বুধবার, ০৭ Jun ২০২৩, ১০:৩৩ অপরাহ্ন

টুকরো স্মৃতি ২: সে কি বুঝেছিল এটাই শেষ দেখা..! -জসিম মল্লিক

টুকরো স্মৃতি ২: সে কি বুঝেছিল এটাই শেষ দেখা..! -জসিম মল্লিক


অনেক সামান্য ঘটনাও কখনও কখনও অসামান্য হয়ে স্মৃতিতে জ্বল জ্বল করে। অনেক ছোটো ছিল সেই ঘটনা কিন্তু তার আবেদন ছিল অনেক প্রগাঢ়। অন্যের কাছে যদিও এর কোনো মূল্য নেই। কিন্তু তবুও এক একটি ঘটনা এমনভাবে সামনে এসে স্মৃতির দরজা খুলে দেয় যে ভাবতেই চোখ ভিজে উঠে। সাজু আর আমি কাছকাছি বয়সের ছিলাম। সাজু আমার তিন চার বছরের বড় ছিল। মা সংসারের কাজ নিয়ে জেরবার থাকতেন। ধান, নারকেল, সুপারি, লাউ , ঝিঙ্গা, ধুন্দুল, সীম এইসব গাছ গাছালি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। খই, মুড়ি ভাজতেন, গোবর দিয়ে উঠোন লেপতেন, পা দিয়ে নিপুণ দক্ষতায় ধান শুকাতেন। মা একলাই পুরো সংসার সামলাতেন। আমাকে ফেলে রাখতেন মাটিতে। কখনও কখনও একটু বুকে তুলে নিতেন। আমি নাকের জ্বলে চোখের জ্বলে বেড়ে উঠছি। মাঝে মাঝে সাজু আমাকে সামাল দিত। শিশু আমাকে কোলে করে নিয়ে পাড়া বেড়াত। সাজুর সাথে আমার অনেক ভাব ছিল, আবার অনেক রেষারেষিও। সামান্য এটা সেটা নিয়ে-মুড়ির মোয়া বা নারকেলের নাড়ু, চিনাবাদাম বা লাঠি লজেন্স নিয়ে ঝগড়া লেগে যেতো। তখন আমাদের সামান্য আয়ের সংসার। বাবা নেই। এক ভাই উপার্জনক্ষম।

মনে পড়ে সেবার ক’দিন ধরে খুউব বৃষ্টি বাদলা হচ্ছিল। টিনের চালের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে পড়ছে পড়ার টেবিলে। আমি ক্লাস থ্রী বা ফোরে পড়ি। এক দুপুরে আমি আর সাজু ঠিক করলাম মাকে বলব ইলিশ পোলাও রান্না করতে। বৃষ্টির দিনে ইলিশ পোলাও খাওয়ার আইডিয়াটা সাজুর মাথা থেকে এসেছে। মাকে বলায় মা একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কে যাবে বাজারে ইলিশ কিনতে! তাৎক্ষনিকভাবে টাকাই বা কোথা থেকে আসবে! সেই রাতে সত্যি সত্যি ইলিশের বন্দোবস্ত হয়েছিল। ইলিশ পোলাও রান্না হয়েছিল। মায়ের মন বলে কথা। কিন্তু ইলিশের মাথা খাওয়া নিয়ে সাজুর সাথে আমার ঝগড়া লেগে গেলো। অভিমানি আমি রাগ করে সে রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে গেলাম!

তারপর অনেক বছর পার হয়েছে। সাজুর বিয়ে হয়ে গেলো। আমি বাড়িতে আসলেই ভাটিখানা যেতাম ওর শশুরবাড়ি। আমি তখন ঢাকায় পড়াশুনা করি। ওর শশুরবাড়ি যখনই যেতাম খাওয়া নিয়ে এমনই পিড়াপিড়ি করত যে অবস্থা কাহিল করে দিত।
বলত, জসিম রসমালাই আনাইছি তোর দুলাভাইরে দিয়ে, ঘরবরনের রসমালাই, চারটা খাবি কিন্তু। ফজলি আম আনাইছি তোর জন্য। দুই পিচ রোষ্ট কিন্তু তোকে খেতেই হবে।
একদিন বলল, আজ তোর জন্য ইলিশ পোলাও রান্না করেছি। মনে আছে ছোটবেলার কথা! রাগ করে না খেয়ে ঘুমিয়ে গেছিলি!! সেদিন মা আমাকে মেরেছিল। ইলিশের মাথাটা খাবি কিন্তু। মাথা তোর অনেক প্রিয়।

সাজু মারা গেলো অকস্মাৎ। দুটো ছোট ছোট সন্তান রেখে। তাও বিশ বছর হয়ে গেছে। কোনো মানে হয়! শেষবার যখন দেখা হলো অনেকক্ষণ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আমার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়েছিল। সেদিন সাজু কেনো যে আচঁল চাপা দিয়ে কেঁদেছিল কে জানে! সে কি বুঝেছিল আর দেখা হবে না! এটাই শেষ দেখা!
আমাকে নিয়ে ওর অনেক গর্ব ছিল। ওর জগতটা ছিল অনেক ছোটো। কিন্তু আমার সবকিছুতেই ওর অনেক আনন্দ ছিল! যখনই যেতাম এমন খুশী হতো! মনে হয় ঈদ লেগে গেছে। আমার কোনো লেখা পত্রিকায় ছাপা হলে শশুরবাড়ির সাবাইকে দেখাতো। ওর অনেক দেবর ননদ ছিল বলত দ্যাখ দ্যাখ আমার ভাই লিখছে ..!

টরন্টো ৮ মে ২০২১

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge