ছমির মিয়া কয়েকদিন থেকে ঘরে খিল লাগিয়ে বসেই আছে। কিন্তু পেটে খিল লাগিয়ে আর কতদিন! এবার তো পেটটার জন্য অন্তত বেরুতেই হয়। কিন্তু যাবেটা কই চারদিক তো বন্ধ, লকডাউন না কি যেন বলে, অত শত বোঝে না ছমির মিয়া। শুধু বোঝে ঘরের বাইরে বের হওয়া নিষেধ, কিন্তু পাশের ঘরে সদ্য রোড এক্সিডেন্টে মারা যাওয়া একমাত্র ছেলেটার বউ আর নতুন বাচ্চাটা। আহারে, ফেরেশতার মতোন বাচ্চাটার কী কান্না! মায়ের বুকের দুধ না পাওয়ার জন্য কান্না নাকি মরা বাপটারে একনজর দেখার জন্য এই কান্না এটা ভাবতে ভাবতেই বুড়োটার মনে হইল, এই যে কয়েকদিন থেকে বাড়িতেই আছে সে, কই মরা বেটাটারে তো তেমন মনে পড়ে নাই। বারবার শুধু মনে পড়েছে আবার কবে বাইরে যাওয়া যাবে রিক্সাটা নিয়ে আবার কবে দুই বেলা ভাত খাওয়া যাবে পেট পুরে! তাহলে ফেরেশতার বাচ্চাটার কান্দন যে দুই ফোঁটা দুধের জন্যই সেটা বুঝতেই বুড়োটার তিনবছরের একটানা কাঁশিতে বুকের পাঁজরটা না ভাঙলেও এবার ভেঙে গুড়োগুড়ো হয়ে গেল।
সব দোষ ওই হারামি বউটার। কত করি কইলাম, এইখনে পড়ি থাকিস না বাপের বাড়ি যা, মুই বুড়া মানুষ তোক আর কদ্দিন খাওয়াইম। না, তার এক কতা সোয়ামির ভিটা ছাড়বার নয়, আর যে শ্বশুরটা বেটির মতোন ভালোবাসে তাক ছাড়িয়া কেমন করি যাইবে।
একন বোঝ হারামি, বোঝ ।
এইসব ভাবতে ভাবতেই একটা অপরাধবোধও বুড়োটাকে কাহিল করে দিলো, যে বউটা এই বুড়োটাকে বাপের মতো ভাবিয়া ঘর ছাড়িল না, তার সমন্ধে এসব কী কইতেছে!
আর বউটারেই বা কী দোষ, সে তো পাশের মেম্বারের বাড়িতে উঠানা কাজ করতেই চেয়েছিল মেম্বারের চরিত্রের কথা ভেবে সায় দেয়নি তো নিজেই। আর বেচারি এই একবেলা দুটো খেয়ে আর কতই বা দুধ দেবে বাচ্চাটাকে, টিপে টিপে আর ক’ফোঁটাই বা বের হয়,বাচ্চাটাও চুষতে চুষতে হয়রান হয়ে কালো হয়ে যায়। পেটে খাবার না পড়লে বুকে দুধ আসে কেমন করে।
এবার ছমির মিয়া ভাবে আর বসে থাকলে চলবে না,বাইর হওয়াই নাগবি অন্তত এই মুখপুড়িটার পেটে দুটো দানার জোগাড়ের জন্য। এমন সময়, মেম্বারের গলা শোনা যায়,
”ও ছমির চাচা,কোনটে বাহে, বাড়িত আচেন?
“হ মেম্বরসাব, আচুং তো বাহে, ক্যান, কী কইবেন কও”
“চাচা, দ্যাশে তো যে রোগ আইলো বাহে, কদ্দিন যে আর কাম কাজ করবার না পান, তার তো ঠিক নাই। তয় চিন্তা করেন না। বউটা কোনটে, ওক একবার মোর কাছোত পাঠান, দ্যাখোং কিছু করা যায় নাকি।”
কথাটা ছমির মিয়ার কানে যেভাবেই ঢুকুক না কেন মাথায় কিন্তু ভালোভাবেই ঢুকেছিল, এসময় হয়তো দৌঁড়ে গিয়ে মেম্বারের জিবটা টান দিয়ে বের করে এনে কয়েকটুকরা করে গরম হাড়িতে সেদ্ধ বসানোর কথা ছিল, কিন্তু কিছুই করলেন না বরং একটা ঢোক গিলে হজম করলেন, দুদিন হইলো পেটটা তো হজম করার মতো তেমন কিছু তাই কথাটাই হজম করতে পেটে পাচার করলেন। আর একটু বুদ্ধি খাটিয়ে কইলেন, ” ও মেম্বার, বউটার তো শরীলটা ভালা না, ছাওয়াটাও একসমানে কানবার নাগছে, তা মুই যাইম এ্যালা, কী কন?’
‘আচ্চা চাচা, আইসেন, শরীল না চললে তো আর কিছু করার নাই, তোমরায় আইসেন, দ্যাকোং কিচু করির পারং কিনা’
এবারের বাক্যটা আরও বিষাক্ত, তবুও হজম করগে হলো ছমির মিয়াকে।
ছমির মিয়া মানুষটা রিক্সা চালিয়ে সংসার চালালে কি হবে এলাকার সবাই তাকে বেশ সম্মান দেয়, আর দেবেই না বা ক্যান সেই যে একটা বেটা জন্মদিয়ে বউটা মরলো, তারপর সেই বেটাটাকে নিয়ে একলা যুদ্ধ, নিজেই মা, নিজেই বাপ, আর কোনো পুরুষ মানুষ হলে দু’মাসও পেরুতো কিনা আর একটা বউ আনতে, কিন্তু ছমির মিয়ার বেলায় একবারে উল্টা। বিয়ে তো করেনি এমনকি তার চরিত্র নিয়ে কেউ কোনদিন টু কথা কইতে পারে নাই। এরপর রিক্সা চালিয়ে সেই ছেলেটাকে বড় করা,পড়ালেখা করানো, খুব বেশিদূর না হোক ডিগ্রিটা যে পড়িয়েছেন, সেটাই বা তার মতো ক’জনে পারে। বুড়োটার যেই একটু সুখের দিন শুরু হলো, ছেলেটার একটা কোম্পানির চাকুরি জোগাড় হলো, একটা ইন্টারপাশ ফুটফুটে মাইয়ার সঙ্গে বিয়াও হলো, কোল জুড়ে একটা চান্দের মতো নাতনি আসলো,মেয়ে জন্মের দিন পনেরোর মাথায় আল্লাহর কী যে ইচ্ছে হলো, রোড এক্সিডেন্ট করে ছেলেটারে কেড়ে নিলো।
ছেলের বউ রাফিয়া ইন্টার পাশ একটা মেয়ে, চাইলে একটা কিছু করতে পারে, করতে পারে কী, করতেও হবে ওকে অন্তত এই বাচ্চাটার জন্য। ওকে বাঁচতে হবে নিজে, বাঁচাতে হবে বাচ্চাটাকে, মানুষ করতে হবে মেয়েটাকে এইসব ভাবনা আছে, তবে এ মুহূর্তে সব ভাবনার মুখে একটা ভয়ঙ্কর কালো মেঘ এসে ভীড় করে বসে থাকে। ভয় হয় রাফিয়ার, ভীষণ ভয় হয়, ভয়ে আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়ে মেয়েটা। একদিকে স্বামীহারা, অন্যদিকে একটা বাচ্চা আছে এমন অবস্থায় কী করবে কী করবে ভেবে হাত পা মাঘের শীতে উদোম গায়ের মতো কেমন ঠাণ্ডা হয়ে আসে, কথা ফোটে না, চোখ মুখ কেমন ফ্যাকাশে লাগে, ঠোঁট জোড়া কেমন শুকিয়ে উপরের চামড়া উঠতে থাকে। এসব ভাবনার মধ্যে ঢুকে বুড়ো বাপটার কথা। মা বাপ হারা রাফিয়ার যখন এ বাড়িতে বিয়ে হলো তখন থেকে সে শ্বশুরকে নিজের বাপ হিসেবেই মানে। আর ছমির মিয়া লোকটাও কী কম মেয়ের মতো দেখে রাফিয়াকে, বরং একটু বেশিই ভালোবাসে মেয়ের চেয়ে, অথবা রাফিয়া কোনদিনই বাপের আদর ভালোবাসা পায়নি বলে মনে হয় নিজের বাবাও হয়তো এর থেকে বেশি ভালোবাসতো না। রাফিয়া মোটামুটি সিদ্ধান্ত পাকা করে নেয়, এই করোনার বন্দিদশা কাটলে সে বুড়ো বাপকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় চলে যাবে, তারপর একটা কাজ জোগাড় হবে নিশ্চয়, অন্তত একটা গার্মেন্টসে কাজ নিশ্চয় জোগাড় হবে তার। বাপের কাছে মেয়েকে রেখে সে করবে চাকুরি। কিন্তু লকডাউনে সে উপায় নেই আপাতত।
করোনার এই সংকটকালে নতুন চাকুরী তো দূরের কথা কত মানুষ চাকুরী হারিয়েছে তার ইয়াত্তা নেই, গাড়ি গাড়ি মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামমুখী হয়েছে আর হবে নাই বা কেন, ঢাকা শহরে কী কাজ ছাড়া, আয় ছাড়া একটা দিনও চলা যায় নাকি, যেখানে পানিটুকু পর্যন্ত কিনে খেতে হয়, সারাদিনে এক জগ পানির জন্য ওয়াসার পানির ট্যাপের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় দীর্ঘ লাইনে। গায়ে গা ঘেষে পিঠের উপর হুমড়ি খেয়ে যেটুকু বা পানি জোটে সেটাও গলায় ঢালা যায় নাকি নিশ্চিন্তে? যায় না। পোকা আর নোংরা ময়লা নিত্য মেশানো থাকে ওতে। কিচ্ছু করার উপায় থাকে না মানুষগুলোর, কোনরকম বস্তির চিপা ঘিঞ্জির মধ্যে ঢুকে পানিটুক ছাকনি দিয়ে চুলায় বসিয়ে বিশুদ্ধ করে খওয়া হয়।
এই তো গেলো পানি, এছাড়া অন্যান্য বাজার তো আছে, এখানে শাকসবজি কোনটার দামই চোখ নামিয়ে কথা বলে না ক্রেতাকে, সে ক্রেতা বস্তিবাসী হোক আর উঁচু বিত্তবানই হোক। তাই কর্মহীন মানুষ বানের জলের মতো ছুটে আসছে গ্রামে। গ্রাম অন্তত অতখানি নিষ্ঠুর হয় না। গ্রাম অন্তত পরম মমতায় বুকে আগলিয়ে রাখে মানুষকে, গ্রাম অন্তত বাঁচিয়ে রাখে মানুষকে।
রাফিয়ার চোখে দূরের আলো দেখার অপেক্ষা। পেটের ক্ষুধা অপেক্ষা মানে না, তাই আপাতত পাশের মেম্বারের বাড়িতেই উঠানা কাজ করে খেতে চায় মেয়েটা, কিন্তু বাপের অনুমতি না মেলায় ঘরে খিল লাগিয়ে পেট কামড়ে বসে থাকতে হয় ওকে।
টিসিবির ডিলারশিপ আছে মেম্বারের, সপ্তাহে দুইদিন চাল,ডাল আটা, চিনি, পেঁয়াজ দেয়া হয় স্বল্প মূল্যে।রাতে মেম্বারের বাড়িতে যায় ছমির মিয়া, মেম্বার তার টিসিবির মালপত্র উঠানামার কাজ দেয় ছমির মিয়াকে। আর সঙ্গে হাতে ধরিয়ে দেয় লকডাউনে সরকারের দেওয়া ত্রাণের একটা টিকেট।
রাতে টিসিবির মালপত্র উঠানামা আর মাসে দুইদিন দিনে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে সরকারের ত্রাণ নিয়ে ভালোই কাটে ছমির মিয়ার সংসার। বাচ্চাটাও আর আকাশ ফাটিয়ে কাঁদে না। বউটাও সব ভুলে হাসি ফোটায় ঠোঁটে, ছমির মিয়ার কাঁশির বেরামটা কমে আসে। সবকিছু ভালোই যেতে থাকে।
রাতে মালপত্র উঠনামা করার পর বুড়োর শরীরটা কেমন নিস্তেজ হয়ে মরার মতো পড়ে থাকে বিছানার উপর, ভূমিকম্পও হলেও যেনো কিছু টের পায় না।
একটা রাত গভীর হয়, বাইরে তখন ফটফটা চান্দের আলো, ঘুম আসে না ছমির মিয়ার, ছেলের কথা মনে পড়ে আর ছফফট করতে থাকে।
হঠাৎ কানে আসে ফিসফিস করে কে।যেন কয়,”রাফিয়া, এই রাফিয়া, দুয়ার খোল কইচুং”।
কার গলা নিশ্চিত হতে সময় লাগে ছমির মিয়ার। মেম্বারের গলা বুঝেই কেমন নিজের মরে যেতে ইচ্ছে করে তখুনি, তবুও অপেক্ষা করে বউটা কী করে এটা দেখার জন্য।
একটুপর শোনা যায় “আপনে আমারে বিরক্ত করলে গলায় ফাঁস দিয়া মরবো কইলাম, লোকজন জানাজানি হইবো।
একথা শুনে বু্ড়োর বুকের ভেতরে কেমন পানি আসে, নিশ্চিত হয়, আর যাই হোক রাফিয়াকে কোনভাবেই মেম্বার বাগে আনতে পারবে না, তার গর্ব হয় রাফিয়ার জন্য । পরিস্থিতি সামাল দিতে ছমির আলী কেঁশে উঠে। একটা পায়ের শব্দ নির্লজ্জের মতো গুটিয়ে গুটিয়ে হেঁটে যায় মেম্বারের বাড়ির দিকে।
পরদিন মেম্বারের বাড়িতে মালমাল উঠানামার কাজ করতে গিয়ে ফেরত আসে ছমির মিয়া।
লকডাউনের মেয়াদ বাড়ার খবর আসে টিভির ভেতর থেকে। ছমির মিয়া তাকায় আকাশের দিকে, রাফিয়াও তাকিয়ে থাকে তারাগুলোর দিকে, হয়তো কোন একটা তারা তার সুদিনের খবর নিয়ে আসবে এই আশায়।
রাত গভীর হয়, আবারও মেম্বারের গলার আওয়াজ পাওয়া যায়। তবে ফিরে যাওয়া পায়ের শব্দ পাওয়া যায় না, ভোরের আলো ফুটলে একনাগাড়ে কাঁদতে থাকে রাফিয়ার দুধের বাচ্চাটা। দরজা খুলে দেখা যায় গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলে আছে রাফিয়া ফ্যানের সঙ্গে।
আর কিছু জানতে পারে না ছমির মিয়া, যখন চোখ খুলে তখন দেখতে পায় আকাশের একটা তারা যেটা তার ছেলে তার পাশে আর একটা তারা বসে থাকে নিশ্চুপ।
Leave a Reply