বুধবার, ০৭ Jun ২০২৩, ১০:৫৫ অপরাহ্ন

একটি ফেলে আসা বাড়ি এবং একটি সুন্দর সকালের স্বপ্ন-জসিম মল্লিক

একটি ফেলে আসা বাড়ি এবং একটি সুন্দর সকালের স্বপ্ন-জসিম মল্লিক


বরিশাল শহরে আমাদের চেয়ে বড় বাড়ি আর কারো নাই। শহরের যে কেউ মল্লিক বাড়ি বললেই চিনে। এক সময় আমি পত্রমিতালী করতাম। পত্রিকায় চিঠিপত্র লিখতাম। আমার নামে প্রচুর চিঠি আসত। জসিম মল্লিক, মল্লিক বাড়ি, বরিশাল এই ঠিকানায় চিঠি চলে আসত। এমন হয়েছে শুধু আমার নাম আর বরিশাল হলেও চিঠি চলে আসত। ’মল্লিক বাড়ির পুল’ ছিল খুব বিখ্যাত। রিকশাওয়ালারা এক টানে নিয়ে আসত যে কোনো জায়গা থেকে। এই পুলের উপর দিয়ে আমরা কত ঝাপাঝাপি করেছি পানিতে। পুলের গোড়ায় ছাপড়া দেওয়া ছোট্ট টং হোটেল ছিল একটা। সেই হোটেলের সকালের পরোটা আর ভাজির ঘ্রাণ এখনও নাকে লেগে আছে। দুপুরের দিকে গোলগুল্লা খেতাম, তারপর ঝাপ দিতাম পানিতে। তখন খাল ছিল ভর ভরন্ত। জোয়ারের সময় ঘোলা জল ছিল। বড় বড় মাল বোঝাই নৌকা আসত। কীর্তনখোলার সাথে ডাইরেক্ট সংযোগ ছিল। এখনও আছে সেই খাল কিন্তু সেই যৌবন আর নেই। সরু একটা পানির স্রোত বয়ে যায় শুধু। আমি যেখানে আমার লাইব্রেরি করব সেটা এই খালের পাশেই পড়েছে। আমার মায়ের সেই জলপাই তলায় লাইব্রেরি হবে। সমস্যা একটাই আমি চাই নির্জনতা কিন্তু খালের পার দিয়েই যে রাস্তাটি গেছে সেটা খুবই ব্যস্ত এখন। কোলাহল আমার পছন্দ না।

আমাদের পুরো বাড়িটা আজও নির্জনতায় ভরা। প্রচুর গাছগাছালি, ঘন জঙ্গল, পাখির কলকাকলি, নির্জন ভাতঘুম দুপুরে ঘুঘুর ডাক, রাতে জোনাকির মিটিমিটি আলো, এমনকি দুর্লভ বাদুরেরাও ঝুলে থাকে গাছের ডালে। আমাদের মল্লিক ফ্যামিলিতে অনেক শরিক বলে চারটা ভাগে ভাগ হয়েছে বাড়ি। এখনতো আমি বাড়ি গেলে নতুন জেনারেশন যারা তাদের চিনতেই পারি না। আমার সামনে দিয়েই হেঁটে যাচ্ছে, আমি চিনি না। আমাকেও চেনে না। অথচ একসময় আমরা পুরো তল্লাটের ছেলে মেয়েদের নিয়ে নানা কর্মকান্ড করতাম। আমাদের একটা লাইব্রেরি ছিল পাকিস্তান আমল থেকেই। রেজিষ্টার্ড লাইব্রেরি। নাম ছিল ইকবাল পাঠাগার এন্ড ক্লাব। সেই পাঠাগারে বই ছিল, খেলাধুলার সরঞ্জাম ছিল। এই ক্লাবের উদ্যেগে বার্ষিক ফুটবল প্রতিযোগিতা, হাডুডু, নাটক, ঘোড়ার দৌড়, নৌকা বাইচ, সাঁতার এবং ছোটদের নিয়ে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হতো। আমাদের বাড়ির হান্নান, নিজাম, মিজানুর, হাসিব, ইউনুস, মনু এদের সবাইকে নিয়ে এই আয়োজন করতাম। আমি আর হান্নান এর নেতৃত্বে ছিলাম। বাড়ির মেয়েরাও আমাদের পাশে ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আশির দশকে আমি ঢাকা চলে আসার পর সব শেষ হয়ে গেছে। সেই খেলাধুলাও নেই, ক্লাবেরও অস্তিত্ব নেই। শুধু খেলার মাঠ পড়ে আছে। খেলার মাঠগুলো আমাদের নিজস্ব সম্পত্তি।

