আমার এক বন্ধু, নাম নীলা। এ শহরেই থাকে।পড়াশুনায় মন্দ নয়। কথা বলে খুব কম। বিশেষ করে কারো সাথে কোনো ঝামেলায় জড়ায়না বললেই চলে।
এই ধরুন কেউ বিনা কারণে তার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিলো। সে কোনো প্রতিবাদই করবে না। এমনকি তার জন্য যদি কোনো শাস্তি পেতে হয়, তাও সাদরে গ্রহণ করবে।
আমার বন্ধুটি বেশ ভালো গাইতে জানতো। কলেজে পড়ার সময় আন্তঃকলেজ সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় একবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো। গান ছিলো তার ভালোবাসা। ঠিক প্রেয়সীর মতো। ক্লান্ত শরীরে চোখ জুড়ে আসা একরাশ ঘুমের মতো। ভীষণ প্রিয়।
নীলা যখন অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী,তখন একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছিলো। ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র কয়েকজন ছাত্র- ছাত্রীরা যারা ভালো গান,নাচ,আবৃত্তি, করে তাদের পারফরম্যান্সের জন্য নির্বাচন করছিলো।
নীলা সেদিন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচিত হলো। তারপর কিছুূদিন কেটে গেলো, নীলা আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় না। প্রায় সপ্তাহ খানেক পর নীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলো।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সিনিয়র আপু সীমার সাথে দেখা করলো। সীমা তাকে দেখেই রেগে গিয়ে বললো,
‘এ্যাই মেয়ে ক্লাসে রেগুলার না, আবার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে চাও কেন? নির্লজ্জ মেয়ে! তোমার মতো নবাব নন্দিনীর জন্য কি জায়গা খালি পড়ে থাকবে? না কি অনুষ্ঠান স্হগিত থাকবে! কোনো সিরিয়াসনেস নেই অথচ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে বলে নাম দিয়েছ। কখনো প্রোগ্রাম টোগ্রাম করেছ,শুনি?’
নীলা একেবারে চুপ । মাথা নিচু করে ডিপার্টমেন্টের লাইব্রেরিতে দাঁড়িয়ে। কোনো কথা নেই নীলার ঠোঁটে। পুরো লাইব্রেরি জুড়ে পিনপতন নীরবতা।
নীলাকে চুপ দেখে সীমা আরো রেগে গেলো। এ্যাই মেয়ে কানে কথা যাচ্ছে না, চুপ করে আছ কেন?
একটুকু মাথা উঁচু করে নীলা লজ্জাবতী ফুলের পাতার মতো লজ্জা আর সংকোচ নিয়ে বললো, আপু আমার আসতে খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু টঙ্গী থেকে মহাখালী ক্লাস করতে আসতে যে টাকা বাস ভাড়া দিতে হয়, তাতো আমার থাকে না। আমারতো বাবা নেই। দু’বেলা খেতেই কষ্ট হয়। প্রতিদিন ক্লাস করাতো স্বপ্নের মতো।
নীলার কথাগুলো শুনে সীমার মুখ জুড়ে সন্ধ্যার অন্ধকারের মতো ছায়া নেমে এসেছিলো আলো ঝলমলে দুপুরে। তাঁর কথাগুলো যেন মনকে ভেঙে দিচ্ছে, কোনো এক নদীর তীর ভাঙা আর্তনাদের মতো।
আমারো অনেকের মতো ক্লাস করতে ইচ্ছে করে।বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে ইচ্ছে করে। গাইতে ইচ্ছে করে। অনেকের কাছে আমার ইচ্ছেগুলো খুব সাধারণ। কিন্তু আমার কাছে এই ইচ্ছেগুলো স্বপ্নের মতো। ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে।
নীলা নামের আমার বন্ধুটি দেখতে বেশ মিষ্টি। তার একজন প্রেমিক পুরুষ ছিলো। নীলার বাবা মারা যাওয়ার পর প্রেমিক পুরুষটিও তাঁকে ছেড়ে চলে যায়। কে হতে চায় যেচে সহায় সম্বলহীনের আশ্রয়! নীলা তাঁর যাবার বেলায় কোনো প্রশ্ন তোলেনি।কোনো বাঁধনে ফিরাতে চায়নি। সেই থেকে নীলা আর কারো চোখে চোখ রাখেনি।
আমার যখন কিছুই ভালো লাগে না,তখন আমি নীলার বাসায় চলে যাই। ওর বাসার ছাদ থেকে গোধূলির আকাশ একসাথে দেখি। ওর মুখ গোধূলির আলোয় মোহনীয় লাগে। আমি তাকিয়ে ভাবি, কতটা ব্যাথা লুকিয়ে রাখো তুমি সবার আড়ালে। জানি, সব জানি আমি।
বিকেলটা সন্ধ্যের কোলে ঢলে পড়তে থাকে। নীলা তার প্রিয় গানটি গায় ,আমি বিভোর হয়ে ওর গান শুনতে থাকি।
তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে।
যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে।
যদি থাকি কাছাকাছি,
দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি–
তবু মনে রেখো।
যদি জল আসে আঁখিপাতে, এক দিন যদি খেলা থেমে যায় মধুরাতে,
তবু মনে রেখো।
এক দিন যদি বাধা পড়ে কাজে শারদ প্রাতে– মনে রেখো।
যদি পড়িয়া মনে
ছলোছলো জল নাই দেখা দেয় নয়নকোণে–
তবু মনে রেখো।
Leave a Reply