আমার এবার জামা কিনে দিতে হবে বাবা,বলে সরাসরি চোখের দিকে তাকায় শ্যামলী। বাবা আল আমিন চাকরি করে ইটভাটায়। ম্যানেজার পোষ্ট। যদিও নামে ম্যানেজার আসলে কাজটা কেরানীর। সকাল ৯ টা থেকে রাত বারোটা। ইট বেঁচো,দাম লিখো,লেবারদের টাকা দাও,কয়লা কেনো,কয়লার হিসাব রাখো বহুত ঝুক্কি-ঝামেলা। মেয়ে এখনো সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে। অস্বস্তি লাগে আমিন সাহেবের। অনেক কষ্টে কসে এক চড় লাগাবার ইচ্ছাকে দমন করে। শ্যামলী ক্লাস সেভেনে পড়ে বদরগঞ্জ গার্লস স্কুলে। এ বয়সের মেয়েরা জেদী হয়, সাজা গুঁজার দিকে একটু ঝোঁক থাকে। আবেগের বসে এরা আত্মহত্যাও পর্যন্ত করতে পারে। এই তো কয়েকদিন আগে পত্রিকায় আসছে খবরটা,মেয়েকে জামা কিনে না দেওয়ায় গলায় দড়ি দিয়ে মারা গেছে তের বছরের এক মেয়ে। আমিন সাহেবের রাগ লাগে এরা কেমন মেয়ে। এরা না মায়ের জাত। এরা বাবার কষ্ট বুঝবে না। বাবা,কিছু বলছ না যে ? আনবা তো আজকে নাকি?
হার মেনে নেয় আমিন সাহেব বলে আচ্ছা মা দেখি। ইটভাটায় যেতে দেরী হয়ে যাবে আজ। শ্যামলীর মা রুকাইয়া টিফিন বাটিতে দুপুরের খাবার দেয়। টিফিন বাটি খুলে আমিন সাহেব প্রতিদিন অবাক হয়। সাধারণ তরকারিকেও অসাধারণ বানিয়ে দেবার এক জন্মগত ক্ষমতা রুকাইয়ার। একেক দিন একেকটা তরকারি।একদিন ডাল দিয়ে সজনা,একদিন কুমড়োবড়ির ভর্তা , একদিন ছোটমাছ, বেগুন আলু দিয়ে কুচিকুচি করে রান্না। আবার কোন দিন কালোজিরার ভর্তা। কতধরনের ভর্তা যে জানে এ মহিলা। কোন চাহিদা নাই,সারাদিন সংসার নিয়ে আছে। কোনদিনও কিছু চায়নি অথচ মেয়ে হয়েছে ঠিক তার উল্টো। রুকাইয়া ধমক দেয়,দু একদিন চড় থাপ্পড়ও দিয়েছিলো। অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় নাই। তবে এ স্বভাব মনে হয় কিছুটা ওর দাদার কাছ থেকে পেয়েছে। ওর দাদা আবু সিকান্দার খুব সৌখিন লোক ছিলেন। সে আমলে ইস্ত্রি করে কাপড় পরতো।একটা ফনিক্স সাইকেল ছিল আর একটা তিন ব্রান্ডের ফিলিপস রেডিও। হাটের দিন সাইকেলে রেডিও ঝুলিয়ে লালদিঘি হাটে যেতেন। সেই সাইকেল আর রেডিও দেখার জন্য লোক জমে যেত। লোকটা শেষ জীবন পর্যন্ত সৌখিনতা করে যেতে পেরেছেন তবে সৌখিনতা করতে গিয়ে সব জমি বিক্রি করে দিতে হয়েছে। এমনকি ভিটাবাড়িও বিক্রি করে দিয়ে ভাড়া বাড়ীতে উঠতে হয়েছিল। সব টাকা শেষ হলে তবেই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে সৌখিন দুচোখ বন্ধ করেছে। দীর্ঘশ্বাস চেপে সাইকেলে চেপে বসে আমিন সাহেব। সংসারটার জন্য কম কষ্ট তো করে না। তিন কিলোমিটার সাইকেলে চড়ে যায়। অটোরিকশায় গেলে দশদশ বিশ টাকা লাগে এজন্য এ শরীর নিয়ে সাইকেল চেপে ভাটায় যায়। সন্তানরা বুঝবে না কেন? অবশ্য তিন সন্তানের মধ্যে বড়জন আর ছোটজন লক্ষি। কোন দাবি নেই তাদের। এই যে দুদিন পর ঈদ এখনও কিছু কিনে দিতে পারেনি কিন্তু এজন্য কোন টু শব্দ নেই। জানে বাবা টাকা পেলে অবশ্যই কিনে দিবে। মেজোজন কেন যে এমন হলো? অথচ আমার আব্বা কখনই ঈদে কিছু কিনে দেয় নাই আমাদের। মনে পড়ে আমিন সাহেবের ঈদ হলে নানাবাড়ি থেকে আসতো নতুন জামা,মায়ের জন্য শাড়ি,আব্বার জন্য নতুন লুঙ্গি, পান্জাবী। ঈদের আগে রাকিবুল মামা আসতো তার এইট্টি মোটরসাইকেল চেপে। সাথে চিনি,সেমাই,সবার জামা। আহা, কি সব দিন ছিলো। কই তারা ছয় ভাইবোন তো কখনই আব্বারে বলে নাই,আমার এবার জামা চাই। সাইকেল অফিসের বারান্দায় রেখে নিজের চেয়ার টেবিলে বসে আমিন সাহেব। ভাটায় আগুন নিভে গেছে, লেবাররা ইট বের করে এনে সাজায় রাখছে। এক নম্বর, দুই নম্বর, তিন নম্বর, ঝামা ইট। ইদ্রিস এক কাপ চা দিয়ে যায়। ফ্যাকাসে চা,কম পাতি মারা। তারপরও চুমুক দেয় আমিন সাহেব। দোকানে খেতে গেলে পাঁচ টাকা। আজ রিয়াজুল পাইকাড়ের কাছে বেতন চেতে হবে। মাসের সাত তারিখ এখনো বেতন দেয় নাই। জোরও করতে পারে না। চাকরি চলে গেলে কি করবে? ভাবতেও ভয় লাগে। পাঁচজন মানুষের সংসার। অথচ জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো। গ্রামে তখন স্কুল হচ্ছে যে কেউ ঢুকতে পারতো বেতন ১৫০ টাকা। আব্বাকে বলাতে বললো,কি দরকার এসব চাকরগিরি করার। জমি দেখাশোনা করো। এরচেয়ে বেশী টাকা পাবা। কথা সত্যই। কিন্তু জমি বিক্রির নেশা, বড় নেশা। সব শেষ করে চলে গেলেন আব্বা। চাকরিটা থাকলে আজ আর ইটভাটায় কাজ করতে হতো না। শাহআলম মাষ্টার তো বন্ধু মানুষ। মাষ্টারি করে কতো উন্নতি করছে। রাস্তায় কতোজন সালাম দেয়, দেখতেও ভালো লাগে। আসসালামু আলাইকুম স্যার। আর নিজে সারাজীবন শুধু সালাম দিয়েই গেলো। এমনকি ইদ্রিসও সালাম না দিয়ে বলে ও ম্যানেজার এতো দেরী করি আলু।
একজন কাস্টোমার এসেছে কারে চড়ে। গম্ভীর মুখে ইট দেখছে। নিজ অভিজ্ঞতা থেকে জানে বেশী আগ্রহ দেখানো যাবে না।গায়ে পড়ে বলা যাবে না,আমাদের ইট সবচেয়ে ভালো তাহলে সন্দেহ করবে। উদাস ভঙ্গিতে বসে থাকতে হবে আর ধমক দিতে হবে এরেওরে। একটা খানদানি ভাব ফুটায় তুলতে হবে। তবে কাস্টমারের পাশে থাকবে মানিক চন্দ্র। সে বলবে একেকজন বিখ্যাত ব্যক্তির নাম যারা ইট নিয়ে গেছে বাকি সব বুকিং। ইট কিছু আছে। এ মাসেই শেষ হয়ে যাবে। নতুন আগুন দিবে সামনের মাসে। এতে কাস্টমার তাড়াহুড়ো করে চলে আসবে ম্যানেজারের কাছে।
আপনাদের ইট দেখলাম ভালোই মনে হচ্ছে। রংপুর থেকে আসছি ইটের জন্য। শুনলাম বদরগন্জের ইট ভালো বলে হাসলো কাস্টমার।
এবার জাল তুলতে হবে,আস্তেধীরে। আমিন সাহেব বলে জ্বী ঠিকই শুনছেন। এখন তো বেশী ইট দিতে পারবো না। সব বুকিং। তো আপনার কতগুলো দরকার।
এবার তাড়াহুড়া করতে গিয়ে জালে পড়ে কাস্টমার। বেচা বিক্রি মন্দ না। প্রচুর লাভ। তারপরও এরা বেতন দিতে গড়িমসি করে। দশজন শেয়ারে এই আর এম ইট ভাটা।
দুপুরে চিংড়িমাছ ভর্তা আর মুগের ডাল দিয়ে ভাত খায় আমিন সাহেব। পেট টানটান হবার কারনে এ সময় খুব ঘুম পায়। বাইরে ঠা,ঠা রোদ। লেবাররাও খেয়ে বসে আছে ছায়ায়। আশেপাশে তেমন গাছ নেই,যেগুলো আছে সেগুলোও মরমর অবস্থা। এখন এদিকে আম,কাঁঠাল ফলন কমে গেছে। পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে সবাই জানে কিন্তু কিছুর করার নাই। রিয়াজুল পাইকাড়রা ক্ষমতাধর। মাঝেমাঝে পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজন আসে সেদিন হেবি খানাপিনা হয় তারপর ম্যানেজারের হাত দিয়ে মোটা খাম দেয়া হয়। হাসতে হাসতে চলে যায় পরিবেশ রক্ষকরা।
আসরের পর মোটরসাইকেল করে আসে রিয়াজুল পাইকাড়। এ সময় পুরাটাই দাঁড়িয়ে থাকতে হয় আমিন সাহেবকে। হিসাব বুঝিয়ে দেবার পর বেতনের বিষয়টা তুলে আমিন সাহেব।
হ, বুজছু তোমারে ঈদ নাগছে,হামরা এলা জালাত বাঁচি না। আইজ হবার নায়।কাইল নেইস টাকা। বলে হাম্বিতাম্বি করে চলে গেল রিয়াজুল পাইকাড়।
চোখের সামনে শ্যামলীর মুখটা ভেসে ওঠে। কি বলবে ওকে আজ শুক্রবার,রবিবার ঈদ। রাত বারোটার পর সাইকেল চেপে বসে আমিন সাহেব। আকাশ অন্ধকার, বৃষ্টি হবে মনে হয়। রাস্তায় তেমন লোক নেই। জোর প্যাডেলে সামনে এগিয়ে যায় আমিন সাহেব। একটা মাইক্রোবাস আসছে মনে হয়। হাইবিমের আলোতে চোখ জ্বলে যায় আমিন সাহেবের। কেঁপে ওঠে হ্যান্ডেল ধরা হাত। জোরে ধাক্কা মেরে চলে যায় ঘাতক মাইক্রো।
ফিনাইলের গন্ধে ঘুম ভাঙে আমিন সাহেবের। সামনে রুকাইয়া,দুই ছেলে মেয়ে শুধু শ্যামলী ছাড়া।
শ্যামলী কই? বলে ইতিউতি চায় আমিন সাহেব।
শ্যামলী এসে বাবার পাশে বসে। চোখ লাল,মুখ শুকনো।
মারে তোর জামা কাল কিনে দিব বলে শ্যামলীর দিকে তাকায় আমিন সাহেব।
বাবা ঈদ তো শেষ, আমার জামা লাগবে না। তুমি দুইদিন অজ্ঞান ছিলে। আমি আর কখনও জামা চাবো না বাবা,বলে বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে শ্যামলী।
পাশের ওয়ার্ডে মনে হয় কেউ মারা গেছে।কান্নার রোল উঠেছে।আমিন সাহেবের চোখও ভিজে যায় আনন্দ আর ব্যর্থতায়। আজ সোমবার। এবার ঈদ হলো না। না হোক, বেঁচে থাকলে আরও ঈদ আসবে জীবনে। ছেলেমেয়েদের দুহাতে জড়িয়ে শান্তিতে চোখ মুছে।
Leave a Reply