শুক্রবার, ০৯ Jun ২০২৩, ০৬:২৪ অপরাহ্ন

অপেক্ষা-এটিএম মোর্শেদ

অপেক্ষা-এটিএম মোর্শেদ

প্রতি বছর এই দিনটির জন্য বিশেষ আগ্রহে অপেক্ষা করে আনোয়ারা বেগম। ১০ মার্চ আনোয়ারা বেগমের বিবাহ বার্ষিকী। ৪৮ বছর পূর্বে আজকের এই দিনে জোৎস্না ভরা রাতে আনোয়ারা বেগমের সঙ্গে আরমান শরীফের বিয়ে হয়েছিল এক অনাড়াম্বর অনুষ্ঠানে। দূর্ভাগ্য বশতঃ বিবাহের প্রথম বার্ষিকীটা তাদের একত্রে পালন করার সুযোগ হয় নাই। তারপরও আনোয়ারা বেগম প্রতি বছর এই দিনে বিশেষ সাজ-সজ্জা করে, আরমান যেভাবে সাজলে পছন্দ করত, খুশি হত সেই ভাবে। সেই লাল বেনারশি শাড়ি, রঙ্গিন চুড়ি, সোনার টিকটি আরোও কত কি? এগুলো পরলে আরমান যে নেই সে কথা মনেই থাকেনা আনোয়ারা বেগমের। মনে হয় কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গেছে। এক্ষুণি ফিরে এসে দু’হাতে তার দু’চোখ ধরে বলবে, “বলত কে?” আরমানের বিচিত্র ধরনের দুষ্টুমি ভরা স্মৃতি গুলো আনোয়ারাকে কখনও হাসায় কখনও কাঁদায়।

আজকে আর আগের মতো সাজতে ইচ্ছে হলোনা। জিনিসপত্র গুলো সব খাটের উপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে, তার অতীত জীবনের পাওয়া না পাওয়ার স্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়। তার মনে হয় এইতো সেদিন আরমানের সাথে তার প্রথম পরিচয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ক্যাম্পাসে দু’একবার দেখা হলেও কোন পরিচয় ছিল না। একদিন সকালে রংপুর থেকে রাজশাহীর বাসে আনোয়ারা বসে আছে; বাস ছেড়ে দিয়েছে এমন সময় কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে গিয়ে আরমান বাসে উঠলো। বাসে কোন সিট ছিলনা শুধু আনোয়ারার পাশে একটা সিট খালি আছে। আনোয়ারার মুখের দিকে তাকাতেই আনোয়ারা বললো, আরে আরমান ভাই আপনি! আপনার বাড়ি রংপুরে নাকি? আরমান বলল, আমারও একই প্রশ্ন, আরমান আবার বলল “কোন ডিপার্টমেন্টে কোন ইয়ারে পড়া হয়”? আনোয়ারা বলল, বাংলা। অনার্স থার্ড ইয়ার। আরমান একটু হেসে বলল, সহপাঠী বা জুনিয়ারদের আপনি বলার মত ভদ্রতা আমি শিখিনি, তাই তোমাকে তুমি করেই বলব। আনোয়ারা বলল, অবশ্যই বলবেন। একটু লাজুক ভাবে বলল, সিট আছে, বসুন। আরমান আনোয়ারার পাশে বসল। আনোয়ারাকে বেশ সংকুচিত মনে হচ্ছে দেখে আরমান বললো, তোমার খুব অসুবিধা লাগছে? আনোয়ারা বলল, না-না, এটা তো দুজনের জন্যই। সারা রাস্তায় দু’জনের মধ্যে অনেক কথা হলো। বাড়িঘরসহ পরিবারের অনেক কিছু জানা হলো। বাস থেকে নামার সময় আরমান বলল, যেকোন প্রয়োজনে স্মরণ করবে। কোন সংকোচ করবে না। আরমানের কথায় যেন কোন আপনজনের সুর প্রতিধ্বনিত হলো। যা মনে রাখার মতো। তাছাড়া মেধা ও ব্যক্তিত্বের কারণে বেশ নেতৃস্থানীয় বলে মনে হয়। ভার্সিটির সকল ছাত্র-ছাত্রী আরমানকে এক নামেই চিনে। এমন একজন ঘনিষ্ঠ পরিচিত এবং একই এলাকার হওয়ায় অনোয়ারার বেশ ভালো লাগে।

এই ভালোলাগাটা অল্প দিনেই কিভাবে যেন ভালোবাসায় পরিণত হয়। আরমান এল.এল.বি মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। তার সঙ্গে ক্লাসে দেখা হওয়ার কথা নয়। কলাভবন, লাইব্রেরীতে পুকুর পাড়ে ইদানিং প্রায়ই দেখা হয়। মনের অজান্তেই দু’জনের অনুরাগের মাত্রা বেড়ে যায়।

দু’একটা কথা, একটু হাটা, তারপর এখানে-ওখানে একত্রে বসা। আনোয়ারা বুঝতে পারে আরমান যদি সাগর হয় তবে সে নিজে নদী। নদী সাগরের মোহনায় এসে পড়েছে, কিছুতেই আর ফেরানো যাবে না। অগত্যায় আনোয়ারা আরমানের কাছে আত্মসমর্পন করে। একদিন বিকেলে আনোয়ারা আরমানকে বলে, আরমান ভাই, মাস্টার্স ফাইনাল হয়ে গেলে আপনি চলে যাবেন? আপনি চলে গেলে আমি কিভাবে এখানে একা থাকবো? আমাকে ভুলে যাবেন না তো? আরমান বলে, তোমার কি মনে হয়? তুমি আমাকে আজ যে কথাটা বলছো সেই কথাটাই আমিও তোমাকে বলব বলব বলে ভাবছিলাম। যাক, ভালই হলো। তোমার লেখা-পড়া শেষ হতে হতে দেখি আমি একটা চাকুরী-বাকুরী জোগাড় করতে পারি কি-না? আমার জন্য ভেবো না। মনোযোগ দিয়ে লেখা-পড়া করো। তুমি ছুটিতে বাড়িতে এলে দেখা তো হবেই।

মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে আরমান বাড়িতে এলে আনোয়ারা যেন একা হয়ে যায়। সারাক্ষণ বিষন্নতায় ভোগে। আরমান প্রতি সপ্তাহে চিঠি লিখে। একটি চিঠির বিনিময়ে আনোয়ারা দুটি করে চিঠি দেয়। এভাবে একটি বছর কেটে যায়। এর মধ্যে আরমানের পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে। কয়েক জায়গায় চাকুরীর চেষ্ঠা করে। পুলিশ বিভাগে পুলিশ অফিসার পদে একটা চাকুরী পেয়ে যায়। পুলিশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা ভাল নয়। অনেক ভেবে সে চাকুরীতে যোগদান না করে পেশা হিসেবে ওকালতীকে বেছে নেয়। আনোয়ারার মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়। এরই মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ-নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৬ দফা দাবী আদায়ের আন্দোলনের ডাক দেয়। ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চÑএর ভাষণের পর তাকে বন্দী করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হলে প্রকাশ্যে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। আরমান স্বসস্ত্র যুদ্ধে অংশ গ্রহনের ইচ্ছার কথা আনোয়ারাকে বলে। আনোয়ারা প্রথমে রাজি না হলেও পরে দেশের স্বাধীনতার স্বার্থে আরমানকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দেয় তবে এক শর্তে। যুদ্ধে যাওয়ার আগেই তাদের বিয়েটা হতে হবে। আরমান অনেক যুক্তি উপস্থাপন, অনেক আপত্তি করলেও আনোয়ারার কাতর অনুরোধের কাছে হার মানে আরমান। অবশেষে ১০ মার্চ তাদের বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের ২ সপ্তাহ পর আরামান দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য দেশের লাখো মানুষের মুক্তির জন্য স্বসস্ত্র যুদ্ধে অংশ গ্রহনের উদ্দেশ্যে নবপরিনীতা স্ত্রী, বাবা-মা’সহ পরিবার ও দেশ-গ্রামের মায়া ত্যাগ করে রাতের অন্ধকারে পাড়ি জমায় ওপার বাংলায়। সেখানে প্রয়োজনীয় অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ফিরে আসে অস্ত্র হাতে স্বদেশের মাটিতে হানাদার মুক্ত করতে। মরিয়া হয়ে সে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। মাঠে, ময়দানে, জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে কয়েক মাস অতিবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে বহুবার পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে। শত্রু পক্ষের অনেককে হত্যা করতে সক্ষম হলেও তার সহযোদ্ধা বেশ কয়েকজন শহীদ হয়েছে তারই চোখের সামনে। এত কিছুর পরও আনোয়ারার কথা সে একদিনের জন্য ভোলেনি। যখন যেখানে গেছে, সেখান থেকে আনোয়ারাকে চিঠি লিখে। প্রত্যেক চিঠিতে লিখে, তুমি ভালো থেকো, সাবধানে থেকো। মাকে দেখো। আমার জন্য ভেবোনা, আমি ভালো আছি। দেশকে স্বাধীন করেই ফিরবো ইনশাআল্লাহ। আনোয়ারা চিঠি পড়ে আর কাঁদে। চিঠির জবাব দেয়ার কোন উপায় নাই, কারণ, চিঠিতে কোনো ঠিকানা থাকতো না। একটা সংবাদ আরমানকে না দিলেই নয়। কিন্তু কোনো উপায় নেই। তাই আনোয়ারা একা একা বিড়বিড় করে বলে, ওগোঃ তোমার ঔরষের সন্তান আমার গর্ভে দিনে দিনে বড় হচ্ছে।

তুমি দেশকে স্বাধীন করে বাড়ি এসো, এটাই হবে তোমার জন্য আমার শ্রেষ্ঠ উপহার। আমাদের সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে স্বাধীন দেশের মাটিতে। পরাধীনতার কোন কলঙ্ক তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে মাথা উঁচু করে বড় হবে। ভাবতে গর্বে আমার বুকটা গর্ভে ভরে যাচ্ছে। আমি তোমার পথ চেয়ে বসে আছি।

মানুষের সব আশা পূরণ হয় না। দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই, গর্ভের সন্তান স্বাধীন দেশের মাটিতে ভূমিষ্ঠ হয়েছে গর্বের সাথে মাথা উঁচু করে বড় হচ্ছে কিন্তু আরমান আর ফিরে আসেনি। দেশ স্বাধীনের মাত্র ২ দিন আগে বাঙ্গালী নামে কলঙ্ক এ দেশীয় যুদ্ধপরাধী রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এবং শহীদ হয়।

আনোয়ারা অনেক কেঁদে-কেটে চোখের পানি শুকিয়ে চোখে আগুন নিয়ে আত্মস্থ হয়। তার গর্ভের সন্তান ২ মাসের শিশু পুত্র আদনান শরীফকে বুকে নিয়ে সে জীবন যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত স্বাধীন দেশে সবকিছু নতুন করে গড়ে তোলার প্রস্তুতি চলে। এলাকায় একটি নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়। আনোয়ারা সেখানে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে। শুরু হয় তার জীবনে একা পথ চলা। একমাত্র ছেলেকে তার বাবার মত মানুষ করার চেষ্ঠা করে। ছেলে দিনে দিনে বড় হয়ে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে পড়ে। সম্মুখে ছেলের ভবিষ্যত ও পিছনে স্বামীর স্মৃতিকে অবলম্বন করে আনোয়ারার দিন কাটে। আনোয়ারা ছেলেকে সব-সময় বলে, তোমার বাবার মত হতে হবে। ছেলে মা’কে প্রশ্ন করে, মা, ‘বাবা কেমন ছিলেন’। একই গল্প বারবার শুনেও তৃপ্তি মিটেনা। আর ছেলেকে বলার ছলে বারবার স্বামীর স্মৃতি রোমন্থন করে তৃপ্তি পায় আনোয়ারা। এভাবেই আনোয়ারা পার করেছে জীবনের চল্লিশটি বছর।

ছেলে আদনান শরীফ এল.এল.বি অনার্সসহ মাস্টার্স পাশ করে বিচারক হিসাবে চাকুরী পেয়েছে তাও কয়েক বছর হলো। ইতিমধ্যে দু’একটি প্রমোশনও পেয়েছে। এদিকে আনোয়ারা কলেজের শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়েছে। আজ ছেলে শীতকালীন ছুটিতে বাড়িতে আসবে। তাইতো আনোয়ারা বেগম অন্যান্য বারের মতো বিয়ের শাড়ীতে সাজেনি। এবার যে ছেলের বৌকে সাজাতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে রাত দুপুর গড়িয়ে গেছে তা আনোয়ারা টেরও পায়নি। আর কিছুক্ষণ পর ফজরের আজান হবে। কিন্তু আদনান এখনও এলো না কেন? এমন সময় কলিং বেলটা বেজে উঠে। আনোয়ারা বেগম দরজা খুলে দিলে ছেলে ঘরে ঢোকে। আনোয়ারা বেগম অস্থির হয়ে উঠে। এতদেরি হল কেন? পথে কোন অসুবিধা হয়নি তো? ছেলে হেসে বলে, না-না, আমার কোনো অসুবিধা হয়নি। “মা তোমার কি খুব ঘুম পেয়েছে”? আনোয়ারা বেগম ব্যস্ত হয়ে বলে না বাবা তুমি এতদিন পর এলে আর আমি কি ঘুমাতে পারি?

তবে শোন, তোমার জন্য শুধু সু-সংবাদ নয় মস্ত বড় একটা সুখের সংবাদ আছে। আনোয়ারা বেগম খুব খুশি হয়ে প্রশ্ন করলেন বাবা, তোমার আবার প্রমোশন হয়েছে? আদনান মাথা নেড়ে বলল, মা অর্থ আর পদমর্যদা জীবনের সব সুখ নয়। যারা তোমার জীবনের সব সুখ-শান্তি কেড়ে নিয়েছে, যাদের জন্য আজ আমি পিতৃহীন, যারা দেশের মাটি এবং মানুষের সাথেবিশ্বাস ঘাতকতা করেছে সেসব নর পিচাস যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের হোথাদের আমার আদালতে দেশের প্রচলিত আইনে বিচার করে উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছি। তুমি খুশি হওনি মা? বাবার আত্মাও নিশ্চই খুশি হয়েছে। সত্যি পিতা-মাতার যোগ্য সন্তান এবং স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে গর্ব বোধ করছি। মাইকে ফজরের আজান শোনা যাচ্ছে। একটু পরেই সূর্য উঠবে। নতুন সূর্য।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge