‘আদিত্য বাবু বাড়ি আছেন নাকি, আদিত্য বাবু ।’ অপরিচিত কণ্ঠস্বরে বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে কে যেন ডাকছে। ডাকটা অন্যনা দেবীর কানে একটু খট্ করেই লাগে । উনি তখন লাউ চিংড়ি তরকারিটা ফুড়ন দিচ্ছিলেন। মৌরালা মাছের চচ্চড়িটা এর মধ্যেই হয়ে গেছে। করলা দিয়ে মুগডাল টাও নামিয়ে নিয়েছেন। এই পদ গুলি উনারা স্বামী-স্ত্রী দুজনই খুব ভালোবাসেন। তাই তো স্বামী আদিত্যনাথ বাবু চেষ্টা করেন প্রতি সপ্তাহে অন্তত একটা দিন বাজার থেকে এই প্রিয় খাবার এর উপকরণ গুলি আনতে। আদিত্য বাবু ডাকটা অন্যনা দেবীর কানে এ জন্য খটকা লাগে যে,এই এলাকার পাঁচ গাঁয়ের মানুষ স্বামীকে মাস্টার বাবু বলেই ডাকে। এখন বেলা প্রায় এগারটা বাজে। আদিত্য বাবু এই সময়টাতে একটু পড়াশোনা নিয়ে ডুবে থাকেন। সরকারি শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর নিয়ে সত্তরোর্ধ এ মানুষটি এখনো নিয়ম করে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেন। অভ্যাস মতো প্রাতঃভ্রমণ শেষে কয়েকটা প্রাণায়াম করে, সকালের হালকা জলযোগ করে পড়ার ঘরে বসে যাবেন। চাকরি থেকে অবসর নিলেও শিক্ষকতা করার অভ্যাস টা ছাড়তে পারেননি। অষ্টম থেকে দশম শ্রেণীর বিভিন্ন পাড়ার ছেলে মেয়েরা স্যারের কাছে পড়তে আসে। মাসে গুরুদক্ষিণা যাই আসুক না কেন এই বিদ্যাদানের কাজটা করে আদিত্যনাথ বাবু বেশ আছেন। নাতি-নাতনি বয়সী ছেলেমেয়েদের নিয়ে দিনের শুরুটা বেশ কেটে যায় । টাকা পয়সার কোন টানাটানি নেই, সেই কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিষয়ে পাশ করে এক বছরের মধ্যেই রাজ্য সরকারের শিক্ষা দপ্তরের চাকরি পেয়েছিলেন ।তখন বয়স কতোই বা হবে, বড়জোর বাইশ বছর বয়স । আদিত্যনাথ বরাবরই স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ, যার ফলে এখনো দেহের কাঠামোটা ভালোই ধরে রাখতে পেয়েছেন। পেনশনে যে পরিমাণে অর্থ রাশি পাচ্ছেন তাদের স্বামী স্ত্রীর হেসে খেলে চলে গিয়েছিলযাচ্ছে। ছেলে-মেয়ে দুটো মাসে মাসে বেশ মোটা পরিমাণ অর্থ রাশি মা-বাবার ব্যাংক একাউন্টে পাঠিয়ে দেয়। ছেলে সিদ্ধার্থ শর্মা ভারতীয় বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার, আর মেয়ে কেন্দ্রীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফের একজন ডাক্তার।
অনন্যা দেবী কাজের পরিচারিকার সহায়তায় রান্নার কাজ করছিলেন। এমন সময় কেউ একজন এসে ডাকছে আদিত্য বাবুকে। কিন্তু উনি তখন পড়ার মধ্যে ডুবে আছেন, তাই হয়তো শুনতে পাচ্ছেন না। অন্যনা দেবী স্বামীর উদ্দেশ্যে উঁচু গলায় বলেন,- ‘ কইগো শুনছো, কেউ তোমাকে ডাকছে, একটু বেরিয়ে দেখো, আমি এখন আসতে পারছিনা। স্ত্রীর ডাকে আদিত্যনাথ এবার সারা দেন এবং ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। দেখেন একজন আগুন্তক উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে।ওর হাতে একটা রেজিষ্টার।
‘কী ভাই,কাকে চাইছেন আপনি?’
‘এই বাড়িতে আদিত্যনাথ শর্মা বলে কেউ থাকেন?’
‘সে আর বলতে, আমি তো নিজেকেই আদিত্যনাথ বলে জানি । আর আমি কেন, সবাই সে কথা জানে । কিন্তু আপনি!’
‘আমি জেলা শাসকের অফিস থেকে আসছি। যদি আপনিই আদিত্যনাথ শর্মা হন তো আপনার একটি চিঠি আছে। কিন্তু তার আগে আপনি যে ওই ব্যক্তি তার একটি আই ডি প্রুফ দেখাতে হবে।’
‘বলো কি ভাই! বুড়ো বয়সে আমাকে কাগজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে আমি আদিত্যনাথ শর্মা কিনা!
‘ আজ্ঞে সেটাই নিয়ম।’
‘দুঃখিত তোমাদের অফিসের চিঠি আমার চাইনা।’
‘না হলে কিন্তু আপনার পরিবার খুব তাড়াতাড়িই মহা বিপদে পড়ে যাবেন।’
‘মানে!’, চমকে উঠেন আদিত্যনাথ বাবু ।গত ক’দিন আগেও মা ঝামেলা গেল, কী সব এন আর সি নামে কোনো একটা আইন নাকি লাঘু হতে যাচ্ছে। প্রত্যেক নাগরিকদের নাকি কাগজে পত্রে প্রমাণ করতে হবে যে তারা এই দেশেরই নাগরিক। অদ্ভুত কথা ! কথাটা শুনে শিক্ষক আদিত্যনাথ শর্মার আত্মাভিমানে ঘা লাগে। উনার হাতে তৈরি অনেক ছেলেমেয়ে আজ কেউবা প্রশাসনের উচ্চ পদের আধিকারিক, কেউ বা সমাজের নীতি নির্ধারক রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
কিন্তু কিছুই করার নেই সত্তোরোর্ধ এই মানুষটিকেও জেলা অফিসের এনআরসি বিভাগের সামনে দীর্ঘ লাইন দিয়ে, ওদের চাহিদামতো কাগজপত্র জমা দিতে হয়েছে।
আজ থেকে ঠিক পনের দিন আগে। পনের দিন পর আজ আবার কি চিঠি নিয়ে এলো কে জানে! আগন্তুক-এর চাহিদামতো আইডি দেখিয়ে চিঠি রিসিভ করেন আদিত্যনাথ বাবু। চিঠি নিয়ে পড়ার ঘরে গিয়ে খুলে পড়তে শুরু করেন। পড়া শেষ হতেই আদিত্য বাবুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। উনার স্ত্রী অন্যনা দেবীর এই দেশের নাগরিক হওয়ার সাপোর্টে যে সব কাগজপত্র জমা হয়েছে, তাতে এনআরসি আধিকারিকরা মোটেও সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। ওদের সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে আরো জোরালো কিছু কাগজ জমা দিতে হবে, নতুবা এনআরসি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। সময় মাত্র আগামী দশ দিন। চিঠিটা পড়ে প্রথমটায় হতাশায় ভেঙে পড়লেও পরক্ষনেই আবার প্রচন্ড রেগে উঠেন। ওদের এতো বড় স্পর্ধা হয় কিভাবে! য মা এই দেশটাকে দু-দুটো দায়িত্বশীল নাগরিক উপহার দিয়েছেন, একজন বিমান বাহিনীর দায়িত্বশীল অফিসার, আরেকজন সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দায়িত্বশীল চিকিৎসক, সেই মা’কে নাকি আজ প্রমাণ করতে হবে যে সে এই পুরা দেশের নাগরিক কিনা!
না, একজন আদর্শ শিক্ষক হিসাবে আদিত্যনাথ শর্মা এই অন্যায় আইন কোনোভাবেই মেনে নেবেন না। প্রশাসনের এই চিঠির উত্তর না দিয়েই প্রথম পর্যায়ের প্রতিবাদ জানাবেন তিনি। দেখা যাক রাষ্ট্র এ ব্যাপারে কতদূর যেতে পারে। প্রশাসন থেকে চরম আঘাত আসে ঠিক বারো দিনের মাথায়, আচমকা একদিন সকালে প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা, বিশাল পুলিশবাহিনী নিয়ে মাষ্টার আদিত্যনাথ শর্মার বাড়িতে এসে উপস্থিত। কাউকে কোন রকম আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই
মহিলা পুলিশ দিয়ে অন্যনা দেবী কে তুলে নিয়ে যায় ডিটেনশন ক্যাম্প নামক কোন এক মানব খোয়াড়ে।
আদিত্য বাবুর মতো এলাকাবাসী নর-নারীরা বাকরুদ্ধ, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। প্রতিবেশী একজন আগ্রহী হয়ে ফোন করে বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার সিদ্ধার্থ শর্মা আর সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ডাক্তার অনিতা শর্মা কে। এখানকার ঘটনা সব বিস্তারিত জানায়। সব কিছু জেনে ছুটে আসে অনন্যা দেবীর ছেলে-মেয়েরা। ওরা ছুটে যায় জেলা প্রশাসনের কাছে, এন আর সি ডিপার্টমেন্টে। ওরা যে কেন্দ্রীয় বাহিনীতে কর্মরত তাও জানায়, কিন্তু আখেড়ে কোনো কাজ হয় না । এমনকি ডিটেনশন ক্যাম্প নামক মানব খোয়াড়ে গিয়েও ওরা মায়ের সঙ্গে একবার দেখা করতে পারেনি । ওরা হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে আসে। সন্তান হিসেবে ওরা বিধ্বস্ত। কিন্তু বাবা আদিত্যনাথ শর্মা বিধ্বস্ত নন। সিদ্ধান্ত যা নেওয়ার নিয়ে নিয়েছেন।স্ত্রী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের মনে অনেক লড়াই করেছেন। এক সপ্তাহের মাথায় সমস্ত প্রেস মিডিয়াকে জানিয়ে জেলা শাসকের অফিসের সামনে আমরণ অনশনে বসেন আদিত্য মাস্টারের এই উদ্যোগে উৎসাহিত হয়ে, এই অমানবিক আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে প্রচুর নর-নারী শামিল হয় । আদিত্যনাথ মাস্টারের অসংখ্য ছাত্র ছাত্রী, গুণমুগ্ধ নাগরিক রয়েছে, সবাই একে একে অনশন মঞ্চে জড়ো হয়।
প্রশাসন চেষ্টা করেছিল পুলিশ দিয়ে অনশনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে। কিন্তু জন জমায়েত আর প্রেস মিডিয়া দের ক্যামেরার সামনে পুলিশ পিছু হঠে। অনশন ধর্নার তিন দিনের মাথায় স্বয়ং জেলাশাসক এসে দাঁড়ান
সত্যাগ্রহী আদিত্যনাথ শর্মার সামনে। ‘ ‘মাস্টারমশাই, আমি বিনীতভাবে অনুরোধ করছি, এই অনশন ধর্না প্রত্যাহার করে নিন।’
‘কিন্তু সাহেব এই অনশন এখন আর আমার ব্যক্তিগত পর্যায়ে নেই, এই যে শত শত নর-নারী দেখছেন, তারা প্রত্যেকেই চাইছে অমানবিক এই এনআরসি বাতিল করা হোক ওই ডিটেনশন ক্যাম্প নামক মানব খোয়াড়ের নরক যন্ত্রণা থেকে মানুষ গুলোকে মুক্তি দেওয়া হোক।’
‘আমি কি করবো বলুন, রাষ্ট্রীয় আইনের কাছে আমরাও অসহায়। তবে মাস্টার মশাই আমি আপনার জন্য একটি দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছি, আজ সকালেই আপনার স্ত্রী অনন্যা দেবী হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেছেন। ওই যে দেখুন অ্যাম্বুলেন্সে করে উনার দেহ আনা হচ্ছে, প্রশাসন চাইছে আপনার স্ত্রীর দেহ গ্রহণ করে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করুন।’
বিনা মেঘে বজ্রপাত হলে যেমনটা হওয়ার কথা, তেমন টাই হলো। হাজার হাজার নর-নারী ঘটনার আকস্মিকতায় বাকরুদ্ধ। একটা মুহূর্তের জন্য যেন পৃথিবীর সমস্ত গতি স্তব্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মুহূর্ত কয়েক পরেই সবাই ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ভেঙে পড়ে সদ্য প্রয়াত অন্যনা দেবীর পুত্র কন্যারা। ওরা ছুটে যেতে চায় নিজের জন্মদায়িনী মাকে দেখতে, কিন্তু রুখে দাঁড়ায় মাস্টার আদিত্যনাথ শর্মা। বজ্রকন্ঠে গর্জ্জে ওঠেন, ‘দাঁড়াও তোমরা। কে এই অন্যনা দেবী, আমরা তো তাকে চিনি না ,জানি না, তার জন্য আমরা এতো উত্তাল হচ্ছো কেন?’
উনার অমন অদ্ভুত কথা শুনে সবাই স্তম্ভিত। স্বয়ং জেলাশাসক চমকে উঠেউ ,’ আপনি বলছেন কি মাস্টারমশাই ! অন্যান্য দেবী যে আপনার স্ত্রী , আপনার সন্তানদের গর্ভধারিণী জননী ।তাহলে—‘
‘মাননীয় জেলা শাসক, আপনি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হয়ে অমন অসাংবিধানিক কথা বলতে পারেন না। ক্ষণিক আগেও আপনারা বলেছেন ওই অন্যনা দেবী এই রাষ্ট্রের কেউ নন । উনি রাষ্ট্রহীন দেশের ছিন্নমূল মানুষ। সুতরাং ওই মহিলা কোন ভাবেই এই আদিত্যনাথ মাষ্টারের স্ত্রী হতে পারেন না। হতে পারেন না কোনো সন্তানের জননী। আপনাদের স্বদেশী রাষ্ট্র উনাকে দেশ হীন পরিচয়ে, মানব খোয়াড়ে আবদ্ধ করে রেখেছিল। আর এখন ওই মানুষটার মৃতদেহের এর দায়ভার আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে চাইছেন কেন! চুপ করে থাকবেন না জবাব দিন।’
হাজারো নর নারীর কন্ঠে গর্জ্জমান স্লোগান উঠে, জবাব চাই জবাব দাও। জনতার বজ্রমুষ্টির সামনে অসহায় রাষ্ট্র,অসহায় রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি।বাধ্য হয়ে সরকারি সীলমোহরে, সহকারী লিখিত বিবৃতি আসে–
‘অন্যান্য দেবী জন্মগত দাবি নিয়েই এ রাষ্ট্রের নাগরিক ছিলেন। প্রশাসনিক ভুলের জন্য প্রশাসন দুঃখ প্রকাশ করছে এবং আগামী দিনে যাতে এমন দুঃখ জনক ঘটনা আর না ঘটে রাষ্ট্র দায়িত্ব নিয়ে সেদিকে খেয়াল রাখবে।
অসংখ্য নর নারী অন্যনা দেবীর মৃতদেহ নিয়ে শোক মিছিলে শামিল হয়। তবে এই মিছিল নিছক শোক জ্ঞাপন এর জন্য নিরব মিছিল নয়, এনআরসি নীতির বিরুদ্ধে লক্ষ কোটি কন্ঠে প্রতিবাদে গর্জ্জমান মিছিল।
Leave a Reply