তনুজের ব্যাপারে আজ লিখবো।সেই ক্লাস ফাইভ থেকে আমরা একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি।পড়াশোনায় সে ভালোই ছিল। মাধ্যমিকটা চারটে লেটার এবং স্টার মার্কস সহ খুব ভালোভাবে উত্তীর্ণ হয়। এরপর হায়ার সেকেন্ডারিতেও অল্পের জন্য ফার্স্টস ডিভিশন তার ভাগ্যে জুটেনি। কিন্তু ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি এবং ম্যাথমেটিকসে সে ভালো মার্কসই পায়। তবে বাংলা এবং ইংরাজিতে অতটা মার্কস পায়নি বলেই ফার্সট ডিভিশন তার হাতছাড়া হয়।
এরপর গ্রেজুয়েশনে কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে সে ভর্তি হয়। প্রথম দু-বছর ভালো রেজাল্ট করে। কোনও ব্যাক পেপার নেই।এবং অনার্স পেপারগুলোতে ৬০ শতাংশের উপরেই রয়েছে।
এবার থার্ড ইয়ারে ওঠার পর তারই এক বন্ধু তাকে একটা নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যাবসায় জুড়িয়ে দেয়।
এর আগের একটা কথা অবশ্য বলা হয়নি।তনুজের বাবার কিন্তু খুব ভালো রোজগার ছিল না তখন।আর তাই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই টাকা রোজগারের দিকে তার ঝোঁক চলে যায়।কিন্তু কোনোভাবেই কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছিল না সে।
আর তাই তার বন্ধু যখন তাকে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং এর ব্যবসার সঙ্গে জোড়ার কথা বলে তখন সে জুড়ে যায়।
অবশ্য এত সহজ হয়নি ব্যাপারটা। সাত হাজার টাকা চাই এই ব্যবসার সঙ্গে জোড়ার জন্য। বাবার হাতে সামান্য টাকাও নেই। তার এক পিসি তখন তাকে তিন হাজার টাকা দেন। বাবার হাতের সোনার আংটি বন্ধক রেখে আরও বাকি চার হাজার টাকা চলে আসে।
তারপর সে এডমিশন নিয়ে নেয়।
প্রথমে সে ভেবেছিল লোক তো অনায়াসেই জুড়তে পারবে সে।আর দু’দিকে দু’জন জুড়ে দিতে পারলেই তো আর কিছু চাই না।এরা আরও দু’জন জুড়বে,এবং এরপর এই চারজন আরও আটজন,এবং এই আটজন আরও ষোলো জন।বাস্তবিক যে ছেলেটা প্ল্যান দেখিয়েছিল সে এত সুন্দর করে এসব দেখায় যে মনে হয়েছিল যেন এই ব্যবসাটা বাঁ হাতের খেলা।খুব তাড়াতাড়ি সে কোটিপতি হয়ে যাবে।
কিন্তু এডমিশন নেওয়ার পর আস্তে আস্তে সে বুঝতে পারে যে ব্যাপারটা তো আর এত সহজ নয়। এত কঠিন যে হতে পারে ব্যাপারটা তা সে একবারের জন্যও কল্পনা করেনি।
একদিন-দু’দিন করে করে বেশ কয়েক দিন চলে যায়,কাউকেই সে প্ল্যান দেখাতেই নিয়ে যেতে পারে না।যাকেই সে বলে যে একটা ব্যবসা রয়েছে,তখনই তারা উত্তর করে যসে,ওহ নেটওয়ার্ক মার্কেটিং,লোক জোড়া–না বাবা আমরা এসবে নেই।
বর্তমান সময়ে এই করোনা কালে নতুন একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে যে,করোনা সংক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সামাজিক দূরত্বের বিধি পালন করা উচিত।কিন্তু নেটওয়ার্ক মার্কেটিং এ জোড়ার সঙ্গে সঙ্গে তনুজের সঙ্গে তখনই সেই নিয়মটা লাগু হয়ে যায়।কেমন যেন ছোঁয়াচে হয়ে যায় সে।কারোর সাথে সে হয়ত অন্য কোনও বিষয় নিয়ে কথা বলতে চায়।কিন্তু দেখা গেল লোকটা তার থেকে আগেভাগেই কয়েক হাত দূরে চলে গেল।না-জানি সে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং এর কথা বলে দেয় সে।আর ওই লোকটা তো নেটওয়ার্ক মার্কেটিং করবে না।কারণ,সবাই এর ব্যাপারে পুরো জ্ঞান নিয়ে বসে রয়েছে।
সেদিন তার মুখ থেকেই শোনা একটা গল্প আমি এখানে তুলে ধরছি।
তনুজ এবং আমার এক কমন ফ্রেন্ড রয়েছে যে কিনা মেডিসিনের ডাক্তার।
আমাদেরই আরেক বন্ধুর মায়ের চোখে কোনও প্রব্লেম দেখা দিয়েছে।এবার সে যখন তনুজকে একটা কিছু করার জন্য বলে,তনুজ তখন আমাদের সেই ডাক্তার বন্ধুটাকে এই ব্যাপারটা জানায়।তখন আমাদের ডাক্তার বন্ধু একজন আই স্পেসিলিস্ট একজনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ করিয়ে দেয়।
এবার ব্যাপারটা খুবই ছোট।কিন্তু এর থেকে অনেক কিছু বুঝতে পারে তনুজ।তার কথামত,একজন ডাক্তার,যে কিনা অন্তত সাড়ে চার-পাঁচ বছর এমবিবিএস এর কোর্স করার পর আরও আড়াই-তিন বছরের জন্য এমডি করার পরও যে কোনও এক বিষয়ে স্পেশালিষ্ট হয়।চোখের ডাক্তার হার্ট এর ব্যাপারে কিছু করতে পারবে না।হার্ট এর ডাক্তার চোখের ব্যাপারে কিছু করতে পারবে না। হাঁড়ের ডাক্তার চোখের ব্যাপারে কিছু বলতে পারবে না।এবং এরকম সব কিছুই।যে ডাক্তার যে বিষয়ে স্পেশালিষ্ট সেই ব্যাপারেই তিনি হাত দেবেন।কিন্তু নেটওয়ার্ক মার্কেটিং এর ব্যাপারে প্রায় সবাই সব কিছুই জানেন।পাড়ার মদন কাকা,বুলুদাদু,নিতাই দা,দুলু মিয়া,বাড়ির পিসি,কাকা,জেঠা,মামা,মামি সবাই-ই নেটওয়ার্ক মার্কেটিং এর ব্যাপারে জানেন।
আর স্বাভাবিকভাবেই এসব কারণে সেই সময়টাতে তনুজের ব্যবসা করতে অনেক অনেক কষ্ট হয়।ব্যবসাটাতে জুড়ে তো যায় সে।কিন্তু অন্য কারুকে সে তার সঙ্গে জুড়তে পারছে না।প্রায় দু-মাস চলে যায়।পড়াশোনা ঢপে উঠেছে।পকেটে টাকা নেই।সাইকেল চালিয়ে আর কত দৌঁড়নো যায়।
অনেক কষ্টে সে অবশেষে তার পাড়ারই এক সমবয়সী পাগল টাইপের ছেলেকে সে তার সঙ্গে জুড়ে দেয়।এবার তারা দুইজন মিলে মানুষ জোটাতে লেগে যায়।কিন্তু দু’জনেই প্রায় অসফল হয়ে পড়ে।আর যদিও অনেক ভুলিয়ে ভালিয়ে কাউকে তারা নিয়ে যায় প্ল্যান দেখাতে,বেরিয়ে এসেই সোজা তারা মানা করে দেয়–আরে ধূর এসব চেইন বিসনেস,এসবে আবার কেউ জুড়ে নাকি।এরপর থেকে আর কোনোদিনও আমাকে এরকম কোনও কিছুর জন্য ডেকে নিয়ে আসবে না।
কত লোকের সঙ্গে তনুজের এরকম করে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় তা কেউ বলতে পারবে না।আজ এর হিসেবও তার কাছে নেই।
এরকম করে করে আরও প্রায় ছ-মাস চলে যায়।এবং তার একদিকে দশ-বারো জন লোক জুড়েছে।কিন্তু অন্যদিকে তো সেই একজনই মাত্র রয়েছে।মাত্র একটা ১৫০০ টাকা চ্যাক সে সেই কবে পেয়েছে,
আর তারপর তো টাকা-পয়সা রোজগারের কোনও চিহ্নই সে দেখতে পাচ্ছে না।
এরই মধ্যে থার্ড ইয়ারের পরীক্ষাটাও তার দেওয়া হয়নি।ব্যবসাও হচ্ছে না।তবে নেগেটিভ কথাবার্তা আর কাজে অসফলতা তাকে একেবারে শেষ করে দিচ্ছে।
প্রায় এক বছর হয়ে গেছে তার এই ব্যবসায়।তার আইডির ডান দিকে যে ছেলেটা এডমিশান নিয়েছিল সে ভালোই একটা টিম বিল্ড করেছে।এবং সেই টিমের কাজে মাঝে মাঝে তাকে সেই জায়গায় যেতে হয়।একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে তনুজ।উইক সাইডে যেহেতু কাজ হচ্ছে না।তা-হলে স্ট্রং সাইড এর দীপকের সঙ্গেই না-হয় কিছুদিন কাজ করুক।কাজ করতে করতে করতে যদি কোনও।একজনকে পেয়ে যায়,এবং এরপর একে উইক সাইডে জুড়ে দিলেই তো কিছু টাকা আসবে।
প্রায় তিন মাস সে দীপকের বাড়িতে থেকে দীপকের সঙ্গে কাজ করতে থাকে।
দীপকের আইডিতে তো দু-চারজন জুড়ছে।কিন্তু উইক সাইডে জোড়ার কোনও প্রশ্নই উঠে না।
এই তিন মাসে যখন কোনও কাজ হচ্ছে না,একদিন যে দীপকের সাইডেরই কোনও এক ছেলে টুকাইয়ের সঙ্গে গুয়াহাটি চলে যায়।হাতে টাকা নেই।দীপকের কাছ থেকেই পাঁচশো টাকা ধার করে সে গুয়াহাটি পাড়ি দেয়।এবং এর মধ্যে যে কত নাটক রয়েছে তা আর বলার প্রয়োজন নেই এখানে।এ জগতের প্রায় সব নেটওয়ার্ক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত লোকই বুঝতে পারবে যে কী কী নাটক হতে পারে।
তবে একটা ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করতেই হয়।গুয়াহাটিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তনুজ।এবার টাকা কোথা থেকে জোগাড় করবে?তার এক পিসি রয়েছেন বাড়িতে,যিনি বিয়ে করেননি।একদিন দুপুরবেলা বাড়িতে ফিরে সে কাপড়-চোপড় ছেড়ে সোজা তার ঘরে চলে যায়।তিনি তখন বাড়িতে নেই।
এবং অনেক খোঁজাখুঁজির পর সে তার বিছানার ডান দিকে একটা সোনার চেন পেয়ে যায়।এবার যে ভেবে নেয় যে এই চেনটা বিক্রি করে সে কিছু টাকা পেয়ে যাবে,এবং সেই টাকা দিয়ে গুয়াহাটিতে চলতে পারবে সে।
ওইদিনই বিকেলে সে কাপড়-চোপড় নিয়ে আবার চলে যায় দীপকের বাড়িতে।এবং সন্ধ্যাবেলা বাজারে যায় দীপকেরই ডাউনলাইনের কোনও ছেলে প্রদীপকে নিয়ে।কিন্তু সোনার দোকানে গিয়ে সে জানতে পারে যে এটা আসল সোনা নয়,নকলের কারবারিদের নাটক এখন।
এবার কী করা যায়?সে তো বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছে যে ক’দিনের জন্য সে গুয়াহাটিতে যাচ্ছে।এবং সেই হিসেবে দীপকের কাছ থেকে পাঁচশো টাকা ধার করে আরও দু’দিন বাদে সে গুয়াহাটি চলে যায়।
সেখানে গিয়ে প্রদীপের মামাবাড়িতেই আশ্রয় নেয় তারা।অনেক বড়ো কাহিনী এটা।কিন্তু একটু ছোট করেই বলে নিচ্ছি এখানে।প্রায় ছ’মাস সেখানে থেকেও কোনও কাজের কাজ কিছু হয়নি।একটা লোককেও তনুজ তার উইক সাইডে এডমিশান করাতে পারেনি।প্রদীপ অবশ্য দু-চারজনকে এডমিশান করিয়েছে।
কোনও একজন লোকের বাড়িতে তো আর দিনের পর দিন থাকা যায় না।তাই দু-হাজার আট এর জানুয়ারি মাসে একদিন তার শহরের এই কোম্পানির ছেলেরা গুয়াহাটিতে একটা ট্রেনিং এর জন্য যায়।এবং আসার সময় তাদের সঙ্গে গাড়িতে করে সে বাড়িতে চলে আসে।
সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় যে এই ব্যবসা তার দ্বারা হবে না।তাই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় সে,যে পরীক্ষা দেবে সে।মন দিয়ে পড়াশোনা করতে থাকে।এবং মার্চ মাসে পরীক্ষায় বসে।
আরও তিন মাস পর রেজাল্ট বেরনোর পর জানা যায় যে,এক পেপারের জন্য তার বিএসসিটা কমপ্লিট হয়নি।মন খারাপ হয়ে যায় তার।
সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ একদিন দীপক এসে হাজির হয় তার বাড়িতে।এবং ব্যবসার কথা বলে।
এবার পাগল তনুজের আবার ব্যবসার দিকে ঝোঁক বাড়ে।চলে যায় সে একটা ওয়ার্কশপে।চার দিনের ওয়ার্কশপ।এবং সেই ওয়ার্কশপের পর কিছুটা চার্জ হয়ে সে চলে যায় শিলচরে,তার এক আপলাইনের সঙ্গে।সেখানে তারা প্রায় মাস চারেক কাটিয়ে নেয়।কেউই এডমিশন নেয়নি।কিভাবে যে তখন এখানে সেখানে যেত সে তা বোধহয় আজ সেও বলতে পারবে না।
শিলচরের একটা ঘটনা তার এখনও মনে রয়েছে।সেদিন সে আমাকে তা জানায়।একদিন সকালে নাকি তার সেই আপলাইন কোথাও চলে যায়।সারাদিন বাড়ি ফেরেনি।যে ভাড়া বাড়িতে তারা থাকত,সেই বাড়িতে।রাত্রিবেলাও ফেরেনি লোকটা।তনুজের কাছে তখন কোনও মোবাইল ফোনও নেই।পরের দিন দুপুরবেলা লোকটা ফিরে আসে।এবং এই পুরো দেড় দিনের মধ্যে তনুজের পেটে কোনও কিছু যায়নি।
এরকম করে আরও কত কিছু করতে হয়েছে তাকে।
শিলচর থেকে ফিরে এসে বাড়িতে আরও কিছুদিন। তারপর আসাম পেপার মিলের একটা কোয়াটারে বেশ ক’মাস থাকে সে। ঘরটা ভাড়া নেয় তার আপলাইন। সে মাঝে মাঝে আসে। এক হাজার টাকা ঘরভাড়া। এবং পাশের ঘরে এক পরিবার থাকে। তার ঘরে খাওয়া। তাকেও মাসে এক হাজার টাকা দেওয়া।
পকেটে যেহেতু টাকা নেই। সেই কোয়াটারে পাড়ি দেওয়ার পূর্বে বাবার কাছ থেকে সাতশো টাকা নিয়ে যায় তনুজ। এবং সেই টাকা দিয়ে অন্তত মাস তিনেক কাটিয়ে নেয় সে।এবং এরপর সেই বছরের দূর্গাপুজোর ষষ্ঠীর দিন সে বাড়ি চলে আসে।
এর আগে মহালয়ার দিন বিচ্ছিরি একটা লজ্জা থেকে সে বেঁচে যায়। যে বাড়িতে সে ভাড়া থাকত সেই বাড়িতে আরও এক পরিবার ভাড়া থাকে। সেই পরিবারে তনুজের বয়সীই এবং তার থেকে বয়সে একটু বড়ো তারা দুই বোন রয়েছে।তাদের সাথে তনুজের ভাল সম্পর্ক হয়ে যায়। মহালয়ার দিন সকালে তারা সবাই মিলে হাঁটতে বেরোয়। ফেরার সময় সে ও ওই দুই মেয়ে একটা মিস্টির দোকানে ঢুকে যায়।সিঙাড়া এবং কফি অর্ডার করে তারা। এবার তনুজের কাছে মাত্র কুড়ি টাকাই রয়েছে। এর থেকে যদি পনেরো টাকা সে খরচ করে ফেলে তা হলে বাড়ি ফিরবে কিভাবে? পুজোর আগে তো তাকে বাড়ি ফিরতে হবে। এবং বাড়ি ফিরতে চাই বারো টাকা।
কিন্তু কিছু করার নেই।সম্মান বাঁচানোর জন্য তাকে পনেরো টাকা খরচ করতে হয়। এবং এরপর যখন তারা বাড়ি ফেরে তখন তার হাতে রয়েছে পাঁচ টাকা। পুজো চলে আসছে,বাড়ি ফেরা চাই।
এরই মধ্যে পঞ্চমীর দিন তার এক আপলাইন কোয়াটারে এসে হাজির হয়। সারাটা দুপুর কাটিয়ে সে বিকেলে অন্য কোথাও চলে যাবে।
তনুজ একটা ফন্দি আঁটে যখন ওই লোকটা একটু সময়ের জন্য বাথরুমে যায়।
তনুজ তার আপলাইনের মানিব্যাগ থেকে দু’শো টাকা সরিয়ে নেয়। এবার তো সে পয়সাওয়ালা।
এরকম আরও কত শত ঘটনা ঘটেছে এই নেটওয়ার্ক ব্যবসায় তার সাথে।
সেই বছরেরই নভেম্বর মাসে সে ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার অফার পায়। সেখানে তার এর আপলাইন কাজ করছে।সেখানে গিয়ে তনুজ তার ব্যবসা খাঁড়া করতে পারবে। এবং ইতিমধ্যে আরও তিনজন লোককে সে তার উইক সাইডে এডমিশান করিয়ে নিয়েছে। কিন্তু একটা বছর তেইশের ছেলে এবং তার কুড়ি বছরের বোন দু’জনই কাজ করতে চায় না।
তনুজ ভেবে নেয় যে লাস্ট একটা ট্রাই করতে হবে।তার হাতে প্রায় চার হাজার টাকা রয়েছে। সেই টাকার ওপর ভর করে সে দিল্লি পাড়ি দেয়।
দিল্লিতে তার সেই আপলাইন, পশ্চিমবঙ্গের একটা ছেলে এবং ঝাড়খণ্ডের আরেকটা ছেলে রয়েছে। সেখানে তাদের একই কাজ,সকালবেলা তারা বেরিয়ে গেলো স্ট্রেঞ্জার মিটিং এ। এবং বিকেলবেলা বাড়ি ফিরে এলো তারা। এরকম করে দিনের পর দিন চলতে লাগলো। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ অতিক্রম হল,তনুজ কিন্তু কাউকে এডমিশান করাতে পারেনি। ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ চলে গেল। তনুজের কোনও কাজ হয়নি। ডিসেম্বর মাসটাই শেষ হয়ে গেল। তনুজের কোনও কাজ হয়নি। এদিকে তার স্ট্রং সাইডে বেশ ক’জন লোক রয়েছেন। কিন্তু কেউই কাজ করছেন না। নেটওয়ার্কিং এর ভাষায় যাকে বলে মারা গেছেন। জানুয়ারি মাসে চারজন লোককে এডমিশান করায় তনুজ। এর ফলে সাড়ে চার হাজার টাকা পেয়ে যায় সে। এতে আরও কিছুদিন চালিয়ে নেয় সে। কিন্তু কেউই কাজ করতে চায় না। তাই বাধ্য হয়ে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে দিল্লির পাট চুকিয়ে সে বাড়ি ফিরে আসে। এবং বাড়ি ফিরে এসে যে অনার্স পেপারটাতে তার ব্যাক রয়েছে তার তৈরারি করে। এবং অবশেষে দু-হাজার-নয় সালে সে গ্রেজুয়েট নয়।
জুন-জুলাই মাসে আবার তার মাথায় একটা ভূত ঢুকে। সে আবার এই নেটওয়ার্কিং বিসনেসটা করবে। এবার সে কোনোমতে তার বাবাকে রাজি করিয়ে তাদের গ্রামের বাড়িতে ক্ষেতের জমি রয়েছে। এর কিছু অংশ বিক্রি করে নেয় এবং এর থেকে প্রায় তিরিশ হাজার টাকা হাতে নিয়ে নিজেই নিজের স্ট্রং সাইডে এবং উইক সাইডে এডমিশান নেয়। আবার সে কাজ শুরু করে। ততদিনে আমাদের শহরে পুরনো যারা এই নেটওয়ার্কিং ব্যবসা করছিল তাদের মধ্যে সামান্য কিছু মানুষ কাজ করছেন।
কিন্তু গুয়াহাটিতে কাজ হচ্ছে। এবং কোম্পামি হেলথ কেয়ার প্রোডাক্ট এবং গ্রোসারি প্রোডাক্ট নিয়ে এসেছে। যে কেউ সেগুলো বিক্রি করতে পারে। এবং এর থেকে মুনাফাগুলো আপলাইনও পেতে পারে।
প্রায় পনেরো হাজার টাকা হাতে নিয়ে সে গুয়াহাটি পাড়ি দেয়। কাজ হচ্ছে না কাজ হচ্ছে না এরকম করে আস্তে আস্তে সে এবার তার টিম বিল্ড হতে থাকে। তার তিনটে আইডিই মোটামুটি একটা হিসেব মেনে চলে এগোচ্ছে।
মাঝে অনেক কিছুই রয়েছে।কিন্তু নন- নেটওয়ার্কার এর জন্য এসব বোঝা সম্ভব নয়।ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রায় দু’শো জনের একটা টিম বিল্ড করে সে। এবং তাও আবার তার তিন আইডি মিলিয়ে রয়েছেন এরা। একটা ভালো এমাউন্ট সে পাচ্ছে এর থেকে।
সবকিছু যেন কেমন একটা অন্য গতিতে চলছে।ইতিমধ্যেই আরও এক বছরের মাথায় ফেসবুক চলে আসে। এবং এর মাধ্যমেও তার টিম বিল্ড হতে অনেক সাহায্য হয়।
বছর তিনেকের মাথায় সারা দেশের প্রায় আট রাজ্যে তার নেটওয়ার্ক তৈরি হয়। আরও পাঁচটা আইডি সে নিজের নামে নিয়ে নেয়। এবার তার মোট আট’টা আইডি রয়েছে। এবং প্রতি আইডি থেকেই পাসে প্রায় দেড় দু-লাখের চ্যাক চলে আসতে থাকে।
ইতিমধ্যে আবার সে খুব ভালো ট্রেনার হয়ে যায়। কোম্পানির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাকে যেতে হয়। এর জন্য আলাদা কিছু টাকা তার পকেটে এসে ঢুকে যায়।
আরও বছর তিনেক চলে যায়। এবার তার নিজের মোট আইডির সংখ্যা ৪৭। এবং প্রতি আইডিতেই মাসে অন্তত চার- পাঁচ লাখ এসে জমা হচ্ছে। প্রচুর টাকার মালিক হয়ে গেছে৷ মোটামুটি নেটওয়ার্ক ইন্ডাস্ট্রিতে তনুজ এক বিশাল নাম। কিন্তু বলে না,মানুষের ক্ষিদে মানুষকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে চলে যায়। এবং তনুজের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এরকম। সে কোম্পানির শেয়ার কেনে নেয়। এবং একে দেশের বাইরে নিয়ে যায়। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া,ইন্দোনেশিয়া,জাপান সর্বত্রই আজ তার অবাদে বিচরণ।
মাসে অন্তত কুড়ি-বাইশ কোটি টাকা সে হাতিয়েই নিচ্ছে। কিন্তু দু-হাজার ষোলো সালে তার মাথায় আরেকটা খেয়াল আসে। সে ভেবে নেয় যে,এবার ইউটিউবে সে একটা নিজের চ্যানেল তৈরি করবে। আজ দু-হাজার বিশ সালে তনুজের ইউটিউবের সাবস্কিপশনের সংখ্যা প্রায় ৩০০ মিলিয়ন। তার প্রতিটি ইউটিউবের ট্রেনিং বিডিও অন্তত ১০০ মিলিয়ন বার দেখা হচ্ছে। দিন দুয়েক বাদে বাদে সে ইউটিউবেই কোনও না কোনও বিষয়ে ট্রেনিং দিয়েই চলেছে।
এবং এই আস্তে আস্তে হয়ত দেশ ও পৃথিবী করোনা নামক অতিমারীকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে চলেছে। আর এই সময়টাতে বিশ্বের প্রায় সব বিভাগই কর্মী ছাটাইয়ের পথে হাঁটছে। কিন্তু আমার বন্ধু তনুজ একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে যারা যারা কাজ ছাড়া হচ্ছেন আজকাল,
সবাই যাতে কোনও না কোনও নেটওয়ার্ক ব্যবসার সাথে নিজেকে জুড়ে নেয়।মাত্র আট-দশ হাজার টাকায় যাতে তারা নতুন একটা ব্যবসা শুরু করতে পারে।
হ্যাঁ,এটা ঠিক যে তনুজ নিজেই আমাকে বলেছে,এই ব্যবসা নিয়ে সমাজে যত ভালো কথা প্রচলিত রয়েছে, এর চেয়ে ঢের বেশি রয়েছে এর বিরুদ্ধে। কোনও লোক হয়ত বছর দশেক আগে কোনও এক নেটওয়ার্ক ব্যবসার সঙ্গে নিজেকে জুড়িয়েছিল।কিন্তু কোনও কিছু করতে পারেনি। তাই আজ বলে বেড়াচ্ছে যে আট হাজার কিংবা দশ হাজার টাকা তার চলে গেছিল। কিন্তু লোকটা নিজে যে কোনও কিছুই করেনি তা ভুলে গেছে৷ এরকম কত শত লোক রয়েছেন এই জগতে যারা অন্য কোনও ব্যবসায় কিংবা অন্য কোনও জায়গায় হয়ত লাখ লাখ টাকা খুইয়েছেন। কিন্তু তা ভুলে গেছেন। এবার নেটওয়ার্ক ব্যবসায় কবে তার আট-দশ হাজার টাকা চলে গিয়েছিল তা সে মনে লাগিয়ে বসে রয়েছে।
তনুজ আমাকে বলেছিল,হ্যাঁ,অনেক কোম্পানি রয়েছে যারা নেটওয়ার্ক ব্যবসার নাম নিয়ে সমাজ থেকে অনেক টাকা হাতিয়েছে। কিন্তু কোনও এক ইশকুলের দশটা ছাত্র মাধ্যমিকে ফেল করে নিলে তো আর বাচ্চাদের মা বাবারা তাদের ছেলেমেয়েদের পড়ানোই বাদ দিয়ে দেন না।
তনুজ আমাকে এও বলেছে,এই জগতে সবাই-ই আর কিছু জানুক কিংবা না জানুক,নেটওয়ার্ক ব্যবসার ব্যাপারে সবাই জানেন। কোনও কিছু না জেনে, এর ব্যাপারে স্টাডি না করে সবাই নেটওয়ার্ক ব্যবসার মাস্টার হয়ে হয়ে বসে রয়েছেন। মাধ্যমিক মাস করতে হলেও অন্তত দশ বছর চাই। কিন্তু নেটওয়ার্ক ব্যবসায় সফল সবাই একদিনেই হয়ে যেতে চান।
এই জগতে মানুষের কোনও অভাব নেই। মানুষের প্রয়োজনের শেষ নেই। তবে এ জায়গায় দাঁড়িয়ে যদি মানুষের চাহিদা মেটাতে পারে কোনও কোম্পানি তা-হলে কেন এর গ্রোথ হবে না?
লকডাউনের এই সময়টাতে সে ঘরে বসেই কাজ চালিয়ে নিয়েছে। দেশ এবং বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় যে স্টোরগুলো রয়েছে সেগুলোও খোলা রয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের মিটিং এর মাধ্যমে নতুন নতুন লোকও জুড়ছেন। এবং তার বিশ্বাস আগামীতে এই ব্যবসা এ জগৎকে আরও বেশি পাশে পাবে।
এতটুকু অবধি স্বপ্ন দেখার পরই ঘুম ভেঙে যায় অরিন্দমের। এবার সে সারাটা সকাল বসে বসে ভাবতে থাকে, কে এই তনুজ?কে এই গল্পের আমিটা? কে প্রদীপ? এবং কে বাকি অন্যান্যরা? কোন্ কোম্পানির ব্যাপারে সে স্বপ্ন দেখে চললো সারাটা রাত?
সাধারণ এক ঘরের ছেলে সে। সাধারণ ব্যবসা করে। লকডাউনের সময়টাতে ব্যবসা হয়নি বলে অনেক কষ্টে তাকে জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে। সরকার অমুখ-তমুখ এবং হাজারো প্যাকেজের কথা বললেও শুধুমাত্র রেশনের চাল আর ডাল ছাড়া কোনও কিছুই তার ভাগ্যে জুটেনি। কারোর কাছ থেকে সে কোনও কিছু চেয়েও নিতে পারেনি,আবার কেউ তাকে কোনও কিছু যেতে দিতেও আসেনি। আস্তে আস্তে যখন লকডাউনে শিথিলতা নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার,তখন সে আবার ব্যবসা শুরু করে। কিন্তু আগের মতো রোজগার নেই। তাছাড়া, প্রতিদিন যেভাবে করোনায় আক্রান্ত এবং মারা যাওয়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে, ব্যবসা করতেও ভয় হচ্ছে। আর এ জায়গায় দাঁড়িয়ে কোথা থেকে এই নেটওয়ার্ক ব্যবসার কথা তার মাথায় এলো এবং এ নিয়ে এত কিছু স্বপ্ন দেখে ফেললো তা ভেবে কোনও কুলকিনারা পাচ্ছে না অরিন্দম।
তবে একটা ব্যাপার তার খুব ভালো লেগেছে–এই যে কোটি কোটি টাকার হিসেব। ছোটবেলা থেকেই গরিবির মধ্যে বড়ো হওয়া অরিন্দম সবসময়ই স্বপ্ন দেখে থাকে যে তার খুব টাকা হবে। আবার আরেকটা ব্যাপারও তার খুব ভালো লেগেছে–তাও হলো ট্রেনিং বা বক্তৃতা। মাঝে মাঝেই সে স্বপ্ন দেখে, যে সে স্টেজে উঠে কথা বলবে,আর বেশ কিছু লোক তার কথা শুনে বার বার হাততালি দেবে। বাস্তবে না-ই বা হল কিন্তু স্বপ্নে তো সে এই দুই জিনিসই পেয়ে গেছে। এটাই আজ তার জন্য যথেষ্ট। এই একটা স্বপ্নের পাশে পাশে চলে, কোলবালিশের মতো একে জড়িয়ে ধরে সে আরও কয়েক দিন কাটিয়ে নিতে পারবে।
Leave a Reply