করোনা মহামারীর কাল এখন। উৎকণ্ঠা অন্তহীন।তাই উৎসব, আনন্দের রঙ অনেকটাই ফিকে। নানা শর্তে জীবনের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু সময় তো বসে থাকে না। আপন গতিতে প্রকৃতির চলমানতা। সে পথ ধরেই এবারও করোনায় ঈদ এলো। ঈদুল ফিতর।
ঈদ আনন্দের, খুশীর, তাই ঈদ উদযাপনে জীবনের ঝুঁকি নিতেও দ্বিধাহীন সবাই। খুশী আর সাম্যের বার্তা নিয়ে ঈদ এসেছে বছরের পরে। গত বছরও করোনা কবলিত ছিল ঈদ আনন্দ। প্রাণের আবেগ হার মানে না জন্যই করোনার বাধা অতিক্রম করেই ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার প্রয়াসী হয় মানুষ।
ঈদের কর্তব্যের কিছু নির্দিষ্টতা আছে। খোদার নৈকট্য লাভের প্রয়াস, ঈদের আনন্দ যেনো সবাই সমান উপভোগ করতে পারে তার সুযোগ করে দেয়া। ধনবান যারা তারা তো আনন্দের সাম্পানে ভেসে বেড়ায় কুণ্ঠহীন। বিত্তের জোয়ার খুশীর তরঙ্গ তোলে তাদের চলমানতায়, যাপিত জীবনে। উল্টো চিত্র অভাবী জনদের। স্বস্তির সজীব হাওয়া সেখানে অনুপস্থিত অনেকটাই। তাদের চন্দ্র-সূর্য ম্রিয়মান অনেকটা। তবুও ঈদের আনন্দের ছোঁয়া নিতে আগ্রহী তারা। এ আগ্রহ বাস্তবায়নে ধর্মীয় বিধান মতে বিত্তবানদের যথাযথ কর্তব্য পালন আবশ্যক। গরীবদের প্রতি করুণা নয়, তাদের হিস্যা দিতে হবে। কারণ ধনীদের উদ্বৃত্ত সঞ্চয়ে গরীবদের ন্যায্য অধিকার আছে।
ঈদকে সর্বজনীনতা দিতে দরকার শুভ ভাবনার বিকাশ। কানাকে কানা, খোড়াকে খোড়া বলিও না তারা মনে কষ্ট পাবে-সেই যে পাঠ তার বাস্তবায়ন সমাজে কতটা সে প্রশ্ন আসে। উপকার করবার মানসিকতার বিকাশও বাধাগ্রস্ত। স্বার্থমগ্নতায় অনেকক্ষেত্রে ডানা মেলতে পারে না পরার্থপরতার শুভ বোধগুলো ।
এমন পরিবেশ থেকে উত্তরণে তরুণরা হতে পারে আশার আলোকবর্তিকা। অসাম্যের মেঘ সরিয়ে তারাই আনতে পারে ঈদের মহাসাম্যের আলোকিত সূর্য। সংকীর্ণতার তরঙ্গ থামিয়ে দিতে পারে যুবশক্তি। কারণ তারাই তো শুভ শক্তির পক্ষের সাধক, মঙ্গলকর্মের দুরন্ত সৈনিক। কাজী নজরুল তারুণ্য শক্তির প্রতি অবিচল আস্থা রেখে বলেছেন-‘তরুণ নামের জয়-মুকুট শুধু তাহার- যাহার শক্তি অপরিমান, গতিবেগ ঝঞ্ঝার ন্যায়, তেজ নির্মেঘ আষাঢ়-মধ্যাহ্নের মাতণ্ডপ্রায়, বিপুল যাহার আশা, ক্লান্তিহীন যাহার উৎসাহ, বিরাট যাহার ঐদার্য, অফুরন্ত যাহার প্রাণ, অটল যাহার সাধনা, মৃত্যু যাহার মুঠিতলে।’ নজরুল যৌবনের মাতৃরূপ সম্পর্কে আবেগধর্মী ভাষায় লিখেছেন-‘যৌবনের মাতৃরূপ দেখিয়াছি- শব বহন করিয়া যখন সে যায় শ্মশানঘাটে, গোরস্থানে,অনাহারে থাকিয়া যখন সে অন্ন পরিবেশন করে দুর্ভিক্ষ বন্যা-পীড়িতদের মুখে, বন্ধুহীন রোগীর শয্যাপার্শ্বে যখন সে রাত্রির পর রাত্রি জাগিয়া পরিচর্যা করে, যখন সে পথে পথে গান গাহিয়া, ভিখারী সাজিয়া দুর্দশাগ্রস্তদের জন্য ভিক্ষা করে, যখন সে দুর্বলের পাশে বল হইয়া দাঁড়ায়, হতাশের বুকে আশা জাগায়।’
ঈদে এমন উদার, স্বার্থত্যাগী তারুণ্য খুববেশী প্রয়োজন। কারণ ঈদের আনন্দ সর্বজনীন করতে তাদের মানবিক কল্যাণবোধ নিয়ে সম্মুখযাত্রী হবার বিকল্প নেই।
সত্য হলো ঈদের ধর্মীয় তাৎপর্য ব্যাপক। ঈদুল ফিতরকে বলা হয় মুসলমানদের জাতীয় উৎসব। এক মুসলমানের সাথে অন্য মুসলমানের ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য স্থাপনের দিন ঈদুল ফিতর। সংঘাত নয়, বিরোধ নয় ,হিংসা-বিদ্বেষ নয়- সবার সাথে ভাল সম্পর্ক স্থাপনের বার্তা বয়ে আনে ঈদ।
ঈদের মানবিক দিক হলো গরীর দুস্থদের আনন্দে শরীক করা । এ জন্য যাদের সামর্থ আছে তাদের টাকা, খাবার ,কাপড় অন্যান্য সামগ্রী প্রদান করতে হবে উদার মনে। এতে গরীররাও আনন্দ পাবে এবং ঈদের খুশি বিস্তৃত হবে । কাজী নজরুল তাঁর কবিতায় উপচানো ভোগের পেয়ালা থেকে গরীবদের দান করতে বলেছেন বিত্তবানদের,কারণ ইসলামে স্ঞ্চয়ের কোনো বিধান নেই-
ঈদ-অল ফিতর আনিয়াছে তাই নববিধান,
ওগো সঞ্চয়ী উদ্বৃত্ত যা করিবে দান ,
ক্ষুধার অন্ন হোক তোমার।
ঈদের ধর্মীয় ও মানবিক দিক যেনো যথাযথ বাস্তবায়িত হয় সে জন্য তরুণদের মনোযযোগী কর্ম তৎপরতা দরকার। ঈদের আনন্দ সবার মাঝে সমানভাবে সঞ্চারিত করতে তরুণদের সৎ ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করতে হবে। কারো আচরণে যেনো কেউ ব্যথিত না হন সে জন্য ভাল আচার আচরণ সম্পর্কে বোঝাতে হবে। রোজা ও ঈদকে কেন্দ্র করে যারা বাজার অস্থিতিশীল করে অধিক মুনাফা অর্জনে ব্যস্ত তাদের বোধোদয়ে সমবেত পদক্ষেপ নিতে হবে তরুণদের। প্রথমত তাদের বোঝাতে হবে ধর্মীয় বিধান সম্পর্কে, রোজা ও ঈদে অধিক মুনাফা ধর্মীয় বিধানের পরিপন্থী তা মন্দকর্ম হিসেব গণ্য হয়, আর তা পাপকর্ম। পত্র-পত্রিকায় লিখতে হবে মুনাফাখোরদের অপকর্ম সম্পর্কে। পৃথিবীর অনেক দেশে বিভিন্ন উৎসবে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখার প্রবণতা দেখা গেলেও আমাদের দেশের চিত্র প্রায়শই বিপরীত। যা ইসলামের রীতিতে শুভবার্তা বহন করে না। রোজার সময়ে দুস্থ যারা খারার অভাবে রোজা রাখতে পারে না সমবেত তরুণরা খাবারের ব্যবস্থা করে দিতে পারলে অনেকের পক্ষে রোজা রাখার পথ সহজ হবে। ইফতারের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে একই নিয়মে। ঈদের কেনাকাটা নির্বিঘ্ন করতে তরুণরা স্বেচ্ছাশ্রমে সহায়তা করতে পারে। অন্ধ, দুস্থ, গরীদের সহায়তার জন্য নিজেদের উদ্যোগে তহবিল গঠন করা গেলে তাদের সহায়তা করা সহজ হবে। চুরি ছিনতাই, অনৈতিক কাজ করে যারা ঈদে মানুষের আনন্দ ধারায় বাধার সৃষ্টি করে তাদের শুভবোধ জাগরণে সমবেতভাবে কাজ করা উচিৎ। মন্দ কাজের সাথে জড়িতদের বুঝিয়ে সত্য, সুন্দর, কল্যাণের পথে আনার জন্য সচেষ্ট হতে হবে যুবকদের।
আমাদের দেশে রয়েছে অনেক পথশিশু, প্রতিবন্ধী, মা-বাবা হারা এতিম অনেক শিশু। দারিদ্র্যের কষাঘাতে তারা বঞ্চিত হয় ঈদের আনন্দ থেকে। যাকাত, ফেতরা বা অনুদান সংগ্রহ করে ঈদ সামগ্রী দিতে পারলে সুবিধা বঞ্চিত শিশুরাও মুখে অনাবিল হাসি নিয়ে ভাসতে পাবে খুশীর জোয়ারে। অনেক দুস্থ আছেন যারা শারীরিক অসুস্থতায় নির্জীব। কোথাও গিয়ে সহায়তা নেবার সামর্থ্য নেই। তাদের জন্য সহায়তার হাত বাড়নো উচিৎ তরুণদের। বন্ধুস্থানীয় অনেক তরুণ আছে যারা অভাবগ্রস্ত। তাদের ঈদ সামগ্রী দেবার পদক্ষেপ নেয়ার দায় তরুণ সমাজরই নেয়া আবশ্যক। তাতে তাদের ঈদ হবে আনন্দময়।
আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রমে বাস করেন অনেক জ্যেষ্ঠ নাগরিক। বয়সের ভারে জীর্ণ ঐ মানুষগুলো আপনজন বঞ্চিত। একদা যাদের কর্মের অঙ্গন ছিল বিস্তৃত, ছিল আশা, ছিল ভালোবাসা। কিন্তু সময়ের নিষ্ঠুরতায় বার্দ্ধকে সাথী করে স্বজন, পরিজনহীন ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম। ঈদে বাঞ্ছিত সন্তান বা আত্মীয়রা আসেন না তাদের সাথে দেখা করতে, ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে। ভালোবাসার কাঙাল, বয়স্ক, হতাশ ব্যক্তিগণের জন্য পোশাক বা ঈদে ভাল খাবার নিয়ে দেখা করে ঈদের শুভেচ্ছা জানালে তারা অনেকটাই ভুলে যাবেন যন্ত্রণা। তঁদের কাছ থেকে মিলবে দোয়া, আর এমন কর্মে মিলবে অসীম আনন্দ।
ঈদকে ঘিরে বিক্রয় প্রতিনিধি নিয়োগ দেয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। তরুণরা খণ্ডকালীন কর্মের মাধ্যমে উপার্জন করে মা-বাবাকে সহায়তা করলে সংসারে আয় বাড়বে আর ঈদের আনন্দও বৃদ্ধি পাবে। নিজের আয়ের টাকায় দুস্থদের সহায়তার মাধ্যমে ঈদ আনন্দের বিস্তার ঘটাতে পারে তররুণরা। বিত্তবানদের সাথে সম্পর্ক রেখে দান খয়রাতে তাদের উৎসাহিত ও সযযোগিতা করার পথও বেছে নিতে পারে তারা। ঈদ যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে স্বেচ্ছাশ্রমে দায়িত্ব পালন করতেও পারে।
আমাদের ছাত্র রাজনীতির আছে গৌরবময় ঐতিহ্য। সে ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলোর কর্মীরা রোজা ও ঈদে নিজেদের উদ্যোগে গরীব শিক্ষার্থীসহ সমাজের অন্যান্য অভাবী মানুষকে সহায়তা উদ্যোগ নিতে পারে। তাতে বাড়বে সুনাম ও মর্যাদা।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের বিচারে তারুণ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। তাঁর ভাষ্য-
‘আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়-
আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা।
এবার করেনায় তরুণরাও অনেকেই বেকার হয়ে পড়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে না পারায় মানসিক উৎকণ্ঠা বেড়েছে। অনেকে চাকরী না পেয়ে সীমাহীন শংকায় প্রহর গুণছে। ব্যবসাও ছাড়তে হয়েছে অনেককে। তবুও অনেকেই রোজা ও ঈদে অভাবগ্রস্ত মানুষ, শিশুদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। ইফতার, ঈদ সামগ্রী বিতরণে অংশ নিয়েছে। মানুষকে নানা সহায়তা দিয়েছে। তরুণদের করোনা নিয়ন্ত্রণেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। নিজেরা মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, ভীড়ে না যাবার রীতি মেনে অন্যদেরকেও উদ্বুদ্ধ করলে করোনা প্রতিরোধ সহজ হবে। তারা কাজ করবে মানুষের সচেতনতা বাড়াতে।
রোজা ও ঈদ ভালো কর্মের সুযোগ এনে দেয়। বাধা-বিঘ্নের বন্ধুর পথ পাড়ি দেবার শক্তি সঞ্চয় করতে হবে তরুণদের, অসুন্দর, অকল্যাণের পথ পরিহার করে মানবিক মঙ্গলের পথ বেছে নিতে হবে। বাস্তবতা হলো ঈদের আনন্দ পূর্ণতা পায় মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমে। আগামীর কর্ণধার হিসেবে এবার ঈদে তরুণদের শপথ হোক মানুষের জন্য ভাল কিছু করার। করোনা জয়ের নাবিক হিসেবে কাজ করার। তাদের সহায়ক হবেন অন্যরা এটাই নিয়ম। সাম্যের সমাজ গড়ার দীক্ষা তো নিতে হবে রোজা ও ঈদের কাছ থেকে। ভালবাসতে হবে দেশকে, মানুষকে। তবেই ঈদের আনন্দ হবে সবার। ঈদের আনন্দকে সর্বজনীতা দিতে তরুণ শক্তির জাগরণ প্রত্যাশা নিয়ে বলি- ‘এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।’
(লেখক- বিশিষ্ট সাহিত্যিক, ভূতপূর্ব অধ্যাপক, বাংলা, কারমাইকেল কলেজ, রংপুর)
Leave a Reply