আজ দুই সপ্তাহ পর অনিমেষ পাতাকে পড়াতে এসেছে। পাতা? হ্যাঁ, পাতা। অনিমেষের ছাত্রী। আজ পড়াতে ইচ্ছে করছে না। পদার্থের পুরনো সমীকরণ কষতে দিয়ে অনিমেষ চুপচাপ বই দেখছে। বই দেখতে দেখতে ভাবছে, আজ চৌদ্দদিন পর আসাতেও কেউ কিছুই জিজ্ঞেস করলো না কেনো? মায়ের মৃত্যুর খবর তো জানানো হয়নি।
‘স্যার, আজ পড়বো না।’
অনিমেষ স্মিত হাসলো। অনিমেষ এরকম কিছুই চাচ্ছিল আজ। তবুও জিজ্ঞেস করলো, ‘কেনো পড়বা না?’
পাতা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। অনিমেষ হকচকিয়ে উঠলো। কান্নাভেজা কণ্ঠে পাতা বললো, ‘স্যার, আপনি এমন কেনো? আপনি আমাকে একবারও জিজ্ঞেস করলেন না, আমি আজ কেনো সেজেছি?’
অনিমেষ অবাক হলো, তাইতো! মেয়েটি আজ অদ্ভুত সুন্দর একটি শাড়ি পরেছে। লাল পাড়, সোনালি জমিন। শাড়ির পাড়ের সঙ্গে মিলিয়ে লাল ব্লাউজ আর লালটিপ পরেছে। ঠোঁটে হালকা লাল লিপস্টিক। আলুথালু চুল। কাজল লেপ্টানো চোখ জলে টইটুম্বুর। এতো বড় একটি বিষয় কী করে চোখ এড়িয়ে গেলো, অনিমেষ দ্বিধায় পড়ে গেলো।
‘তোমার নিজের থেকেই শোনার জন্য জিজ্ঞেস করিনি। আমি তো জানিই আজ তোমার জন্মদিন।’ ছাত্রীর কান্না থামানোর জন্য অনিমেষ ছোট্ট এই মিথ্যেটুকু বললো। এই মিথ্যেটুকু একটি দারুণ দৃশ্যের অবতরণ ঘটালো। কান্নাভেজা বালিকার মুখে হাসি। সম্ভবত এটি পৃথিবীর সুন্দরতম দৃশ্যগুলোর একটি।
‘মা বলেছেন আপনাকে?’
‘না। আমি নিজেই জানি।’
‘আপনি আমার জন্মদিন মনে রেখেছেন স্যার! আমি সত্যিই বিশ্বাস করতে পারছি না। আপনি এতো ভালো কেনো স্যার!’
অনিমেষ স্মিত হেসে মনেমনে শুকরিয়া জ্ঞাপন করলো, ভাগ্যিস ধারণা সঠিক ছিলো।
‘ঠিক আছে আজ তোমার ছুটি।’
‘ধন্যবাদ স্যার।’
অনিমেষ আজকের মতো উঠতে চাচ্ছিলো। আজ মনটা বিশেষ ভালো যাচ্ছে না। পাতা থামিয়ে দিলো, ‘ভেবেছেন কি, আমার ছুটি দিয়ে পালিয়ে যাবেন! উঁহু। আজ আপনার ছুটি দিচ্ছি না।’
‘পাতা, স্যারকে ডাইনিংয়ে নিয়ে এসো।’ ভেতর থেকে পাতার মা ডাকছেন।
‘স্যার, চলুন, মা ডাকছেন।’
পোলাও, গরুর কালোভুনা, খাসির রেজালা, মুরগির রোস্ট, ডিম, শসার সালাদ, দই, বরই আচার ইত্যাদি আরও কীসব। টেবিল ভর্তি খাবার। অনিমেষ খাচ্ছে, পাতা খাবার পরিবেশন করছে, পাতার মা বসে গল্প করছে।
‘দেখো বাবা, তুমিও আমাদের পরিবারের একজন। তুমি কিন্তু আমাদেরকে এখনো আপন ভাবতে পারোনি।’
‘আসলে আন্টি…’
অনিমেষের মুখের কথা কেড়ে নেন পাতার মা, ‘আমি জানি তোমার মা মারা গেছেন। তুমি দুই সপ্তাহ কেনো, দুইমাস পরে এলেও আমি কিছুই মনে করতাম না। কিন্তু তোমার মা মারা গেছেন, এই খবরটা তুমি আমাকে দিতে পারতে। আমাদেরও তো দুশ্চিন্তা হয়। ছেলেটির কী হলো না হলো।’
‘আসলে আন্টি মা’র বয়স হয়েছিলো, চলে যাওয়াটা যদিও অস্বাভাবিক ছিলো না। কিন্তু এভাবে হঠাৎ চলে যাওয়াতে আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম। কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না।’
‘পাতা, স্যারকে মাংস উঠিয়ে দাও।’
‘না থাক, লাগলে আমি নেবো। আন্টি পরে কার কাছে শুনেছেন মা’র মৃত্যু সংবাদ?’
‘তোমার বাসার ফোন দিয়েছিলাম। পিচ্চিটা ধরেছিলো। তোমাকে জানাতে বলেছিলাম, হয়তো বলেনি। যাইহোক, কিছু মনে করো না বাবা। তোমাকে কাছের মানুষ ভাবি, তাই একটু অধিকার খাটাই।’
অনিমেষ বিনয়ী কণ্ঠে বলে, ‘আরে না না, কী যে বলেন। মন খারাপ করবো কেনো!’
‘পাতা, তুমি তোমার স্যারকে খাওয়াও, আমি উঠি। অনিমেষ, কিছু লাগলে চেয়ে নিও বাবা।’
পাতার মা উঠে যান। পাতা ওর স্যারকে খাওয়াচ্ছে।
‘স্যার, সত্যি করে বলুন না, আমাকে আজ কেমন লাগছে?’
অনিমেষ মাথা নিচু করে খাচ্ছিলো। মাথা নিচু অবস্থায় খেতে খেতে বললো, ‘অনেক সুন্দর।’
অনিমেষের এরূপ ভঙ্গিতে দেয়া উত্তর মেনে নিতে পারলো না পাতা। সে একদম চুপ হয়ে গেলো। চোখের কোণায় জল চিকচিক করছে। অনিমেষ মাথা নিচু করে খাচ্ছে। টেবিলে পানি অর্ধপূর্ণ কাচের গ্লাসটি। পাতা গ্লাসটি হাতে নিয়ে সজোরে মেঝেতে নিক্ষেপ করলো। ঝনঝন শব্দে মুহূর্তেই চূর্ণবিচূর্ণ। অনিমেষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলো পাতা। অনিমেষ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।
Leave a Reply