ঈদ শব্দটির অর্থ উত্সব। ভিন্ন সময়ে দুইভাবে উদযাপিত ঈদ সারা বিশ্বের মুসলিম সমাজ পালন করে থাকেন। সেই ঈদ বা উত্সবের মধ্যে প্রধান হল ঈদ উল ফিতর। ইসলাম ধর্মানুযায়ী হিজরি ক্যালেন্ডার এর পবিত্র রমজানে ১ মাস রোজা বা সিয়াম সাধনার পর শাওয়াল মাসের ১ তারিখে খুশি উদযাপনকে ঈদ বলা হয়।
ঈদুল ফিতর, অর্থাত্ ” রোজা ভাঙার দিবস” ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের দুটো সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উত্সবের একটি। এই ঈদ উল ফিতর উত্সব। সমগ্র ইসলাম ধর্মালম্বী মানুষ যারা এই রমজান মাসে রোজা পালন করেন তারা ঈদের দিন রোজা ভঙ্গ করেন, মেতে ওঠেন খুশির ঈদে। রোজা হলো ইসলাম শাস্ত্র বর্ণিত এক পথ বা পন্থা যার মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের মানুষ, একমাস অর্ধদিবস উপবাস পালন করেন, এবং তারপর সন্ধ্যায় উপবাস ভঙ্গ করেন ইফতার এর মাধ্যমে।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ / তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।
মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় ও আনন্দের উৎসব ঈদ-উল-ফিতর নিয়ে বাঙালি কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত কালজয়ী গান। বাঙালি মুসলমানের ঈদ উৎসবের আবশ্যকীয় অংশ। কবির শিষ্য শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমদ-এর অনুরোধে ১৯৩১ সালে কবি নজরুল এই গান রচনা ও সুরারোপ করেন।
১৯৩১ সালে লেখার চারদিন পর শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের গলায় গানটি রেকর্ড করা হয়। রেকর্ড করার দুই মাস পরে ঈদের ঠিক আগে আগে এই রেকর্ড প্রকাশ করা হয়। গ্রামাফোন কোম্পানি এর রেকর্ড প্রকাশ করে। রেকর্ডের অপর গান ছিল কবির ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর, বদনসীন আয়, আয় গুনাহগার নতুন করে সওদা কর। হিজ মাস্টার্স ভয়েস কোম্পানির রেকর্ড নম্বর এন- ৪১১১। প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ।
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’– এটি কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত কালজয়ী একটি গান। বাঙালি মুসলমানের ঈদ উৎসবে এ গানটি এক প্রকার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমদ-এর অনুরোধে ১৯৩১ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই গান রচনা করেছিলেন এবং নিজেই সুরারোপ করেছিলেন। লেখার চারদিন পর শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের গলায় রেকর্ড করা হয় গানটি। রেকর্ড করার দুমাস পর ঈদের আগে রেকর্ডটি প্রকাশ করা হয়। তৎকালীন গ্রামাফোন কোম্পানি এর রেকর্ড প্রকাশ করেছিল। তখনকার দিনে চারদিকে শ্যামা সঙ্গীতের জয়জয়কার, শুনলে অবাক হবেন, মুসলিম নামে হিন্দু সঙ্গীত গাইলে গান চলবে না, তাই মুসলমান শিল্পীরা হিন্দু নামে শ্যামা সঙ্গীত করতো, যেমন, মুনশী মোহাম্মদ কাসেম হয়ে যান ‘কে. মল্লিক’, তালাত মাহমুদ হয়ে যান ‘তপন কুমার’। বাংলা ইসলামী গানের প্রচলনের প্রাথমিক ইতিহাস এবং যাদের ত্যাগ ও পরিশ্রমের ফলে কালজয়ী কিছু গানের সৃষ্টি হয় তাদের সম্পর্কে জানা আবশ্যক। “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে” গানটি তৈরির পিছনের কাহিনি।
শ্যামা সঙ্গীতের রেকর্ডিং শেষে কাজী নজরুল ইসলাম বাড়ি ফিরছেন। যাত্রাপথে তাঁর পথ আগলে ধরেন সুর সম্রাট আব্বাস উদ্দীন। একটা আবদার নিয়ে এসেছেন তিনি। আবদারটি না শোনা পর্যন্ত নজরুলকে তিনি এগুতে দিবেন না।
আব্বাস উদ্দীন নজরুলকে সম্মান করেন, সমীহ করে চলেন। নজরুলকে তিনি ‘কাজীদা’ বলে ডাকেন। নজরুল বললেন, “বলে ফেলো তোমার আবদার।”
আব্বাস উদ্দীন সুযোগটা পেয়ে গেলেন। বললেন, “কাজীদা, একটা কথা আপনাকে বলবো বলবো ভাবছি। দেখুন না, পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল এরা কী সুন্দর উর্দু কাওয়ালী গায়। শুনেছি এদের গান অসম্ভব রকমের বিক্রি হয়। বাংলায় ইসলামি গান তো তেমন নেই। বাংলায় ইসলামি গান গেলে হয় না? আপনি যদি ইসলামি গান লেখেন, তাহলে মুসলমানদের ঘরে ঘরে আপনার জয়গান হবে।”
বাজারে তখন ট্রেন্ড চলছিলো শ্যামা সঙ্গীতের। শ্যামা সঙ্গীত গেয়ে সবাই রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছে। এই স্রোতে গা ভাসাতে গিয়ে অনেক মুসলিম শিল্পী হিন্দু নাম ধারণ করেন। মুনশী মোহাম্মদ কাসেম হয়ে যান ‘কে. মল্লিক’, তালাত মাহমুদ হয়ে যান ‘তপন কুমার’। মুসলিম নামে হিন্দু সঙ্গীত গাইলে গান চলবে না। নজরুল নিজেও শ্যামা সঙ্গীত লেখেন, সুর দেন।
গানের বাজারের যখন এই অবস্থা তখন আব্বাস উদ্দীনের এমন আবদারের জবাবে নজরুল কী উত্তর দেবেন? ‘ইসলাম’ শব্দটার সাথে তো তাঁর কতো আবেগ মিশে আছে। ছোটবেলায় মক্তবে পড়েছেন, কুর’আন শিখেছেন এমনকি তাঁর নিজের নামের সাথেও তো ‘ইসলাম’ আছে।
দুই মাস পর রোজার ঈদ। গান লেখার চারদিনের মধ্যে গানের রেকর্ডিং শুরু হয়ে গেলো। আব্বাস উদ্দীন খান জীবনে এর আগে কখনো ইসলামি গান রেকর্ড করেননি। গানটি তাঁর মুখস্তও হয়নি এখনো। গানটা চলবে কিনা এই নিয়ে গ্রামোফোন কোম্পানি শঙ্কায় আছে। তবে কাজী নজরুল ইসলাম বেশ এক্সাইটেড। কিভাবে সুর দিতে হবে দেখিয়ে দিলেন।
হারমোনিয়ামের উপর আব্বাস উদ্দীনের চোখ বরাবর কাগজটি ধরে রাখলেন কাজী নজরুল ইসলাম নিজেই। সুর সম্রাট আব্বাস উদ্দীনের বিখ্যাত কণ্ঠ থেকে বের হলো- “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ…”। ঈদের সময় গানের এ্যালবাম বাজারে আসবে।
অল্প কয়দিনের মধ্যেই গানটির হাজার হাজার রেকর্ড বিক্রি হয়। একসময় যিনি ইসলামি সঙ্গীতের প্রস্তাবে একবাক্যে ‘না’ বলে দিয়েছিলেন, আজ তিনিই নজরুল-আব্বাসকে বলছেন, “এবার আরো কয়েকটি ইসলামি গান গাও না!” শুরু হলো নজরুলের রচনায় আর আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠে ইসলামি গানের জাগরণ।
বাজারে এবার নতুন ট্রেন্ড শুরু হলো ইসলামি সঙ্গীতের। এই ট্রেন্ড শুধু মুসলমানকেই স্পর্শ করেনি, স্পর্শ করেছে হিন্দু শিল্পীদেরও।
একসময় মুসলিম শিল্পীরা শ্যামা সঙ্গীত গাইবার জন্য নাম পরিবর্তন করে হিন্দু নাম রাখতেন। এবার হিন্দু শিল্পীরা ইসলামি সঙ্গীত গাবার জন্য মুসলিম নাম রাখা শুরু করলেন। ধীরেন দাস হয়ে যান গণি মিয়া, চিত্ত রায় হয়ে যান দেলোয়ার হোসেন, গিরিন চক্রবর্তী হয়ে যান সোনা মিয়া, হরিমতি হয়ে যান সাকিনা বেগম, সীতা দেবী হয়ে যান দুলি বিবি, ঊষারাণী হয়ে যান রওশন আরা বেগম।
তবে বিখ্যাত অনেক হিন্দু শিল্পী স্ব-নামেও নজরুলের ইসলামি সঙ্গীত গেয়েছেন। যেমনঃ অজয় রায়, ড. অনুপ ঘোষল, আশা ভোঁসলে, মনোময় ভট্টাচার্য, রাঘব চট্টোপাধ্যায়।
গানগুলো ক্লাসিকের মর্যাদা পেয়েছে। গানগুলো রচনার প্রায় নব্বই বছর হয়ে গেছে। আজও মানুষ গুনগুনিয়ে গানগুলো গায়।
বাংলায় ইসলামি গানের যে নবজাগরণ নজরুল সূচনা করেছিলেন, যে পথ দেখিয়েছেন, পরবর্তীতে সেই পথের পথিক হয়েছেন জসীম উদ্দীন, ফররুখ আহমদ, গোলাম মোস্তফা, গোলাম মুহাম্মদ, মতিউর রহমান মল্লিক এবং হাল আমলের কবি মুহিব খান সহ অনেকেই।
Leave a Reply