‘আমি কি বেঁচে আছি না কি বেঁচে থাকার ভান করছি তোমাদেরকে অবিশ^াস্যভাবে অবাকের অতলে তলিয়ে দেবার জন্য?’
ওদের দশ-বারোজনের ভেতর থেকে একজন শে^তাঙ্গ বয়স্কলোক এসে আমার রক্তাক্ত ডানহাতটা ধরে খাদের গহীন থেকে ধূলিচ্ছন্ন ভূপৃষ্ঠে তুলতে তুলতে বললেনÑ
তুমিই একমাত্র ভাগ্যবান যাকে আমরা বাঁচাতে পেরেছি।
‘অবিশ^াস্য হলেও সত্যি যে, তুমি বেঁচে আছো!’
ভূপৃষ্ঠে আমার ক্ষতাক্ত পদচিহ্নের পরশ পড়তে না পড়তেই শোনতে পেলাম এই চরম অসত্যটা। ওদের ভেতর থেকে কেউ একজন এভারেস্ট বিজয়ীর মতো উল্লাস ভঙ্গিমায় বলে উঠলে নিমিষেই একটা জম্পেশ পরিবেশ তৈরী হয় সেখানে। আর আমার কেবল মনে হতে থাকে যেন আমি পুনরুত্থিত হচ্ছি এই না বোঝার কোরকে মুড়ে থাকা পৃথিবীর পরিক্রমণে।
ওদের প্রত্যেকের পড়নে ছিলো মার্কিন সেনাদের ইউনিফরম। ওরা আমাকে একটা জলাপাই রঙের জিপগাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছে উচুঁনিচু পথের বুক বেয়ে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে আরো ভেতরে। আমি জানি যাচ্ছি কিন্তু কোথায় যাচ্ছি জানি না। জানি না, ওই পাহাড়গুলোর শেষে আরো কতগুলো পাহাড় পেরোতে হবে আমাকে। অথবা আমি কে? আমাকে আবিস্কার করবার কসরতও করছি যেতে যেতে। হুট করে মনে পড়লে অন্তর্গত আমিকে আড়াল করবার করুণ কসরত করি। আর বাইবেলের বাক্যের মতো কতিপয় মিথ ছড়িয়ে দিই উৎসুকদের মাঝে। যেহেতু তারা বাইবেলকে মানুষর উপরে রাখে।
সংখ্যাহীন কোশ্চেনের ভীড়ে ছোট ছোট ইংরেজি বাক্যে শেষমেশ ওদেরকে আমি বোঝাতে সফল হই যে, আই অ্যাম এ ইন্ডিয়ান। মাই রিলিজন ইজ হিন্দুজম। মাই নেম ইজ…
তারপর থেকে পাহাড় পেরোতে পেরোতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। দেখেছি সেসব পাহাড়ের অদ্ভুত অগ্নিগিরির উৎসারণ। তাতে হেঁটেছি দিনের পর দিন। পুড়েছি রাতের পর রাত। তবু আমি বেঁচে আছি বলে ওদের ধারণা। এই ধারণাটাকে তারা আরো উজ্জীবীত করে তোলে প্রতিদিন সকালবেলায় যখন তাদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয় দাপ্তরিক বিষয়আশয় নিয়ে। তখন তারা আমাকে ‘গুড মর্নিং’ নামের ছোট্টএক বাক্যের বিভায় আমার নিষ্প্রভ মুখটাকে প্রজ্জ্বোল করার কসরত করে। যদিও আমার ভেতর আমাকে জীবীত মনে হয় না ওইসব ঘটনার পর থেকে।
আর কতো হিমদরজা পেরিয়ে আমাকে আমার কাছে ফিরতে হবে জানি না। নিজের ভেতরে নিজেই বিরবির করি। বিরবিরিটা শেষ হতে না হতেই দীর্ঘশ^াসটা ফুসফুস এফোঁড়-ওফোঁড় করে জানালা দিয়ে সোজা ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে মিশে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। আমি বুকের ভেতর জগদ্দল পাথরের ন্যায় একটা ওজনশীল ব্যথা টের পাই। এই ব্যথাটাকে বয়ে বেড়াচ্ছি বহুদিন ধরে। চারদেয়ালের মাঝখানে আমি। দেয়ালে ঝোলানো একটা লাল রঙের রাশিয়ান ঘড়ি। ঘড়িটা দেখে আমি প্রতিদিন আমার কর্মপরিকল্পনা ঠিক করি। দেয়াল ঘড়িটায় তাকাতেই চোখের ভেতরেও হালকা একটা ব্যথা টের পেলাম। চল্লিশ ওয়াটের এনার্জি লাইটটা এখনও জ¦লছে। কদিন থেকে আলো জ¦ালিয়েই ঘুমানোর অভ্যেস হয়ে গেছে আমার। এই অভ্যেসটাকে মোটেও পছন্দ না। তবু মাঝে-মধ্যে বিরক্তিকর বিষয়গুলোকেও এখন খুব পছন্দ করতে হচ্ছে অনিচ্ছা শর্তেও। ঘুমের মাঝে ভেসে আসা মৃতদের হিম-মুখচ্ছবিগুলো যেন আমাকে এখনও তাড়া করছে। ক্ষতাক্ত শরীরের হৃদপিণ্ড থেকে উদগত আর্তনাদগুলো মনে হচ্ছে এখনও আমার কানে বেজে যাচ্ছে কোনো এক অন্ধ বেহালার মতো। আমি কি সেসব থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাচ্ছি? নিজেকেই প্রশ্ন ছুড়ে বসি। কেউ উত্তর দেবার মতো এখানে নেই। আমার ভেতরে যে আমি আছে সে-ও না। আমি যখন আমার দেশ ছেড়ে ইরাকে আসি তখন আমার আত্মীয়রা এভাবে কেঁদেছিল। আমি কেবল জিরাফের মতো তাদের অশ্রুপাতের দিকে তাকিয়েছিলাম। তারপর মহাপতঙ্গের ডানায় চেপে ইরাকে আসি। এখানে এসে কখনোই ভাবিনি মৃতদের প্রতিবেদন লিখে আমাকে বেঁচে থাকতে হবে।
ফজরের আযান ভেসে আসছে। কোনো এক সহকর্মীর মুখে শুনেছি যে, মার্কিন হামলার আগে বাগদাদে মসজিদ ছিল সংখ্যাহীন। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ভাসতো আজানের সুর। তাতে ডুবে থাকতো পুরো বাগদাদ শহর। যুদ্ধের আগ্রাসনে নিরপরাধ স্বপ্নের সঙ্গে নিঃশ্চিহ্ন হয়ে গেছে মসজিদগুলোও। যে স্বপ্নগুলো লাশে রূপান্তরিত হয় রাতের অন্ধকার ম্লান হবার আগেই। মার্কিন সেনারা লাশগুলো জড়ো করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসে জলপাই রঙের জিপগাড়িতে। তারপর সেগুলো কবরাস্থানে পাঠানোর আগে অস্থায়ী মর্গে পাঠানো হয় প্রাথমিক প্রতিবেদন লেখার জন্য। আমি এই কাজটাই করি। ছকে সাজানো একটা এ ফোর সাইজের কাগজে প্রতিদিন ভোর ছয়টা থেকে সকাল আটটা অব্দি আমি আমার কাজটা নিখুঁতভাবে করবার চেষ্টা করি। এই যেমনÑলাশটা নারী না পুরুষ, গায়ের রঙ ফর্সা/কালো না শাদা, উচ্চতা কেমন, লাশে রূপান্তরিত হবার সময় পড়নে কী কী ছিল, কিসের আঘাতে মারা গেছে, আঘাতটা কোথায় লেগেছে, ইরাকি না ভিনদেশি।
মা-বাবাকে প্রায়ই চিঠিতে লিখি যে, আমাকে নিয়ে তোমরা কখনো দুঃশ্চিন্তা করবে না। এখানে আমি একটা ভালো কাজ পেয়েছি। আর আমি আমার কাজ নিয়ে বেশ আনন্দেই আছি। ঈশ^র, তোমাদের দীর্ঘজীবী করুক। অথচ কাজটা মোটেও আনন্দ পাবার মতো কোনো কাজ নয়। বাঁচতে হবে বলে করছি। কিন্তু বাঁচবো কিনা সেটাও জানি না। কিংবা আদৌ বেঁচে কি না তাও জানি না। কেবল একটা অন্ধ অনুমানের উপর ভর করে বেঁচে আছি।
প্রতিবেদন লেখার কাগজ কলম নিয়ে ভোর ভোর বেড়িয়ে পড়ি। কোয়াটারের বাইরে এখনও আবছা অন্ধকারে চোখ বুঁজে আছে বাগদাদ শহরটা। ডিসেম্বর মাস। শৈত্য প্রবাহে খেঁজুরবৃক্ষের শুষ্ক রুক্ষ পাতাগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে। গায়ের কাশ্মিরি শালটা ঠিকমতো জড়িয়ে নিই। এরপর অস্থায়ী মর্গের দিকে হাঁটি। মর্গের ওয়াচম্যান আমাকে দেখে মাথা নুইয়ে অভ্যর্থনা জানানোর ভঙ্গিমা শেষে গেট খুলে দেয়। আমি তার মাথা নোয়ানোর ভঙ্গিটাকে ঘৃণা করি কিন্তু কোনোদিন তাকে বলতে পারি না। এই কথা বলাটা আমার ডিউটির মধ্যে পড়ে না। মর্গে ঢুকে দেখি অনেক স্বপ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে লাশের ভঙ্গিমা করে। গত ভোরেও যারা খেঁজুরবৃক্ষের পাতাগুলোর কেঁপে উঠার দৃশ্য দেখে বিমোহিত হতো হয়তোবা। মনে মনে আমি অনুমান করি। কেননা এখন-অব্দি আমি অনেক অনুমানের উপর ভর করেই বেঁচে আছি। রক্তের দাগ এখনও মানচিত্রের মতো লেপ্টে আছে ক্ষতাক্ত শরীরগুলোতে। হাহাকারে আমার ভেতরটা ভরে উঠছে। আফসোস ছাড়া আমার কিছুই করবার নেই তাদের জন্য। কাগজ-কলম নিয়ে হাঁটু মুড়ে বসি পড়ি লাশগুলোর মাঝখানে। কোনোরকম দ্বিধা ছাড়াই প্রথম লাশের কাছে আসি।
লাশের লিঙ্গ : পুরুষ
উচ্চতা : ৬ ফিট
বয়স : আনুমানিক ষাট
গায়ের রঙ : ফর্সা
মৃত্যুর সময় পড়নে ছিলো ফুল হাতা শার্ট আর ফুলপ্যান্ট
বোমার আঘাতে মৃত্যু হয়েছে।
আঘাতটা মাথায় লেগেছে।
বোমায় মুখটা উড়ে গেছে।
জাতীয়তা : ইরাকি।
দ্বিতীয় লাশের কাছে আসি।
লাশের লিঙ্গ : নারী
উচ্চতা : ৫ ফিট ৬ ইঞ্চি
বয়স : আনুমানিক চল্লিশ
গায়ের রঙ : ফর্সা
মৃত্যুর সময় পড়নে ছিলো সালোয়ার-কামিজ।
গুলির আঘাতে মৃত্যু হয়েছে।
আঘাতটা বুকে লেগেছে।
বোমায় মুখটা উড়ে গেছে।
জাতীয়তা : আফগানিস্তান।
এভাবে মোট বারোজন লাশের প্রতিবেদন প্রস্তুত করে ইনফরমেশন অব ডেথ দপ্তরের প্রধানের কাছে জমা দিতে এলে তিনি আমাকে সুপ্রভাত সম্ভাষণে সিক্ত করেন। দাঁতের সাথে দাঁত চেপে পরষ্পর সংযুক্ত ঠোঁট জোড়াকে ঈদের চাঁদের মতো ধনুকের ন্যায় বাঁকিয়ে একটা মুচকি হাসি আমাকে উপহার দেন। এই উপহার আমি চাকরির সূচনা থেকেই পেয়ে আসছি। গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে তিনি আমার প্রতিবেদনগুলোয় চশমার ভেতর থেকে তার কুয়াশার ন্যায় ঝাপসা দৃষ্টির আস্তরণ ছড়ান। আমার হাতের লেখার ফন্ট বড় হওয়ায় পড়তে বেশি বেগ পেতে হয় না তাকেÑএ কথা তিনি প্রথম দিনেই জানিয়েছিলেন, যেদিন আমি তাকে আশিটা লাশের প্রতিবেদন হস্তান্তর করেছিলাম। সেদিনের তুলনায় দিনদিন লাশের সংখ্যা কমে যাওয়ায় মাঝে-মধ্যে তিনি হতাশ^াসে উপচে পড়ছেন।
‘আশা করি তুমি তোমার কাজটাকে এনজয় করছো?’
প্রধানের এমন কোশ্চেনে আমি অপ্রস্তুতভাবে জি বলে ভদ্রতা অটুট রাখার চেষ্টা করলাম।
বিকেলে বাগদাদের পাহাড়ে উঠে কেওক্রাডং পাহাড়ের কথা ভাবি। মাথার উপর দিয়ে মহাপতঙ্গগুলো উড়ছে হন্তারকের ন্যায়। এরপর থেকে আলো আমার সহ্য হয় না। পৃথিবীর কোনো ক্ষুধা আমাকে তাড়িত করে না। আমার ভেতরে কোনো এক লাশের উপস্থিতি টের পাই। তবে কী সেই লাশেরও প্রতিবেদন আমাকে লিখতে হবে!
এতসব বুঝে ওঠার আগেই বাগদাদের মসজিদ থেকে ফজরের আযান ভেসে আসছে। সুবহে সাদিকের আবছায়া এখনও আধমরা পৃথিবীর পিঠে লেগে আছে। প্রতিবেদন লেখার কাগজ কলম নিয়ে ভোর ভোর বেড়িয়ে পড়ি। মর্গের ওয়াচম্যান পুরনো পদ্ধতিতেই গেট খুলে দেন। নিঃশব্দে প্রথম লাশের কাছে আসি। বুকের ডান পাশে বসি। তারপর ডাইরি খুলে বিরবির করে লিখে যাইÑ
লাশের লিঙ্গ : নারী
উচ্চতা : ৫ ফিট ৩ ইঞ্চি
বয়স : একুশ
গায়ের রঙ : শ্যামলা
মৃত্যুর সময় পড়নে ছিলো সালোয়ার, কামিজ।
আত্মহননে মৃত্যু হয়েছে।
যোনিপথে আঘাত পেয়েছে।
বিষে মুখটা নীল হয়ে গেছে।
জাতীয়তা : বাংলাদেশী।
Leave a Reply