১
আমার ভিতর অনেক অনুশোচনা কাজ করে। সামান্য ভুল করলেও অনুশোচনায় ভুগি। যখন ভুল করি তখন বুঝতে পারি না যে ভুল করছি। তখন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কেমন করে যেনো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। একেই বলে এঙ্গার প্রবলেম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনিয়ম দেখলে আমি প্রতিবাদী হই। ক্ষুব্দ হই। ক্ষোভ প্রকাশ করি। আমার সাথে অন্যায় হচ্ছে দেখলে আমি তা মেনে নিতে পারি না। পূর্বাপর পরিণতি না ভেবেই প্রতিবাদ করি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার প্রতি কি অবিচার হয় না! হয়। অনেকই হয়। আমি কি সব অন্যায়ের প্রতিকার করতে পারি! না। পারি না। আমার বন্ধু আলম বলেছে সব অনিয়মের প্রতিকার আমি করতে পারব না। তাই ছোট খাট অনিয়মকে মেনে নিতে হবে। বলেছে, বি হ্যাপি ম্যান। কিন্তু রাগের সময় সব ভুলে যাই। প্রতিজ্ঞা ভুলে যাই। মনে হয় তখন শয়তান আমার উপর দখল নেয়। হজ্জ করতে যেয়ে শয়তানকে পাথর ছুঁড়ে মেরেছি। বড় শয়তান, মাঝারি শয়তান, বড় শয়তানকে পাথর মেরেছি। আল্লাহর কাছে বলেছি আল্লাহ শয়তান যেনো আমাকে পরাভূত করতে না পারে।
মানুষ যদি বুঝতে পারত সে ভুল করছে তাহলে অনেক ভুলের হাত থেকে রেহাই পেতো। কিন্তু মানুষ বুঝতে পারে না। আমিও পারি না। আমার অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। আমার অনেক ত্রুটি। অনেক মানুষ আছে ভুল করেও কখনও অনুশোচনায় ভোগে না। ভুলটাকেই জাষ্টিফাই করতে চায়। নানা যুক্তি তর্ক দিয়ে নিজের ভুলটাকে সঠিক প্রমান করতে চায়। এইসব মানুষদের সাথে কিছুতেই পেরে উঠা যায় না। আবার কিছু মানুষ আছে ছোট খাট অন্যায়কে গায়ে মাখে না। মেনে নেয়। মেনে নিতে পরাটাই বড় শক্তি। কথায় আছে যে সহে সে রহে। রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। প্রতিবার আমার হার হয়। কিন্তু প্রতিবার আমি আমার ভুল স্বীকার করি এবং ভুলের জন্য অনুতপ্ত হই বলে হারতে হারতেও হার থেকে বেঁচে যাই। প্রকৃতিও আমাকে রক্ষা করে।
২
কিন্তু সেদিনের একটা ঘটনায় কয়েকদিন ধরে খুব আপসেট আমি। ঘটনা সামান্য। ওটা নিয়ে না ভাবলেও চলে। তাও কেনো যে ভুলতে পারি না! আমার অভ্যাস হচ্ছে যখন গাড়ি ড্রাইভ করি তখন রেডিও ছেড়ে রাখি। কখনও এফ এম ব্যান্ডে নিউজ শুনি, কখনও এএম ব্যান্ডে গান শুনি। হিন্দী গান। সেদিনও এএম ব্যান্ড চালু ছিল। আমি রেড লাইটে দাঁড়ানো। জায়গাটা হচ্ছে লেয়ার্ড ড্রাইভ এবং এগলিনটন এভিনিউ। আমি লেয়ার্ড থেকে লেফটে যাব, ইষ্টে। এই ইন্টারসেকশন দিয়ে আমাকে সবসময় কাজে যেতে হয়। যখনই আমি লেয়ার্ডের এই সিগনালে দাঁড়াই তখনই এএম ব্যান্ডে একটা ঘর ঘর শব্দ হতে থাকে। সম্ভবতঃ সিগনাল ঠিকমতো পায় না। এখানেই মেট্রো ট্রেনের কাজ চলছে। সে কারণেও সিগনাল পেতে সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হয়।
আমি অপেক্ষা করছি গ্রীন সিগন্যালের জন্য। সিগনাল পড়েছে। আমার ঠিক সামনেই একটা ছোট্ট ফিয়াট গাড়ি দাঁড়ানো। পুরনো গাড়িটা। লাল রং। কিন্তু গাড়িটা যাচ্ছে না। কেনো যাচ্ছে না! সমস্যা কি! আমি একটু অস্থির প্রকৃতির। আমার যা স্বভাব। এখানকার বয়স্ক মানুষরা একটু স্লো ড্রাইভ করেন। আশি নব্বুই বছর বয়সেও গাড়ি ড্রাইভ করেন। চল্লিশ কিলোমিটার জোনের রাস্তায় দেখা গেলো তিরিশ কিলোমিটারে চালাচ্ছেন। আমি পিছনে বিরক্ত হচ্ছি। কিন্তু কিছু করার নাই। সিঙ্গেল লেনে ওভারটেক নিষিদ্ধ এবং হর্ণ বাজানো অভদ্রতা। ডানে বা বাঁয়ে গাড়ি চলে গেলে স্বস্তি পাই। আমি সামনের ফিয়াটকে পর পর দু’বার লম্বা হর্ন দিলাম। তারপরও যাচ্ছে না গাড়িটা! এদিকে পিছনে গাড়ি জমে গেছে। আমাকেও একজন পিছন থেকে মৃদু হর্ণ দিয়েছে। এদেশে হর্ণ বাজানোকে কিঞ্চিত অপমানের চোখে দেখা হয়।
৩
হর্ণ বাজানোয় সামনের গাড়ির দরজা খুলে একজন মাথা বের করে প্রচন্ড বিরক্ত ভঙ্গিতে হাত দিয়ে বাঁ দিকে ইঙ্গিত করল আমাকে। মানুষটা খুবই বয়ষ্ক, সত্তুর আশি হবে বয়স। পাশে একজন নারীও বসা। হাজবেন্ড ওয়াইফ। সাথে সাথেই দেখলাম দুটো ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি এগলিনটন ওয়েষ্টের দিকে গেলো সাঁই সাঁই করে। এদেশে যখন ফায়ারব্রিগেড+এম্বুলেন্স এবং পুলিশের গাড়ি যদি সিগনাল বাজিয়ে যায় তখন রাস্তায় যারা থাকে সবাই গাড়ি পুলওভার করে। যারা সিগনালে থাকে তারা গ্রীন লাইট পড়লেও দাঁড়িয়ে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার ভুল বুঝতে পারলাম। ফায়ারব্রিগেডের গাড়ি যে আসছে সিগনাল বাজিয়ে সেটা আমি শুনতেই পাইনি কারণ আমার রেডিও চালু ছিল এবং ঘর ঘর শব্দটা হচ্ছিল তখন।
এরপর থেকেই আমি অনুশোচনায় ভুগছি। অনুশোচনা এই জন্য যে আমি বয়ষ্ক দুজন মানুষকে বিরক্ত করেছি হর্ণ বাজিয়ে। তারা আতঙ্কিত হয়েছে। নির্ঘাত আমাকে বর্বর, অসভ্য ভেবেছে। এটা মনে করে আমার চোখ দিয়ে পানি চলে এসেছিল। মনে মনে অনেকবার ক্ষমা চেয়েছি মানুষ দু’জনের কাছে। আল্লাহর কাছে বলেছি আমার ক্ষমা পৌঁছে দিন। সেই দিনের পর থেকে আমি কয়েকদিন আর রেডিও বাজাইনি। যতবার লেয়ার্ড আর এগলিনটন দিয়ে যাই ঘটনাটা মনে পড়ে।
টরন্টো ২৮ মে ২০২১
Leave a Reply