শুক্রবার, ০৯ Jun ২০২৩, ০৫:১৮ অপরাহ্ন

মাটির কাছে-রাজকুমার শেখ

মাটির কাছে-রাজকুমার শেখ

ঘন বট গাছটার নিচে এখন গভীর ছায়া। মাথার উপর সূর্যটা টগবক করছে। গরম কালে মাঠে কাজ করা যে কত কঠিন কাজ সেটা ভালো করেই জানে মালেক। চাষি পরিবারে জন্ম হলে যা হয়। তার পূর্বপুরুষও চাষবাস নিয়ে জীবন কাটিয়ে গেছে। তারও জীবন কাটছে মাটি নেড়ে। মাটির মতন আপন কে আছে এ জগতে। মালেকের কথা যেন শোনে মাটি। তার বুকে যে বীজ-ই পোঁতে সে তা সবুজ ডানা মেলে ফুঁড়ে ওঠে মাটি থেকে। ফুল দেয়। ফল দেয়। মালেক কখনো মাঝে মাঝে হাত বুলিয়ে দেয় তাদের সবুজ পাতাতে। যেন তার সন্তান। ওর আদরে ভরে ওঠে ফসল। সে কখনো কখনো জমির মাটি মুঠো করে তুলে নিয়ে কপালে ঠেকাই। যেন সে তার পিতৃত্বের ঋণ শোধ করছে। মাটির গন্ধ মেখে এসে বসে বট গাছের নিচে। বড়ই আরাম লাগে তার।মাঠ থেকে উঠে আসা ঝিরঝিরে বাতাসে তার গায়ের ঘাম শুকিয়ে আসে। চোখটাতে কেমন নিভু নিভু একটা ঝিমুনি ভাব। বট গাছটাই কত পাখি আশ্রয় নিয়েছে।তাদের চিকন গলার শব্দ যেন মনে হচ্ছে এই দুপুরে মোহন বাঁশি বাজাচ্ছে।মাঠের পাশেই সমাজের কবর স্থান।সে দিকে একবার চায় ও। মাঝে মাঝে কবরের পাশ দিয়ে গেলে তার দাদুর কবরটাকে সে লক্ষ্য করে। মনটা তার নিমেষে খারাপ হয়ে যায়।
দাদুর ঘাড়ে চেপে মেলা দেখার সাধ সে এখনো ভুলেনি।ওর দাদু তামাক সেবন করত।গা থেকে তামাক তামাক একটা গন্ধ সব সময় লেগে থাকত।
সে গন্ধ এখন সে আর পায় না।মনটা তার খারাপ করে কখনও সখনও ।মানুষ এক জীবনে কত কী-ই হারিয়ে ফেলে।যা কোনো দিনই ফিরে আসে না।এই মাঠ ঘাট সবই পড়ে থাকবে।একদিন সেও চলে যাবে। এই কবর স্থানে কোথাও না কোথাও তারও কবর হবে।
তার এই মুহূর্তে জায়গাটা দেখতে ইচ্ছে হল।কিন্ত সে জায়গা তো খোদা পাকই জানে।মালেক তাকিয়ে থাকে কবর স্থানের দিকে।ওর চোখে জল চলে আসে।কেমন একটা ভয় পায় সে। এই বাংলার মুখ সে আর কোনো দিনই দেখতে পাবেনা।বিবির মুখ।
মালেকের দুচোখ দিয়ে আপনা আপনি জল গড়িয়ে পড়ে।সে ভেতরে কেমন একটা কষ্ট অনুভব করে। আজকাল এমন চিন্তা তার আসছে। মাথা থেকে সে কিছুতেই চিন্তাটা বের করে দিতে পারছে না।
কি– গো মিয়া, বাড়ি যাবা না? বেলা যে পড়ি আসছে।
রাশেদের কথায় ওর চমক ভাঙে।রাশেদও তার মতো চাষি। একই গ্রামে তাদের বাস। মালেকের ঘোরটা কেটে যায়। একটু সময় নিয়ে বলে, যাবোরে –রাশেদ, একটু ঢুলুনি মতো এসেছিল।
বাড়ি গিয়ে ঘুমাও না। এখানে সে আরাম পাবা নাকি?
আরাম! আমাদের আরাম বলতে কিছুই নেইরে রাশেদ।এই গাছ তলায় সব।
রাশেদএকটু মজা করে বলে, ভাবি বুঝি ঘর থেকে বের করে দিয়েছে?
বলে হাসতে থাকে।
গাছের পাখি গুলো সে হাসিতে চুপ মেরে যায়। আজ দুপুরটা কেমন অন্য রকম।মালেক আর রাশেদ এক সময় বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।

দুই.
আজ ওর ঘুম ভাঙ ছিল না।মালেকের বউ বার কতক ডেকে গেছে। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। মালেক নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। আজ যেন তার কোনো তাড়া নেই। মানুষকে তো একটা সময়ে এসে থামতেই হয়। যাবতীয় কর্ম শেষ হয়ে। দুনিয়াদারি কথা ফুরিয়ে যায়। দেহ পড়ে থাকে মাটির শেষ আশ্রয়ে।
যে ডানায় ভর করে জীবন বাতাস উড়ে যায় সে পাখিটিকে কেউই দেখেনি। ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। হায়রে জীবন!
মালেকের মুখের উপর সকালের নেক রোদ এসে পড়েছে। মুখটা দেখে মনে হচ্ছে নতুন একটি শিশুর মুখ।
উঠোনে ঝাঁট দিতে দিতে নয়নতারা সেদিকে তাকিয়ে থাকে। মানুষটির বড়ই খাটুনি। থাক ঘুমিয়ে। মনে মনে বলে কথাটা নয়নতারা।
নয়নতারা কাজে মন দেয়।ওদের বাড়ির উঠোনের এক পাশে নিমগাছটাই একটা পাখি একটানা ডেকেই চলেছে। ডাকটা বড়ই মধুর। নয়নতারা কান পেতে শোনে। ওর ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। স্কুলের কদম ডালে অমনি ডাকত পাখি। পাখি ডাকলেই স্কুলে আর মন টিকতো না।কেমন একটা উড়ো উড়ো ভাব।জানালা গলিয়ে মন পালাতো দূর খেতের পারে। নয়নতারার পড়ায় মন বসত না। অনেকদিন পর পাখিটা তার ছোটবেলার কথা মনে করিয়ে দিল। ওর মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। নয়নতারা তার ছোট বেলায় ফিরে যায়। দুপুরে পালিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কিতকিত খেলা আর পরের গাছের পেয়ারা চুরি করা এখনো তার মনে আঁক কাটে। নদীর বুকে নৌকা করে ভেসে বেড়ানো। মাছরাঙা দুপুর যেন এখনো মনে ঝিলিক দেয়।
যত বয়স হচ্ছে যত বেশি পুরনো দিনগুলি মনে পড়ছে। নয়নতারা কাজ ফেলে গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকে। পাখিদের গাছ যেন হারিয়ে যাচ্ছে। এদেরও আশ্রয় চায়। নয়নতারার কষ্ট হয় এদের কথা ভেবে।
এক সময় ঝাঁট দেওয়া শেষ করে মালেককে ডাকে।মালেক উঠতে চায় না। সে মাঠের কাজ আজ ভুলে গেছে। ওদের কোন সন্তানাদি নেই। তাই নয়নতারা মনে মনে কষ্ট পায়। তবে তা নিয়ে মালেকের কোনো ভাবনা নেই। তার সন্তান বলতে বলদ জোড়া। মাঠে লাঙল দিতে দিতে তার জীবনের অনেক খানিই ক্ষয়ে ফেলেছে। এ জীবনে তো আর ফসল কম ফলায় নি। তাই তার মনে কোনো কষ্ট নেই। ক্ষেতের পাশে দাঁড়ালে তার সন্তানরা মাথা হেলিয়ে ওর কথার উত্তর দেয়। ফসল তার জীবনের স্বপ্ন।
নয়নতারাকে যখন রাতে আদর করে তখন মানুষটির গা থেকে কেমন সবুজ সবুজ গন্ধ বের হয়। নয়নতারা বিভোর হয়ে সে গন্ধ নেয়।মালেকের গা ঘেঁষে সে শুয়ে থাকে। যেন দুটি নদী।
নয়নতারা মালেকের পাশে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সকালের রোদে মাটির গন্ধটা ছড়িয়ে দিচ্ছে বাতাসে।নয়নতারা আলতো করে মালেকের কপালে হাত রাখে।রোদ বাড়তে থাকে। পাখিটা আবার ডেকে ওঠে।

তিন.
দুপুর গড়িয়ে গেছে অনেকক্ষণ। মালেক চাষ শেষ করে এসে বসেছে বটগাছের নিচে। আয়াসী বাতাস দিচ্ছে। ওর অন্তর জুড়িয়ে যাচ্ছে সে বাতাসে। গত কাল থেকেই তার শরীরটা কেমন ঝিমঝিম করছে। মনটাও ভালো নেই। আজ ওর সন্তান থাকলে মাঠের অনেক কাজই সঁপে দিত তাদের হাতে। নয়নতারাকে সে সুখ দিতে পারেনি। দোষটা হয়তো তারই ছিল।কতবার মজিদ চাচা ওকে শহরে গিয়ে ডাক্তার দেখাতে বলেছে। কিন্তু সে কথায় কোনো কান দেয়নি। এখন সে বুঝছে।এখন বুঝে আর কোনো লাভ নেই। মালেক সবুজ ঘাসে গা এলিয়ে দেয়। একটু দূরেই কবরস্থান। রোদ পড়ে ধূ ধূ করছে। এক একদৃষ্টিতে সে চেয়ে থাকে কবরের দিকে। মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। এখান থেকে কোথাও আর যাওয়া যায় না। শেষ বিচার একদিন হবে ভালো কাজের আর মন্দ কাজের।
মালেক তো খোদার কোনো প্রশ্নের-ই উত্তর দিতে পারবে না।
সে সারা জীবন ধরে চাষ-ই করে গেল। তার ভাল কাজ বলতে এই চাষ। যা মানুষের মুখে অন্ন জোগায়।
মালেকের কেমন ভয় পেয়ে যায়। সত্যি তো তাকেও মরতে হবে। ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। খাঁ খাঁ করছে সব। সে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে কবরের দিকে। ভাঙ্গা পচা বাঁশ গুলো যেন ওর বুকে গুঁতো দিচ্ছে।তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। সে যেন বোবা হয়ে গেছে।
আস্তে আস্তে তাকে মাটির গন্ধ এসে জড়িয়ে ধরে। যেন চারপাশে মাটির প্রাচীর গড়ে উঠেছে। মালেক পালাতে চাইছে। তার নিঃশ্বাস এখন মৃত্যু গন্ধ।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge