রবিবার, ২৮ মে ২০২৩, ০৬:৩৭ পূর্বাহ্ন

মঞ্জুরি-আব্দুল খালেক ফারুক

মঞ্জুরি-আব্দুল খালেক ফারুক

বিকেলের সূর্য্যটা পশ্চিমাকাশে রক্তিম রশ্মি ছড়িয়ে বিদায় বার্তা জানাচ্ছে। মৃদুমন্দ বাতাসে প্রশান্তির ছোঁয়া। আজ মেঘমুক্ত আকাশ। নীলের সাগরে ডুব দিয়ে আছে দিগন্ত।
আমি বসি আছি নদীর তীরে। নদীর নাম মানস। বর্ষায় ঘোলা পানিতে ডাকে বান। শরতের স্বচ্ছ পানিতে শ্যাওলার হাসি। এই নদীটি কখনও শান্ত। কখনও বিক্ষুদ্ধ। ঠিক যেন মঞ্জুরির মতো। আমার হৃদয়কাশের সবটুকু জুড়ে তারার মতোন জ্বলে আছে সে।
মঞ্জুরি ছিলো খুব মায়াবি। কখনও তার ডাগর দুটি চোখ মেলে অপলক চেয়ে থাকতো আমার দিকে। কখনও আমার উসকো খুশকো চুলগুলো পরিপাটি করার কাজে নিমগ্ন থাকতো। মুখের ভাষা হারিয়ে যেত কোন গগনে- বোঝা কঠিন। তখন নিরব নিস্তব্ধতা ভর করতো চারপাশে।
মঞ্জুরিকে আমার মাঝে মাঝে খুব অচেনা মনে হতো। আমি ওর অবয়বে শান্ত সুবোধ বালিকার স্বরুপ যেমন দেখেছি; তেমনি দেখেছি ডানপিটে আর চ ল স্বভাব, ওর কিশোরী সুলভ উচ্ছ্বলতা।
কলেজের নবীনবরণে প্রথম দেখা। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। কী মিষ্টি আর মায়াবি মুখ! আমি ওর মায়াবি চোখের গভীরে হারিয়ে গিয়েছিলাম ক্ষাণিকটা সময়।
ওর কণ্ঠে যখন শুনলাম, ‘এতো জল ও কাজল চোখে, পাষাণী আনলো বলো কে’-আমার মনের ভেতর কীসের যেন তোলপাড়।’ ইচ্ছে করছে বলি, ‘তোমার নিষ্পাপ চোখের কাজল আমি বিরহের জলে মুছে যেতে দিবনা মঞ্জুরি’। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর সুমধুর কণ্ঠের গান শুনছিলাম। কখন যে অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে-বুঝতে পারিনি।
হঠাৎ মঞ্জুরিকে দেখলাম কয়েকজন বান্ধবী পরিবেবিষ্ট হয়ে আসছে এদিকে। তার সৌন্দর্য আর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ করার মতো ব্যাপার ছিলো। তড়িৎ সিদ্ধান্ত ফেললাম। কথা বলবো ওর সঙ্গে। আমি তখন আচমকা সাহসী হয়ে উঠলাম। আমার চিরাচরিত লাজুকতা বিসর্জন দিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালাম। বললাম, ‘তোমার গান কিন্তু খুব ভালো হয়েছে। কী সুন্দর অসাধারণ কণ্ঠ! শ্রোতারা সবাই বিমুগ্ধ।’
‘আমি মনে হয় কিছুটা বাড়িয়ে বলছেন।’-মঞ্জুরির কণ্ঠে অনুযোগ।
‘উহু একটুও বাড়িয়ে বলিনি। সুন্দরকে সুন্দর বলাই শ্রেয়। তা না হলে সুন্দরের অমর্যাদা হয়।’
‘আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন।’
‘এবার মনে হয় তুমি বাড়িয়ে বললে।’
মঞ্জুরি হাসে। হাসতে থাকে। মনে হয় ওর হাসিতে পৃথিবীও হাসছে।
‘ভালো থাকবেন।’ মঞ্জুরির ভূবণ ভূলানো হাসির ছটায় আলোকিত হলো কলেজের বারান্দা। ও চলে গেলো। আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম ক্ষাণিকটা সময়।
এরপর মঞ্জুরির সঙ্গে পরিচয়, বন্ধুত্ব আর প্রণয়ে খুব কাঠ খড় পোড়াতে হয়নি। কখনযে মঞ্জুরি আমার মনের গহীন কোণে ঠাঁই নিয়েছে বুঝতে পারিনি। মঞ্জুরিকে নিয়ে আমার স্বপ্নের ভাসানযাত্রার যাত্রা শুরু হয়েছে। স্বপ্ন দেখাতো পাপ না। মঞ্জুরির প্রেমমুগ্ধ আমি তখন জীবনের সবটুকু নি:শেষ করতেও রাজী। মঞ্জুরিকে ভালোবাসা যদি কোন অপরাধ হয়, তো সেই অপরাধে আমি ফাঁসিতে ঝুলতে রাজী। মনে হতো, মঞ্জুরি আমাকে ভালোবেসে যে কোন ত্যাগ স্বীকারে রাজী। আমার সঙ্গে দেখা করা আর কথা বলার জন্য তার আকুতি দেখে তাই মনে হতো আমার। আমাকে ছাড়া ওর জীবন অর্থহীন এমন কথা প্রায়ই বলতো।
কিন্তু মানুষ যা চায়, তা কী সবই পায়। সময় বদলে যায়। বদলে যায় চিরচেনা মানুষ। এই বোধ হয় নিয়তি। কক্ষচ্যূত উল্কার মতো নিমিষেই স্বপ্ন ছুটে যায়। আকাশ টের পায়না। জীবনও থেমে যায়না।
মনে পড়ে, একদিন মঞ্জুরির সঙ্গে মানস নদীর বালুচরে হাঁটছিলাম। শেষ বিকালের মরা রোদের প্রলেপ লেগে কাঁশবনে তখন নৈসর্গিক শোভা। আজ শাড়ি পড়েছে মঞ্জুরি। শখের শাড়ি। নীল আঁচল, সাদা জমিন। দক্ষিণা বাতাসে উড়ছিল সেই শাড়ির আঁচল। অবাধ্য এলোচুল আছড়ে পড়ছিল কোমল মুখশ্রীতে। দুআঙ্গুল দিয়ে অদ্ভুত নিপূণতায় ও বারবার অবাধ্য চুলগুলোকে শাসন করছিল।
আমরা হাঁটছি পাশাপাশি। নীলাকাশে আর খন্ড খন্ড মেঘের ভেলা। এক ঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে দৃষ্টি সীমার প্রান্ত ছুঁয়ে। এক রাখালের মেঠোসুরের উন্মাদনা দিগন্ত জুড়ে। মঞ্জুরি গান গাইছিল গুণ গুণ করে। আমি সেই মনোহর দৃশ্যটাকে ভুলে অনেকটা খাপছাড়াভাবে বলি-‘আচ্ছা মঞ্জুরি-যদি কোন দিন তুমি হারিয়ে যাও আমার জীবন থেকে?’
মঞ্জুরি অবজ্ঞার হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বলে, ‘ধ্যাৎ তোমার যত ফালতু চিন্তা। তুমি ছাড়া আমার জীবনের কোন মানে আছে?
আমি চিরকাল তোমার হয়েই থাকবো।’
মঞ্জুরি সে কথা রাখেনি। সরকারি চাকুরে বাবার বদলীর সুবাদে মঞ্জুরি চলে গেল অনেক দূরে। যাবার আগে এক ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের সঙ্গে তার বিয়েও নাকি পাকাপাকি হয়েছে। অনন্ত সুখের হাতছানিতে কাবু হয়ে মঞ্জুরিও সায় দিয়েছিল সেই বিয়েতে।
আমি এসববের কিছুই জানতাম না। তার বান্ধবী নীলার কাছে যেদিন জানলাম, সেদিন মঞ্জুরি চলে যাবে। সেই অন্তিম সময়ে সুখ সপ্নে বিভোর মঞ্জুরির সামনে দাঁড়িয়ে তাকে বিব্রত করতে চাইনি। যাবার আগে নীলার মাধ্যমে আমাকে এক চিরকুট পাঠিয়েছিল মঞ্জুরি। তাতে লেখা, ‘মাহমুদ দু:খ করনো। তোমাকে কষ্ট দেয়ার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। ভালো থেকো।’
অদ্ভুত! মঞ্জুরি তোমার অদ্ভুত খেয়াল! ভালোবাসা যে তোমার কাছে নিছক খেয়াল-বুঝতে পারিনি।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge