আম একটি রসালো, সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফল। বসন্তে আমের মুকুল আসে এবং গ্রীষ্মে পাকে। আমকে ফলে রাজা বলা হয়। তবে আমগাছ আমাদের জাতীয় গাছ।
আমের কথা রামায়ণে পাওয়া যায়। যথা- হরণকৃত সীতার সাথে হনুমানের যখন দেখা হয় তাকে খেতে দেওয়া ফল খুব সুমিষ্ট আর সুস্বাদু বলে সীতা রাম-লক্ষণের জন্য খেতে দেন এই ফল। হনুমান এই ফলের একটি খেলে এত ভালো লাগে যে, লোভ সামলাতে না পেরে সবগুলোই খেয়ে ফেলে। তা অপরাধ বোধ হওয়ায় হনুমান সীতার কাছে ক্ষমা চেয়ে এ ফলের নাম ও কোথায় পাওয়া যায় জানতে চাইলে সীতা কিছুই বলতে পারে না। হনুমান বিভিন্ন ফল অন্বেষণ করে একটি ফলে সেই সীতার দেওয়া ফলের স্বাদ পেয়ে যায়। আর গাছেই খেয়ে আঁটি ছুড়ে ফেলে। হিন্দুধর্মে বিশ্বাস করে এই ছুড়ে ফেলা আঁটি গজিয়ে আমগাছ বিস্তার লাভ করে।
খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে দিগি¦জয়ী বীর সম্রাট আলেকজান্ডার ভারতবর্ষ আক্রমণের পর এক আম বাগানে তাঁবু গেড়ে বিশ্রাম নেয়ার সময় আমের সঙ্গে পরিচিত হন। আমের স্বাদ তাকে এতটাই ভক্ত সাজান যে, প্রাসাদের চারধারে আমের বাগানে ছেয়ে দেন।
আম নিয়ে প্রচলিত গল্পে জানা যায়, ৬৩২-৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে চীন দেশের পর্যটক হিউয়েন সাং ভারতবর্ষে বেড়াতে আসেন। সেই সময় তিনি ফল হিসেবে আমকে পরিচিত করে তোলেন। আরব অভিযাত্রী ইবনে হানকাল আমের কথা বিশেষ ভাবে তার বইয়ে তুলে ধরেন। মোগল সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) আম এতটাই প্রিয় ছিল যে, আম দিয়েই শুরু হতো অতিথি আপ্যায়ন। আর আমের ফলন বাড়াতে বিহার রাজ্যের দারভাঙ্গায় এক লাখ চারা রোপণ করে পরিচর্যা করেন। ইতিহাসের পাতায় আজও এই বাগানের নাম লাখবাগ। এটিকে ভারতীয় উপমহাদেশে সবচেয়ে বড় আমবাগানবরা হয়। মূলত মোগল সম্রাটের আমলে ভারত উপমহাদেশে বিভিন্ন জাতের আমের উদ্ভাবন হয়েছে।
আমের ইংরেজি নাম ম্যাংগো। বৈজ্ঞানিক নাম ম্যাংগিফেরা ইন্ডিকা।
প্রচলিত কথায় জানা যায়- বহু আগে প্রেমের দেবতা কিউপিড মানব হৃদয়ে প্রণয় জাগাতে প্রেমের তীরের অগ্রভাগে আমের মুকুল গেঁথে দেন। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে আমগাছ অতি পবিত্র। জাতকের ইতিহাস লেখা হয় আমগাছকে ঘিরে। হিন্দুধর্মে আমের পল্লব, পাতা পূজার একটি অন্যতম উপাচার বা উপকরণ। হিন্দুধর্মে ষষ্ঠিপূজায় আমকে সুতো বেঁধে পূজো শেষে মঙ্গলের জন্য হাতে বেঁধে দেওয়া হয়।
ভ’ত, দৈত্য-দানব কিংবা কুবাতাস থেকে রক্ষা পেতে আমের পাতা গেঁথে রাখা হয় ঘর কিংবা যানবাহনে কিংবা শরীরের সাথে।
বাংলাদেশের সব অঞ্চলে আমের চাষ হয়। তবে উন্নত জাতের আম চাষ হয় চাপাই নবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর ও রংপুর এলাকায়। চাপাই নবাবগঞ্জের কানসাট বাজারকে আমবাজারের রাজধানী বলা হয়। এছাড়াও শিবগঞ্জ, ভোলাহাট, আলীনগর, রহনপুর এরাকায় আমের বড় বাজার বসে। ঠাকুরগাঁও জেলার একটি আমগাছ আড়াই বিঘা জমি জুড়ে রয়েছে। সূর্যপুরী নামীয় এই আমটিও পরিচিতি লাভ করেছে। এছাড়াও রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা বিশেষ স্থান লাভ করেছে।
পূর্বে আমের ও গাছের ধরন বা বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী লোকজন কালিয়া, চেপ্টি, মাল দইয়া, মাটিখোড়া সেন্দুরিয়া, গুলটি, থালুয়া নামে ডাকত। কিন্তু এখন স্বাদ, ধরন ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নানান নামের আম রয়েছে। ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ক্ষিরসাপাতি, হিমসাগর, ক্ষীরসাগর, ফজলি, মোহনভোগ, লখনা, আশ্বিনা, আম্রপালি, হাঁড়িভাঙ্গা উল্লেখযোগ্য। ্ বারোমেসে আমও ফলে।
আম পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। উচ্চমাত্রার চিনি, ভিটামিন ‘এ’ এবং ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে এই ফলে। আমে রয়েছে ভিটামিন ‘বি’ কমপ্লেক্স। কাঁচা আমে প্রচুর ‘সি’ ভিটামিন রয়েছে। ভিটামিন শরীরের স্নায়ুগুলোতে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়। শরীরকে রাখে সতেজ। ঘুম আসাতে সাহায্য করে। আমে রয়েছে প্রচুর পরিমানে আঁশ। আঁশ জাতীয় ফল কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, মুখের ব্রণ প্রতিরোধ করে। আমে খনিজ লবণের উপস্থিতিও রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে। দাঁত, নখ, চুল মজবুত করার জন্য আমের খনিজ লবণ উপকারী ভ’মিকা পালন করে। বুদ্ধি ও শরীরে শক্তি সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য আম ভীষণ দরকারি ফল।
পাকা আম চুষে, চিবিয়ে, ছিলিয়ে, রস করে খাওয়া ছাড়াও টক, চাটনি, সস্ করে খাওয়া হয়। ডালে আম মিশিয়ে খাওয়া হয়। কাঁচা আম কেটে রোদে হলুদ লবণ মিশিয়ে শুকিয়ে অনেক দিন পর্যন্ত রেখে খাওয়া যায়। যার নাম আমশি। এছাড়াও বিভিন্ন রকমের আচার বানিয়ে রাখা হয়। পাকা আমের রস দিয়ে আমসত্ত্ব করে রেখে খেতে কার না মজা লাগে! এছাড়াও সিরকা, তেল, ঘি এ আম রেখে অনেকদিন পর্যন্ত খাওয়া হয়। যদিও এখন ফ্রিজ, প্যাকেটজাত, হিমাগার জাতীয় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় আম রাখতে।
গ্রীষ্মকালের াআম শীতকালে খাওয়ার একটি পদ্ধতির নাম আমের নাম ‘কোহিতুর’। এটি আমেরও নাম। এটি নবাবদের খুব পছন্দের ছিল। এই আম ঘি আর মধুভান্ডে বোঁটা কাটার জায়গাটি মোমের প্রলেপ দিয়ে ঢেকে সংরক্ষণ করে কোনো প্রকার লোহার ছুরি-চাকু ছাড়াই বাঁশের ছুরি দিয়ে কেটে খাওয়া হত। অনেকেই মনে করেন, মোগল সম্রাট শাহজাহানের কোহিনুর সিংহাসনের নামের উচ্চারণত কারণেই এই আমের নামকরণ হয়েছে কোহিতুর। বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে মোগল ও নবাবী আমলের নাম অনুযায়ী আমের নামকরণ আজও চালু আছে। কোহিতুর আমের জাত বৃদ্ধি তেমন না পেলেও এটি এখনও জনপ্রিয়। জানা যায়, ভারতের পশ্চিবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার নবাবদের মতিঝিলের লালবাগ পার্কে কিছু কোহিতুর আমের গাছ রয়েছে।
বিশেষ করে ভারতের পাহাড়ী ও বন্য অঞ্চলে আমগাছ ছিল। সিংহল পর্যন্ত তার অবস্থান ছিল। সময়ের পরিক্রমায় তা সমতলে ছড়িয়ে পড়ে। হালে চীম, ব্রাজিল, ইতালি, তুরস্ক, বৃটেন, যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অঞ্চলে আম চাষ হয়।
এক সময় আম বিক্রয় হতো শ’ হিসাবে। গ্রামগঞ্জে বিক্রয় হতো হালি হিসাবে। তবে এখনো হালি হিসাবে বিক্রয়ের চল আছে কোথাও কোথাও। মজার বিষয় গাইবান্ধা অঞ্চলে সব কিছু চারটিতে হালি কিন্তু আমের বেলায় এখনও ছয়টিতে হালি।
আম নিয়ে ছড়া, গল্প, কবিতা কম লেখা হয়নি। আম আঁটির ভেপু এখনও গ্রামের ছেলেরা বাজিয়ে থাকে আমের মৌসুমে।
আমের ভিটামিন আর পুষ্টিগুণ থাকলেও এটির ভেষজগুণও আছে। এর আঁটি ভেষজও চিকিৎসায় ব্যবহার হয়।
গ্রামাঞ্চলে জামাই-মেয়ের বাড়িতে আম দুধ দেওয়ার রেওয়াজ এখনও চালু আছে। আর কোনো কাজের জন্য খুশীকরণ উপাদান ও উপাহার হিসেবে নামকরা আমেরও কদরও কম নয়। আমের সময় মেয়ে জামাই সহ আত্মীয়ের সমাগম ঘটে। ভাগ্নেকে আম খাওয়ার জন্য এ মৌসুমে নেমন্তন্ন করার রেওয়াজ আজও চালু আছে।
আমগাছের কাঠ জ্বালানী , আসবাবপত্র তৈরিতে দারুণ উপযোগী। এর মূল শিকড়, গোড়া লাঙ্গল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
আমাদের জাতীয় বৃক্ষ আমগাছ। তো দেখি-
× বাংলাদেশের যেদিকে চোখ যায় কী গ্রাম, কী শহর সর্বত্রই আমগাছ চোখে পড়ে। আমগাছ দেশে সর্বত্রই সহজে জন্মে। বীচি থেকে চারা গজিয়ে কিংবা কলম করেও এ গাছের চারা সহজে লাগানো যায়।
× আমাদের জাতীয় সংগীতে আমগাছের কথা আছে।
× মহান ভাষা আন্দোলনের সময় ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সমাবেশ হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায়।
× ১৯৭১ সালে ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের মুজিবনগর সরকার গঠিত হয় বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে।
× ১৭৫৭ সালের ২৩জুন বাংলা-বিহার- উড়িস্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উ দ্দৌলার পরাজয় ঘটে ব্রিটিশদের হাতে পলাশীর আমবাগানে।
× আম অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও কর্মসংস্থানে ভ’মিকা রাখছে। দেশে ক্রমে আমের বাগান আকারে চাষ বাড়ছে। বিদেশেও আম রপ্তানি দিনে দিনে বাড়ছে।
× গ্রামে একটি কথার প্রচলন আছে যে, ‘আমে ধান’ অর্থাৎ বিশ্বাস করে যে, যেবারে আমের ফলন বেশি হয় সেবারে নাকি ধানের ফলনও বেশি হয়।
সবশেষে একটি কথা না বললেই নয়, কাঁচা কিংবা আধাপাকা কিংবা পাকা আম কেটে নুন, মরিচ, তেল, হলুদ, কাসুন্দি কিংবা সরিষা বাটা দিয়ে মেখে যাকে বলে আমঝালা সামনে ধরলে জিহ্বাকে কী আটকানো যায়!
Leave a Reply