অনেকটা বিষয়ভিত্তিক হলেও সাধারণ পাঠক মহলে সহজ ও সুপাঠ্য হিসাবেই গণ্য হবে বলে আমার বিশ্বাস।

বইটির চূড়ান্ত মূল্যায়ন:
সাধারণত আমার কৌতুহলের বাইরের লেখা খুব একটা পড়ি না। এমকি অনাগ্রহের বিষয়বস্তু নিয়ে পর্যালোচনাও করি না। তবে আশ্চর্যজনকভাবে তেমন না হওয়া সত্ত্বেও বইখানি আমার চিন্তায় নতুনমাত্রা যোগ করেছে। বিজ্ঞান বিষয়ক বইয়ের বাইরে এপর্যন্ত যে কটি বই পর্যালোচনা করেছি, তার মধ্যে এই বইটি অন্যতম। নারী সত্তার অন্নেষণকে ৫ এর মধ্যে ৫ এর কম দেওয়ার উপায় নেই।

জাহিদ হোসাইন: পোশাক শিল্প কার্যব্যবস্থাপক

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge