পরশু অরুনের বিয়ে। সে এখন খুশির উপর আছে। একটু পর পর তার চোখ বেয়ে বেয়ে টলটলে জল পরে। খুশির জল। খুশিতে ন্যাড়াকে সে মাঝে মাঝেই চোখ টিপুনি মারে। আকারে ইংগিতে ন্যাড়াকে তার মুল্য বুঝায়। তবে আজকাল ন্যাড়ার সাথে ভাবটা বেড়েছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে দুজন আলাপ করে। দুমাস হলো অরুনকে জড়িয়ে ধরেছিল ন্যাড়া। সেদিন বাড়িতে মানুষ বলতে তারা দুজনই। অরুন বারান্দায় বসে ছিল। ন্যাড়া তার পাশে এসে বসলো।
অরুন বললো – ওহ, তুই।
-চমকে উঠলি যে?
-এমন করে বসলে না চমকে উপায় আছে। দূরে গিয়ে দাড়া।
-আমাকে এত অসয্য কেন তোর?
-না, তোকে নিয়ে সোহাগ করবো।
ন্যাড়া কাতর গলায় বললো- আমার আশাটা পুরন করলি না।
অরুন মাথা দুলাতে দুলাতে বললো- আহা, দেয়ালে গিয়ে গা ঘষ যা।
-তোকে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।
-ওমা শখ কত? চাকরের আবার ভালবাসা, সর সর।
-আমি চাকর, আর তুই কি?
-তোর চেয়ে ভালো আছি। কথা নাফুরাতেই অরুনকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিল।
ন্যাড়ার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে অরুন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাফাতে হাঁফাতে বললো- কুত্তা, ভাগ এখান থেকে। আরেকবার কাছে এসেছিস তো-
সেই থেকে অরুন ন্যাড়া থেকে দূরে দূরে থাকে। তারা দুজনেই এতিম। লোকমান সাহেবের বাসায় ছোটবেলা থেকে আশ্রিত। পনেরটা বছর হল তারা এ বাড়িতে কাজ করে। বলতে গেলে এই বাড়ির আংগিনায় দুজনার বেড়ে উঠা। লোকমান সাহেবের বউ শিউলি অরুনকে নিজের মেয়ের মতই ভাবে।
অরুন কোমর হেলে হেলে আংগিনা ঝাড়ু দিচ্ছে। এর মধ্যে এক বালতি কাপড় হাতে এগিয়ে দিয়ে শিউলি বললো- ধর ধর, কত কাজ বাকি। পুরা ঘর অপরিস্কার। জলদি জলদি কাপড় ভিজিয়ে ঘরে আয়। আমি আলমিরা গোছাচ্ছি।
অরুন বালতিটা হাতে করে টিউবওয়েলের ধারে গেল। টিউবওয়েল চেপে চেপে বালতি ভড়ালো।
পাউডার দিয়ে একমনে কাপড় ভিজাচ্ছিলো সে। হঠাৎ ন্যাড়া পাশে এসে বসলো।
অরুন মাথা তুলে বললো- কি চাস?
-কিছু না।
-তাহলে পেচার মত মুখটা নিয়ে সামন থেকে ভাগ।
-কেন না ভাগলে কি করবি?
-চাচীমাকে বলবো তুই আমাকে খুব জ্বালাচ্ছিস।
-ন্যাড়া অভিমানের সুরে বললো- এত রাগিস ক্যান তুই হ্যাঁ। বল না চাচীকে বল। আমি কি চাই তুই বুঝিস না।
-না।
-আমার আশা টা।
-তোর আশাটা মানে।
-এমন চেচাচ্ছিস ক্যান। আস্তে বল।
-কী চাস তুই বলতো?
-আমায় বিয়ে করবি।
-বিয়ে করলে খাওয়াবি কি?
-যা খাবো তোকেও তাই খাওয়াবো।
-সেজন্যই আমার পিছু লেগেছিস।
-তোকে খুব ভালবাসি।
-আমার কাছে ওমন ভালোবাসার কোন দাম নেই। কী আছে তোর। যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে তার দোকান আছে, জমি আছে। আর তোর তো থাকার একটা ঘর ও নেই। মনের ভিতর আবার ভালোবাসা।
-তুই আমাকে দুই চক্ষে দেখতে পারিস না।
-তোর স্বভাবটাযে খুব ভালো।
-কী খারাপি করেছি।
-আমার দিকে এমন করে তাকাশ কেন। আমিও তো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। সুখ, আহলাদ, যৌবন সব তো আমার আছে। ভাগ এখান থেকে। আর কখনো আমার দিকে অমন করে তাকাবি না। কী আছে তোর হ্যাঁ, কি আছে তোর?
বলতেই কেঁদে ফেললো অরুন।
মনে মনে সে ন্যাড়াকে ভালোবাসে। ভীষন ভালোবাসে। বুঝকাল থেকেই দুজন এক বাড়িতে কাটিয়েছে। এক সাথে এই বাড়িতে বেড়ে উঠেছে। ছোটবেলায় কতবার ন্যাড়ার ঘাড়ে উঠেছে সে। একবার ন্যাড়ার ভীষণ জ্বর হয়। সেবার অরুন কি শ্রমটা না দিল। রোজ সময় করে করে ন্যাড়ার মাথায় পানি ঢেলেছে। তোয়ালা দিয়ে মাথা পরিস্কার করছে। অচেতন মনে কতবার ন্যাড়াকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে। একবার ন্যাড়া মেলা থেকে লাল চুড়ি এনে দিয়েছিল। সেবার মনে হয়েছিল ন্যাড়ার হাত ধরে পালিয়ে যেতে।
অরুন নিজেকে সামলে নিয়ে বললো- দেখ আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।কাল বাদ পরশু বিয়ে। এখন তোর সাথে আহলাদ করার সময় নেই। হাতে মেলা কাম।
-হা জানি তোর মেলা কাম। তুই তো বিয়ে করে ভালই থাকবি।
অরুন রেগে গিয়ে বললো – ভালো থাকবো না মন্দ থাকবো সেটা দিয়ে তোর কাম কি। এখন জ্বালাস না সামন থেকে ভাগ।
ন্যাড়া আবার নির্জীব গলায় বললো- আমায় ভালবাস না।
অরুন কাপড় ফেলে বড় বড় চোখে ন্যাড়ার দিকে তাকালো।
ন্যাড়া বাড়ির বাইরে গেল।
দুপুরে খাবার সময় শিউলি অরুনকে ডেকে বললো- ন্যাড়া কোথায়?ওকে দেখছি না যে। ওকে ডাকতো। দুমন ধান ভাংতে হবে। বিয়েতে অনেক মেহমান আসবে। তখন এসব করার সময় হবে না।
অরুন উঠে গেল ন্যাড়াকে ডাকতে। গেটের কাছেই ছিল ন্যাড়া। অরুন কাছে গিয়ে বললো – খেতে আয়।
-আমি এখন খাবো না।
-কখন খাবি?
-পরে।
-চাচীমা তোকে ডাকলো।
-তোর বিয়ে হয়ে গেলে আমি এবাড়িতে থাকব না।
-পাগলামি করিস না। তোকে বিয়ে করা যায় না।
-কেন যায় না।
-জানিনা।
-চল আজ পালিয়ে যাই।
-আমি চাচীমাদের মনে কস্ট দিতে পারবো না।
-আমি তোর জন্য সব করবো।
-আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুই খেতে আয়, নইলে চাচীমা কিছু ভাববে টাববে।
ন্যাড়া আর কিছু বললো না। অরুনের সাথে হেটে হেটে আসলো। আসতে অরুনের হাত ধরে বললো- তোর জন্যই এতদিন এখানে ছিলাম
ন্যাড়ার কথা শুনে অরুন থামলো।
-সত্যি তুই আমায় ভালবাসিস?
-হা সত্যি। এই দেখ তোর জন্য কি এনেছি?
-কি?
ন্যাড়া কোমরের ভাঁজ থেকে একটা লাল ফিতা বের করে অরুনের হাতে দিলো।
অরুন একদৃষ্টিতে মুখ পানে তাকিয়ে থাকলো। এ তাকার মাঝে কোন রাগ নেই, অভিমান নেই, শুধু একটা নিস্পলক দৃষ্টি ন্যাড়ার ভালোবাসাকে আগাগোড়া একটানা নীবির পর্যবেক্ষনে তোলপার করে তুললো।
বিয়ের সব আয়োজন শেষ। অরুনকে গাড়িতে ওঠানোর পায়তারা চলছে। গাড়ি হর্ন দিচ্ছে। প্যাঁ পুঁ। কিন্তু অরুন আকাশ ফাটিয়ে কাঁদছে। কি যে কান্না। যেন তাকে আস্ত কবর দিচ্ছে। চেষ্টা করেও শিউলি কান্না থামাতে ব্যর্থ হলো। অরুনের কান্নায় ন্যাড়ার বুকটা হু হু করে কেঁপে উঠছে। তার গাল বেয়ে বেয়ে জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। নোনতা নোনতা জল। ন্যাড়ার দম আটকে যাচ্ছে। সহ্য হচ্ছে না কান্না। যেন বুকের ভিতর কেউ পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে। সহ্য করতে না পেরে ন্যাড়া দৌঁড়ে ঘরে গেল। হাতের কাছে যা পেল ব্যাগে ভড়ালো। তারপর চোখ মুছতে মুছতে পিছন গেট খুললো।
রাস্তায় গাড়ি একটানা হর্ন বাজাচ্ছে। সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। তার কানে বাজছে অরুনের কান্নার আওয়াজ।
Leave a Reply