আমাদের বাড়িতে অনেকগুলো পুকুর ছিল। সেই সব পুকুরে মাছ ছিল, গভীরতা ছিল। আমরা সাঁতার প্রতিযোগিতা করতাম, মাছ ধরতাম। জাল ফেলা হতো। সেই জাল ভরে উঠত শোল, গজার, শিং, বাইলা, মেনি পুঠি মাছ। বরশি ফেলতাম। পুঠি, টেংরা, মেনি মাছ উঠত। স্কুল থেকে এসেই পানিতে ঝাঁপ দিতাম। চোখ লাল না হলে উঠতাম না। মাঝে মাঝে মা এসে পানি থেকে টেনে তুলত। সাবান দিতাম না বলে গায়ের চামরা সাদা হয়ে থাকত। কাদায় মাখামাখি থাকতাম। কাপড় ধোয়া ৫৭০ সাবান পেলেই মহাখুশী। পেষ্ট, ব্রাশ ছিল না বলে দাঁত ব্রাশ করতে ভুলে যেতাম। ময়লা, নোংরা একদল রাস্তার ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়াতাম। ঘুড়ি উড়াতাম, মার্বেল খেলতাম, চারা খেলতাম, সাইকেল দাবরিয়ে মেয়েদের পিছনে ঘুরতাম। আবার বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বই এনেও পড়তাম। আমার দুরন্তপনার জন্য অনেকে আমাকে দেখতে পারত না। আমাকে বাতিলের খাতায় রেখেছিল। বলাবলি করত, ছ্যামরা এককারে উচ্ছন্নে গ্যাছে।

ফল ফলাদির জন্য আমাদের বাড়ি বিখ্যাত ছিল। আম, জাম, লিচু, গাব, কাঠাল, আনারস, তাল, বেল, আমলকি, ডউয়া, জলপাই, তেতুল, পায়লা, কাউ, জাম্বুরা, পেয়ারা, বড়ই, আতাফল, জামরুল ছিল। কি ছিল না! সবই ছিল। অনেকগুলো বিশালাকৃতির জাম গাছ ছিল। সেই গাছে রসালো জাম ধরত। দুই চারটা খেলেই পেট ভরে যেতো। সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখতাম গাছের নিচে জাম পড়ে আছে। মাটি দেখা যায় না, শুধু জাম। আর এতো সুস্বাদু ছিল। এতো জাম খাওয়ার মানুষ ছিল না। শহরের মানুষরা এসে জাম পেড়ে নিয়ে যেতো ব্যাগ ভর্তি করে। আমাদের কিছু দিয়ে যেতো। আমরা সেসব লবন, তেল, শুকনো মরিচ দিয়ে মেখে ঝাঁকিয়ে খেতাম। এখন সেই গাছও নেই, ফলও নেই। কেমন করে সব নিধন হয়ে গেলো। আর সেসব দিন ফিরবে না কখনও। লোভ আর নগরায়নের নামে সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
নিজের লেখা কয়েকটি লাইন দিয়ে শেষ করছি…
ভালবাসি কোনো নদী বা সমুদ্রের কাছে পৌঁছে যেতে,
যেখানে অনেক গাছপালা আছে,
পাখি ডাকে,
মাটির সোঁদা গন্ধ পাওয়া যায়,
বুনো ফুল ফোটে।
মেকানিক্যাল প্রেমহীন শহরে কে থাকতে চায়!
সুন্দর একটি সকাল হবে,
পাখিরা বাসা ছেড়ে উড়বে, ঘুরবে, ডাকবে,
খুব পরিষ্কার বাতাস বইবে,
কুয়াশায় ভিজে থাকবে চারদিক,
আধফোটা কুঁড়ি পাপড়ি ছড়াতে থাকবে সে রকম কোথাও…।

টরন্টো ৩০ মে ২০২১

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge