বাংলাদেশের বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর এবং ভারতের পশ্চিম বঙ্গের কুচবিহার, জলপাইগুড়ি ও আসাম অঞ্চলের প্রায় ১৪ শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী আঞ্চলিক গান হচ্ছে ভাওয়াইয়া। এই বিশাল অঞ্চলের অভাজন শ্রেণির মানুষ যেমন রাখাল, মইশাল, গাড়িয়াল ও ক্ষেতে কর্মরত শ্রমজীবী মানুষরাই প্রধানতঃ এ গানের শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার ছিলেন। এখন শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের অনেকেই এ গানের কথা ও সুরের মালা তৈরিতে অবদান রাখছেন।
নারীমনের আকুতি ভাওয়াইয়া গানের উপজীব্য বিষয় হলেও, গ্রামীণ জনপদের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের বহুবিধ অনুসঙ্গ যেমন সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, অভাব-বঞ্চনা ইত্যাদিও যুক্ত হয়েছে এ গানে। মহেশ চন্দ্র রায়ের লেখা ও সুরকরা ‘নড়াই নড়াই নড়াই, ভাত কাপড়ের নড়াই’ এবং আমার লেখা ও সুরকরা ‘আয়শার মায়ের পাইস্যা হারাইচে, সারা রাইতে নিন পারে নাই কান্দি কাটাইচে’ গান দুটি অভাব-বঞ্চনা আঙ্গিকের গান।
ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দীন আহ্মদ গ্রামোফোন রেকর্ডে এই ভাওয়াইয়া গান গাওয়ার পর এ গানের সুরমাধুর্য, ভাব, গায়কি এবং এর শিল্প ও কাব্যমূল্য দেশ-বিদেশের বিশাল শ্রোতাগোষ্ঠিকে আকর্ষণ করেছিলো বলেই ভাওয়াইয়া গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। আব্বাসউদ্দীন আহ্মদের পথ ধরে হাজারো শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার ভাওয়াইয়া জগতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। তাঁদের মধ্য থেকে হাতে গোনা মাত্র দু’চারজন শিল্পী ভাওয়াইয়া বিষয়ক সংগঠক হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিতি পেয়েছেন।
আমরা আরো জানি, ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দীন আহ্মদের গাওয়া অর্ধেকেরও বেশি গানসহ অতীতের সহস্রাধিক বছরে হাজার হাজার গান হারিয়ে গেছে। আব্বাসউদ্দীন আহ্মদের গান সংগ্রহ করার আগে রংপুরের জেলা কালেক্টর প্রাচ্য ভাষাবিদ জর্জ আŸ্রাহাম গ্রিয়ারসন মাত্র দুটি ভাওয়াইয়া গান সংগ্রহ করেছিলেন। ভাওয়াইয়া গানের হারিয়ে যাওয়া বন্ধ করা, গানগুলো সংগ্রহ করা, এ গান শুদ্ধভাবে শেখানো এবং গবেষণা করাসহ শুধুই ভাওয়াইয়া গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করার পাশাপাশি সাংগঠনিক অন্যান্য কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য সংগঠনের প্রয়োজন যে ছিল, গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি বিগত শত শত বছরে হয়তো কেউ ভেবেছিলেন, কিন্তুু এ দেশে ভাওয়াইয়া গানের কোনো সংগঠন বা ভাওয়াইয়া গানের কোনো স্কুল প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ কেউ গ্রহণ করেননি বলেই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়!
বাংলাদেশের ভাওয়াইয়া জগতে ব্যতিক্রমী, অত্যন্ত কষ্টসাধ্য, ঐতিহাসিক ও অনেক বড়ো মাপের এ কাজটি করতে হয়েছে এই অধম এ.কে.এম মোস্তাফিজুর রহমানকে। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে আমি বাংলাদেশ বেতার, রংপুর কেন্দ্রে প্রযোজনা সহকারী (সংগীত) পদে যোগদান করার সুবাদে ভাওয়াইয়া শিল্পীদের খুব কাছে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম। শিল্পীরা আমার কাছে ভাওয়াইয়া বিষয়ক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করার কথা শুনে বিপুল উৎসাহ দেখালেও, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কাজটি করার সাহস কারো মধ্যে না দেখে আমি সাময়িকভাবে দমে গিয়েছিলাম। কিন্তুু হাল ছাড়িনি।
১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর আব্বাসউদ্দীন আহমদের মৃত্যুবার্ষিকীতে লালমনিরহাট জেলার বড়বাড়ীহাট শহীদ আবুল কাশেম কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছিল লোকসংগীত সংগঠন ‘গীদালের আখড়া’র ভাওয়াইয়া ও লোকসংগীত রজনী। ওই রজনী মঞ্চে বক্তব্য দানকালে এক পর্যায়ে আমি বলেছিলাম, ‘ভাওয়াইয়া শিল্পীদের জন্য ‘ভাওয়াইয়া পরিষদ’ নামে শুধুই ভাওয়াইয়া গান নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করলে কেমন হয়? আপনারা কি বলেন?’ আমার প্রস্তাবে শিল্পীরা সেদিন উদ্বেলিত হয়েছিলেন। সভা শেষে মনোরঞ্জন রায়সহ উপস্থিত শিল্পীদের অনেকেই আমাকে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করার অনুরোধ জানালে আমি বাংলাদেশ বেতার, রংপুর কেন্দ্রের অগ্রজ সংগীত প্রযোজক মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দীনের সাথে পরামর্শ করে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলাম।
আমার বিশেষ প্রচেষ্টা অনেককেই আগ্রহী করে তুলেছিল। আমরা ভেবেছিলাম, ভাওয়াইয়ার আকরভূমি খ্যাত রংপুরে ভাওয়াইয়া গানের স্কুল ও সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হলে রংপুরের মর্যাদা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। ভাওয়াইয়ার আকরভূমি শব্দ দুটি পূর্ণতা পাবে। রংপুর শহরে ভাওয়াইয়া গানের একটি স্কুল নেই, ভাওয়াইয়া বিষয়ক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য কোনো সংগঠন নেই, অথচ এই ভাওয়াইয়া গান আমাদের গর্বিত ঐতিহ্যবাহী গান বলে আমরা অহঙ্কার করি। আমার এমন একটি বিশেষ উদ্যোগকে তাই সবাই সমর্থন দিয়েছিলেন।
ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দীন আহমদের কনিষ্ঠ পুত্র মুস্তাফা জামান আব্বাসী তাঁর বাবার ব্যবহৃত কমপ্লিট সুটটি ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে আমাকে দিয়ে বলেছিলেন, ‘মোস্তাফিজ, আমি দু’বছর থেকে ভাবছি আমার আব্বার কমপ্লিট স্যুটটি কাকে দেই। যতবার ভেবেছি, ততবারই তোমার কথা মনে পড়েছে। আমি ভেবেছি, আমার নাতিকে দিলে সে একদিন পড়ে এটা ফেলে দিবে। সে এটার মর্যাদা বুঝবে না। আমার শরীরেও খাটে না। তোমার শরীরে বেশ মানাবে। এই কমপ্লিট স্যুটটি আমি তোমাকে দিতে চাই। তুমি খুশি? তবে, আমার শর্ত হচ্ছে আব্বার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে তুমি এটা পড়বে।’
রংপুরের নিউইঞ্জিনিয়ার পাড়ার (জেলঅ পরিষদেও পেছনে ব্রিজ সংলগ্ন) আজকের এই ভাওয়াইয়া চত্বর আমার ২৯ বছরের জীবনপাত করা সাংগঠনিক উদ্যোগ ও পরিশ্রমের ফসল এবং সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহিদ খানের আন্তরিক সহযোগিতার ফল। ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে ওই পাড়ার বিশিষ্ট কবি রোমেনা চৌধুরী, তাঁর বিয়াই লেখক মো. আবদুল জলিল, তাঁদের ছেলে মেয়ে এবং জেলা পরিষদের সচিব মো. মজিবর রহমান ও অফিস সহকারী মো. মঞ্জের আলী প্রামাণিকের সহযোগিতায় আমরা ওই জায়গাটি দখল করে সেখানে সাংগঠনিক কাজ শুরু করেছিলাম।
ওই চত্বরে ভাওয়াইয়া গানের স্কুল পরিচালনা করতাম। ওই স্কুলে ভাওয়াইয়া গান, দোতোরা ও বাঁশি শেখানো হতো। গানের ক্লাস নিতেন রেজেকা সুলতানা ফ্যান্সী এবং রওশন আরা সোহেলী, দোতোরা শেখাতেন মো. সোলায়মান এবং বাঁশি শেখাতেন ধীরেন্দ্রনাথ বর্মণ।
১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮-এর মে মাস পর্যন্ত বাংলাদেশ ভাওয়াইয়া পরিষদ, রংপুরের ব্যানারে ভাওয়াইয়া গানের স্কুল পরিচালনার পাশাপাশি আয়োজন করা হয়েছিলো ২৪টি ভাওয়াইয়া সন্ধ্যা এবং ১১টি ভাওয়াইয়া রজনী। ভাওয়াইয়া গানের জাতীয়ভিত্তিক প্রথম এই সংগঠনটির উদ্যোক্তা ও মহাসচিব হিসেবে কার্যক্রমগুলোর উদ্যোগ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করেছি নানা কষ্টকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে।
।। টালত মোর ঘর নাহি পরবাসি
হাড়িত ভাত নাই নিতি আবেশি।।
পদকর্তা : ঢেনঢন পাদানম
চর্যাপদের ওপরের পদ দুটির প্রায় সবগুলো শব্দই ভাওয়াইয়া অঞ্চলের মানুষ প্রতিনিয়তই উচ্চারণ করে থাকেন। ভাওয়াইয়া গানের মানুষ হিসেবে আমি উপলব্ধি করেছিলাম চর্যাপদের সমসাময়িককালে ভাওয়াইয়া গান রচিত হয়েছিল। তাই বলা যায়, ভাওয়াইয়া গানের বয়স প্রায় ১৪০০ বছর।
অবাক হওয়ার মতো বিষয়টি হচ্ছে বাংলাদেশে ভাওয়াইয়া গানের কোনো সংগঠন বা ভাওয়াইয়া গান শেখানোর জন্য কোনো স্কুল ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের আগে কেউ প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। আমার জীবনের বিশাল প্রাপ্তিটি হচ্ছে, আমি উদ্যোগ গ্রহণ করে ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের ৭ তারিখে প্রতিষ্ঠা করেছিলাম ভাওয়াইয়া শিল্পীদের জাতীয়ভিত্তিক প্রথম সংগঠন “বাংলাদেশ ভাওয়াইয়া পরিষদ, রংপুর।”
প্রখ্যাত ভাওয়াইয়া শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার মো. কছিম উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ১৫ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠিত হয়েছিলো। চেয়ারম্যান মনোনীত হয়েছিলেন মো. নূরুল ইসলাম জাহিদ। উদ্যোক্তা হিসেবে আমাকে মহাসচিব মনোনীত করা হয়েছিলো। বাংলাদেশ ভাওয়াইয়া পরিষদ, রংপুরের প্রতিষ্ঠাতা কমিটির অন্যান্য সদস্যগণের পদবি ও নাম-
ভাইস চেয়ারম্যান (১) রোকসানা আফরোজ রিক্তা
ভাইস চেয়ারম্যান (২) এস এম নূরুল আমিন লাবু
যুগ্ম মহাসচিব কে এম শাহানুর রহমান
অর্থ সচিব খন্দকার মোহাম্মদ আলী সম্রাট
সাংস্কৃতিক সচিব অনন্ত কুমার দেব
সাংগঠনিক সচিব ভূপতি ভূষণ বর্মা
সমাজকল্যাণ সচিব মো. হাফিজার রহমান
প্রচার সচিব এস এম খলিল বাবু
দপ্তর সচিব রওশন আরা সোহেলী
কার্যনির্বাহী সদস্য রাধা রানী সরকার
কার্যনির্বাহী সদস্য এস এম নজরুল ইসলাম
কার্যনির্বাহী সদস্য নাসরিন আমিন
কার্যনির্বাহী সদস্য তাজুল চৌধুরী
আব্বাউদ্দীন আহ্মদ গ্রামীণ অভাজন শ্রেণির মানুষের হাজার বছরের লালিত আঞ্চলিক গান ভাওয়াইয়াকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়ে যেমন ইতিহাস গড়েছেন, ভাওয়াইয়াকে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে, এ গানের প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠা করে আমিও তেমনি ইতিহাসের একাংশে এক চিলতে জায়গা করে নিয়েছি। আমি মনে করি, উপর্যুক্ত কারণেই হয় তো আমাকে ‘ভাওয়াইয়া বিষয়ক সংগঠন প্রতিষ্ঠার পথিকৃৎ’ বলা হচ্ছে। ভাওয়াইয়া অঙ্গন, রংপুর বিভাগীয় শাখার সভাপতি, বিশিষ্ট কবি, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের গীতিকার এবং বাংলা একাডেমির সদস্য খন্দকার মো. সাইদুর রহমান আমাকে নিয়ে একটি পুস্তক রচনা করেছেন। পুস্তকটি প্রকাশ করেছে রংপুরের আইডিয়া প্রকাশন। তিনি পুস্তকটির নাম দিয়েছেন ‘ভাওয়াইয়া বিষয়ক সংগঠন প্রতিষ্ঠার পথিকৃৎ এ.কে.এম মোস্তাফিজুর রহমান’।
১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ বেতার, রংপুর থেকে বদলি হয়ে আমি বাংলাদেশ বেতার, ঢাকায় চলে এলে আমার অবর্তমানে সংগঠনটি অকার্যকর হয়ে পড়ে। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে রংপুর শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে সংগঠনের ১০টি শাখার সদস্যদের উপস্থিতিতে সাধারণ সভায় আমি রেজেকা সুলতানা ফ্যান্সীকে চেয়ারম্যান এবং সামিউল হাসান লিটনকে মহাসচিব করে ২১ সদস্যবিশিষ্ট যে কমিটি গঠন করে দিয়ে ঢাকায় এসেছিলাম, সেই কমিটির উদ্যোগহীনতার কারণে ভাওয়াইয়া পরিষদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে! আমাদের অনেকের অনেক ত্যাগে, অনেক তিতিক্ষায়, অনেক শ্রমে সংগ্রহ করা প্রায় ৫০,০০০/- টাকার স্থাপনা অবহেলায় পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে গেছে! বাউন্ডারি ওয়ালের সব ইট চুরি হয়ে গেছে! ১৬ ফিট বাই ১৬ ফিট একটি টিনশেড পাকা ঘর নির্মাণ করে সেখানে ভাওয়াইয়া গান, দোতোরা ও বাঁশির ক্লাস নেয়া হতো। সেই টিনের চাল ভেংগে পড়ে গেছে! পাশের ঘরের অসমাপ্ত দুটি দেয়ালও ধসে পড়ে গেছে!
১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে শুরুতেই আমরা এখানে একটি টিনের চালাঘর নির্মাণ করেছিলাম। টিন কেনার জন্য ওই সময় পৌর সভার তহবিল থেকে ৫০০০/- (পাঁচ হাজার মাত্র) টাকা অনুদান দিয়েছিলেন তৎকালীন চেয়ারম্যান শরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু এবং সেই ঘরের ঘেরা দেয়ার টাকা দিয়েছিলেন কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শহীদ শুকরানা।
ওই সময় রংপুর অঞ্চলে আমরা একক ভাওয়াইয়া সন্ধ্যা, ভাওয়াইয়া সন্ধ্যা, দ্বিমাসিক ভাওয়াইয়া সন্ধ্যা এবং ভাওয়াইয়া রজনীর আয়োজন করতাম। দেশের প্রথম ভাওয়াইয়া রজনীর আয়োজন করেছিলাম আমরাই ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে রংপুর টাউন হলে। সংগঠনটির উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব হিসেবে ওই রজনীর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলাম আমি। ওই ভাওয়াইয়া রজনী মঞ্চে মো. কছিম উদ্দিনকে ‘ভাওয়াইয়া যুবরাজ’ উপাধীতে ভূষিত করেছিলেন বিশেষ অতিথি পুলিশ সুপার রহমত জাহান শিকদার।
১৯৯২ থেকে ১৯৯৮ এর মে মাস পর্যন্ত সাড়ে ৭ বছরে আমরা ২৪টি ভাওয়াইয়া সন্ধ্যা এবং ১১টি ভাওয়াইয়া রজনীর আয়োজন করেছিলাম। রংপুরের পুলিশ সুপার রহমত জাহান সিকদারের বদান্যতায় আমরা ভাওয়াইয়া টপ টেন শিরোনামের একটি অডিও ক্যাসেট সংগীতার ব্যানারে বাজারজাত করেছিলাম। আমাদের চেষ্টায় ভাওয়াইয়ার একটা জোয়ার এসেছিল। সেই জোয়ারের ঢেউ এখন ছড়িয়ে পড়েছে দিক দিগন্তে। এখন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিও ভাওয়াইয়া উৎসব, ভাওয়াইয়া বিষয়ক সেমিনার এবং কর্মশালার যে আয়োজন করছে, দেশে যে আন্তর্জাতিক ভাওয়াইয়া উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তা আমার উদ্যোগেরই ফল।
বাংলাদেশ ভাওয়াইয়া পরিষদ, রংপুর প্রতিষ্ঠিত না হলে, আমি ভাওয়াইয়ার অনুষ্ঠানগুলো শুরু না করলে, হয়তোবা আজো একটিও ভাওয়াইয়া সন্ধ্যা অনুষ্ঠিত হতো না। যেমন হয়নি গত শত শত বছরে। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের আগে এমন একটি অনুষ্ঠানেরও আয়োজন হয়নি কারো উদ্যোগে। শুধুই ভাওয়াইয়া গানের অনুষ্ঠান আয়োজন করে শ্রোতাদের মুগ্ধতায় ভরিয়ে তোলা যায়, আমার আগে বোধ করি কেউ ভাবেনওনি।
ভাওয়াইয়া পরিষদ বিলুপ্ত হয়ে গেলে আমাকেই উদ্যোগ নিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছিলো ভাওয়াইয়া একাডেমি, ঢাকা
আমার মতো নগণ্য একজন সংগঠকের অভাবে রংপুরের মতো জায়গায় ভাওয়াইয়া পরিষদ বিলুপ্ত হয়ে গেলে আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। রংপুরের সাড়ে সাত বছরের আমার এবং অতগুলো মানুষের অমানসিক শ্রম বৃথা হয়ে যাবে? রংপুরে গিয়ে সাংগঠনিক কাজ করাও আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। উপায়ান্তর না দেখে আমি সাবেক যোগাযোগ উপমন্ত্রী ভাওয়াইয়াপ্রেমী আসাদুল হাবিব দুলুর স্মরণাপন্ন হই। তাঁর পরামর্শেই আমি উদ্যোগ গ্রহণ করি এবং তাঁর সহযোগিতায় আমরা প্রতিষ্ঠা করি দেশের ভাওয়াইয়া বিষয়ক দ্বিতীয় সংগঠন ‘ভাওয়াইয়া একাডেমি, ঢাকা’।
দ্বিতীয় এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠাকল্পে এর প্রথম সভা ২৪ জুলাই ২০০২ খ্রিস্টাব্দ তারিখে মন্ত্রী মহোদয়ের রেল ভবনের অফিস কক্ষে আমিই আহ্বান করেছিলাম। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন মন্ত্রী মহোদয় নিজে। সভায় আমি ডেকেছিলাম রথীন্দ্রনাথ রায়, এস এম আমজাদ হোসেন দীপ্তি এবং আসাদ বাবুকে। প্রথম ওই সভায় রথীন দা (রথীন্দ্রনাথ রায়) সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, প্রতিষ্ঠিত হতে যাওয়া সংগঠনটির নাম হবে, ‘ভাওয়াইয়া একাডেমি, ঢাকা’।
পরের মাসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সভায় আমি ঢাকার সব ভাওয়াইয়া শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। ওই সভায় আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছিল এবং সেই কমিটিতে আমাকে সদস্যসচিব মনোনীত করা হয়েছিলো। মন্ত্রী মহোদয়ের সহযোগিতায় ২৪ জুলাই থেকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত তিন মাসের মধ্যে আমি সদস্যসচিব হিসেবে ভাওয়াইয়া ভবন নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ের জমির ২টি নকশা যোগাড় করেছিলাম। প্রথমটি ৬ শতক এবং পরেরটি ছিলো এক একর ৬ শতক। ভাওয়াইয়া একাডেমির সদস্যসচিব হিসেবে ৩ মাস আমি অবিরাম কাজ করেছি। বাংলাদেশ রেলওয়ে ঢাকার ডি আর এম সাহেবও মন্ত্রী মহোদয়ের মতো চাইতেন ঢাকায় ‘ভাওয়াইয়া ভবন’ হোক।
ভাওয়াইয়া একাডেমির সভা অনুষ্ঠিত হবে এমন খবর আমি প্রথম আলোর মতো জাতীয় পত্রিকায় ছাপিয়েছিলাম। লাজ্জাত এনাব মহছি বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছিলেন। যথারীতি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের দিন ২৮ নভেম্বর আমাকে মনোনীত করা হয়েছিলো যুগ্মমহাসচিব-(২) পদে। চেয়ারম্যান মনোনীত হয়েছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় রথীন্দ্রনাথ রায়, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান শ্রদ্ধেয়া নাদিরা বেগম, মহাসচিব মো. আজিজুল ইসলাম এবং যুগ্মমহাসচিব (১) হয়েছিলেন এস এম আমজাদ হোসেন দীপ্তি। কমিটির অন্যান্য পদের সদস্যরা ছিলেন-
ভাওয়াইয়া, একাডেমি, ঢাকা’র প্রতিষ্ঠাতা কমিটি
প্রতিষ্ঠা : ২৮ নভেম্বর, ২০০২ খ্রিস্টাব্দ
১. আহ্বায়ক ও চেয়ারম্যান : রথীন্দ্রনাথ রায়
২. সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান : নাদিরা বেগম
৩. ভাইস চেয়ারম্যান : সৈয়দ গোলাম আম্বিয়া
৪. ভাইস চেয়ারম্যান : প্রকৌশলী এস এম গোলাম মোস্তফা
৫. মহাসচিব : আজিজুল ইসলাম
৬. যুগ্ম আহ্বায়ক ও যুগ্ম মহাসচিব (১) : এস এম আমজাদ হোসেন দীপ্তি
৭. উদ্যোক্তা, সদস্যসচিব ও যুগ্ম মহাসচিব (২) : এ.কে.এম মোস্তাফিজুর রহমান
৮. অর্থ সচিব : শরীফা রানী
৯. সাংস্কৃতিক সচিব : বদিয়ার রহমান
১০. যুগ্ম সাংস্কৃতিক সচিব : আব্দুল জলিল
১১. সাংগঠনিক সচিব : শফিউল আলম
১২. প্রচার ও প্রকাশনা সচিব : পিয়াল মাহমুদ
১৩. সমাজ কল্যাণ সচিব : মো. মোখলেসুর রহমান
১৪. গবেষণা সচিব : আলী মাসুদ পারভেজ মুরাদ
১৫. সদস্য : শাহজাদ হোসেন চম্পা
১৬. সদস্য : আখতারুল আলম
১৭. সদস্য : হাফিজুর রহমান
১৮. সদস্য : মহিতুজ্জামান লাভলু
১৯. সদস্য : জিনিয়া খান মালা
২০. সদস্য : তুলশি সাহা
২১. দপ্তর সচিব : মো. রোস্তম আলী প্রামাণিক।
ভাওয়াইয়া একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে আমি ভেবেছিলাম, বেঁচে গেলাম। সংগঠনের বোঝা আমাকে আর বইতে হবে না। কিন্তু না, আমার বিধি বাম। ভাওয়াইয়া একাডেমি, ঢাকা কমিটি গঠনের পর আড়াই বছর পর্যন্ত যখন কোনো সাংগঠনিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারছিলো না, তখন আমি ভীষণ অবাক হয়েছিলাম।
অতপর, আমি যে পারি তা দেখিয়ে দিতে প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, আমার নিজের নামে সংগঠন ‘মোস্তাফিজ একাডেমি, ঢাকা’। মোস্তাফিজ একাডেমির ব্যানারে এক বছরে ৪টি অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলাম।
মোস্তাফিজ একাডেমির চারটি অনুষ্ঠান ছিল-
১. সংগীত বিষয়ক সেমিনার ও সংগীত রজনী
২. দ্বৈতকণ্ঠে ভাওয়াইয়া গানের অনুষ্ঠান
৩. ভাওয়াইয়া রজনী এবং
৪. ভাওয়াইয়া সন্ধ্যা
বলা বাহুল্য যে, আমার উদ্যোগে দ্বৈতকণ্ঠের ওই অনুষ্ঠানটিই ছিলো দেশে অনুষ্ঠিত প্রথম দ্বৈতকণ্ঠে ভাওয়াইয়া গানের অনুষ্ঠান। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে আমি এবং আমার স্ত্রী সালমা মোস্তাফিজ দ্বৈতকণ্ঠে ১১টি ভাওয়াইয়া গান পরিবেশন করেছিলাম।
পরের কাহিনী আমার এবং ভাওয়াইয়ামোদী সবার জন্য আনন্দে উদ্বেলিত হওয়ার মতো। চতুর্থ অনুষ্ঠানের সময় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফজলুর রশিদ মৃধার অনুরোধে পুরাতন ঢাকার মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ পিন্টু আমাকে ৫০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। এই সময়টা ছিল ঢাকা তথা বাংলাদেশের ভাওয়াইয়ার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়, একটা টার্নিং পয়েন্ট।
লোকমুখে আমি শুনতে পাচ্ছিলাম, মন্ত্রী মহোদয় প্রায় নাকি বলছিলেন, “আমি কি ভাওয়াইয়া একাডেমির জন্য বাড়ি খুঁজে বেড়াবো? আপনাদের জন্য আমি মোস্তাফিজ সাহেবকে হারিয়েছি!!” বাস্তবতা ছিল এ রকম- ভাওয়াইয়া একাডেমির জন্য মোহাম্মদপুরের জাকির হোসেন রোডে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে সাইনবোর্ড টাঙ্গানোর পরও ভাওয়াইয়া একাডেমির কর্তারা যখন গানের স্কুল শুরু করতেই পারছিলেন না, তেমন মোক্ষম সময়ে আমার হাতে চলে এসেছিল নগদ ৫০ হাজার টাকা।
আমি বুঝতে পেরেছিলাম ভাওয়াইয়ার ঝাণ্ডা ওড়ানোর দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে। ওরা পারছে না !! আমি জানতাম, ওরা পারবেই না। তাই, ৮ এপ্রিল ২০০৫ খিস্টাব্দ তারিখে আমি উদ্যোগ গ্রহণ করে প্রতিষ্ঠা করেছিলাম ‘ভাওয়াইয়া অঙ্গন’ নামের ৭ সদস্যবিশিষ্ট ছোট্ট একটি সংগঠন। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করে পূর্বরাজাবাজার থেকে বাসা বদল করে আমি চলে এসেয়েছিলাম ওই মোহাম্মদপুরে। যে মোহাম্মদপুরে ভাওয়াইয়া একাডেমির উদ্যোগ মুখ থুবরে পড়েছিলো। বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম নূরজাহান রোডের আর/২২ নম্বর বাসার দ্বিতীয় তলায়। সেখানে ভাওয়াইয়া অঙ্গনের ব্যানারে শুরু করেছিলাম এক যোগে তিনটি প্রকল্প।
১। ভাওয়াইয়া গানের স্কুলের কার্যক্রম
২। মাসিক ভাওয়াইয়া সন্ধ্যা এবং
৩। ভাওয়াইয়া সংগ্রহ
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ভাওয়াইয়া একাডেমি ২০০২ থেকে ২০২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ১৮ বছরে ঢাকায় ৬টি ভাওয়াইয়া সন্ধ্যা এবং দুদিনব্যাপী মাত্র ১টি ভাওয়াইয়া উৎসবের আয়োজন করেছিলো। গানের স্কুলটি পরিচালনা করেছিলো ৩ মাস।
অন্য দিকে ভাওয়াইয়া অঙ্গন, ঢাকা আমার উদ্যোগে ২০০৫ থেকে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ১৫ বছরে ২টি ভাওয়াইয়া বিষয়ক সেমিনার, ১টি ভাওয়াইয়া বিষয়ক কর্মশালা, ৫৬টি ভাওয়াইয়া সন্ধ্যা, ৪টি ভাওয়াইয়া রজনী এবং ১০টি ভাওয়াইয়া উৎসবের আয়োজন করেছে। ২০০৫ থেকে ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভাওয়াইয়া গানের স্কুল পরিচালনা করেছে।
ভাওয়াইয়া অঙ্গনের মাত্র একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করেছি আমরা। ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করে দেয়া ওই শাখাটির নাম ‘ভাওয়াইয়া অঙ্গন, রংপুর বিভাগীয় শাখা’। আনন্দ সংবাদ এই যে, ভাওয়াইয়া অঙ্গনের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক স্থানীয় সরকার বিভাগের সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান জেলা পরিষদের পেছনে নিউইঞ্জিনিয়ার পাড়ার জমিটা ভাওয়াইয়া অঙ্গনের নামে বন্দোবস্ত করে দিয়ে সেখানে ৩৬ ফিট টিনশেড বিল্ডিং নির্মাণ করে দিয়েছেন। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ভাওয়াইয়া অঙ্গন, রংপুর বিভাগীয় শাখার প্রধান পৃষ্ঠপোষক থাকবেন রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মাননীয় মেয়র (যখন যিনি নির্বাচিত হবেন)।
ভাওয়াইয়া অঙ্গন, রংপুর বিভাগীয় শাখার প্রতিষ্ঠাতা কমিটি
প্রতিষ্ঠা : ১ জানুয়ারি ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দ
১. সভাপতি : রোমেনা চৌধুরী
২. সহ-সভাপতি : রাধা রানী সরকার
৩. সচিব : খন্দকার মো. সাইদুর রহমান
৪. অর্থ ও সাংগঠনিক সচিব : সামিউল হাসান লিটন
৫. সাংস্কৃতিক সচিব : মো. সোলায়মান
৬. প্রচার ও প্রকাশনা সচিব : সুলতান আহমেদ সোনা
৭. দপ্তর সচিব : নগেন চন্দ্র মহন্ত
প্রশিক্ষক
১. মতিউজ্জামান টুটুল ২. রণজিৎ কুমার রায় ৩. সত্যেন্দ্রনাথ রায়
৪. হরিদাস চন্দ্র রায় ৫. মাইদুল ইসলাম
ঢাকায় ভাওয়াইয়া অঙ্গনের বিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করার পাশাপাশি রংপুরে ভাওয়াইয়া অঙ্গনের শাখা খোলা ও ভাওয়াইয়া চত্বরের উন্নয়নে আমার একান্ত ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। সমস্ত বাধা অতিক্রম করেছি। সংগঠনটিকে সরকারের রেজিস্ট্রেশনভুক্ত করা, ঢাকায় ৫৬টি ভাওয়াইয়া সন্ধ্যা, ৪টি ভাওয়াইয়া রজনী, ১০টি ভাওয়াইয়া উৎসব, ২টি ভাওয়াইয়া বিষয়ক সেমিনার ও ১টি ভাওয়াইয়া বিষয়ক কর্মশালার আয়োজন করা, সম্পাদক হিসেবে প্রতি তিন মাসে ভাওয়াইয়া বিষয়ক পত্রিকা ‘ত্রৈমাসিক সাময়িকী, ভাওয়াইয়া’ প্রকাশ করতে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করা, প্রেসে যাতায়াত করা, প্রুফ দেখা, পত্রিকার জন্য লেখা যোগাড় করা, ভাওয়াইয়া পদক প্রবর্তন ও প্রদান করা, আয়োজনগুলোর জন্য মিলনায়তন ভাড়া করা, অতিথি, শিল্পী ও বাদ্যযন্ত্রশিল্পী যোগাড় করা, আয়োজনগুলোর দাওয়াতপত্র ছাপানো ও বিলি করা, আয়োজনের সচিত্র সংবাদ প্রকাশের জন্য পত্রিকা ও চ্যানেলগুলোর সাথে যোগাযোগ করা, রংপুর বিভাগীয় শাখার জমিটির লিজ-এর ব্যবস্থা করতে ঢাকায় মাননীয় মন্ত্রী ও এমপিদের সুপারিশ নেয়া, রংপুরে গিয়ে রংপুর পৌরসভার বর্তমান ও সাবেক চেয়ারম্যান, রংপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান এবং সাহিত্য সংগঠন অভিযাত্রিক সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংসদের সভাপতির সুপারিশ নেয়ার পর জেলা পরিষদে জমা দিয়ে লিজের জন্য বাংলাদেশ সচিবালয়ে আবু আলম শহিদ খানের স্থানীয় সরকার বিভাগের দপ্তর ও রংপুরে জেলা পরিষদে দৌড়ঝাঁপ করা, ভাওয়াইয়া চত্বরের সীমানা প্রাচির নির্মাণ করা, স্থানীয় সরকার বিভাগে অর্থ বরাদ্দ করে রংপুর জেলা পরিষদের মাধ্যমে ভাওয়াইয়া অঙ্গনের ৩৬ ফিট টিনশেড বিল্ডিং নির্মাণ করে নেয়া, নিজেদের উদ্যোগে আরো ৪০ ফিট টিনশেড ঘর ও বর্দ্ধিত বারান্দা নির্মাণের জন্য অর্থ যোগাড় করা, ভাওয়াইয়া অঙ্গন, রংপুর বিভাগীয় শাখায় বিদ্যুৎ সংযোগ নেয়া, রংপুরে ৪দিনব্যাপী ও ২দিনব্যাপী দুটি ভাওয়াইয়া উৎসবের আয়োজন করা, ভাওয়াইয়া সন্ধ্যা, দ্বৈতকণ্ঠে ভাওয়াইয়া সন্ধ্যা ও ভাওয়াইয়া রজনীর আয়োজন করা, ৫দিনব্যাপী ২টি ভাওয়াইয়া বিষয়ক কর্মশালার আয়োজন করা, রংপুরের ভাওয়াইয়া চত্বরে মাটি ভরাট করা এবং ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দীন মঞ্চ নির্মাণ করার জন্য অর্থ সংগ্রহ ও খরচ করতে কি পরিমাণ শ্রম আমি দিয়েছি, তা কলমের আঁচড়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
আমার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো দেশের প্রথম একক ভাওয়াইয়া সন্ধ্যা
১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে রংপুরের মাটিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে দেশের প্রথম একক ভাওয়াইয়া সন্ধ্যা। ওই সন্ধ্যার শিল্পী ছিল আমার পুত্র ছোট্ট সাহস মোস্তাফিজ। সেই ভাওয়াইয়া সন্ধ্যার আয়োজক সংগঠন ছিলো বাংলাদেশ ভাওয়াইয়া অ্যাকাডেমি, রংপুর।
ওই একক সন্ধ্যায় রংপুর টাউন হলে নেমেছিল ভাওয়াইয়ামোদী পাঁচ শতাধিক মানুষের ঢল। সাহস মোস্তাফিজ হয়ে আছে দেশের ভাওয়াইয়ার সেই ইতিহাসের আর এক ধারক ও পথের দিশারী শিল্পী। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১০ জুন সাহসের বয়স ছিল ৫ বছর ৭ মাস ১০ দিন। প্রথম শ্রেণি পড়ুয়া সাহস রংপুর টাউন হল ভর্তি শ্রোতাকে গান শুনিয়ে মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন করেছিল। আমরা অবাক বিস্ময়ে ওর মধুমাখা আধো আধো কণ্ঠের ভাওয়াইয়া গান শুনে আপ্লুত হয়েছিলাম।
ওই দিন রংপুর শহরের পাশ্ববর্তী গ্রাম নিশবেতগঞ্জ থেকে আনা হয়েছিল একটি গোরুর গাড়ি। গাড়িটিকে বর্ণিল সাজে সাজানো হয়েছিল। তার পর রংপুর শহরের প্রধান সড়কে গাড়িটিকে প্রদক্ষিণ করানো হয়েছিল। গাড়িতে সাহসের পাশে বসা ছিলেন নাট্যশিল্পী মোল্লা মোসাদ্দেক হোসেন এবং রংপুর টাউন হলের এম এল এস এস বকুল। পুরোটা পথ ভিডিও করা হয়েছিল। ফলে, মানুষ কৌতুহলী হয়েছিলেন। আর সে কারণেই, রংপুর টাউন হলে কাউন্টার সেল হয়েছিল প্রায় ৪,০০০/= টাকা। টিকেটের মূল্য ছিল ১০ ও ২০ টাকা।
সাহসকে শিল্পী হিসেবে আমরা এমনভাবে তৈরি করেছিলাম যে, হল ভর্তি লোকের সামনে ওইটুকু বাচ্চা সচ্ছন্দে গেয়েছিল এক এক করে ৭টি গান। তার তালও কাটেনি সুরও ছোটেনি। ওই বয়সে সাহস গেয়েছিল ঝাঁপ, তেওরা, দাদরা, দ্রুতদাদরা ও কাহারবা মোট ৫টি তালের গান। যখন সে স্কুলে যাওয়া কেবল শুরু করেছে, সেই সময় তার এমন গায়কিতে আমরা মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়েছিলাম। সাহসের ৭টি গান শেষ হয়ে গেলে শ্রোতারা তার কচিকণ্ঠে আরো গান শুনতে চেয়েছিল।
লেখক : ভাওয়াইয়া ব্যক্তিত্ব, ভাওয়াইয়া শিল্পী, গীতিকার, সুরকার ও সংগঠক
Leave a Reply