ইটেরা কি বুঝতে পারে, মানুষের কথা? তাই যদি হয় তবে কতকথা জমা আছে তাদের বুকে। এত কথা বুকে নিয়ে এতগুলো বছর পার করতে কষ্ট হয় না ওদের। মাঝারি গড়নের লাল ইটের বুকে কথা শুনতে কান পাতি। পরিত্যক্ত মন্দিরে নিকষকালো অন্ধকার। গুমোট হাওয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসে। চোখ বন্ধ করে দেখতে পাই পুরোহিত ধুপ চড়িয়েছেন। দেবীর পায়ের কাছে রক্ত জবা আর শ্বেত পদ্ম। পুরোনো হলেই ভুলে যেতে হয় বুঝি? ভুলে যাই তাদের অর্থ কড়ি আর প্রতিপত্তির কথা। মন্দিরের সামনে শতবষী কাঠগোলাপ গাছে শতফুলের মেলা। সুগন্ধ বুঝিয়ে দেয় এখনও পৃথিবীতে ভালোবাসা বিলাতে হয় নিঃস্বার্থভাবে। মন্দিরের সামনে দিয়ে জংলাপথ ধরে হেঁটে যেতে যেতে চোখে পড়ে নাম না জানা ফুল আর পথে পড়ে থাকা পঁচা আম,ক্ষয়ে যাওয়া জীবনের মতো। দেখা উপজাতি যুবতীর সাথে, হামাক বিশ টাকা দে কেনে, সরিষার তেল কিনিম। জানা গেল তার ছেলের মাথায় দিবে। বাড়ি রংপুর মর্ডান। বিয়ে হয়েছে এখানে। সুগঠিত শরীর থেকে চোখ ফিরিয়ে দেখি হাতের ডানে ধ্বসে পড়া বিল্ডিং। সে বলে এটা টাকা রাখার ঘর। হবে হয়তো, কে জানে? সেই টাকা আজ নেই, নেই প্রহরী। বিশ টাকা হাতে দেই। চলে যায় শরীরে হিল্লোল তুলে। নাম জানা হয় না। হবেও না কোনদিন। চাহিদা যে মাত্র বিশ টাকা।
সন্ধ্যা নেমে আসে জমিদার বাড়ির আঙিনায়। চোখে ভাসে ঝাড়বাতির আলো,ধুপের গন্ধ আর কানে আসে তানপুরার সুর। নিক্কন তুলে যে রমনী মনোরঞ্জন করতো জমিদার বাবুর। সে কি আছে আসেপাশে। কি নাম ছিলো তার? তার কষ্টের কথা কাকে বলে সে? দরজা জানলা বিহীন ঘরগুলো দাঁত ছাড়া দৈত্যর মতো। চিকন সিড়ি বেয়ে ঠিক দোতলায়। পাশের কাঠগোলাপ গাছ থেকে ভেসে আসে সুগন্ধে মন কেমন করে ওঠে। রানী কি বিকালে ছাদে উঠে সূর্যাস্ত দেখতো? চুল শুকাতো দুপুর বেলা। রাণীর কানে কি কাঠগোলাপ গুঁজে দিত রাজা? অথচ ইটাকুমারীকে বলা হতো দ্বিতীয় নবদ্বীপ। শিক্ষা সংস্কৃতিতে এগিয়ে ছিল এ অঞ্চল। কত শত পন্ডিতের আবাসস্থল। ইটাকুমারী জমিদার বংশের ৫ম পুরুষ শিবচন্দ্র এ রাজবাড়ি নির্মাণ করেন। ডিমলার রাজা জানকীবল্লভ সেন ১৮৫২- ১৯১০ এ রাজবাড়ির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ফতেহপুর চাকলা ছিল সরকার কোচবিহারের অংশ। মোগল অভিযানের সময় এ চাকলার ছয় আনা অংশের অধিকারী ছিলেন কোচবিহার মহারাজ দপ্তরের একজন কানুনগো নরোত্তম। এই নরোত্তমের হাত ধরেই ইটাকুমারী জমিদার বংশের শুরু। শেষ ঘটি(উপেন্দ্র কুমার) আর মটির (নৃপেন্দ কুমার) হাত ধরে।
যাত্রা শুরু রংপুর টাউনহল থেকে। সাতটা মোটরসাইকেল, এগারো জন ঘর পালানো মানুষ৷ পরে যোগ দেয় বন্ধু মামুন। সব মিলিয়ে মোটে বারো জন। শহর ছেড়ে সরে যেতে থাকি। ফেলে রেখে যাই তালাবন্ধ ঘর৷ পকেটে চাবি। জানি ফিরতে হবে। ফিরতে হয় বলে।
সুমনের বাড়ি সংলগ্ন মাদ্রাসা কাম মসজিদে যাত্রা বিরতি। এক দম দুরত্বে সুমনের বাসা। বাড়ির পাশে পুকুর। সুমন তোমার পুকুরে পদ্ম ফোঁটে? পদ্ম ফোঁটার দিন সাপ আর ভ্রমরের খেলা দেখার জন্য তুমি কি পাড়ে বসে থাকো?
অতিথি সাক্ষাৎ ভগবান বলে না, সুমন এমনিতেই ব্যবস্থা করেছিল অনেক পদের নাস্তা আর ফল। অসুস্থ শরীরে ভাবীর কষ্ট বুঝি। আবারও পথ চলা৷ মেঠো পথের স্থান করে নিয়েছে পিচ ঢালা কালো পথ। সে পথ দখলে গ্রামের কিষাণের। খড় শুকানো,ধান শুকানো। একসময় ছিলো নদী এখন পথ নির্ধারন করে দেয় নগরী। এসব খড়,ধানের কারনে বাড়ছে দূর্ঘটনা। কে কাকে বলবে? সবাই বলে,শোনার কেউ নাই। পথের দুধারে সোনালী ধান আর গাছদের মিতালি। পাওটানা বাজারে অপুর পরিচিত একজন আমাদের পান করিয়ে শান্ত করে। আবারও ছুটে চলা। বাঁধের উপর দিয়ে লক্ষ্য পাওয়ার প্লান্ট। পথে পড়ে আলিবাবা থিম পার্ক। কাজ চলছে,উদ্ধোধনের অপেক্ষায়। বিনোদন পিয়াসি মানুষের তিয়াস মেটাবে এই পার্ক নিশ্চিত। যেখানে পথের শেষ সেখানে থামতে হয়। তিস্তাতে পানি আছে তবে সে পানি কাকচক্ষুর মতো স্বচ্ছ না। তারপরও মজনু, অপু, শাপলা ভাই, শাহিন ভাই, মামুন, জাকির নেমে পড়ে জলকেলিতে। শরীর তো জলই। জলের ডাক অস্বীকার করা বড় কষ্টের। আমি দূর হতে দেখা মানুষ। জলপাড়ের লোক দেখি, দেখি বাদাম ক্ষেত,বাঁধের উপর আইসক্রিম বিক্রেতা, চানাচুর বিক্রেতা আর রঙবেরঙের মানুষ। মানুষ ছাড়া আর কার কাছে যাবে মানুষ?
Leave a Reply