ঈদ নিয়ে কত স্মৃতিই যে মানুষের থাকে তার ইয়ত্তা নেই। এই আমি, যে কোন দিন বাড়ির বাইরে ঈদ করবো তা কল্পনাই করিনি, সেই আমি নিয়মিতভাবেই, প্রতি ঈদে নিজ বাড়ির বাইরে ঈদ উদযাপন করে যাচ্ছি। শৈশবের ঈদ, বড়বেলার ঈদ কতই না পার্থক্য? বাবার সাথে ঈদ আবার নিজে বাবা হয়ে ঈদ। সত্যি অনেক পার্থক্যের। ছোটবেলার কথা খুব মনে পড়ে। ঈদ উপলক্ষে নতুন সাবান কেনা হতো। ঈদের দিন সেই সাবান দিয়ে গোছল। গোছলের পর কেন যেন সেদিন খুব ফর্সা হয়ে যেতাম এবং শরীরে সবসময় একটা সুগন্ধ লেগে থাকতো। তখন গায়ের সাবান বলতে ছিল লাক্স, আর তার সাথে নতুনভাবে যুক্ত হয়েছিল কসকো সাবান।কসকো সাবান ছিল পিচ্ছিল, শক্ত, সহজে ক্ষয় হয়না এমন। এই গুনের কারনে বর্তমানে এটি হোটেলে বহুল ব্যবহৃত হয়।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে আমরা দুইভাই আব্বার সাথে গোছল করতে যেতাম প্রায় অর্ধকিলোমিটারের পথ পারি দিয়ে রোংগারদহ নামক বিশাল দীঘিতে। গ্রামের অনেকেই সেখানে গোছল করতে যেত। আব্বা সেদিন আমাদের শরীর কচলিয়ে দিতেন। আমরা মাথাতেও তখন সাবান মাখতাম। শ্যাম্পু তখন দেখিইনি। তখন মানুষের অভাব ছিল প্রচন্ড। অনেকেই কাপড় কাচা সাবান দিয়ে, কেউবা মাটি ঘষে গোছল সেরে নিতেন। আব্বা প্রতিবেশিদেরও আমাদের সাবান ব্যবহারের সমান সুযোগ দিতেন। সে সময় সুগন্ধি সাবান দিয়ে গোছল করা ছিল একটা বিরাট ব্যাপার। এখন এসব ভাবলেও কেমন যেন লাগে, বিশ্বাসই হয়না। মনে হয় স্বপ্নই ছিল।
গোছলের পর খাবারে আমাদের নির্ধারিত মেনু থাকতো খিচুড়ির সাথে ডিম ভূনা, কখনো ডিম রান্না আর তারপর শেমাই। মা সবসময় এই খাবারই রাধঁতেন। এক মাস রোজা রাখার পর সকাল বেলা প্রথম এই খিচুড়ি খাওয়া অন্যরকম ভাললাগায় ভরে থাকতো। খাওয়া শেষে আব্বার সাথে মাঠে যাওয়া, ঈদের দিনে প্রচন্ড রোদের মাঝে খোলা মাঠে ইমাম সাহেবের খুতবা শোনা, ইমাম সাহেবের মাঠ পড়ানি, মসজিদের উন্নয়ন ফি, ফেতরার চাঁদা উঠানো কতইনা স্মৃতি মনে পড়ে।ঈদের জামাতের পর কোলাকুলি, নামাজ শেষে ভিন্ন পথে হেটে বাড়ি আসা, আর দাদী, চাচাদের বাসায় ঈদের শেমাই খাওয়া খুব, খুব মনে পড়ে।
আমাদের সময় এক ঈদে জামা পেলে অন্য ঈদে পেতাম না। পেতাম যেকোন একটি, হয় পাঞ্জাবি, নয় শার্ট, কিংবা জুতো। পাঁচ ভাইবোন ছিলাম আমরা। আব্বা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। জমি জিরাত বেশ থাকলেও তার পক্ষে অত সম্ভব ছিলনা সবাইকে সবকিছু দেয়া। নগদ টাকার অভাব ছিল তখন। মনে পড়ে, একবার কি যেন চেয়েছিলাম না পেয়ে রাগ করে ঈদের মাঠে যাইনি। সেদিন যে কি খারাপ লেগেছিল আমার! তবে জামার জন্য নয়। নামাজ না পড়ার কারনে। আসলে ঈদের নামাজ না আদায় করলে ঈদের অনুভুতিই আসেনা। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। এরপর থেকে যত কষ্টই হোক, যত দূরেই থাকি ঈদের নামাজ আদায় করার চেষ্টা করেছি।
দূরে বলছি একারনে, আমি পড়াশুনাজনিত কারনে চার বছর বিদেশে অবস্থান করেছি। ইসলামিক কোন দেশ নয়, বিধর্মীদের দেশ দক্ষিন কোরিয়াতে। মসজিদের সংখ্যা ছিল অতি নগন্য, নেই বললেই চলে। সে দেশের একজন নাগরিকও মুসলিম ছিলনা ইরাক -কুয়েত যুদ্ধের আগে। শুনেছি উপসাগরীয় সেই যুদ্ধে মার্কিন বাহিনীর সাথে যৌথবাহিনীতে যোগ দেয় দক্ষিন কোরিয়ান সেনাবাহিনী। সেই যুদ্ধের পর কিছু কোরিয়ান সামরিক সেনা মুসলিম হয়। এরাই পরবর্তীতে ২/১ টা মসজিদ গড়ে তোলে সেই দেশে। তবে এক্ষেত্রে পাকিস্তানের অবদানও অনেক। প্রচুর পাকিস্তানি মুসলিম কোরিয়াতে ব্যবসা করে এবং তারা মসজিদের ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালনও করে। ইদানিং অনেক বাংলাদেশী মুসলিম ভাইয়েরা কোরিয়াতে বিভিন্ন কারণে অবস্থান করে। অন্যদেশের মুসলিমদের সাথে মিলেমিশে বাসা ভাড়া নিয়ে জুম্মার নামাজ আদায় করে থাকে।কখনোবা ওয়াক্তিয়া নামাজও আদায় করে।
যেটা বলছিলাম, আমরা যারা ছাত্র ছিলাম ঈদের দিনও আমরা ছুটি পেতাম না। একবেলা ঈদের নামাজ পরে শেমাই খেয়ে ল্যাবে ফিরে গিয়ে রিসার্চ করতাম আমরা। প্রফেসর এই একবেলাই ছুটি দিত।ঈদের দিন সকালে কয়েকজন বাংগালী মিলে ট্যাক্সি ভাড়া করতাম, তারপর দেগু শহরে যে মসজিদটা ছিল সেই মসজিদে গিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করতাম। সবাই নয় কেউ কেউ। যেতেই লাগতো প্রায় আধঘন্টা। ভাড়া লাগতো বাংলাদেশী টাকায় প্রায় দেড় হাজারের মত। অনেক দেশের মুসলিম নাগরিক ঈদের দিনে সেখানে নামাজ পড়তে যেত। একবার দেখা হলো সেনেগালের কিছু মুসলিম নাগরিকের সাথে। ইয়া বিশাল উচ্চতার একেকজন। সাড়ে ছয়ফিটের নীচে কেউ নন। আমরা পরিচিত হলাম, পরস্পরের সাথে কোলাকুলি করলাম। আমাদের মত খাটো লোকদের সাথে কোলাকুলি করতে তাদের যথেষ্ট কষ্ট হয়েছিল। সেই সময়ে বিশ্বকাপ ফুটবলে সেনেগাল খুব ভাল করেছিল। আমি সে দলের সাপোর্টারও ছিলাম। জানতে পেরে তারা ভীষণ খুশী হয়েছিল।
একক অথবা পরিবারসহ দুইভাবেই কোরিয়াতে ঈদ উদযাপন করেছি। কোরিয়াতে পরিবারসহ ঈদের আনন্দ ছিল আলাদা। আমরা চাইতাম বাংলাদেশ এবং কোরিয়া উভয়দেশেই যেন একইসাথে ঈদ হয়। কিন্তু সবসময়ই উল্টো হতো। দেশের একদিন আগেই কোরিয়াতে ঈদ হয়ে যেত। তাই টেলিফোনেই সবার সাথে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতাম। আমরা বাংগালী যে কয়েকটি পরিবার এবং ব্যাচেলররা কোরিয়াতে থাকতাম ঈদের দিন বিকেলবেলা বাচ্চাকাচ্চাসহ আমাদের ট্রাডিশনাল পোশাক পড়ে সবাই মিলে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াতাম। আমাদের পাজামা পাঞ্জাবী, মহিলাদের শাড়ী দেখে কোরিয়ান বন্ধুরা বেশ আনন্দ পেত, নানা প্রশ্নও করতো। ঈদের দিন সবকিছু ঠিকই ছিল শুধু আত্মীয় স্বজনের অভাব বিশেষ করে মায়ের অনুপস্থিতিটাই পীড়া দিত বেশি।
করোনা শুধু ঈদ নয় মানুষের জীবনধারাই পরিবর্তন করে দিয়েছে। ঈদের ছুটিতে বাড়ী যাওয়া এখন আর হয়ে উঠেনা। তার উপর কর্মস্থল ত্যাগে সরকারের নিষেধাজ্ঞা। সবকিছু মিলিয়ে স্ব স্ব অবস্থানে ঈদ আর বৈচিত্র্য নিয়ে আসছেনা। বাচ্চাদের ঈদ আনন্দ বলতে জামা কাপড়ের আনন্দ। এযুগের ছেলেমেয়েরা কত জামাকাপড় যে গিফট পায় তার হিসেব থাকেনা। এমনও হয় ঈদের দিন হয়তো একবার পড়েছে পরে আর না পরার কারনে সে জামাই আর তার গায়ে লাগেনি। মামা, খালা, চাচা, ফুপী সবাই এখন যার যার সাধ্যমত গিফট দেয়। আমাদের সময় এটা ছিল চিন্তারও অতীত।
ঈদের আরেকটা স্মৃতির কথা বলি। সেবার সপরিবারে আমরা গেছিলাম ইন্ডিয়াতে। ঈদের জামাত আদায় করতে গেছিলাম দিল্লীর বিখ্যাত শাহী জামে মসজিদে। রাস্তা ভুল করার কারনে সেদিন যথাসময়ে জামাত ধরতে পারিনি। সে আফসোস সারাজীবনই থাকবে।যাহোক, শাহী মসজিদ বিশাল এক মসজিদ। সম্রাট শাহজাহানের আমলে নির্মিত এই মসজিদটিতে একসাথে ২৫০০০ মুসলিম নামাজ আদায় করতে পারে।নামাজ শেষে এর স্থাপত্যশৈলী দেখলাম ঘুরে ঘুরে। খুব চমৎকার। মসজিদের পাশে সব দোকানপাট মুসলমানদের বলে মনে হয়েছে। তবে খুব নোংরা, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ছিল যা মোটেই কাম্য ছিল না। আমরা লক্ষ্য করেছি ইন্ডিয়ার যেসব এলাকায় মুসলমানদের বাস সে এলাকাগুলোই ছিল অপেক্ষাকৃত নোংরা এবং অপরিচ্ছন্ন। নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজারে গিয়ে তার চেয়েও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ দেখেছি। তবে এর মধ্যেও সবচেয়ে স্বস্তিকর বিষয় ছিল শাহী মসজিদ এলাকার খাবার দাবার। সব রেস্টুরেন্টেই গরুর মাংস, তন্দুরী রুটি, বিরিয়ানী পাওয়া যাচ্ছিল। গরুর মাংস ছিল খুব সস্তা। তবে মুস্কিল ছিল তারা পার্সেল দিচ্ছিল না। আমরা দিল্লীর যে এলাকার হোটেলে উঠেছিলাম সেখানে খাবারের বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। সাউথ ইন্ডিয়ান খাবার ছিল বেশি। শুধু ভেজ আর ভেজ। করিম’স হোটেল নামে একটি মুসলিম রেস্টুরেন্ট ছিল, যার খাবারের মান ভাল হলেও দামটা তুলনামূলক বেশিই ছিল। মনে পড়েছে আমাদের এলাকাটির নাম ছিল কড়োলবাগ। তবে সেখানের স্ট্রীট ফুড বেশ ভাল ছিল। হোটেলের অনেকেই দেখতাম সেখান থেকে খাবার কিনে নিয়ে যাচ্ছে। আমরাও বাদ যাইনি, দুই একদিন আমরাও নিয়েছি।
বিদেশবিভুঁইয়ের ঈদের কথাতো হলো, দেশের ঈদের স্মৃতিও কম নেই। শশুরবাড়ীতে ঈদ, নিজ বাড়ীতে ঈদ, কর্মস্থলে ঈদ সবগুলোই ছিল আনন্দের, বৈচিত্র্যপূর্ণ। তবে বাবার সাথে সেই ঈদের মুহুর্তগুলো বেশি মনে পড়ে। হয়তো আমাদের সন্তানেরাও এমনি করে আমাদের কথাও ভাববে।
Leave a Reply