বুধবার, ০৭ Jun ২০২৩, ০৯:০৭ অপরাহ্ন

সেই থেকে আমি অনেক একলা-জসিম মল্লিক

সেই থেকে আমি অনেক একলা-জসিম মল্লিক

সেই থেকে আমি অনেক একলা
জসিম মল্লিক


আমার অনেক বাড়ি যেতে মন চায়। এ রকম মনে হওয়ার কারন আমি চাইলেও যেতে পারছিনা তাই বেশি করে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কোভিড আমার পায়ে শেকল পড়িয়ে রেখেছে। আমার প্রিয় কিছু জায়গা আছে, সেসব জায়গায় আমি যেতে চাই। আমি এক জায়গায় বেশিদিন স্থির থাকতে পারি না, আমি অনেক অস্থির প্রকৃতির মানুষ। আমাকে আপাত শান্ত প্রকৃতির মনে হলেও আমি মোটেও তা না, ভিতরে ভিতরে আমি প্রচন্ড অস্থির, একরোখা, জেদি মানুষ। যারা আমার খুব ঘনিষ্ট তারাই শুধু জানে সেটা। আমি যখন যেটা করতে চাই, যখন যেখানে যেতে চাই, যখন যেটা বলতে চাই তা না পারলে আমি প্রচন্ড যন্ত্রণায় ভুগি। আমার ঘুম নষ্ট হয়ে যায়, খেতে পারি না, কাজ করতে পারি না, লিখতে পারি না। আমার প্রিয় জায়গাগুলোতে আমি বারবার যেতে চাই। আমার কোনো খারাপ লাগে না তাতে। ক্লান্তি আসে না। প্রিয় জায়গার প্রিয় মানুষদের সাথে মিশতে চাই। আমার প্রিয় মানুষের সংখ্যা বেশি না। পরিচিত অনেক কিন্তু প্রিয় অল্প ক’জন।
সবাই আমাকে বোঝে না। আমিও সবাইকে বুঝি না। সমস্যা আমারই বেশি। আমি প্রায়ই আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। প্রবল উৎসাহ আর আকংখা নিয়ে কারো সাথে মিশি, নিজেকে উজার করে দেই। তারপর কোনো এক সময় আবিষ্কার করি আরে তার প্রতি তো আমার আগ্রহ নষ্ট গেছে! এর কারণ সামান্য। যখনই আমি দেখি সে আমার টাইপ না, সে স্বার্থপর তখনই আগ্রহটা হারিয়ে যায়। কিন্তু আমি তাকে বুঝতে দেই না। আমার ত্রুটির কারণেও অনেকে আমাকে খারিজ করে দেয়। তাই আমার আপনজনের সংখ্যা বেশি বাড়ে না। তাই যে ক’জন প্রিয় মানুষ আছে বারবার তাদের সান্নিধ্য পেতে চাই। এক বছরের বেশি বাংলাদেশে যাই না। বরিশালের রাস্তা, অলি গলি দিয়ে হাঁটি না। ঢাকার ধুলো বালি গায়ে মাখি না, ট্রাফিক জ্যাম, ভীড়ভাট্টা দেখি না। আজকাল কেবলই মনে হয় আমি কতদিন নিউইয়র্ক যাই না, লসএঞ্জেলেস যাই না, কোলকাতা যাই না, লন্ডন যাই না, প্যারিস যাইনা, ব্যাংকক যাই না, কুয়ালামপুর যাই না। কতবার হংকং যাওয়ার কথা ভাবি, ভিয়েতনাম যেতে চাই, সিডনি, টোকিও, বার্লিন যেতে চাই। এসব জায়গায় আমার যাওয়া ডিউ হয়ে আছে। কিন্তু যাওয়া কি হবে! আবার কি সেসব জায়গার বন্ধুদের সাথে মেশা হবে! সবকিছু অনিশ্চিত। জীবন অনিশ্চিত। শুধু আশা বেঁচে থাকে।

আমার অনেক বাড়ি যেতে মন চায়। সেই আশায় বসে আছি। কিন্তু আমারতো আসলে কোথাও কোনো বাড়ি ঘর নাই। মা সবসময় বরিশালে জলপাই তলায় একটা বাড়ির কথা বলতেন। এটা মায়ের একটা অবসেশন ছিল। বলতেন একটা বাড়ি করবি জলপাই তলায়, পুরো তেরো কাঠা জমির ঘেরওয়ালা, ছ’টা আম, চারটে কাঠাল, দশটা সুপুরি আর দশটা নারকেল গাছ লাগাবি, পিছনে থাকবে কলার ঝাড়। কুঞ্জলতা আমার বড় পছন্দ, বুঝলি! বেড়ার গায়ে গায়ে লতিয়ে দেবো। তুইতো শিম খেতে ভালোবাসিস-একটু শিমের মাচান করবি, গোয়ালঘরের চালের উপর লকলকিয়ে উঠবে লাউডগা.। আরো কতকি বলতেন যার কেনো অর্থ নেই। পারষ্পর্যহীন কিন্তু তাই আমি কান পেতে শুনতাম..। কিন্তু সেই বাড়িও করা হয়নি আজও।
সেজন্য আমার একটু মনোকষ্ট আছে বটে আবার এটাও ঠিক যেভাবে আছি ভালোইতো আছি। ঘরহীন ঘরে। ঠিক করেছি আমার যা কিছু আছে তা মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেবো আর পৃথিবীটাকে ঘুরে ঘুরে দেখব। শৈশব থেকেই আমার মধ্যে একটা উড়ানচন্ডি ভাব ছিল। আমি যখন তখন ঘর থেকে বের হয়ে পড়তাম। দু’চারটাকা জমলেই চলে যেতাম দূরে কোথাও। চেনা নাই জানা নাই বেড়িয়ে পরতাম ঘর থেকে। কখনো খুলনা, কখনো যশোর, কখনো পটুয়াখালি, কখনও ফরিদপুর, কখনো বগুড়া, কখনো রাজশাহি চলে যেতাম। ট্রেনের থার্ডক্লাসে চড়ে চলে যেতাম বগুড়া বা লঞ্চের ডেকে শুয়ে চলে যেতাম ঢাকা। পকেটে পয়সা থাকত না বলে না খেয়ে রাত পার করতাম। মা অনেক টেনশন করতেন আমাকে নিয়ে। কখনোই আমাকে ঘরমুখো করতে পারেন নি। একদিন মা বলেছিলেন, তুমি একটা পাখি। কানাডা আসার পর মৃত্যুর আগেও একবার এই কথা বলেছেন। বলেছিলেন, তুমি আমার ছোট সন্তান হয়েও তোমাকে আমি কাছে পেলাম না। পাখির মতো এই দেখি, আবার দেখি নাই। তারপর মা কেঁদেছিলেন। বলেছিলেন, তোমার মাথায় কেবল ঘুঘু ডাকে।

আমি আসলে আকস্মিক সংসারি। আমার চমৎকার দুটি সন্তান আছে। তারা আমাকে দারুণ বোঝে। এটাই আমার শক্তির জায়গা। তাই আমি যে কেনো সময় ঘর হতে বেড়িয়ে পড়তে দ্বিধা করব না। আমার অনেক একলা হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কোথায় যেনো একটা মায়ার বন্ধন রয়ে গেছে। মায়া জিনিসটা খুব খারাপ! খুব পোড়ায়! আমাকে সামনে এগুতে দেয় না, কেবল পিছু টানে। কিন্তু আমিতো একলা মানুষ বস্তুত। প্রবাস জীবনের একাকীত্বকে কিছুটা হলেও দূর করে আমার লেখালেখি। আমি লিখি আমার আনন্দের জন্য। আমার আনন্দানুভূতিগুলো বন্ধুদের সাথে শেয়ার করি। বন্ধুরাই আমার বেঁচে থাকার প্রেরনা হিসাবে কাজ করে। আমি যাদের জন্য অনেক করেছি তারা প্রায় সবাই আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। এর কারন আমার জানা নাই। এই রহস্য কিছুতেই উদঘাটিত করতে পারি না। কিন্তু তা সত্বেও আমার কোনো রাগ ক্ষোভ হয় না। এমনটাই হওয়ার কথা। তা সত্বেও আমি আমার হাতকে সংকুচিত করব না। এটা আমার মায়ের নির্দেশ। সেই নির্দেশ মেনে চলি সবসময়।
লেখালেখির ক্ষেত্রে আমার কোনো গুরু নাই। বই পড়ে পড়ে আর শৈশবের একাকীত্ব আর নির্জনতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই আমি কাগজ কলম হাতে নিয়েছিলাম। আমাদের মতো পরিবারে সেসব ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। আমাদের রয়েছে এক বিশাল পরিবার কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে আমাদের অবস্থা ছিল অনেক খারাপ। দুই বছর বয়সে পিতৃহীন হওয়ার কারনে অন্যান্যদের তুলনায় আমরা একটু পিছিয়ে ছিলাম। আমার নিরক্ষর মা এক অনন্ত লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন সারা জীবন। আমাদের জন্য পাতের খাবার তুলে রেখেছেন। আমাকে নিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তা ছিল বেশি। আমি ছিলাম প্রথাবিরোধী এক কিশোর। দুরন্ত, চঞ্চল।
সারাক্ষন চোখে চোখে রেখেও বাধতে পারেননি। এর কারণ হচ্ছে আমার মধ্যে যে আলাদা এক আমি আছে মা তা বুঝতেন না। এক-একদিন সন্ধ্যেবেলা আমার খুব মন খারাপ লাগত। এমন এক-একটা বিকেল বেলা আছে যখন সূর্য ডুবে যাওয়ার সময়ে অন্তত একটা মায়াবী অপার্থিব আলো এসে পড়তো উঠোনে। আকাশের রং যেত পালটে। সমস্ত বাড়িটায় কেমন এক আলো আঁধারির সৃষ্টি হত। হঠাৎ হঠাৎ আমার বহুজনের মাধ্যে হারিয়ে যাওয়া আমাকে অনুভব করতাম। টের পেতাম আমার আলাদা একা এক ’আমি’ আছে। সেই সব বিষন্ন বিকেলে আমার মাঝে মাঝে মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে হত। প্রায়ই পশ্চিমের ঘরে মাকে খুঁজতে গিয়ে পেতাম না। সংসার নিয়ে মা ব্যস্ত। সেই থেকে আমি একলা হয়ে গেছি।
টরন্টো ৫ মে ২০২১

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge