ইতু, ইলতুৎমিশ। ভারতের ইতিহাসে এক মহান ব্যক্তির নামে নাম বলে যার একমাত্র অবশিষ্ট গৌরব। এমনই এক যুবক ‘বেকারের চিঠি’ উপন্যাসের মুল চরিত্র। যার বিপরীতে তরী নামের সহজ ও অতিসাধারণ তরুনীর গভীর, অকৃত্রিম এবং উপেক্ষার অযোগ্য ভালবাসার স্বরুপ বর্ণিত হয়েছে ৬৪ পৃষ্ঠার এ উপন্যাসে।
বেকার এবং বেকারত্বের চাবুকে ন্যুব্জ হয়ে পড়া এক যুবক, যে কীনা একটা চাকরির পিছনে ছুটতে ছুটতে হাপিয়ে উঠেছে, যেন রাষ্ট্রশাসিত জীবনের সাথে পাল্লা দিয়ে উঠে দাঁড়াতে ব্যর্থ সে। চিঠির খাম থেকে প্রতিবার প্রতিটি চিঠি তাকে সে ভৎর্সনাই করে। প্রতিটি চিঠি রেফারীর লাল কার্ড হয়ে মুখের সামনে দাঁড়ায়। যার সহজ অর্থ ‘তুমি ব্যর্থ’। প্রচ্ছদের ভাষা তারই জলজ্যান্ত ভাষ্য দিচ্ছে যেন। যাতে ঝলসানো আগুনের আলোয় ভেসে উঠে বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার কবলে গ্রাস হওয়া জীবনের হাহাকার আর আত্নচিৎকারের প্রতিচ্ছবি। উপন্যাসের সমস্ত অংশ জুড়ে সমসাময়িক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রচলিত অনিয়মকে ঘৃণাভরে তিরষ্কার করেছেন লেখক রম্যতার ছলে।
‘কাঙাল হরিনাথের বংশধর’ টাইপের এক পত্রিকা সম্পাদকের দপ্তরে চাকরি প্রার্থী হিসেবে পদচারণার মধ্যদিয়ে শুরু হয়েছে উপন্যাসের কাহিনী। রম্যতার কৌশলে বর্ণিত কথামালায় লেখক বোধহয় ‘কাঁটা ঘায়ে লবণ’ ছিটিয়েছেন সমাজের সেই খলনায়কদের দিকে। লেখক তার বাস্তব জীবনে দেখা ঘটনাকে চিত্রায়িত করেছেন অক্ষরের তুলিতে। সচেতন পাঠক তার চিহ্ন পাবে বইটির প্রতিটি পাতায় পাতায়। সম্পাদনায় ছোট খাটো ত্রুটি থাকলেও গল্পের ধারাগুলো বর্ণিত হয়েছে সহজ ভাষায়। চেনা শব্দে। যা যেকোন ধরনের পাঠকের কাছেই গ্রহনযোগ্যতা পাবে। শুরুতেই ইতুর দেখা সম্পাদকের চরিত্র, তার জ্ঞান ও কর্মপদ্ধতি দেখে মনে হয়েছে তিনি এ পদের অযোগ্য। ‘মনে হয় ইনি রাজনীতির ময়দান থেকে খাবি খেয়ে অবশেষে সাংবাদিক হয়েছেন। অথবা –মনে হয় এনার বিরাট কোন জ্যাক আছে।’
শুধুমাত্র এই জ্যাকের জোর, খুঁটির জোর কিংবা কোটার জোর নেই বলেই ইতুকে এমন হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে, কিন্তু কোন সদুপায়, সুযোগ কোনটাই পাচ্ছে না সে। অথচ রেস্টুরেন্টের মালিক মুক্তিযোদ্ধা ইসলাম মিয়া- যিনি তিন খানসেনাকে খতম করার বদৌলতেই হোক আর খুঁটির জোরেই হোক সব ছেলেমেয়ের সরকারি চাকরি নিশ্চিত করে এখন নাতি-নাতনির চাকরি নিয়ে ভাবছেন আয়েশ করে। আর ইতুর না আছে খুঁটি কিংবা, না আছে কোটার জোর। সুতরাং এই দুর্বল ইতুরাই মুলত আজকের সমাজের উচ্ছিষ্ট হয়ে জীবন কাটায়।
কথিত খুঁটির জোর বাড়াতেই হোক বা তার বাবার আর্জি পূরণেই হোক, ইতুকে অনেকটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও একদিন এলাকার এমপির দ্বারস্থ হতে হয়। যারা ‘হরেক রকম চুলের ছাঁট, বাহারি পোশাক, চশমা পরে বিদেশী লুক..’ নেয়া যুবকের আশির্বাদে ক্ষমতা পেয়ে বসেন। সেখানে ইতু দেখলেন আর এক রঙ্গম । লেখক বর্ণনা করেছেন – সংসদে তার কথাবার্তা শুনলে হাউজে হাসির ঝড় উঠে। অথচ এমপি সাহেব নিজের অযোগ্যতার কথা ভুলে চাপাবাজির কসরতে ইতুকে হেনেস্তা করার সুযোগ পায়। অতঃপর ‘দশ লাঁখ টাকার খঁরচ দিলে রিটার্ন-ভাঁইভার সব ব্যবস্থা আমরা করবো’- এমপির পিএসএর এই ব্যবস্থাপত্র নিয়ে তাদের ফিরতে হয়।
ইতুর বড় অপরাধ সে সৎ। নইলে নিরাময় ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের এ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজারের চাকরিটাকে ওভাবে পায়ে ঠেলতে পারতো না সে । রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার জানে আলমের মত ভেল্কিবাজি করে কিংবা গরীব মানুষদের রক্তচোষা ডাক্তারদের কমিশনে কমিশন বসিয়ে দিব্যি পকেট ভারী করতে পারতো ইতু আর দশজন চাকরিজীবী দুর্নীতিবাজদের মত। কিন্তু কমিশন শব্দের সাথে অপিরিচিত ইতু ‘গরীবের টাকার কোন কমিশন হয় না’ বলে নিবৃত্ত করলো নিজেকে, প্রতিঘাত করলো সেইসব দানবের পেটে। আবার তার খালার প্রস্তাবে রাজি হয়েও সে পারতো নিজেকে বিক্রি করে দিতে একটি চাকরির কাছে। মেয়ের বিনিময়ে কাড়ি কাড়ি টাকা আর ‘মেয়ের জমিজমা লিইখ্যা’ নিয়া চাকরির ‘স্বাধীন জীবন’ সে উপভোগ করে পারতো। কিংবা পারতো তার ফুফা ভন্ড, ইউটিউব হুজুরের মত কোন সহজ পথ ধরে নিজেকে দাঁড় করাতে।
‘ইতু ভাবছে, একজন বেকার যুবক, যার অর্থ আর যোগাযোগ নেই, তার জন্য এ দেশে একটি চাকরি অধরা। আবার চাকরি পেলেও ধরে রাখা কঠিন। কারণ সবখানেই অনিয়ম আর দুর্নীতি।’ ঠিক মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’ সিনেমার রনজিতের মত। যার শুধুমাত্র একটি কোর্ট-প্যান্টের অভাবে চাকরি পাওয়া হয়ে উঠে না সাহেবদের কোম্পানিতে অথচ বুকে কত স্বপ্ন। রনজিতের, তার মায়ের, বোনের এবং রনজিতের জন্য অপেক্ষমান প্রণয়িনীর। কিন্তু এসবই কি আসল যোগ্যতা? মেধা কি কিছুই নয় তবে? মায়ের ভালবাসা অন্ধ হয়ে জীবনের ফারাহ্ কাটাতে ইতুর মা অবশেষে ইতুকে তাবিজের আশ্রয় নেয়ার তাগিদ দেয়। কারণ বেকার যুবক মা-বাবার ঘাড়ে অভিশাপের বোঝা হিসেবে চেপে থাকে। তার সাথে জড়িয়ে থাকে মান-সম্মান, আশা, বাঁচা। তাই তারা সে বোঝা নামাতে উঠে পরে লাগে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা ইসলাম মিয়ার মতো ইতুর বাবার খুঁটি কিংবা কোটার জোরতো নাই।
চারিদিকে অজস্র হতাশার হাতছানির মধ্যে বলতে গেলে দোকানদার রমজান ভান্ডারীই ইতুর একমাত্র বন্ধু। যার কাছে সে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে সহজে। অপরদিকে চেঙ্গু হালিম ইতুর সমবয়সী হয়েও সমাজ, রাষ্ট্র ও জীবনের কোপে আজ সে পথচ্যুত। অন্ধকার পৃথিবীর বাসিন্দা। আলোর বিপরীতে যে আঁধার, সে আঁধারের সহচর। ‘দুই পৃথিবী’ সিনেমার গানের মতোই ‘আলোতে যদি পথ না পাই খুঁজে আঁধারে পা আমি বাড়াবোই।’ জীবনে আলোর পথচ্যুত সে চেঙ্গু হালিম পরে আছে শুধু রামধোলাইয়ের অপেক্ষায়।
হালিম আর ইতুর মধ্যে মুখ্য পার্থক্য ভালবাসা। ইতুর আছে মায়ের-বাবার ভালবাসা, খালার-ফুফুর এবং তরীর। হতাশার মধ্যে এতগুলো ভালবাসাই যেন ইতুকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ‘কোনটা উপেক্ষা, কোনটা অবহেলা’ সেটা বুঝেও তরী ইতুকে বেঁধেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। তরী ইতুকে সব সময় কাছে পাবার আশায় পথ চেয়ে থাকে অথচ ইতু কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যহীন বস্তুকে ধরার উন্মত্ত প্রচেষ্টায় তাকে বারবার উপেক্ষা আর অবহেলা করলেও তরী জানে ইতু তাকে কতটা চায় মনে প্রাণে। সুতরাং একটু প্রশ্রয় পেলেই যেন দু’জনের প্রেম উস্কে উঠে।
‘তোর সব কিছুতেই হেঁয়ালী। এ জীবনে কিছু তো করতে পারবি না’- বেকাররা এই বাক্যের সাথে চিরকাল বাস করে আসে। ‘বেকারের কোন কাজ নেই’ সুত্রকে ধরে ফুফুর ‘বেকারের আবার কাজ কী?’ কথার উত্তরে যথার্থই উত্তর দেয় ইতু – ‘বেকার বলেই তো বেশি বিজি থাকতে হয়’ । সে বিজি যে কতটা ইজি তা একজন বেকার ছাড়া আর কেই বা বুঝে?
‘আজকাল নিজেকে বড় একা মনে হয় ইতুর। মা-বাবার স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ এক যুবকের পৃথিবীতে থাকা অর্থহীন মনে হয়।’
‘ত্রিশ বছর বছরের এক বেকার যুবকের পক্ষে স্বপ্ন দেখাও পাপ’ হলেও একজন বেকারের বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল শুধু স্বপ্নই। তা হোক দিনে কিংবা রাতে। এই সব অব্যবস্থাপনার মুখে থু দিয়ে তারপরও ইতুকে স্বপ্ন দেখতে হয় তাকে ডেকে পাঠানো হবে সরাসরি মন্ত্রণালয়ে। এবং চাকরিতো পাবেনই সসম্মানে, সেই সাথে কাঠগড়ায় দাঁড়াবে দুর্ণীতিবাজ ‘কোট পরা ভদ্রলোক’রাও। অথচ ঘুম ভাঙলেই সে স্বপ্ন মলিন হয়। একা পথের সঙ্গি হয় শুধু ভাবনাগুলোই, শুধু একটি প্রশ্নই ‘এই স্বদেশটা কার? কার জন্য এই রাষ্ট্রের জন্ম?’ যে স্বপ্ন, যে প্রশ্ন লেখকের। যে স্বপ্ন, যে প্রশ্ন স্বদেশপ্রেমী সকলের।
পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি এবং চকচকে মানানসই মলাটে, মাঝি বাঁধনের প্রচ্ছদে, ফ্রেব্রুয়ারী ২০২১, এনামুল হক কর্তৃক চমন প্রকাশ থেকে প্রকাশিত এ বইটির মুল্য ১৯০ টাকা। আব্দুল খালেক ফারুক ব্যক্তিগত জীবনে একজন শিক্ষক, ডিগ্রী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক। সেই সাথে প্রায় তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে দেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে আসছেন। নিজে সম্পাদনাও করছেন একটি মাসিক পত্রিকা। এছাড়া নাট্যকার এবং গীতিকার হিসেবে তার পরিচয় না দেবার অবকাশ নেই। তার লেখা আ লিক গান কুড়িগ্রাম তথা রংপুরকে সমৃদ্ধ করেছে। এবং লেখালেখির সাথে সমান তালে চলছে তার সংষ্কৃতি সেবা। এজন্য পুরস্কৃত হয়েছেন একাধিক পুরস্কারে। প্রকাশিত মোট বই ৭টি। সদা হাস্যজ্বল এবং মিশুক মানুষ হিসেবে তাকে চেনা। তার লেখা ‘বেকারের চিঠি’ নি:সন্দেহে পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করবে।
Leave a Reply