রবিবার, ২৮ মে ২০২৩, ০৫:৫৫ পূর্বাহ্ন

বিশ্ব মেডিটেশন দিবস বিশেষ আয়োজন

বিশ্ব মেডিটেশন দিবস বিশেষ আয়োজন

মেডিটেশন। মস্তিষ্ককে স্থির করার মাধ্যমে মানুষের মনের রাগ, ক্ষোভ কমাতে খূব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই মেডিটেশন। যার কারণে মানুষ খুব ধীরস্থিরভাবে যেকোনো পরিস্থিতি সামলাতে পারে।বলা হয়ে থাকে শরীর ও মনের সব ধরনের অসুবিধা দূর করে মেডিটেশন।যার ফলে একজন মানুষ ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে চাকরির ক্ষেত্রেও সমস্যার সমাধান ও সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়।
বিশ্বজুড়ে মেডিটেশন করা মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে করোনা মহামারির কারণে পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ যখন ঘরবন্দি দিনযাপন করছে তখন অনেকেরই মানসিক চাপও জীবনের একটা অংশ হয়ে গেছে। কোয়ান্টাম মেথডের তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর প্রায় ৫০কোটি মানুষ এখন নিয়মিত মেডিটেশন করেন।স্ট্রেস বা মানসিক চাপ, হৃদরোগ, ঘুমের সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীরা খুব ভালো ফল পেয়েছেন।
বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও লাখ লাখ মানুষ ধ্যান বা মেডিটেশন করে নিজেদের জীবন-যাপনকে করে তুলেছেন অর্থবহ। এসব প্রেক্ষাপট সামনে রেখে বাংলাদেশে ২১ মে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস পালিত হবে।
বাংলাদেশে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস পালনের মূল উদ্যোক্তা কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। এই সংগঠনের উদ্যোগে শুক্রবার ২১ মে ফাউন্ডেশনের সেল, প্রিসেল, শাখা, সেন্টারসহ দুই শতাধিক ইউনিটে সাংগঠনিকভাবে এবং ঘরে ঘরে ব্যক্তিগতভাবে লাখ লাখ মানুষ সম্মিলিত মেডিটেশনে অংশ নেবেন। এদিন বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৯টায় সারা দেশে এবং দেশের বাইরে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন শাখা ও ভার্চুয়াল সেলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ধ্যানমগ্ন হবেন। মেডিটেশন দিবসের প্রতিপাদ্য, ‘নিয়মিত মেডিটেশন, সুস্থ সফল সুখী জীবন’।

মনীষীদের ভাষায়, মানবজীবনের একক হচ্ছে প্রশান্তি। প্রশান্তি ছাড়া অর্থ-বিত্ত, খ্যাতি, সাফল্য সবকিছুই অর্থহীন। সেই প্রশান্তির খোঁজ মিলছে মেডিটেশনে। ইতিবাচক চিন্তার মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষ সমস্যা ও দুর্দশাগ্রস্ত প্রাত্যহিক জীবন বদলে ফেলেছেন। নিরাময় লাভ করেছেন দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে। কাঙ্ক্ষিত সাফল্য এসেছে হাতের মুঠোয়। ২০১৮ সালের এক জরিপে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা ৫২ ভাগ প্রতিষ্ঠানই তাদের কর্মীদের মেডিটেশনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। কারণ, তারা দেখছে, মেডিটেশন করা কর্মীর উৎপাদন ক্ষমতা মেডিটেশন না করা কর্মীর চেয়ে শতভাগ বেশি। বাংলাদেশের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও সেদিকে ঝুঁকছে।
বোস্টনের মাইন্ড বডি মেডিকেল ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ডা. হার্বার্ট বেনসন তার সাড়া জাগানো বেস্ট সেলার ‘রিলাক্সেশন রেসপন্স’ বইয়ের পর সম্প্রতি ‘ব্রেকআউট প্রিন্সিপাল’ নামে আরেকটি বই লিখেছেন। তাতে তিনি বলেছেন, মনকে শিথিল করার মাধ্যমে কীভাবে একজন মানুষ তার মানসিক সামর্থ্যকে তুঙ্গ অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ দৈনন্দিন চিন্তাভাবনার জঞ্জাল এবং মাথা খারাপ করে ফেলা সমস্যার বাইরে এসে যদি ভাবা যায়, কিছুটা সময় যদি অন্য চিন্তায় ডুবে থাকা যায়, তাহলে চিন্তার রাজ্যে তৈরি হয় সেই স্বচ্ছতা আর স্থিরতা, যা দেয় সঠিক সিদ্ধান্ত ও সমাধান।
আধুনিক মানুষের সুস্থ জীবনযাপনের পথে বড় অন্তরায় স্ট্রেস। হৃদরোগ, ক্যান্সার, ফুসফুসের জটিলতা, লিভার সিরোসিসসহ আরও নানা রোগের মূলে রয়েছে স্ট্রেস। এই স্ট্রেস মুক্তির জন্য মেডিটেশন এখন সারা বিশ্বে সমাদৃত। স্ট্রেস মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের শত শত হাসপাতালে চিকিৎসকরা প্রতিরোধমূলক যত্ন হিসেবে রোগীদের যোগ-মেডিটেশন প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। স্ট্রেস থেকে মুক্তি না পেলে শরীর মন পেশা সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কাজেই এত সবের ক্ষতি না করে প্রতিদিন নিয়মিত মেডিটেশন করাই বুদ্ধিমানের কাজ। বিশ্ব মেডিটেশন দিবস এই বার্তাটিই নিয়ে এসেছে।

মেডিটেশন মানসিক দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ দূর করে। এটা এখন আর নতুন কোনো তথ্য নয়। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের নানারকম প্রযুক্তির সাহায্যে মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা এখন জানতে পারছেন যে, মেডিটেশন মস্তিষ্কের কাঠামো ও কাজকে সরাসরি প্রভাবিত করে থাকে। বিশেষ করে সচেতনতা, মনোযোগ এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে মেডিটেশনের ভূমিকা প্রত্যক্ষ করে নিউরোসায়েন্টিস্টরা রীতিমতো অভিভূত।
নভেম্বর ২০০৫-এ যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেট্স জেনারেল হাসপাতালের রিসার্চ-সায়েন্টিস্ট সারা লাজার ২০ জন নারী-পুরুষের ওপর চালানো তার এক গবেষণার প্রাথমিক ফল প্রকাশ করেনÑযারা প্রতিদিন ৪০ মিনিট করে মেডিটেশন করতেন। তাদের মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে সারা দেখলেন, নিয়মিত মেডিটেশনের পর তাদের মস্তিষ্কের সেরিব্রাল কর্টেক্সের পুরুত্ব বেড়েছে। সেরিব্রাল কর্টেক্স হলো মস্তিষ্কের সেই অংশ যা সিদ্ধান্ত গ্রহণ, মনোযোগ এবং স্মৃতিশক্তি নিয়ন্ত্রণ করে।
এর আগে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের ওপর চালানো প্রায় একই ধরনের একটি পরীক্ষায়ও ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া গিয়েছিলো। কিন্তু দিনের প্রায় বেশিরভাগটাই মেডিটেশনে আত্মনিমগ্ন থাকা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের তুলনায় এবারের এ গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন বোস্টন এলাকারই বিভিন্ন কর্মজীবী সাধারণ মানুষ। আর এতে যে বিষয়টি প্রমাণিত হয় তা হলো, দিনের মাত্র কিছুটা সময় নিয়মিত মেডিটেশন করলেই এ ফল পাওয়া যায়।
শুধু মনোযোগ বা স্মৃতিশক্তি নয়, সারা লাজারের গবেষণার আরেকটি চমকপ্রদ আবিষ্কার হলোÑবয়স বাড়ার সাথে সাথে কর্টেক্সের যে অংশ পাতলা হতে থাকে মেডিটেশন সেটিকেও রোধ করতে পারে।
নিয়মিত মেডিটেশন করলে মনোযোগ এবং আরো বেশি সচেতনতা নিয়ে কাজ করা যায়। কেউ কেউ বলেন, তাহলে দুপুরের খাওয়ার পর কিছুটা ঘুমিয়ে নিলেও কি একইভাবে চাঙ্গা হওয়া যায় না? না, বলেছেন ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির বায়োলজির প্রফেসর ব্রুস ওহারা। তিনি একদল কলেজ ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে একটি গবেষণা চালান, যেখানে নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে তাদের কিছু সংখ্যককে মেডিটেশন, কিছু সংখ্যককে ঘুম এবং বাকিদেরকে টেলিভিশন দেখানো হয়। এরপর একটা নির্দিষ্ট স্ক্রিনে বাতি জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বলা হয় একটি নির্দিষ্ট বোতাম টিপতে।
এ পরীক্ষায় দেখা গেল, যারা মেডিটেশন করেছে তারা অন্যদের চেয়ে দ্রুত এবং দক্ষতার সাথে তা করতে পেরেছে। যারা ঘুমিয়ে ছিলো তাদের তৎপরতা ছিলো তুলনামূলক ধীর। অর্থাৎ মেডিটেশনের ফলে মস্তিষ্কের সু-সমন্বয় এবং তৎপরতা বাড়ে।
মেডিটেশনের এ ইতিবাচক প্রভাবের কারণেই ডয়েচ ব্যাংক, গুগল বা হাগস্ এয়ারক্রাফটের মতো বড় বড় ব্যবসায়িক কর্পোরেশনগুলো তাদের কর্মীদের জন্যে মেডিটেশন ক্লাসের ব্যবস্থা করেছে। তারা দেখছে, এতে করে তাদের কর্মীদের মেধা শাণিত হবার পাশাপাশি উৎপাদন ক্ষমতাও বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। কর্মীদের অসুস্থতার হার কমেছে, কমেছে কাজে অনুপস্থিতির হারও।

প্রশান্তিময় সুখী সুন্দর জীবনযাপনের জন্যে মেডিটেশন ও ইতিবাচক চিন্তার কার্যকারিতা এখন সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন। সাম্প্রতিককালে এর কার্যকারিতার প্রমাণ মিলেছে মাতৃগর্ভে থাকা অনাগত সন্তানের ক্ষেত্রেও। একাধিক গবেষণায় গর্ভস্থ শিশুর ওপর মায়ের চিন্তা-চেতনা, ধ্যানধারণা, ইতিবাচকতা ও মেডিটেশনের প্রভাব খুঁজে পেয়েছেন চিকিৎসাবজ্ঞানীরা।
গবেষকরা বলেন, গর্ভাবস্থায় মায়ের চিন্তা আবেগ অনুভূতি তার অনাগত সন্তানের বিকাশকে সরাসরি প্রভাবিত করে। শতাধিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, বিভিন্ন ধরনের আবেগের প্রভাবে মায়ের শরীর থেকে নিঃসৃত হরমোন ও নিউরোট্রান্সমিটার গর্ভস্থ শিশুর শরীরে প্রবেশ করে এবং শিশুকে সরাসরি প্রভাবিত করে। মায়ের যেকোনো আনন্দে নিঃসৃত এন্ডোরফিন, সেরোটনিন, অক্সিটোসিন ইত্যাদি আনন্দবর্ধক রাসায়নিক উপাদান গর্ভস্থ শিশুকেও উৎফুল্ল করে তোলে সমানভাবে। এর পাশাপাশি যেসব মা এ সময় নিয়মিত মেডিটেশন করেন তাদের গর্ভস্থ সন্তানের হার্টবিটসহ পুরো কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেম স্বাভাবিকভাবে কাজ করে।
অন্যদিকে, মায়ের স্ট্রেস দুশ্চিন্তা হতাশা ইত্যাদি নেতিবাচক আবেগ শিশুর শারীরিক-মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভাবস্থায় যেসব মা খুব বেশি স্ট্রেস-আক্রান্ত ছিলেন পরবর্তীতে তারা অস্থিরমতি, অপরিণত ও স্বল্প ওজনধারী সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। কারণ, মায়ের নেতিবাচক আবেগ ও স্ট্রেসের প্রভাবে নিঃসৃত কর্টিসোল হরমোন গর্ভস্থ শিশুকেও মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়।
তাই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ-এ সময় অযাচিত মানসিক চাপ সামলাতে এবং আনন্দবর্ধক এন্ডোরফিনের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে মায়েদের প্রশান্ত ও চাপমুক্ত জীবনযাপন করা চাই, যা খুব সহজেই সম্ভব মেডিটেশন ও ইতিবাচক জীবনচর্চার মধ্য দিয়ে। এতে শিশুর নার্ভাস সিস্টেম ও রোগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চমৎকারভাবে গড়ে উঠবে। এজন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো ইতিবাচক মনছবি-মায়েরা তাদের চিন্তায় আর কল্পনায় বার বার অবলোকন করবেন একটি সুস্থ সুন্দর ও প্রাণোচ্ছল শিশু।
বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ব্যাপক আকারের একটি গবেষণা পরিচালনা করেন, যেখানে ১৯৭৩ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত টানা ২২ বছর ধরে ১.৩৮ মিলিয়ন শিশুর ওপর তাদের মায়ের চিন্তা, কথা ও মানসিক অবস্থার প্রভাব লক্ষ করা হয়। গবেষকদলের মতে, মায়ের সব ধরনের চিন্তার প্রভাবই রয়েছে তার গর্ভস্থ শিশুর ওপর। তাই এ সময় পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি যেমনই হোক, গর্ভধারী মায়েদের উচিত সচেতনভাবেই ইতিবাচক চিন্তাভাবনা ও জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করা। তাদের অনাগত সন্তানের সুষম মনোদৈহিক বিকাশের সম্ভাবনা তাতে বাড়ে।
গবেষকরা বলছেন, গর্ভকালীন সময়ে মেডিটেশন, গভীর শিথিলায়ন, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি শেষপর্যন্ত গর্ভস্থ শিশুর প্রতি মায়ের যথাযথ মনোযোগ দেয়ার বিষয়টিকেই সুনিশ্চিত করে। আর এর ফলে মায়ের সাথে সন্তানের আত্মিক যোগাযাগের ভিত্তিটাও হয় সুদৃঢ়।
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী ও জিনতত্ত্ববিদ ড. ব্রুস লিপটন তার আলোচিত ‘বায়োলজি অব বিলিফ’ বইটিতে লিখেছেন, গর্ভস্থ শিশুর সুস্থ সুন্দর বিকাশের জন্যে মায়ের যত্ন ও পুষ্টিকর খাবার গুরুত্বপূর্ণ বটে, এর পাশাপাশি ইতিবাচকতায় উজ্জীবিত থাকার বিষয়টিও সমান গুরুত্ববহ। তাই সব চিকিৎসকেরই উচিত এ ব্যাপারে গর্ভবতী মা ও তার পুরো পরিবারকেই একটি সুস্পষ্ট ধারণা দেয়া।

ওটা ছিলো তাদের গেমস ক্লাব। ৪৫ মিনিট খেলাধুলা করে ক্লাসে ফেরার পর ব্যাগ থেকে বই বের করে ষষ্ঠ শ্রেণীর বাচ্চাগুলো রীতিমতো হতভম্ব। ওদের মধ্যে ১০/ ১২ জনের বই থেকে কে যেন কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে নিয়েছে। যেসব পাতা ছেঁড়া হয়েছে, সামনের পরীক্ষায় সে বিষয়গুলি রয়েছে। বোকা বোকা চোখে এ ওর দিকে তাকায়। কী করবে এখন! কে করলো এটা? ঘটনা শুনে শিক্ষকরাও অবাক।
ঘটনাটা কোলকাতার সল্টলেকের ভারতীয় বিদ্যাভবন স্কুলে। ঘটেছিলো ২০০৭ সালের প্রথম দিকে। স্কুলের অধ্যক্ষা অনিন্দিতা চট্টোপাধ্যায় বলেন, ওই ক্লাসে যারা ভালো ফল করে তাদের বই থেকেই এভাবে পাতা ছিঁড়ে নেয়া হয়েছিলো। মনে হয় ক্লাসেরই অন্য কোনো বাচ্চার কাজ এটা। কেন? অনিন্দিতা দেবীর উত্তর-‘প্রতিযোগিতা, আবার কী! আসলে ওই ১০/ ১২ জন লেখাপড়ায় ভালো। ওদের বই থেকে পাতাগুলি ছিঁড়ে নিলে পরীক্ষার আগে বিষয়টি পড়তে পারবে না ওরা। হিসেব সহজ।’
দৌড়, দৌড়, দৌড়! খুব ভালো নম্বর, সবার থেকে বেশি নম্বর, প্রথম হওয়ার মতো নম্বর পেতেই হবে। প্রতিযোগিতার চাপে পড়ুয়ারা বিভ্রান্ত। চাপ কমাতে তাই মেডিটেশনের সাহায্য নিচ্ছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। অনেকে আবার নিয়মিত কাউন্সেলিং-ও করাচ্ছেন। ভারতীয় বিদ্যাভবনে পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে পড়ুয়াদের পাঁচ মিনিট মেডিটেশন করাচ্ছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। একেবারে খুদেরাও যেমন রয়েছে, তেমনি বাদ যাচ্ছে না একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর পড়ুয়ারাও।
স্কুলে মিডটার্ম পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষা শুরু হয় বেলা ১১টায়। তার আধঘণ্টা আগে সাড়ে ১০টায় প্রার্থনা ও মেডিটেশন শুরু। টানা ৩০ মিনিট চোখ বন্ধ করে ডেস্কের ওপরে দুহাত রেখে পিঠ সোজা করে বসা। কিন্তু চোখ আর কতক্ষণ বন্ধ রাখা যায়? পাশের বন্ধু কী করছে, টিচার কোথায় গেলেন, এগুলো তো দেখতে ইচ্ছে করে। অধ্যক্ষা বলেন, ‘ওরা যে একভাবে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে পারবে না, সেটা ধরে নিয়েই আমরা এটা শুরু করেছি। তবে ওই যে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকল, মনটা একটু শান্ত হলো, সেটাতেও ভালো ফল পাওয়া যাবে।’
পরীক্ষার হলে ঢুকেও বইতে চোখ বুলিয়ে নেয়ার অভ্যাসটা ভালো নয়। ওতে বাচ্চাদের মন আরো চঞ্চল হয় বলে শিশু-মনোবিদরা জানান। সেই জায়গায় ধ্যান ওদের স্থির করতে সাহায্য করে। প্রতিদিন প্রথম পিরিয়ডের শুরুতে পাঁচ মিনিটের জন্যে এ অভ্যাসটি করানো হবে বলে অধ্যক্ষা জানান। তিনি বলেন, ‘মিথ্যা কথা বলবো না’, ‘সহপাঠীদের সাহায্য করবো’-এ ধরনের কিছু কথা ওরা যদি নিয়মিত মনে মনে আওড়ায়, তাহলেও ওদের মনে এর প্রভাব পড়বে।
অভিনব ভারতী স্কুলের অধ্যক্ষা সঙ্ঘমিত্রা মুখোপাধ্যায় জানান, বাচ্চাদের চাপ কমাতে তারা নিয়মিত কাউন্সেলিং করান। তিনি বলেন, অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সব থেকে বেশি চাপ কাজ করে। এর কারণ কী তা ঠিক বোঝা যায় না। এই চাপকে তারা বলছেন ‘আনডিফাইন্ড স্ট্রেস’।
চীনের স্কুলগুলোতে মেডিটেশন চর্চার ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। নতুন স্কুল, নতুন ক্লাস, নতুন সেমিস্টার এবং নতুন সিলেবাস নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যে সাধারণ ভীতি কাজ করে, তা থেকে মুক্তি পেতে বিভিন্ন স্কুলে গঠন করা হয়েছে মেডিটেশন ক্লাব। প্রতি বৃহস্পতিবার এই ক্লাবের সদস্য শিক্ষার্থীরা মেডিটেশন ও অন্যান্য সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেয়। ফলে দেখা গেছে, অন্যান্যদের তুলনায় তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটেছে এবং পরীক্ষায় তাদের ফলাফলও আগের থেকে ভালো।

লিজা গিজারা একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার। তার এক ক্লায়েন্টের জন্যে একটা নতুন বিজ্ঞাপনের আইডিয়া ভাবছেন বেশ কদিন ধরেই। কিন্তু না, নতুন কোনো আইডিয়া কোনোভাবেই আসছে না। চিন্তা করতে করতে তিনি প্রায় কাহিল। এক বিকেলে সমস্ত দুর্ভাবনা ঝেড়ে ফেলে পোষা কুকুরটাকে নিয়ে লিজা বেরিয়ে পড়লেন বাড়ির পাশের সী-বিচে। বালির ওপর হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তার মাথায় একটা কথা যেন ঝিলিক দিয়ে উঠলো-‘সংযুক্ত হও’। তিনি কয়েক পা হেঁটে যেতেই একটা মূর্তি দেখতে পেলেন আর সেখানেই খুঁজে পেলেন তার সমাধান। লিজার ভাষায়, ‘নিজেকে সত্যিই আমার খুব ভাগ্যবান মনে হলো। মনে হলো, সমাধানটা কেউ যেন আমার জন্যেই পাঠালো’।
আমরা নিজেরাও হয়তো অনেক সময় এরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি যখন মনে হয়েছে আমার কোনো ভুল হচ্ছে না, সব আমার পক্ষেই আছে। ক্রিকেট খেলায় যখন ব্যাটিং করছি প্রতিটা শট যেন ঠিক সেরকমই হচ্ছে, যেমনটা আমি চাইছি কিংবা কঠিন সব সমস্যার সমাধানগুলো যেন একটার পর একটা লাইন ধরে আসছে যা এতদিন খুব ভোগাচ্ছিলো আর রীতিমতো অসম্ভব মনে হয়েছিলো। আমাদের অধিকাংশের কাছেই এমন মুহূর্তগুলো একেবারে বিরল নয়। কিন্তু এটা কি কাকতালীয় কোনো ব্যাপার? না, মোটেই নয়।
বোস্টনের মাইন্ড বডি মেডিকেল ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ডা. হার্বার্ট বেনসন। তার সাড়া জাগানো ‘রিলাক্সেশন রেসপন্স’ বইটি ১৯৭৫ সালে বেস্ট সেলার হয়েছিলো। সম্প্রতি ‘ব্রেকআউট প্রিন্সিপাল’ নামে তিনি আরেকটি বই লিখেছেন। তাতে বলেছেন, মনকে শিথিল করার মাধ্যমে কীভাবে একজন মানুষ তার মানসিক সামর্থ্যকে তুঙ্গ অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ দৈনন্দিন চিন্তাভাবনার জঞ্জাল এবং মাথা খারাপ করে ফেলা সমস্যার বাইরে এসে যদি ভাবা যায়, কিছুটা সময় যদি অন্য চিন্তায় ডুবে থাকা যায়, তাহলে চিন্তার রাজ্যে তৈরি হয় সেই স্বচ্ছতা আর স্থিরতা, যা দেয় সঠিক সিদ্ধান্ত ও সমাধান।

শার্লিন এব্রাম ৪৩ বছর বয়সী একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। বছর কয়েক ধরেই স্বামীর সঙ্গে তার বনিবনা হচ্ছিলো না। কিন্তু ডিভোর্সের সিদ্ধান্তও তিনি নিতে পারছিলেন না। কারণ এসব নিয়ে ভাবতে গেলেই তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়তেন।
অবশেষে ১৯৯৪-এর পুরো গ্রীষ্ম জুড়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি তার সেন্ট লুইসের বাড়ির বাগানে চরকার মতো ছোট্ট এক ধরনের সেলাই নিয়ে মেতে উঠতেন। প্রতিদিন কিছু সময় ধরে এটা চালাতেন, কিছু একটা বুনতেন। এবং একটা সময় তিনি ডুবে যেতেন ভাবনাহীন, ভয়হীন এক গভীর তন্ময়তায়। আর এভাবেই শার্লিন একসময় বুঝতে পারেন তার বিয়েটা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা অর্থহীন। তিনি ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ফিরে পান নতুনভাবে জীবন শুরু করার মানসিক শক্তি ও দৃঢ়তা।
প্রফেসর হার্বার্ট বেনসনের ভাষায়, চিন্তাক্লিষ্ট মনটাকে যখন কিছুক্ষণের জন্যে দূরে সরিয়ে রাখা যায়-হতে পারে সেটি শার্লিনের মতো কোনো স্ব-উদ্ভাবিত ব্যক্তিগত উপায়ে কিংবা মেডিটেশন বা শিথিলায়নের মতো কোনো পরীক্ষিত পদ্ধতিতে-তখন ব্রেনে ঘটে এক রাসায়নিক পরিবর্তন। দেহে তখন নাইট্রিক অক্সাইড তৈরি হয়। একসময় বিজ্ঞানীরা এটিকে বিষ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও আশির দশকের গোড়ায় তারা বুঝতে পারেন যে, বিভিন্ন শারীরবৃত্তিয় কার্যক্রম, যেমন : উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এর ভূমিকা আছে।
বেনসন বলেন, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ব্রেনে যখন নাইট্রিক অক্সাইড তৈরি হয় তখন একদিকে যেমন তা উদ্বেগজনিত ক্ষতিকর হরমোনের প্রভাবকে মোকাবেলা করছে অন্যদিকে ব্রেনে নিউরোট্রান্সমিটারের তৎপরতাকেও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে জন্ম নেয় ভালো থাকার এক আনন্দদায়ক অনুভূতি। শুধু তা-ই নয়, ঝর্নাধারার মতো সৃজনশীল ভাবনার স্ফূরণ কিংবা কঠিন সব সমস্যার ফলপ্রসূ সমাধান খুঁজে পাওয়ার অনুভূতিও মানুষ পেতে পারে সে সময়।
তাই দৈনন্দিন কাজের বিরক্তি বা সমস্যার চাপে পড়ে হাল ছেড়ে দেবেন না। বরং নিমগ্ন হোন গভীর মেডিটেশনে কিংবা ডুবে যান সুখকর কোনো ভাবনায়। কিছুক্ষণ পর সত্যিই অনুভব করবেন পরিস্থিতি আপনার অনুকূলে, কারণ তা সমাধানের উপায় এখন আপনারই হাতে।

আধুনিক মানুষের সুস্থ জীবনযাপনের পথে সবচেয়ে বড় হুমকি স্ট্রেস। হৃদরোগ, ক্যান্সার, ফুসফুসের জটিলতা, লিভার সিরোসিসসহ আরো নানা রোগের মূলে রয়েছে স্ট্রেস। এগুলো নিরাময়ে স্বাস্থ্যখাতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয়ের পরিমাণ ১৯০ বিলিয়ন ডলার। এই সমস্যা মোকাবেলায় সে-দেশের শত শত হাসপাতালে চিকিৎসকরা প্রতিরোধমূলক যত্ন হিসেবে রোগীদের যোগ-মেডিটেশন প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। (Seattle times, May 17 2009)

হার্ভার্ডের ফিজিওলজিস্ট ওয়াল্টার ক্যানন আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগেই আবিষ্কার করেন যে, আমরা যখন স্ট্রেসড হই তখন আমাদের রক্তচাপ, হৃৎস্পন্দন, মাংসপেশীর চাপ এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়।

হার্ভার্ডেরই আরেক গবেষক ডা. হার্বার্ট বেনসন ১৯৬৭ সালে দেখান যে, মেডিটেশন আমাদের শরীরে স্ট্রেসের ঠিক বিপরীত প্রতিক্রিয়া ঘটায় অর্থাৎ রক্তচাপ, হৃৎস্পন্দন, মাংসপেশীর চাপ এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিকে স্বাভাবিক রাখে। তার লেখা ‘দা রিলাক্সেশন রেসপন্স’ বইয়ে তিনি বলেছেন, স্ট্রেসের কারণে আমাদের দেহে যে ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স সৃষ্টি হয় সেটিকে প্রশমিত করে মেডিটেশন মন ও দেহকে অধিকতর শান্ত ও সুখী অবস্থায় নিয়ে আসে। বইটি ছিল সর্বাধিক বিক্রিত। অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে যে, মেডিটেশন আমাদের দেহে স্ট্রেসের জন্যে দায়ী হরমোন কর্টিসলের নিঃসরণ কমিয়ে দেয়।

ক্রনিক স্ট্রেস আমাদের শরীরে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বাড়িয়ে দিয়ে বয়স বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে এবং ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, এজমা, সোরিয়াসিসের মতো মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, মেডিটেশন অক্সিডেটিভ স্ট্রেস হ্রাস করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০০৬ ও ২০০৮ সালে গবেষক ড্যান উইজক ও তার সহকর্মীরা ৬০ জন স্বেচ্ছাসেবকের ওপর এক অভিনব পদ্ধতি আলট্রা উইক ফোটন ইমিশন মেসারমেন্ট প্রয়োগ করে তাদের দেহকোষে বিক্রিয়াশীল অক্সিজেন পরিমাপ করেন এবং দেখতে পান যে, যারা নিয়মিত মেডিটেশন করেন তাদের দেহে এই ফোটন রেডিয়েশন এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের মাত্রা অনেক কম।  স্ট্রেস থেকে মুক্তি না পেলে শরীর মন পেশা সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কাজেই এতসবের ক্ষতি না করে প্রতিদিন নিয়মিত মেডিটেশন করাই বুদ্ধিমানের কাজ। বিশ্ব মেডিটেশন দিবস এই বার্তাটিই নিয়ে এসেছে।

আরমান আহমেদ (ছদ্মনাম)। পেশায় ডেন্টাল সার্জন। নিজে চিকিৎসক ছিলেন বলে স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন বরাবরই। প্রতিদিন নিয়ম করে এক ঘণ্টা হাঁটতেন, খাবারেও অতিরিক্ত তেল-চর্বি এড়িয়ে চলতেন সবসময়। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, মাত্রাতিরিক্ত কোলেস্টেরল কিছুই তার ছিলো না। ওজনও ছিলো শতভাগ নিয়ন্ত্রণে। হঠাৎ একদিন শোনা গেল, তার হার্ট অ্যাটাক করেছে। তিনি সিসিউতে ভর্তি আছেন।
আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব কারোরই বিশ্বাস হতে চাইলো না খবরটা। এমন পরিমিত আর নিয়মনিষ্ঠ জীবনযাপন যার, তার কীভাবে হার্ট অ্যাটাক হলো। দিন কয়েক বাদে ধীরে ধীরে একটু সুস্থ হতে শুরু করলে ডাক্তার তার কেস-হিস্ট্রি নিতে গিয়ে বুঝলেন, আরমান সাহেবের হার্ট অ্যাটাকের কারণ মূলত তার মানসিক চাপ। পারিবারিক কিছু অশান্তিতে ভুগছিলেন, মাস কয়েক ধরে একটা অসহনীয় অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে, অসহ্য এক স্ট্রেস প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খাচ্ছিলো তাকে। যার অন্যতম পরিণতি এই আকস্মিক হার্ট অ্যাটাক।
ধূমপান, মেদস্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগের পারিবারিক ইতিহাস, অতিরিক্ত কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার ইত্যাদির পাশাপাশি টেনশন ও স্ট্রেস হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ। গত শতকের শেষভাগে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক গবেষণার ফলে বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগ, বিশেষত হৃদরোগের সাথে স্ট্রেসের যোগসূত্রের বিষয়টি তো এখন স্পষ্ট।
মার্কিন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ক্রিচটন বলেন, হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ মানসিক চাপ। দীর্ঘ গবেষণার পর তিনি দেখিয়েছেন যে, কোলেস্টেরল বা চর্বিজাতীয় পদার্থ জমে করোনারি আর্টারিতে রক্ত চলাচল কমিয়ে দিলেই যে হার্ট অ্যাটাক হবে এমন কোনো কথা নেই। দেখা গেছে, করোনারি আর্টারির ৮৫% বন্ধ অবস্থা নিয়েও একজন ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিয়েছে; আবার শুধুমাত্র স্ট্রেস, টেনশন বা মানসিক চাপের কারণে একেবারে পরিষ্কার আর্টারি নিয়ে আরেকজন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেয়ার ফ্রেডম্যান তার সহকর্মী রোজেনম্যানকে নিয়ে পঞ্চাশের দশকে একটি গবেষণা-প্রতিবেদন তৈরি করেন। তাতে বলা হয়, হৃদরোগের সাথে অস্থিরচিত্ততা, বিদ্বেষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি, তীব্র অনুভূতিপ্রবণতাÑঅর্থাৎ নেতিবাচক জীবনদৃৃষ্টির সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। আর এ ধরনের ব্যক্তিত্ব-বৈশিষ্ট্য দেখা যায় যাদের মধ্যে তাদেরকে গবেষকদ্বয় অভিহিত করেন টাইপ এ ব্যক্তিত্ব (Type A Personality) হিসেবে। ১৯৭৪ সালে তারা এ নিয়ে একটি বইও লেখেন-‘টাইপ এ বিহেভিয়ার এন্ড ইয়োর হার্ট’। বইটি তখন বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলো। মূলত তখন থেকেই টাইপ এ পার্সোনালিটি বাক্যটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের মূলধারায় ব্যাপক পরিচিতি পায়।
এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, সুস্থ হৃদযন্ত্রের জন্যে চাই মানসিক প্রশান্তি ও সঠিক জীবনদৃষ্টি। আর মানসিক প্রশান্তি ও চাপমুক্ত জীবনের জন্যে মেডিটেশনের ভূমিকা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে হৃদরোগ চিকিৎসার পথিকৃৎ ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ-এর মহাসচিব জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) ডা. আব্দুল মালিক তার আত্মজীবনী ‘জীবনের কিছু কথা’ বইতে লিখেছেন, ‘শরীরের ওপর মনের প্রভাব অপরিসীম। তাই দেহের পাশাপাশি মনের যত্ন নেয়াও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মন বা আত্মা ভালো না থাকলে শরীরও ভালো থাকে না। কাজেই আমাদের দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপনের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এজন্যে নিয়মিত নামাজ, প্রার্থনা ও মেডিটেশন করা উচিত। চাপমুক্ত জীবনযাপন, মানসিক সুস্বাস্থ্য ও সুস্থ হৃদযন্ত্রের জন্যে রিলাক্সেশন বা শিথিলায়নের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সারা বিশ্বে তাই এটি দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে’।
একাধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এটি এখন প্রমাণিত সত্য যে, মেডিটেশন হৃদরোগ প্রতিরোধ ও নিরাময় দুক্ষেত্রেই কার্যকর ভূমিকা রাখে। সাধারণভাবে, রক্তের উচ্চ কোলেস্টেরল হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম কারণ। মেডিটেশন এই অস্বাভাবিক বেশি কোলেস্টেরলের মাত্রাকে কমিয়ে আনতে পারে।
মেডিকেল কলেজ অব জর্জিয়ার ফিজিওলজিস্ট ডা. বার্নেস ১১১ জন তরুণ স্বেচ্ছাসেবীর ওপর একটি গবেষণা চালান। তিনি বলেন, কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ ব্যবহার করে আগে যে ফল পাওয়া যেত, তা-ই পাওয়া সম্ভব মেডিটেশনে। ২০০৭ সালে আমেরিকান সাইকোসোমাটিক সোসাইটির বার্ষিক কনফারেন্সে তিনি এ রিপোর্টটি পেশ করেন।
এছাড়াও ১৯৭৯ সালে দুজন গবেষক এম জে কুপার এবং এম এম আইজেন ২৩ জন উচ্চ কোলেস্টেরল রোগীর মধ্যে ১২ জনকে মেডিটেশন করান। ১১ মাস পর দেখা যায় যে, মেডিটেশনকারী দলের কোলেস্টেরল ২৫৫ থেকে ২২৫-এ নেমে এসেছে।
মেডিটেশন করোনারি ধমনীর ব্লকেজ ও রক্তচাপ কমায়Ñবিজ্ঞানীরা এতদিন জানতেন শুধু এটুকুই। কিন্তু মেডিটেশনের মনোদৈহিক প্রভাব সম্বন্ধে সাম্প্রতিক যে তথ্যটি এখন তাদের আলোচনার বিষয় তা হলো, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক প্রতিরোধসহ হৃদরোগজনিত যেকোনো অকালমৃত্যু ঠেকাতে মেডিটেশন অত্যন্ত কার্যকরী।
আমেরিকায় ২০১ জন আফ্রো-আমেরিকান হৃদরোগীকে নিয়ে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, যারা নিয়মিত মেডিটেশন করেন তাদের ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি অন্যান্যদের তুলনায় শতকরা ৪৭ ভাগ কমে গেছে। এ প্রসঙ্গে গবেষকদের একজন থিওডর কচেন্ বলেন, মানুষ ওষুধ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে, কিন্তু আমাদের গবেষণায় এটাই প্রমাণিত হলো যে, স্ট্রেসজনিত রোগের ঝুঁকি কমাতে সবচেয়ে শক্তিশালী ও কার্যকরী পন্থা মেডিটেশন। রিডার্স ডাইজেস্ট-এ প্রকাশিত হৃৎপিণ্ডের সুস্থতা বিষয়ক একটি স্বাস্থ্য-প্রতিবেদনে এ তথ্যগুলো প্রকাশিত হয়। শুধু তা-ই নয়, হৃদরোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে মেডিটেশনের ভূমিকার সত্যতা এখন স্থান পেয়েছে কার্ডিওলজির প্রধান প্রধান পাঠ্যবইয়ের সাম্প্রতিক সংস্করণগুলোতেও।
Hurst’s : The Heart বইটির দ্বাদশ সংস্করণে বলা হয়েছে-‘…মেডিটেশন জীবনে শৃঙ্খলা নিয়ে আসে। শরীর স্থির হয়, মন হয়ে ওঠে প্রশান্ত। এর ফলে একটি নিরাময়ের অনুরণন সৃষ্টি হয়, যা হৃদরোগের ভীতিকর বুকব্যথা থেকে মুক্তি দেয় এবং জীবনমানের উন্নতি ঘটায়। হৃদরোগীদের জীবনধারা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তাই এর ভূমিকা রয়েছে এবং এটি এথেরোরিগ্রেশন করে বা করোনারি ধমনীতে জমে থাকা কোলেস্টেরলের নিঃসরণ ঘটায়।’ (পৃষ্ঠা ২৪৬৮)।
Braunwald’s Heart Disease বইটির অষ্টম সংস্করণে ১১৫৭ পৃষ্ঠায় রয়েছে-‘… মেডিটেশন, যোগ ব্যায়াম, গভীর শ্বাসপ্রশ্বাস (প্রাণায়াম) ব্যথা-বেদনা ও দুশ্চিন্তা দূর করে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, এ পদ্ধতিতে মানসিক চাপ কমে ও রোগ নিরাময় সুসম্পন্ন হয়। এছাড়াও মেডিটেশন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং শরীরে ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ায়।’
তাই হৃদযন্ত্রের সুস্থতার জন্যে মানসিক চাপমুক্ত জীবনযাপন করুন। আর তা সম্ভব নিয়মিত মেডিটেশন বা ধ্যানমগ্নতায়। দিনে অন্তত ৩০ মিনিট মেডিটেশন আপনাকে নিয়ে যাবে নতুন আনন্দলোকে। প্রশান্তি হবে আপনার নিত্যসঙ্গী। অযাচিত সব দুঃখ-কষ্ট আর নেতিবাচকতা আপনার কাছ থেকে পালিয়ে যাবে দূরে, অনেক দূরে। আপনি হয়ে উঠবেন সুস্থ সুন্দর প্রাণবন্ত এক নতুন মানুষ।
ডা. আতাউর রহমান: মেডিকেল কাউন্সিলর এন্ড মোটিভিয়ার, কোয়ান্টাম হার্ট ক্লাব/কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন

সুখী হতে কে না চায়? সুখের খোঁজে কত কী-ই না করে মানুষ। সুখের আকাক্সক্ষা যেন সার্বজনীন। কিন্তু সত্যিকারভাবে কজনই-বা এর দেখা পায়? গুণীজনেরা বলেন, সত্যিকারের সুখের ছটায় সবসময় ঝলমল করে ওঠে একজন মানুষের চেহারা, অভিব্যক্তি ও আচরণ। চলুন শোনা যাক, তেমনই একজন সুখী মানুষের গল্প-
ম্যাথু রিকার্ড। ৬৪ বছর বয়সী এ মানুষটি একসময় কাজ করেছেন অণুজীব বিজ্ঞানী হিসেবে। বর্তমানে তিনি একাধারে লেখক আলোকচিত্রী গবেষক অনুবাদক ও একজন ধর্মপ্রাণ ভিক্ষু। এতগুলো উপাধির সাথে তার নামের পাশে এখন যুক্ত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষের উপাধি। রীতিমতো বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত এটি।
রিকার্ডের চেহারাটা যেন একজন প্রশান্ত মানুষের মুখচ্ছবি। তিনি মনে করেন, প্রত্যেক মানুষই পারে অফুরান আনন্দ আর সুখের অনুভূতিতে নিজের জীবনকে পরিপূর্ণ করে তুলতে। সহিষ্ণু দৃষ্টির এ মানুষটির ঠোঁটের কোণে একটা ছোট্ট হাসি স্থান করে নিয়েছে সবসময়ের জন্যেই। রিকার্ডের এ নিরন্তর সুখের রহস্য কী? উত্তর একটাই-দৈনন্দিন জীবনে নিয়মিত মেডিটেশন চর্চা।
২০০৪ সালে একাধিক ল্যাবরেটরি টেস্টের পর রিকার্ড পেয়েছেন বিশ্বসুখী মানুষের খেতাব। কয়েক ধাপবিশিষ্ট গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, তার মধ্যে রয়েছে আনন্দপূর্ণ জীবনের এক অভাবনীয় ক্ষমতা। গবেষণাকালে বিজ্ঞানীরা তার পুরো মাথাটাকে মুড়ে ফেলেছিলেন ২৫৬টি ইলেকট্রোড দিয়ে। সীমাহীন উৎসাহ নিয়ে তারা রিকার্ডের ব্রেনের ওপর মেডিটেশনের প্রভাব অনুসন্ধান করতে থাকেন।
গবেষণা ও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিজ্ঞানীদের সামনে যে জিনিসটি উন্মোচিত হয়েছে, সেটি এককথায় দারুণ চমকপ্রদ। রিকার্ড এবং অন্যান্য ধ্যানমগ্ন ভিক্ষুর ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, তাদের ব্রেনের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স অত্যন্ত সুতীক্ষ। উল্লেখ্য, মানুষের তৃপ্তি, সুখ আর আনন্দের মতো ইতিবাচক আবেগগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় ব্রেনের এ অংশটি থেকেই।
৩৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে মেডিটেশন চর্চা করছেন ম্যাথু রিকার্ড। যার ফলে তিনি এখন তার মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। তার ভাষায়, মেডিটেশন স্থায়ী ও অনন্ত সুখের মূল উপাদান। A Guide to Developing Life’s Most Important Skill বইতে সুখের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে রিকার্ড লিখেছেন, সুস্থ সুন্দর মন থেকে উৎসারিত এক গভীর অনুভূতিই হলো সুখ। ২০০৭ সালে প্রকাশিত এ বইটি পরবর্তীতে বেস্ট সেলার-এর সম্মান লাভ করে। মূলত সুখ নিয়ে তার অনুভূতি উপলব্ধিগুলোই রিকার্ড তুলে ধরেছেন এ বইটিতে।
দেশ থেকে দেশে ঘুরে ঘুরে মানুষের কাছে তিনি পৌঁছে দিচ্ছেন সুখের গূঢ় তত্ত্ব। গভীর আগ্রহে এ সুখী মানুষের কথা শুনতে আসেন ছাত্র থেকে করপোরেট পেশাজীবীসহ সব ধরনের মানুষ। সহজ ভাষায় সৌম্য ভঙ্গিতে তিনি বলে চলেন-‘সুখ হচ্ছে এমন এক প্রশান্ত অনুভূতি, যা অযাচিত সব দুঃখ অশান্তি আবেগকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়….’।
রিকার্ড বলেন, সুখের জন্যে আমরা চারপাশের অনেক কিছুতে অবলম্বন খুঁজে বেড়াই। কিন্তু আসলে এর সন্ধান করা উচিত নিজের অন্তর্গত আনন্দলোকে। আমি বিশ্বাস করি, সুখী হওয়ার একমাত্র উপায় এটাই। আর আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন-চারপাশে কী ঘটছে তা মোটেও বিবেচ্য নয়, বরং পারিপার্শ্বিক এ ঘটনাগুলোকে আমরা কীভাবে দেখছি অর্থাৎ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপরই নির্ভর করে জীবনের সুখ ও আনন্দ।

আসলে বিষয়টি এমন যে, পারিপার্শ্বিক অবস্থা যা-ই হোক, আমাদের সবার মধ্যেই রয়েছে সুখী হওয়ার এক আশ্চর্য ক্ষমতা। এর জন্যে আগে আমাদের মনটাকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে হবে। জানতে হবে এর উপায়। কারণ শারীরিক-মানসিক সুস্থতা, নিয়মানুবর্তী জীবনযাপন-এ সবকিছুর জন্যেই মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা জরুরি।
শরীরের সুস্থতা ও সৌন্দর্য বজায় রাখার জন্যে প্রতিদিন আমরা কত কী-ই না করি। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি, সেদিকেই আমাদের মনোযোগ সবচেয়ে কম। তা হলো-নিজের মনের দিকে তাকানো, মনের যত্ন নেয়া। আসলে মনের প্রতি, অন্তর্গত অস্তিত্বের প্রতি এ মনোযোগই আমাদের উপলব্ধিগুলোকে আরো শাণিত করে তোলে। নিরন্তর সুখের দেখা পাই আমরা। আর এর সবচেয়ে কার্যকরী প্রক্রিয়াটি হলো মেডিটেশন। দিনে আধঘণ্টা মেডিটেশন আপনাকে পৌঁছে দেবে এক আশ্চর্য সুখানুভূতির রাজ্যে।
আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত যা ঘটে চলেছে তা কিন্তু আমাদের দুঃখের কারণ নয়, বরং এসব ঘটনায় আমরা যেভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি, মূলত তা-ই আমাদেরকে অসুখী করে তোলে। এ প্রসঙ্গে রিকার্ডের উপলব্ধি- ‘পৃথিবীর সবকিছুকে আমি কখনোই নিজের ইচ্ছেমতো পরিবর্তন করে ফেলতে পারবো না কিন্তু নিজের মনটাকে তো পরিবর্তন করতে পারি আমি। আর যিনি নিজের মনকে পরিবর্তন করতে পারেন অর্থাৎ নিজেকে বদলাতে পারেন তিনি পৃথিবীটাকেই পারেন বদলে দিতে।’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সুখের পেছনে ছোটা এবং ক্রমাগত এভাবে ছুটতে থাকা আধুনিক মানুষের একটি অবসেশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে প্রতিনিয়তই আমরা যেন পারিপার্শ্বিক সব অযাচিত আবেগ-অনুভূতির সাথে যুদ্ধে পরাভূত হচ্ছি। তাই সুখী হওয়ার জন্যে রিকার্ডের পরামর্শ-ভেতরে কৃতজ্ঞতাবোধ সন্তুষ্টচিত্ততা কল্যাণকামিতা লালন করুন। আপনি সুখী হবেন। শুধু মনোরম আর সুখপ্রদ অভিজ্ঞতার পেছনে ছুটলেই আপনি সত্যিকারের সুখী হতে পারবেন না। কারণ, সুখী হওয়াটা নির্ভর করে কিছু মানবিক আচরণের ওপর যেমন : উদারতা, পরার্থপরতা, সমমর্মিতা, অন্তর্গত শক্তি। সেইসাথে চাই প্রশান্ত মন। আর আনন্দময় সুখের পথে সবচেয়ে বড় হুমকি হলো অহংকার ও আত্মকেন্দ্রিকতা। তাই সুখী হতে হলে সমমর্মী ও অন্যের কল্যাণকামী হোন সবার আগে। এভাবেই শুরু হবে আপনার সুখযাত্রা।
‘বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষ’-উপাধিটি এমন জাঁকালো আর দশাসই হলেও ম্যাথু রিকার্ডের বার্তাটি কিন্তু খুব সরল। যা সহজেই বোধগম্য এবং অনুসরণযোগ্য। তা হলো-দয়ালু হোন, নিঃস্বার্থ মমতায় প্লাবিত করুন নিজের অন্তর। অন্তর্গত শক্তি, উদারতা আর কৃতজ্ঞতাবোধে পূর্ণ হোক আপনার সমগ্র অস্তিত্ব। নিয়মিত ধ্যানমগ্ন হোন। সত্যিকারের সুখের দেখা মিলবেই।
ডা. আতাউর রহমান: মেডিকেল কাউন্সিলর এন্ড মোটিভিয়ার, কোয়ান্টাম হার্ট ক্লাব

দেশে বা দেশের বাইরে সব জায়গাতেই নেশা বা আসক্তির কারণে প্রতি বছর ঝরে যায় প্রচুর সম্ভাবনাময় তরুণ। মারামারি হানাহানি ইত্যাদির একটি বড় কারণ এই আসক্তি। সহিংসতা, সামাজিক বিশৃংখলা ও অপরাধের একটি বড় কারণ এই আসক্তি। সমাজের সর্বস্তরে, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মাঝে, মেডিটেশন চর্চা চালু করে এই আসক্তির বিরুদ্ধে একটি কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব।
নেশা বা আসক্তি হচ্ছে কোনোকিছুর ওপর এক ধরনের মানসিক নির্ভরতা। সাধারণভাবে নেশা বলতে এলকোহল বা মাদকাসক্তিকে বোঝালেও নেশা যেমন হতে পারে ধূমপান, তেমনি কোমল পানীয়, এনার্জি ড্রিংকস, ওষুধ, টনিক থেকে শুরু করে জুয়া, যৌনাচার, এমনকি কেনাকাটাও পরিণত হতে পারে নেশায়। মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক বা ভিডিও গেমস হতে পারে নেশার বিষয়।
‍নেশা হলো এক ধরনের মস্তিষ্কবিকৃতি। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নেশাগ্রস্ত তাদের ব্রেনের গঠন এবং কর্মকাঠামোয় এমন কিছু ক্ষতিকর পরিবর্তন আসে যা অন্যদের মধ্যে নেই। বিশেষ করে মাদকাসক্তদের চিন্তাপ্রক্রিয়ায়ও দেখা গেছে বিশেষ কিছু পরিবর্তন। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে শুরু করে মনোযোগ, আবেগ, দৃষ্টিভঙ্গি-সবকিছুই প্রভাবিত হয় ঐ পরিবর্তিত অবস্থা দ্বারা।
প্রচলিত অন্য যে-কোনো চিকিৎসাব্যবস্থার চেয়ে সিগারেট, মাদক ও অন্য যে-কোনো ড্রাগের আসক্তি থেকে নিরাময়ে মেডিটেশনই এখন বেশি কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে নানা গবেষণায়। এ গবেষণাগুলোর একটা মেটা এনালিসিস করেছেন মহাঋষি ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্টের চার্লস আলেক্সান্ডার ও তার সহযোগীরা। তারা দেখেছেন, সবগুলো ফলাফলেই আসক্তি থেকে রোগীরা অন্য যে-কোনো প্রক্রিয়ার চেয়ে মেডিটেশনে বেশি কার্যকরীভাবে নিরাময় হয়েছেন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই। তাদের পুনরায় মাদকাসক্ত হওয়ার হারও অনেক কম।
২০০৬ সালে ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন ইন সিয়াটলের বিজ্ঞানী বাওয়েন জেলখানার মাদকাসক্ত বন্দিদের ওপর বিপাসনা মেডিটেশনের প্রভাব বিষয়ে এক গবেষণা চালান। এতে দেখা যায়, জেলে থাকার সময় যারা মেডিটেশন কোর্সে অংশ নিয়েছেন জেল থেকে বেরিয়ে তাদের মাদকাসক্তির পরিমাণ কমেছে। এসব মাদকের মধ্যে এলকোহল যেমন আছে তেমনি আছে কোকেন, মারিজুয়ানা ইত্যাদিও। মেডিটেশনকারী গ্রুপের মধ্যে মাদকের প্রভাবজনিত মানসিক সমস্যাও কম। সামাজিক পরিবেশের সাথে তারা আরো ভালোভাবে খাপ খাওয়াতে পারছে।
বিটেল এবং অন্যান্যের গবেষণায় দেখা গেছে, এইচআইভি ঝুঁকিপূর্ণ আচরণে লিপ্ত মাদকাসক্তদের মেডিটেশন ড্রাগের নেশা এবং পরিণামে এইচআইভি থেকে রক্ষা করেছে।
ক্যালিফোর্নিয়া স্কুল অব প্রফেশনাল সাইকোলজি, বার্কলের গবেষক ক্যারোল বলেন, মেডিটেশন জীবনে একটি উদ্দেশ্যপূর্ণতা তৈরি করে যা মাদকাসক্তি থেকে মুক্তির প্রধান কারণ।
২০০৭ সালে ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন এর স্কুল অব মেডিসিন এন্ড পাবলিক হেলথ এর গবেষক ডেভিস এ গবেষণাটি চালান। এতে তিনি ১৮ জন এমন ধূমপায়ীকে বাছাই করেন যারা ২৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে দিনে ২০টি করে সিগারেট খেতেন। ডেভিসের গবেষণার জন্যে মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশনে অংশ নিয়ে তারা ধূমপান ছাড়তে পেরেছেন। গবেষণার ৬ সপ্তাহ পর শারীরিক পরীক্ষায় দেখা যায়, ১৮ জনের মধ্যে ১০ জন আর ধূমপান করেনই নি।
বাংলাদেশেও নিয়মিত মেডিটেশন চর্চা করে শত শত মানুষ ধূমপান মাদকের মতো নেশা থেকে যেমন নিজেদেরকে মুক্ত করেছেন, তেমনি সফট ড্রিংকস, এনার্জি ড্রিংকস, দুধ-চায়ের মতো ক্ষতিকর খাদ্যাভ্যাসকেও ছেড়েছেন অবলীলায়। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মেডিটেশন চর্চার সুযোগ করে দিচ্ছে নানাভাবে। তাদের ওয়েবসাইটে রয়েছে ফ্রি মেডিটেশন অডিও ডাউনলোড করার সুযোগ। যে কেউই এখান থেকে অডিও ডাউনলোড করে তা শুনে শুনে মেডিটেশন চর্চা করে উপকৃত হতে পারেন।
ডা. আতাউর রহমান, চিকিৎসক ও লেখক

বিশ্ব জুড়ে এখন অসংক্রামক ব্যাধির দৌরাত্ম। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো উচ্চ রক্তচাপ, ডায়বেটিস ও স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন। এই রোগগুলোর জন্য কিন্তু কোন ভাইরাস দায়ী নয়। দায়ী ভুল জীবনাচার, ভুল খাদ্যাভ্যাস। মেডিটেশনের মত একটি সহজ চর্চা যদি দৈনন্দিন জীবনে যুক্ত করা যায় তাহলে খুব সহজেই এই রোগগুলো থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।
হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে মেডিটেশনের সাফল্য প্রশ্নাতীত। ২০০৪ সালে আমেরিকার জার্নাল অব হাইপারটেনশন-এ ১৫৬ জন স্বেচ্ছাসেবীর ওপর তিনমাস ধরে চালানো গবেষণার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায়, প্রেশার কমানোর জন্যে যারা খাবার এবং ব্যায়ামনির্ভর চর্চা করেছে এবং যারা কিছুই করে নি তাদের তুলনায় যারা মেডিটেশন করেছে তাদের সিস্টোলিক ও ডায়াস্টলিক দুই ব্লাড প্রেশারই কমেছে।
হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপের সংকটসীমায় যাদের অবস্থান তারা মেডিটেশনে দ্রুত প্রশান্তি অনুভব করেন। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল কর্তৃক পরিচালিত ১৯৭৪ সালের এক সমীক্ষায় বলা হয়, ২২ জন উচ্চ রক্তচাপ আক্রান্ত রোগীকে মেডিটেশন শেখানোর আগে ও পরে মোট ১২শত বার পরীক্ষা করা হয়। একমাস থেকে পাঁচবছর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, তাদের গড় রক্তচাপ ১৫০/ ৯৪ থেকে ১৪১/ ৮৮ তে নেমে এসেছে।
ডায়াস্টলিক প্রেসার সংকটসীমা থেকে নেমে যায় গ্রহণযোগ্য সীমার মধ্যে। সিস্টলিক প্রেসার স্বাভাবিক সীমায় না নামলেও উল্লেখযোগ্য উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। মধ্যবয়সী একজন মানুষের স্বাভাবিক প্রেশার ধরা হয় ১২০-১৪০/ ৬০-৯০; সেখানে হাইপারটেনশনের সংকটসীমা ধরা হয় ১৫০/ ১০০।
ব্লাডপ্রেশার কমানোর ক্ষেত্রে মেডিটেশন এবং এ জাতীয় পদ্ধতিগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে যত ধরনের গবেষণা হয়েছে সেগুলোর একটি মেটা এনালিসিস তৈরি করেন ২০০৭ সালে গবেষক রেইনফোর্থ এবং তার সহযোগীরা। তারা মোট ১০৭টি রিপোর্ট পান। তারা দেখেন ট্র্যান্সেন্ডেন্টাল মেডিটেশন প্রেশার কমানো ছাড়াও হৃদরোগের অন্যান্য ঝুঁকি হ্রাসের ক্ষেত্রেও কাজ করে।
ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও নিয়মিত মেডিটেশন অত্যন্ত ফলপ্রসূ।
২০০৮ সালে থাইল্যান্ডের বিজ্ঞানী চাইওপানোন্ট ৫০ জন টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীর ওপর গবেষণা করেন। সকালে নাশতার পর এই রোগীদেরকে তিনি মেডিটেশন করান। দেখা গেল, মেডিটেশন এবং পরিমিত জীবনপদ্ধতি অনুসরণ করে তাদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিক আছে।
আরেক গবেষণায় রোজেনউইক ও তার সহকর্মীরা ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে HbA1c (গ্লাইকোসাইলেটেড হিমোগ্লোবিন) এর মাত্রা পর্যবেক্ষণ করেন। HbA1c হলো এক ধরনের গ্লুকোজ জাতীয় হিমোগ্লোবিন যা ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে দেখা যায়। তারা দেখেন মেডিটেশন রক্তে এই HbA1c এর মাত্রা কমিয়ে দেয়। সেই সাথে রক্তচাপকেও স্বাভাবিক রাখে। এমনকি এই গবেষণাও প্রমাণ করে মেডিটেশন হতাশা, দুশ্চিন্তা ও নানারকম মানসিক অস্থিরতা কমায়। ডায়াবেটিক রোগীদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়ার এগুলোও উল্লেখযোগ্য কারণ।
এছাড়া, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, মেডিটেশন স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস তৈরিতে সহায়তা করে।
ইন্ডিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর দা স্টাডি অব হেলথ, রিলিজিয়ন এন্ড স্পিরিচুয়ালিটির ডিরেক্টর জেন ক্রিসলার ১৮ জন স্থূলকায়া মহিলার ওপর এক গবেষণা চালান। দেখা গেল মেডিটেশন করার পর তাদের ওজন বৃদ্ধির হার কমেছে।
গবেষক সিং এবং তার সহকর্মীরা এক গবেষণায় দেখতে পান যে, প্রেডার-উইলি সিনড্রোমে আক্রান্ত অল্পবয়স্করা যদি নিয়মিত মেডিটেশন, ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস করেন তবে তারা ওজন কমাতে সফল হন। প্রেডার উইলি সিনড্রোম হলো অতিভোজনের কারণে ওজন বাড়ার এক ধরনের বংশগত রোগ। এই রোগে আক্রান্তরা অনেক খাওয়া-দাওয়ার পরও সবসময় ক্ষুধাবোধে ভুগতে থাকে। ফলে ছোটবেলা থেকেই মোটা হতে হতে একটা সময় চলে যায় আয়ত্তের বাইরে এবং আক্রান্ত হয় নানা জটিলতায়।
বৈজ্ঞানিক নানা গবেষণার ফলে এখন সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপ অনেকটাই কমে গেছে। কিন্তু অসংক্রামক ব্যাধির ফলে মানুষের অসুস্থ হওয়ার পরিমাণ বাড়ছে। জীবনাচারে সামান্য পরিবর্তন আনলেই এসব অসংক্রামক ব্যাধির হাত থেকে খুব সহজে নিস্তার লাভ করা সম্ভব। মেডিটেশন যেহেতু বহু প্রাচীন কিন্তু একইসাথে অত্যন্ত আধুনিক একটি চর্চা তাই এটাই হতে পারে এই সময়ের সবচেয়ে বড় ওষুধ, সবচেয়ে বড় টিকা – সব ধরণের অসংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে।

নানা গবেষণার মাধ্যমে এটি এখন এক প্রমাণিত সত্য যে, মেডিটেশন হৃদরোগের প্রতিরোধ ও নিরাময়- দুক্ষেত্রেই খুব কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
মার্কিন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ক্রিচটন দীর্ঘ গবেষণার পর দেখিয়েছেন যে, হৃদরোগের কারণ প্রধানত মানসিক। তিনি বলেছেন, কোলেস্টেরল বা চর্বি জাতীয় পদার্থ জমে করোনারি আর্টারিকে প্রায় ব্লক করে ফেললেই যে হার্ট অ্যাটাক হবে এমন কোনো কথা নেই। কোরিয়ার যুদ্ধের সময় রণক্ষেত্রে নিহত সৈনিকদের নিয়মিত অটোপসি করা হতো। ডাক্তাররা তখন সবিস্ময়ে লক্ষ্য করেন যে, নিহত তরুণ সৈনিকদের শতকরা ৭০ জনেরই আর্টারি চর্বি জমে প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে (চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে এডভান্সড স্টেজ অফ এথেরোসক্লেরোসিস) এবং দ্রুত হার্ট অ্যাটাকের পথে এগুচ্ছে। এদের মধ্যে ১৯ বছর বয়ষ্ক তরুণ সৈনিকও ছিল। ডা. ক্রিচটন প্রশ্ন তোলেন, তরুণ আর্টারিগুলো এভাবে চর্বি জমে বন্ধ হওয়ার পরও সাধারণভাবে মধ্য বয়সে এসে কেন হৃদরোগের আক্রমণ ঘটে? যদি শুধু করোনারি আর্টারিতে চর্বি জমাটাই হৃদরোগের কারণ হতো তাহলে তো এই তরুণ সৈনিকদেরও মৃত্যু গুলির আঘাতে নয় হৃদরোগেই হতো।
আবার দেখা গেছে, আর্টারির ৮৫% বন্ধ অবস্থা নিয়েও একজন ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিয়েছে; ওদিকে একেবারে পরিষ্কার আর্টারি নিয়েও অপর একজন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। ৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোর ডা. মেয়ার ফ্রেডম্যান এবং ডা. রে রোজেনম্যান দীর্ঘ গবেষণার পর দেখান যে, হৃদরোগের সাথে অস্থিরচিত্ততা, বিদ্বেষ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি বা জীবনপদ্ধতির সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে।
বাইপাস সার্জারি, এনজিওপ্লাস্টি ও ওষুধই দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগীদের একমাত্র চিকিৎসা হিসেবে প্রচলিত ছিল। ডাক্তাররা বলতেন, আর্টারি একবার ব্লক হওয়া শুরু করলে বাইপাস সার্জারি বা এনজিওপ্লাস্টি ছাড়া কোনো পথ নেই। অথচ অস্ত্রোপচারের পর রোগী যখন পুরনো জীবন অভ্যাসে ফিরে যায়, সে আবারও আক্রান্ত হয় ব্লকেজসহ হৃদযন্ত্রের নানা জটিলতায়। জরিপে দেখা গেছে, অপারেশনের পরও প্রতি ২০ জনের ১ জন রোগীর আবার হার্ট অ্যাটাক হয় এবং স্ট্রোক হয় ৪০ জনে ১ জনের। বিশেষ করে রোগীর বয়স যত বেশি হয় বাঁচানোর সম্ভাবনাও তত কমে যায়। দ্বিতীয়বার বাইপাস করানো মানে ঝুঁকির পরিমাণ ১০% থেকে ২০% বেড়ে যাওয়া। অপারেশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং বিপুল ব্যয়ভারের কথাতো বলাই বাহুল্য। প্রতিবছর আমেরিকায় শুধুমাত্র বাইপাস সার্জারির জন্যেই ব্যয় হয় ২,৬০০ কোটি টাকা।
অথচ খাদ্যাভাস এবং জীবনযাপন পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে এর চেয়ে অনেক ভালো ফল পাওয়া গেছে বিশেষজ্ঞদের অভিজ্ঞতায়। এ বিষয়ে গবেষণায় নেতৃত্ব দেন ক্যালিফোর্নিয়ার কার্ডিওলজিস্ট ড. ডীন অরনিশ। যোগগুরু সৎ সচ্চিদানন্দের যোগ, ধ্যান এবং নিরামিষ ভোজনের জীবনদর্শনে প্রভাবিত হয়ে হৃদরোগের ক্ষেত্রে এর ভূমিকা নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। তিনি প্রথম ১৯৮৭ সালে ৪০ জন গুরুতর হৃদরোগীকে একবছর ধরে মেডিটেশন, যোগ ব্যায়াম ও কম কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার গ্রহণ করানোর মাধ্যমে হৃদরোগ থেকে মুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্রে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় এটি প্রথম পৃষ্ঠার খবর হিসেবে প্রকাশিত হয় সে বছর। তাঁর বিখ্যাত বই প্রোগ্রাম ফর রিভার্সিং হার্ট ডিজিজ বেস্ট সেলার গ্রন্থে রূপান্তরিত হয়। ওষুধ ও সার্জারি ছাড়া যে হৃদরোগ নিরাময় করা যায়, এটা তিনিই প্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করেন।
সাপ্তাহিক নিউজ উইক-এর জুলাই ২৪, ১৯৯৫ সংখ্যায় হৃদরোগ নিরাময়ে তাঁর অসাধারণ সাফল্যের বিবরণ দিতে গিয়ে গোয়িং মেইনস্ট্রিম নিবন্ধে বলা হয়, ওমাহার একটি বড় বীমা কোম্পানি ২০০ হৃদরোগীকে ডা. ডীন অরনিশের বছরব্যাপী হৃদরোগ নিরাময় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। কারণ বাইপাস সার্জারিতে যেখানে ৫০ হাজার ডলার খরচ পড়ে, সেখানে অরনিশের বছরব্যাপী কার্যক্রমে অংশগ্রহণের খরচ হচ্ছে সাড়ে ৭ হাজার ডলার। ২ শত রোগীর মধ্যে ১৯০ জন এ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ অব্যাহত রাখেন। একবছরে ১৯০ জনের মধ্যে ১৮৯ জন সুস্থ হয়ে যান। মাত্র একজন রোগীর অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়।
এই অভাবনীয় সাফল্যের ফলে আরো ৪০টি বীমা কোম্পানি অরনিশের কার্যক্রমে রোগীদের উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেছে; আর সারা দেশ থেকে হাসপাতালগুলো ডাক্তারদের টিম অরনিশের কাছে পাঠাচ্ছে এ প্রক্রিয়া শেখানোর ট্রেনিং নিতে। কারণ এ প্রক্রিয়ায় যে শুধু অপারেশনের খরচ বাঁচে তা-ই নয়, বরং অপারেশনের পর রোগীকে যে সারাজীবন ওষুধ খেতে হয়, সে ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ব্যয় থেকেও রোগী অব্যাহতি লাভ করে। হৃদরোগ নিরাময়ে অরনিশের প্রক্রিয়া এত ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে যে, একে আর বিকল্প চিকিৎসা বলা যায় না, বলতে হয় চিকিৎসার মূলধারায় এর অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে।
কোলেস্টেরল হার্ট অ্যাটাকের প্রাথমিক কারণ। মেডিটেশন অস্বাভাবিক বেশি কোলেস্টেরল মাত্রাকে কমিয়ে আনতে পারে। রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল আর্টারি ব্লক হওয়ার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আপাতত মনে হতে পারে যে, মন কীভাবে রক্তে কোলেস্টেরল প্রবাহকে নিয়ন্ত্রিত করবে! কারণ রক্তের কোলেস্টেরল খাবার, বয়স, হেরিডিটি, হজম ক্ষমতা এবং লিভারের কার্যক্রমের এক জটিল প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রিত হয়।
১৯৭৯ সালে দুজন গবেষক এম জে কুপার এবং এম এম আইজেন ২৩ জন উচ্চ কোলেস্টেরল রোগীকে নির্বাচিত করেন। এদের মধ্যে ২২ জনকে মেডিটেশন শেখানো হয় এবং ১১ মাস তারা নিয়মিত মেডিটেশন করেন। অবশিষ্ট ১ জন মেডিটেশন করেন নি। ১১ মাস পর দেখা যায় যে, মেডিটেশনকারী গ্রুপের কোলেস্টেরল উল্লেখযোগ্য পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। গড়ে ২৫৫ থেকে ২২৫-এ নেমে এসেছে। আমেরিকায় ২২০ মাত্রাকে স্বভাবিক গড় মাত্রা ধরা হয়।
মেডিকেল কলেজ অফ জর্জিয়ার ফিজিওলজিস্ট ডা. বার্নেস ১১১ জন তরুণ স্বেচ্ছাসেবীর ওপর এক গবেষণা চালান। এদের মধ্যে ৫৭ জনকে মেডিটেশন করানো হয়, বাকিদের শুধু স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্যাদি শেখানো হয়।
৮ মাস পর দেখা যায় ১ম গ্রুপের সদস্যদের রক্তবাহী নালীর সংকোচন-সম্প্রসারণ ক্ষমতা বেড়েছে ২১% যা হৃৎপিণ্ডের সুস্থতার একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। কারণ এনডোথিলিয়াম নামের রক্তনালীর আবরণের এই অসুবিধা থেকেই অল্পবয়সে একজন মানুষের শরীরে শুরু হয় হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রক্রিয়া। অন্যদিকে ২য় গ্রুপের এ ক্ষমতা কমেছে ৪%। বয়স বাড়লে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও ১ম গ্রুপের ক্ষেত্রে কমেছে। ডা. বার্নেস বলেন, লিপিড কমানোর ওষুধ ব্যবহার করে যে ফল আগে পাওয়া যেত তা-ই পাওয়া যাচ্ছে মেডিটেশনে। ২০০৭ সালে আমেরিকান সাইকোসোমাটিক সোসাইটির বার্ষিক কনফারেন্সে এ রিপোর্টটি পেশ করা হয়।
১৯৮৭ সালে গবেষক ডা. ডেভিড ওরমে জনসন এক ব্যাপক নিরীক্ষা চালান। তার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যারা মেডিটেশন করেন, তাদের ডাক্তারের কাছে পরামর্শ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। আমেরিকায় জীবন সংহারক মারাত্মক দুটি ব্যাধি হচ্ছে হৃদরোগ এবং ক্যান্সার। ড. জনসনের সমীক্ষায় দেখা যায়, যারা মেডিটেশন করেন তাদের মধ্যে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক অনেক কম। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির পরিমাণ হচ্ছে ৮৭.৩ শতাংশ কম।
১৯৯৬ সালে প্রফেসর লিনডেন, স্টসেল এবং মরিস হৃদরোগের ওপর মেডিটেশনের কার্যকারিতা সংক্রান্ত ২৩টি গবেষণা রিপোর্টের ফলাফল বিশ্লেষণ করেন। এতে তারা দেখেন, প্রতিটি গবেষণাই নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছে মেডিটেশন হৃদরোগ প্রতিরোধের একটি কার্যকরী প্রক্রিয়া। প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থার সঙ্গে নিয়মিত মেডিটেশন হার্ট-এটাকে মৃত্যুর হার কমায় ৪১ শতাংশ এবং পুনরায় হার্ট-এটাক হওয়ার সম্ভাবনাকে কমায় ৪৬ শতাংশ।
দুর্বল হৃদপিণ্ডের কারণে শরীরের নানা সমস্যায় আক্রান্ত হন যে রোগীরা তাদেরকে বলা হয় কনজেস্টিভ হার্ট ফেইলিওরের রোগী। বছর দশেক আগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত মেডিটেশন করে এ রোগীরা তাদের শারীরিক অবস্থার প্রভুত উন্নতি ঘটিয়েছেন।
গড় বয়স ৬৪ এবং সম্প্রতি কনজেস্টিভ হার্ট ফেইলিওরের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এমন ২৩ জন রোগীকে নিয়ে একটা পরীক্ষা করলেন পেনসিলভ্যানিয়া ইউনিভার্সিটির স্কুল অব মেডিসিনের একদল গবেষক। রোগীদের কয়েকজনকে ৩ মাস, কয়েকজনকে ৬ মাস মেডিটেশন করানো হলো। এরপর তাদেরকে বলা হলো সিক্স মিনিট ওয়াকটেস্ট নামে একটা পরীক্ষায় দাঁড়ানোর জন্যে। দেখা গেল যারা কিছুই করেন নি, তাদের তুলনায় সিক্স মিনিট ওয়াকটেস্টে এরা অনেক ভালো করেছেন।
মেডিটেশন : হৃদরোগের প্রতিরোধ
নানা গবেষণার মাধ্যমে এটা এখন এক প্রমাণিত সত্য যে, মেডিটেশন হৃদরোগের নিরাময়ে যেমন, তেমনি প্রতিরোধেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। মেডিকেল কলেজ অব জর্জিয়ার ফিজিওলজিস্ট ড. বার্নেস ১১১ জন তরুণ সেচ্ছাসেবীর ওপর এক গবেষণা চালান। এদের মধ্যে ৫৭ জনকে মেডিটেশন করানো হয়, বাকিদের শুধু স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্যাদি শেখানো হয়। ৮ মাস পর দেখা যায়, ১ম গ্রুপের সদস্যদের রক্তবাহী নালীর সংকোচন-সম্প্রসারণ ক্ষমতা বেড়েছে ২১% যা হৃদপিণ্ডের সুস্থতার একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। কারণ এনডোথিলিয়াম নামের রক্তনালীর আবরণের এ অসুবিধা থেকেই অল্পবয়সে একজন মানুষের শরীরেও শুরু হয় হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রক্রিয়া। অন্যদিকে ২য় গ্রুপের এ ক্ষমতা কমেছে ৪%। বয়স বাড়লে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও ১ম গ্রুপের ক্ষেত্রে কমেছে। ড. বার্নেস বলেন, লিপিড কমানোর ওষুধ ব্যবহার করে যে ফল আগে পাওয়া যেত তাই পাওয়া যাচ্ছে মেডিটেশনে। ২০০৭ সালে আমেরিকান সাইকোসোমাটিক সোসাইটির বার্ষিক কনফারেন্সে এ রিপোর্টটি পেশ করা হয়।
২০০৪ সালে আমেরিকার জার্নাল অফ হাইপারটেনশন-এ ১৫৬ জন স্বেচ্ছাসেবীর ওপর ৩ মাস ধরে চালানো গবেষণার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায় প্রেশার কমানোর জন্যে যারা খাবার বা ব্যায়ামনির্ভর চর্চা করেছে এবং যারা কিছুই করে নি এ দুই গ্রুপের তুলনায় যারা মেডিটেশন করেছে তাদের সিস্টোলিক এবং ডায়াস্টলিক দুটোই উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
মেডিটেশন অস্বাভাবিক বেশি কোলেস্টেরল মাত্রাকে কমিয়ে আনতে পারে। কোলেস্টেরল হার্ট-এটাকের প্রাথমিক কারণ। রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল আর্টারি ব্লক হওয়ার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আপাতত মনে হতে পারে যে, মন কীভাবে রক্তে কোলেস্টেরল প্রবাহকে নিয়ন্ত্রিত করবে! কারণ রক্তের কোলেস্টেরল খাবার, বয়স, হেরিডিটি, হজম ক্ষমতা এবং লিভারের কার্যক্রমের এক জটিল প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রিত হয়।

আজ ২১মে ২০২১। আজ সারা পৃথিবীতে মেডিটেশনকে যারা ভালবাসেন, মেডিটেশন যারা চর্চা করেন, তাদের জন্যে একটি আনন্দের দিন। আজ বিশ্ব মেডিটেশন দিবস। আমাদের জন্যে আরো আনন্দের এজন্যে যে, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এই দিবসটি উদযাপন করছে।

মেডিটেশন দিবসটির সূত্রপাত যেভাবে? বিশ্ব মেডিটেশন দিবস পালনের ইতিহাস পৃথিবীতে খুব দীর্ঘ নয়। বৃটেন সহ কিছু দেশে কিছু ছোট সংগঠন এটি আয়োজন করে আসছে। বৃটিশ নাগরিক উইল উইলিয়ামস এর প্রধান উদ্যোক্তা। যিনি একসময় নিদ্রাহীনতার রোগে ভুগতেন। তিনি মাত্র এক দশক ধরে মেডিটেশন চর্চা করছেন। ছোট পরিসরে এবং ক্ষুদ্র সংগঠনিক প্রেক্ষাপটে এ দিনটি বিশ্বের কিছু জায়গায় পালিত হয়। বাংলাদেশে দিবসটি এবারই প্রথমবারের মতো পালিত হচ্ছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে। সে হিসেবে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন একটি যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করছে এবং এ সুযোগ দানের জন্যে আমরা পরম করুণাময়ের কাছে গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।বাংলাদেশে গত প্রায় তিন দশক ধরে মেডিটেশনকে জনপ্রিয় করা শুধু নয়, একে সংস্কৃতির অংশে পরিণত করেছে কোয়ান্টাম। আজকে আমাদের অন্যতম কার্যক্রম ছিল সকাল ৯.৩০ মিনিটে মেডিটেশন। বিশ্বের যে প্রান্তেই আমরা থাকি না কেন, বাংলাদেশ সময়ের সাথে মিলিয়ে আজকে সকাল ৯.৩০ মিনিটে আমরা বিশেষ ধ্যানে নিমগ্ন হয়েছি।

২১ মে ২০২১ মে ডিটেশন দিবসের বাণী : এবার মেডিটেশন দিবসে আমাদের বাণী খুব সহজ, খুব সরল। নিয়মিত মেডিটেশন, সুস্থ সফল সুখী জীবন।
জীবন একটাই। জীবনের চাওয়াগুলো উঠে এসেছে এই বাণীতে। আমরা প্রথমত চাই সুস্থতা। সুস্থতার কী গুরুত্ব করোনাকালে আমরা ভালোভাবে উপলব্ধি করেছি। চাই সফলতা। আমরা চাই সুখ।এ প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে পড়ল, এক লোক গিয়ে হাজির এক বুজুর্গের কাছে। সে শুনেছে যে বুজুর্গ খুব আল্লাহওয়ালা বান্দা। তিনি যার জন্যে যে দোয়া করেন, সেটি আল্লাহ কবুল করেন। লোকটি দীর্ঘদিন বুজুর্গের সাথে ছায়াসঙ্গীর মতো লেগে রইল। একদিন সুযোগ বুঝে সে বলল, হুজুর আমার একটা আর্জি আছে, আমার জন্যে আল্লাহর কাছে যদি দোয়া করতেন।
বুজুর্গ বললেন, শুধু একটা আর্জিই করতে পার। লোকটি বলল, না না হুজুর, আমার একটিই চাওয়া। আর তা হলো, সাত মহলা বাড়িতে, নাতি-নাতনি, পোতা-পুতি পরিবেষ্টিত অবস্থায় তৃপ্তির সাথে মারা যেতে চাই। বুজুর্গ বললেন যে, আর বাকি রাখলে কী! কারণ সাত মহলা বাড়িতে থাকা মানে কী? ধনাঢ্য জীবন।নাতি-পুতি পরিবেষ্টিত থাকা মানে কী? দীর্ঘ জীবন ও সুস্থ জীবন। তারপরে তৃপ্তির সাথে মারা যেতে চাওয়া মানে কী?সুখী একটি জীবন। আসলেই তো, বাকি থাকল আর কী। অথচ লোকটি বলেছিল তার একটিই চাওয়া। লোকটি বুদ্ধিমান ছিল, তাই তার চাওয়াকে এক বাক্যে তুলে ধরতে পেরেছে।
আমরাও পরম করুণাময়ের অনুগ্রহে বেশ বুদ্ধিমান। সেইসাথে মেডিটেশন চর্চা করায় আমাদের বুদ্ধির বিকাশ আরো সুন্দর হচ্ছে দিনকে দিন। একাধিক গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, মেডিটেশন মানুষের ব্রেনেরতৎপরতাবাড়ায়, তারবুদ্ধিমত্তা, সিদ্ধান্তগ্রহণক্ষমতাকেবাড়ায়।সেই বুদ্ধিমান লোকের মতো তাই আমরা যারা বুদ্ধিমান আছি, আমাদের চাওয়াও একটি। তা হলো-নিয়মিত মেডিটেশন, সুস্থ সফল সুখী জীবন।

মেডিটেশনকীওকেন? মেডিটেশন হলো মন ও ব্রেনকে সুপরিকল্পিত ও সুনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার করার একটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া। এটিকে মনের ব্যায়াম বলতে পারেন। মনের যত্ন নেয়ার একটি প্রক্রিয়াও বলতে পারেন। কারণ যেটুকু সময় আমরা মেডিটেশন করি, সেটুকু সময় আমরা নিজের মনের সাথে সুন্দর একটি সময় কাটাই। এই সময়ে মনের কোনো ক্ষত যেমন দুঃখ, হতাশা, অনুশোচনা থাকলে তা সারানোর চেষ্টা করি; মনে কোনো আবর্জনা যেমন রাগ ক্ষোভ থাকলে তা পরিষ্কার করি। একটি ঘরকে যেমন নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হয় নতুবা বসবাসের উপযোগী থাকে না। ঠিক তেমনি মনকে প্রতিদিন পরিচ্ছন্ন করতে হয়। কারণ প্রতিদিন নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে মনের ভেতরে রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণা জমতে থাকে। যা পুঞ্জিভূত হয়ে একদিকেযেমন রোগ-ব্যাধির সৃষ্টি করে, অন্যদিকে প্রশান্তি ও সাফল্য অর্জনকে বিঘ্নিত করে। এই মনকে স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন করে মেডিটেশন।
বর্তমান সময়ের যুগযন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যেও মেডিটেশনের প্রাসঙ্গিকতা আরো বেশি। পণ্য আগ্রাসন ও অসুস্থ প্রতিযোগিতার মুখে আমরা ইদানীং নিজেকে হারাতে বসেছি। ক্রমাগত চাওয়া-পাওয়ার এক নিদ্রাহীন প্রতিযোগিতা আমাদেরকে ক্লান্ত, বিমর্ষ ও হতাশ করে দিচ্ছে। নিজের দিকে তাকাতে আমরা ভুলে গেছি।মেডিটেশন নিজের দিকে তাকাতে, নিজেকে ভালবাসতে ও নিজের প্রতি মনোযোগী হতে শেখায়।

কেন সুস্থ সফল সুখী জীবনের জন্যে আমরা মেডিটেশনের সহযোগিতা নিচ্ছি? বাবাশিবানন্দ। বিশ্বের প্রবীণতম মানুষ। বয়স ১২৫বছর হলেও শারীরিক অবস্থা ৪০/৫০ বছর বয়সী মানুষের মতো! রক্তচাপ, সুগার ও কোলেস্টেরল স্বাভাবিক। হার্ট, কিডনি, লিভার-সবই ঠিকঠাক। চশমা ছাড়াই পরিষ্কার দেখতে পান। স্মৃতি শক্তি এখনো তীক্ষ্ণ। এই অবিশ্বাস্য সুস্থতার অন্যতম কারণ প্রাণায়াম-যোগ-ধ্যান চর্চা।
ম্যাথিউ রিকার্ড।৭৫ বছর বয়সী এই ধ্যানীকে বলা হয় সবচেয়ে সুখী মানুষ। গবেষণায় দেখা গেছে, মেডিটেশন কালে তার মস্তিষ্কের বামপ্রি-ফ্রন্টালকরটেক্স তৎপর হয়ে ওঠে। এতে অবিশ্বাস্য রকম ভাবে বাড়ে সুখ অনুভবের মাত্রা। তার সুখীজীবনের নেপথ্যে রয়েছে সাড়ে তিন দশকের মেডিটেশন চর্চা-গবেষকদের অভিমত এটি।
জাতীয় অধ্যাপক প্রয়াত ডা. এম আর খান। বাংলাদেশে শিশু চিকিৎসার সূচনা ও বিকাশে তিনি ছিলেন একজন কিংবদন্তী। কোয়ান্টাম মেথড কোর্সের ৩২৮ ব্যাচে পর্যবেক্ষক হিসেবে তিনি অংশ নেন। চারটি দিন ৪০ ঘণ্টার পুরোটা সময় তিনি কোর্সে ছিলেন। বছরখানেক পরে ৩৪৩ তম ব্যাচে তিনি কোর্সটি রিপিট করেন এবং পুরো চারদিন। কোর্সে অংশ নেয়া কতটা জরুরি সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চিকিৎসাবিজ্ঞানের মানুষ হিসেবে আমি জানি, আমাদের মস্তিষ্কে যে লক্ষ কোটি নিউরোন রয়েছে, তার অধিকাংশই আমরা ব্যবহার করি না। কিন্তু এগুলোকে কীভাবে উজ্জীবিত করতে হয়, কাজে লাগাতে হয় কোর্সের বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনায় তা বলে দেয়া হয়।
অর্থাৎ এই তিন ধ্যানী ব্যক্তিত্বের উদাহরণের মধ্য দিয়েই আমরা বুঝতে পারছি যে সুস্থতা, সুখ ও সাফল্যের অধিকারী হওয়ার জন্যেমেডিটেশন কতটা জরুরি। মেডিটেশন করলে শতকরা ৭৫ ভাগ মনোদৈহিক রোগ থেকে যে-কেউ মুক্ত থাকতে পারবেন কোনোরকম ওষুধ ছাড়াই। কারণ মন ভালো তো সব ভালো। আর মেডিটেশন মনকে ভালো রাখে, ফলে শরীরটাও ভালো থাকে। এজন্যে যিনি মেডিটেশন করেন না তারচেয়ে যিনি মেডিটেশন করেন তার সুস্থ থাকার ক্ষমতা চার গুণ বেশি।

শুধু সমস্যা থাকলেই মেডিটেশন করতে হবে-এটা ভুল ধারণা : বরং সফল মানুষরা মেডিটেশন করেন। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিল্পপতিরা মেডিটেশন করেন। রাষ্ট্রনায়ক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, প্রশাসকরা করেন। কেন করেন? প্রশান্তির জন্যে, মস্তিষ্ককে আরো বেশি ব্যবহার করার জন্যে। আমেরিকায় মেডিটেশন কারীদের দলে নামলিখিয়েছেন ফোর্ডমটরসের প্রধান ধনকুবের বিলফোর্ড, সাবেক মার্কিন ভাইসপ্রেসিডেন্ট আলগোর দম্পতি, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারীক্লিনটন এবং হলিউডের নামি-দামি সব শোবিজ তারকা। তাদেরতোঅর্থ, খ্যাতি, ক্ষমতাকোনোকিছুরঅভাবনেই। তারপরও কেন মেডিটেশন করেন? প্রশান্তিরজন্যে। এইব্রেনটাকে আরো সুন্দরভাবে কাজেলাগানোরজন্যে, আরোসফলহওয়ারজন্যে। ১৯৯৩সাল থেকে কোয়ান্টাম মেথডকোর্সে অংশনিয়েছেন দেশেরবরেণ্য চিকিৎসা বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, সমাজতাত্ত্বিক, ধর্মবেত্তা, কবি, লেখক, শিল্পীসহ সফল ব্যবসায়ী, সমাজপতি ও শোবিজস্টার। তারাও মেডিটেশন করছেন প্রশান্তির জন্যে, সফল হওয়ার জন্যে।

একজন ধ্যানীর মধ্যে রাগ, বিরক্তি বা একঘেয়েমি কাজ করে না : মেডিটেশন ব্রেনের এমিগডালা অংশের তৎপরতাকে নিয়ন্ত্রণ করে ব্যক্তির আবেগকে সংহত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। কারো কোনো নেতিকথা, নেতি আচরণ, নেতি ঘটনা সেই ধ্যানীর প্রশান্তিকে, আনন্দকে, মনের সুখকে কেড়ে নিতে পারে না। যে কারণে মেডিটেশনচর্চাকারীদের টেনশনকরারপ্রবণতাকম, রেগে যাওয়ার বা ক্ষুব্ধ হওয়ার প্রবণতা কম থাকে। একঅফিসে কোয়ান্টামের একজন কর্মী গিয়েছিলেন একটি কাজে। সে অফিসের যে কর্মকর্তার কাছে গেছেন, তিনি সেবা দেয়ার বদলে অনর্গল ঝাড়ি (ঝাড়ি বুঝি তো আমরা, বকাবকি) দিতে লাগলেন। একতরফা বকাবকি করে ক্লান্ত হয়ে যখন তিনি থামলেন, তখন কোয়ান্টামের সেই কর্মী প্রশান্ত চেহারা নিয়ে শুনছেন। তখন সেই অফিস কর্মকর্তা বললেন, আমি আসলে পরীক্ষা নিচ্ছিলাম আপনার। আপনারা কোয়ান্টামের মানুষরাই তো বলেন, রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। তাই টেস্ট করলাম আপনি রেগে যান কিনা! যাক্, পরীক্ষায় আপনি পাস করেছেন। আসলে একজন ধ্যানী যেভাবে নিজের রাগ-ক্ষোভকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, ছ্যাত করে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠা থেকে বিরত রাখতে পারেন নিজেকে, তা সত্যিই চমৎকার। ধ্যানীরা প্রো-অ্যাক্ট করেন সবসময় অর্থাৎ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সর্বোত্তম করণীয় করার চেষ্টা করেন।

প্রতিটি মহান ধর্মে মেডিটেশন সম্পর্কে কী বলা হয়েছে? পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, (হে নবী!) ওদের বলো, আমি তোমাদের একটিমাত্র পরামর্শ দিচ্ছি, এককভাবে বা যৌথভাবে আল্লাহর সামনে সচেতন হয়ে দাঁড়াও। নিজের গভীরে ধ্যানে নিমগ্ন হও। (৩৪:৪৬)।
প্রিয়নবী (স) বলেছেন, একঘণ্টার ধ্যান ৭০ বছরের নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম-আবু হুরায়রা (রা); সহিহ আল জামে উস সগীর, ইবনে হিব্বান।
পবিত্র বেদ-এ আছে, যোগ-ধ্যানের মাধ্যমেই আমরা অর্জন করি জ্ঞান, সৌন্দর্য ও ক্ষমতা-যজুর্বেদ ১১.২।
পবিত্র ধম্মপদে আছে, উচ্ছৃঙ্খল ও মূর্খ ব্যক্তির শত বছরের জীবনের চেয়ে প্রাজ্ঞ ও ধ্যানীর একদিনের জীবন উত্তম-সহস্‌সবগ্‌গো ১১১।
পবিত্র বাইবেলে আছে, সদাপ্রভুর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যখন আমি ধ্যানমগ্ন হই, তখন আমি মহানন্দে বিরাজ করি-গীতসংহিতা ১০৪ : ৩৪।

এজন্যে মেডিটেশন করতে হবে প্রতিদিন : প্রতিদিন দুবেলা করতে পারলে বেশ ভালো। তা না পারলে দিনে অন্তত একবার, তিরিশ মিনিট সময় ধরে করা প্রয়োজন। বিশেষ করে সকালে ঘুম ভাঙার পরে, দিনের কাজ শুরুর আগে। তখন মনকে কথা শোনানো সুন্দর হয়। একটি নতুন দিন যে আমরা পেয়েছি প্রভুর কাছ থেকে, তা সুন্দরভাবে কাজে লাগানোর জন্যেই এই মেডিটেশন করা। মেডিটেশনে মনের বাড়িতে গিয়ে সকালে কী কাজ করব, কার সাথে দেখা করব, কোন কাজ কতটুকু এগিয়ে নেবো, কাকে ফোন করব, কার সাথে কী কথা সেরে নেবো ইত্যাদিরএকটি ছক বা কাজের তালিকা করে ফেলতে পারি। একইভাবে দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা ও রাতের পরিকল্পনা আমরা করে ফেলার সুযোগ পাই মেডিটেশনে। এতে করে কী হয়! কাজগুলো নিয়ে মনে মনে চিন্তা করতে করতে আমরা মানসিকভাবে কাজের সাথে একাত্ম হয়ে যাই। তারপর বাস্তবে যখন কাজগুলো করতে যাই, তখন দেখা যায় যে, কাজে মনোযোগ বেড়ে গেছে, কাজের প্রতি টান বাড়ছে। কাজটা শেষ পর্যন্ত সুন্দরভাবে করা যাচ্ছে। কোয়ান্টাম মেথড কোর্স করার আগে যে পড়া পড়তে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যেত এখন তা অপেক্ষাকৃত অনেক কম সময়ে সম্পন্ন করতে পারছে শিক্ষার্থীরা। কোর্সে এসে নামাজে মনোযোগী হতে পেরেছেন, নামাজ পড়ে তৃপ্তিপেয়েছেন এমন অনেক অনুভূতিও আছে। কেউ যদি দিনে দুবেলা আধা ঘণ্টা করে মোট এক ঘণ্টা মেডিটেশন করেন, তাহলে দিনের ২৩ ঘণ্টাকে আরো সুপরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাতে পারবেন। তা না হলে তার কাজগুলো জট পাকাতে থাকবে, কাজের ফসল তিনি ঘরে তুলতে পারবেন না।

মেডিটেশনের নানা উপকার নিয়ে কোয়ান্টামের দুটো প্রকাশনা : আমাদের সবার কাছেই এই মেডিটেশন বুলেটিনটি আছে। আমরা পড়েছি। এর দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় দেখুন, একটি আশার কথা, একটি প্রার্থনা ব্যক্ত করা হয়েছে। সেটি হচ্ছে সুস্থ থাকুক, দেহ-মন। কখন সুস্থ থাকবে দেহ? কখন ভালো থাকবে মন? যখন সঙ্গী হবে মেডিটেশন। দেহ ও মনকে সুস্থ রাখার ক্ষেত্রে মেডিটেশনের ১৫টি গুরুত্বপূর্ণ অবদান এখানে তুলে ধরা হয়েছে।

মেডিটেশনের উপকার পাবেন চর্চাকারী সবাই : শিশু থেকে শুরু করে ৮০ বছর বয়সী, যে-কেউ মেডিটেশন করে উপকৃত হতে পারে। মেডিটেশনে সময় ব্যয় করা হচ্ছে ফলপ্রসূ সময় ব্যয়। এজন্যে আধঘণ্টার জন্যে বসে যান। অডিও প্লে করে দিন। দুচোখ হালকাভাবে বন্ধ করুন, যেভাবে ধীরে ধীরে দম নিতে ও ছাড়তে বলা হয়েছে নিন। যা যা মনের চোখে দেখতে বলা হচ্ছে তা দেখার চেষ্টা করুন, তবে জোর করে দেখার দরকার নেই। কানে শুনলেও অবলোকন হয়ে যায়। এজন্যে প্রথমদিকে অডিও দিয়ে করা ভালো। এতে লেভেলটা সুন্দর হয়। যখন অভ্যস্ত হয়ে যাবো, তখন অডিও ছাড়াও করা যাবে।
শুধু দমটা ধীরে নেবেন। দম যত ধীর হবে, দেহ তত স্থির হবে। মনটাও ধীরে ধীরে প্রশান্ত হতে শুরু করবে। তারপর সেই প্রশান্ত মনটাকে আমরা যে কথা শোনাবো, যেটাকে আমরা অটোসাজেশন বলি, সে কথাগুলো মনে গেঁথে যাবে। মন তখন সেই কথা অনুসারে ব্রেনকে কাজ করতে নির্দেশনা দেবে। মনকে যদি শোনাই সুস্থ সুস্থ, মন সুস্থ থাকার জন্যে যাবতীয় নির্দেশনা দেবে ব্রেনের মাধ্যমে পুরো শরীরকে। কারণ এত শক্তিশালী যে ব্রেন আমাদের, তাকে চালায় মন। মনকে তখন আমরা যে ছবি দেখাবো, যেটাকে আমরা মনছবি বলছি, সে ছবি অনুসারে ব্রেন কাজ শুরু করবে। যেভাবে ক্লাস সিক্সে পড়ুয়া অবস্থায় কোয়ান্টাম মেথড কোর্সে এসে ড. রুবাব মো. ইমরোজ খান সৌরভ তার মনকে বলেছিলেন যে, আমি অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট হবো, ব্রেন তাকে সাহায্য করেছিল পরবর্তীতে একজন সফল অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট হতে। ড. রুবাবের ভিডিও সাক্ষাতকারটি আছে কোয়ান্টাম ওয়েবসাইটে, ইউটিউবে, চাইলে দেখে নিতে পারি।

মেডিটেশন মনের জট খুলতে সাহায্য করে: আসলে আমাদের সকল সমস্যা শুরু হয় মন থেকে। একজন সফল বিশ্বাস করেন, আমি পারব। আর একজন ব্যর্থ সন্দেহে ভোগেন, আমি কি পারব? এক শিক্ষার্থী, যে কোনোদিন গণিতে ৭৫-এর বেশি পায় নি, সে কোয়ান্টাম মেথড কোর্স করার দু মাসের মাথায় এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে সাধারণ গণিতে পেল ৯৭ আর উচ্চতর গণিতে পেল ৯৮। কেন? কীভাবে? কোর্সের আলোচনা তার মাঝে এই উপলব্ধি এনে দিয়েছিল যে, আমি যা চাই, আমি তা পাবো এবং পাওয়ার জন্যে যা করতে হয় আমি তা করব। যে কারণে কোর্স শেষ করার পরদিন থেকে প্রতিদিন শিথিলায়ন মেডিটেশন ছিল তার রুটিনে আর ছিল হাতে লিখে লিখে গণিত অনুশীলনের কাজ। মেডিটেশন আর অনুশীলন তার গণিত পরীক্ষায় খারাপ করার যে মনের জট ছিল দীর্ঘ দশ বছরের স্কুল জীবনে, তা কেটে দিতে সাহায্য করেছিল।
এজন্যেই ১৯৯৩ সাল থেকে কোয়ান্টাম দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে বলেছিল, মেডিটেশনে আসুন, মনের জট খুলে যাবে। যারা এসেছেন, তাদের মনের জট খুলে গেছে। লাখো মানুষের জীবনে এসেছে সাফল্য। জটিল জটিল রোগ থেকে মুক্ত হয়ে সুস্থতা আর প্রাণবন্ততার আনন্দ নিয়ে বাসায় গেছেন। পারিবারিক সামাজিক যত সমস্যা এর মূল কারণও কিন্তু মনের জট। মেডিটেশনের মাধ্যমে মানুষ মমতার ভাষা আয়ত্ত করতে শেখে। যে পরিবারে মেডিটেশন চর্চা হয় সেখানে পরস্পরের বোঝাপড়া ভালো ও হৃদ্যতা বেশি। মেডিটেশন চর্চার মধ্য দিয়েই একজন মানুষ হয়ে উঠতে পারে ভালো মা/ বাবা, একজন ভালো স্বামী/ স্ত্রী, একজন ভালো ভাই/ বোন, একজন ভালো বন্ধু ও একজন ভালো সন্তান।
কীভাবে মনের জট খুলে দেয় মেডিটেশন? সুতো যেমন লাইন করে পেঁচিয়ে রাখলে জট পাকায় না, ঠিক সেভাবে। যখন আমরা কোয়ান্টাম মেডিটেশন করি, আত্মনিমগ্ন হই, তখন মন ধীরে ধীরে সুশৃঙ্খল হয়। মন তখন ঠিক লাইনে আসে। ফলে মনের জটটা খুলে যায়। রোগ শোক নেতিবাচকতা ব্যর্থতা হতাশা অশান্তির বদলে আসে প্রশান্তি, সুস্থতা আর সুখের জোয়ার।তাই আসুন, সবাই মিলে আমরা আজ প্রত্যয়ন করি, একসাথে বলি, নিয়মিত মেডিটেশন করব … সুস্থ সফল সুখী জীবন গড়ব।

কোর্সে আসুন, ভালো থাকুন : আমরা অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, আগামী জুন মাসের ১৮ তারিখ থেকে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ৪৭৫ তম কোয়ান্টাম মেথড কোর্স। ঢাকার আইডিইবি ভবনে অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকায় হলেও সারাদেশ থেকে আগ্রহী যে-কেউ অংশ নিতে পারবেন। ফাউন্ডেশনে পুরুষ ও মহিলাদের পৃথক আবাসনের ব্যবস্থা রয়েছে। আর যারা ঢাকায় আছেন তারা তো কাকরাইলে যাওয়া-আসা করতে পারবেন। কোর্স শুরু হবে সকাল ৯টা থেকে। চলবে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত। সকালে দুপুরে, বিকেলে নামাজ আদায় ও খাবার গ্রহণের বিরতি তো থাকবেই। যারা আমরা কোর্স করব করব বলে ভাবছি, তারা দ্রুত নাম তালিকাভুক্ত করব। যারা কোর্স রিজুভিনেশন মানে রিপিট করব বলে ভাবছি, তারাও দ্রুত নাম তালিকাভুক্ত করব। কারণ আসন সীমিত, শেষ মুহূর্তে যেন ফিরে যেতে না হয়।
আমাদের তো জানা আছে রিজুভিনেশন ফি ১০০০ টাকা, যারা শিক্ষার্থী তাদের জন্যে ৬০০ টাকা। আর প্রথমবারের মতো যারা কোর্সে আসবেন, তাদের জন্যে সাড়ে এগারো হাজার টাকা মাত্র। এ পরিমাণ যে কত কম এই মেডিটেশন বুলেটিনের চতুর্থ পৃষ্ঠাটিমেহেরবানি করে দেখে নেবেন। এখানে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিটেশন কোর্সে কতটুকু শেখানো হচ্ছে আর কত ফি নেয়া হচ্ছে সে বিবরণ আছে। কোয়ান্টামে অবশ্য একটি সুযোগ আছে। সেটি হলো-একবারে পুরো সাড়ে এগারো হাজার টাকা দিতে না পারলেও আমরা কোর্স করার নিয়ত করে কোর্স একাউন্ট খুলে ফেলতে পারি আংশিক টাকা প্রদানের মাধ্যমে। অবশ্য এই সাড়ে এগারো হাজার টাকাটাকে আমরা কখনোই বলি না, কোর্স ফি। এটি আসলে কোয়ান্টাম পরিবারের সাথে আজীবন সংযুক্ত থাকার একটি অনুদান মাত্র। এর মাধ্যমে আমরা যে আইডি কার্ডটি পাব, সেটিই এই কোয়ান্টাম পরিবারে আমাদের সম্মানিত সদস্য হওয়ার পরিচয় বহন করবে।
আজকে যারা সম্মানিত এসোসিয়েট আছেন, তাদেরকে অনুরোধ করব কোর্সটি করুন। তাহলে আপনারা শিখবেন সে বিজ্ঞান যা দিয়ে জীবনকে সুন্দর করা যায় কীভাবে, জীবনে ভুল কত কম করা যায়, জীবনের কাজগুলো কত সহজে করা যায়, জীবনের অঙ্ক কীভাবে মেলানো যায়। ধরুন শরীরের কোথাও সামান্য কেটে গেলে কিছু দুর্বাঘাসনিয়ে মুখের লালা দিয়ে ডলে ক্ষতস্থানে তা দিলে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। সেক্ষেত্রে জানতে তো হবে যে, দুর্বাঘাস দিয়ে এই উপকার হয়। ঠিক তেমনি মেডিটেশন এবং কোয়ান্টাম মেথড কোর্সের মাধ্যমে জীবনকে কীভাবে শান্তিময়, আনন্দময় ও সাফল্যময় করা যায়, তা আমরা জানি। তাই যারা জানেন না, তাদেরকে জানাতে হবে মমতার সাথে। তাই কোর্সে আসার জন্যে অন্তত একজনকে যেন আমরা উদ্বুদ্ধ করি। আর নিয়মিত মেডিটেশন করে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনকে সুস্থ, সফল ও সুখী করি-আজকে বিশ্ব মেডিটেশন দিবসে এটাই হোক আমাদের প্রার্থনা।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge