পরের কথা, নিজের কথা
শাহেদুজ্জামান লিংকন
জানালার পাশে সদ্য রাখা কলমদানী-কাম-ব্রাশদানীতে ব্রাশ রাখতে গিয়ে কানে এলো অশ্রাব্য শব্দটা। পাশাপাশি কোথাও তর্ক-বিতর্ক বা ঝগড়ার একটা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিলো। অশ্রাব্য শব্দের উৎপত্তি সেখান থেকেই জেনেও আমি বোকার মতো তাকালাম ঘরের মাঝখানে চেয়ারে উপবিষ্ট এনামুল হকের দিকে, আর তিনি তাকালেন নিচের দিকে। (ধরিত্রী দ্বিধা হও)। আমি ও এনামুল হক যুগপৎ লজ্জিত হলাম। পরক্ষণেই তিনি মুখ তুলে তাকালেন। সেখানে লজ্জা ও সম্মানহানির চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে ধরা দিলো। তারপর স্বগতোক্তির সুরে তিনি বললেন, আসলে আপনাকে আগে বলা উচিত ছিলো। এদের জন্যে মানসম্মান রাখা দায়। আত্মীয়-স্বজন কিচ্ছু মানে না। আল্লাহর এমন কোনো দিন নাই এদের ঝগড়া না করলে চলে না। ফজর আর মাগরিব বাদ দুই ওয়াক্তে। একনাগাড়ে কথাগুলো বলে হৃত সম্মান উদ্ধারে ব্যর্থ হলে এনামুল হক ‘আপনি গোছগাছ করেন, আসতেছি’ বলে প্রস্থানের নামে এক প্রকার পলায়ন করলেন।
পাশের বাড়ির স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া চলছেই। এনামুল হক বললেন যে, তারা প্রতিদিন দুই ওয়াক্তে ঝগড়া করে। যাহোক, কি আর করার? শুনতে শুনতে একসময় গা সওয়া হয়ে যাবে। আমি যেখান থেকে এসেছি সেখানে এমন ঝগড়ার ব্যবস্থা না থাকলেও, গালাগালির যে চর্চা একদম হয় না তা নয়। এ বাড়ি-ও বাড়ি প্রায়শই কলহ বাদে। আর এখানে তো এক বাড়িতেই, স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্য, কথাযুদ্ধ। সে দেখা যাবে খন।
একসময় তাদের ঝগড়া স্তিমিত হয়ে এলো। এশার আযান পড়ছে। এনামুল হক দরজা ঠেলে আমাকে দেখে প্রশ্ন করলেন, শেষ হইলো? আমি ‘না’ উত্তর দিলে তিনি বললেন, ঠিকাছে শেষ করেন। আমি নামাজটা পড়ে আসি।
আমার খাওয়ার ব্যবস্থা এনামুল হকের বাসাতেই হবে। এই বাবদ ভাড়ার পাশাপাশি বাড়তি কিছু টাকা ধরিয়ে দিতে হবে। সেটা কতো তা এখনো ঠিক হয়নি। এতে আমার রান্নার ঝামেলাটাও কমবে, আর বাড়ির খাবারের স্বাদটাও পাওয়া যাবে। প্রথমদিন হিসেবে আজ অবশ্য আমাকে দাওয়াত দিয়েছেন।
জিনিসপত্র গুছিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এসে আমি রুমে বসে অপেক্ষা করি। বেশ খিদে পেয়েছে। কাজে থাকার দরুণ টের পাইনি এতোক্ষণ। চারকোণাকৃতির বাড়িটার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে আমার রুম। দু’টো দরজা, জানালা তিনটা। গ্রাম হলেও ইলেকট্রিসিটির সুবিধা আছে। ফ্যান আছে। ফ্যান চালানোর মতো গরম এখনো পড়েনি। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো অ্যাটাচড বাথরুম। গ্রামে এমন বাসা ভাড়া পাওয়া কঠিন। এমন বাসা কেন, যে কোনো বাসা-ই পাওয়া কঠিন। অনেক খোঁজ করে পেয়েছি। তাই আমার সৌভাগ্যই বলতে হবে। এনামুল হকের প্রতিপত্তি একটু অনুমানের চেষ্টা করি। বাড়ির সামনে দুইটা মুরগির খামার, একটা পুকুর, নানান ধরনের গাছপালা। সামনের জমি-জিরেতগুলো তারই হবে হয়তো। বেশ কিছু মহিলা ও পুরুষকে কাজ করতে দেখেছি মুরগির ফার্মে। তবে হক দম্পতির সন্তানাদি সম্বন্ধে কিছুই জানি না এখনো।
এনামুল হকের ফিরতে বেশ দেরিই হলো। উনি নিজেই তা স্বীকার করলেন । একটা সালিশ ছিলো। পাড়ায় তার যে একটা প্রভাব আছে বুঝতে পারলাম। বাড়ির আঙ্গিনামুখী একটা দরজা আছে রুমের। সেই দিক দিয়ে আমাকে তিনি নিয়ে গেলেন খাওয়ার রুমে।
সেখানে দেখি মহা আয়োজন। পোলাওয়ের ঘ্রাণ পেলাম ঢুকতেই। বেরেস্তা ভেদ করে গরম পোলাওয়ের বাষ্প উড়ছে ডিশ থেকে। ডিম, মাছ, পোটল ভাজি, ডাল, সালাদ কিছুই বাদ যায়নি আয়োজন থেকে। এনামুল হককে কি সম্বোধন করবো তা নিয়ে ভাবছিলাম খেতে খেতে। এ পর্যন্ত কিছু বলে ডাকার প্রয়োজন পড়েনি। এখন যেহেতু এখানে থাকতে হবে, তাই একটা সম্বন্ধ ঠিক করা দরকার।
হক সাহেবের বয়স অনুমানের চেষ্টা করি। পয়তাল্লিশ প্লাস হবে। আমার ও তার বয়স বিবেচনা করলে তাকে ভাই বা চাচা দু’টোতেই মানায়। এই দ্বিধা থেকে আমাকে উদ্ধার করলেন মিসেস হক। মাংস তুলে দিতে গিয়ে আমি ‘আর না, আর না’ বললে মিসেস হক বললেন ‘শরম করো না বাবা। খাও। তুমি তো আমাদের ছেলের মতো।’ আমি উত্তর দেই, না চাচি লজ্জা না। খাচ্ছি-ই তো। এনামুল হক এর আগ পর্যন্ত আমাকে আপনি সম্বোধন করলেও, তার স্ত্রী একেবারে তুমিতে নেমে আসায়, তার স্ত্রীর কথায় যোগ দিতে ‘খান খান’ না বলে ‘খাও’ বলে ফেললেন। এই সুযোগে আমি সন্তানাদির ব্যাপারে প্রশ্ন করার অবকাশ পেলাম। আমার মনে হচ্ছিলো, যেহেতু ‘ছেলের মতো’ বললেন তাই কোনো ছেলে থাকতে পারে। হয়তো পড়াশোনা বা চাকরির খাতিরে বাইরে থাকে বলে এখনো দেখিনি। আর বিবাহযোগ্য মেয়ে থাকলেও থাকতে পারে। অপরিচিতদের সামনে সহজেই যুবতী মেয়েদের দাঁড় করায় না গ্রামের পিতা-মাতারা, এমনটাই জানি।
অনুমানের সাথে মিলিয়ে নিতে আমি প্রশ্নটা করেই ফেলি, ‘ছেলে-মেয়ে কয়জন আপনাদের?’ আমার প্রশ্নের জবাব পেতে ডানে মাথা ঘোরাতে গিয়ে দেখি এনামুল চাচার পোলাওয়ের ভিতরে চলাচলকারী হাতের আঙ্গুলগুলো থেমে গেলো। তাই তখনকার অশ্রাব্য শব্দটা শোনবার পর বোকার মতো মুখের দিকে তাকালাম না এবার। হয়তো চাচা-চাচী দু’জনেই ততোক্ষণে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেন। তাদের নীরবতা তাদেরকে নিঃসন্তান হিসেবে ঘোষণা করে আমার কাছে। সেটা চাচা মুখেও বলে দেন, কেউ নাই বাবা। তারপর খাওয়াটুকু শেষ করা পর্যন্ত কেউ কারো মুখের দিকে তাকাই না।
খাওয়ার পর অন্তত ঘণ্টা খানেকের আগে আমি শুই না। স্বাস্থ্যের একটা ব্যাপার তো আছেই। এই সময়টাতে অফিসের কোনো কাজ থাকলে সেরে ফেলি অথবা প্রায় মুখস্ত হয়ে যাওয়া চার-পাঁচটা গল্প-উপন্যাসের পাতায় চোখ বুলাই। আজ তো কোনো কাজ নেই। বই পড়তেও ইচ্ছে করছে না। এক বই আর কতোবার পড়া যায়? নতুন কিছু বই কেনা দরকার। এখন এনামুল চাচাকে নিয়েই বরং একটু ভাবি। তাহলে কোনো সন্তান নেই তাদের? সন্তান না থাকার বেদনা ঠিক কেমন জানি না আমি, তবে একটু উপলব্ধি করার চেষ্টা করি। এতোবড় বাড়ি। অথচ ছেলে-মেয়ে থাকবে না? কেমন খাঁ খাঁ করবে! তাই শূন্যতাকে ঢাকতে হয়তো এতোগুলো কাজের লোক রেখেছেন বাসায়। ছেলে-মেয়ের কথা ভাবতে গিয়ে আমি একটা শিশুকে দেখতে পাই চোখের সামনে, যে কেবল ‘দা দা দা আর বা বা বা’ আওড়াতে শিখেছে।
ঘুমাবার আগে মানিব্যাগটা সিথানে রাখার জন্য তোশকের একটা কোণ উল্টালে আমার চোখ আটকে যায়। কালো সাইনপেনে খাটের ডাশার মধ্যে দু’টি ইংরেজি বর্ণ। এস, এম। মাঝখানে একটা সংযোগ চিহ্ন। তোশক বিছানোর সময় আমার চোখ এড়িয়ে গেছে, আর এখন একেবারে ভিতরে ঢুকে গেলো। কিন্তু কোনো প্রশ্রয় না পেতে তোশকের অপরপ্রান্ত তুলে মানিব্যাগটা ভিতরে চালান করে দিয়ে ঝটপট ট্রাংক থেকে ‘শেষের কবিতা’ বের করে আনি। শুধু ‘শেষের কবিতা’-ই যথেষ্ট নয় ভেবে চাচীর কাছে এক গ্লাস পানি চেয়ে নিয়ে ২ মিলিগ্রাম ডিসোপ্যানের আশ্রয় নেই।
হক চাচার কথার সত্যতা পেলাম ঘুম ভাঙ্গতেই। পাশের বাড়ির স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার গুঞ্জন কানে এলো। তবে আশার কথা তাদের ঝগড়ার শব্দে ঘুম ভাঙ্গেনি। ছটা থেকে সাড়ে ছটার মধ্যে অটোমেটিক আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। বায়োলজিকাল ঘড়ি হয়ে গেছি। গুঞ্জনের পাশাপাশি আরো একটা জিনিস আবিষ্কার করলাম। আমার অবস্থান স্বাভাবিক নয়। খাটের প্রান্তে বালিশ দিয়ে কাত হয়ে আছি। ঘাড়-মুখ একদিকে হেলে পড়েছে। ঘাড়টা ব্যথা করছে। দুই উরুর মাঝখানে ‘শেষের কবিতা’। পূর্বরাতের কথা মনে পড়ে গেলো। কোনো সময় দিলাম না নিজেকে।
ব্রাশ নেয়ার জন্য জানালার কাছে গিয়ে জানালাটা খুলে দিলে চোখে পড়লো এক মহিলা বাড়ির খোলান ঝাড়ু দিচ্ছে। ঝাড়ু দেয়ার ভঙ্গি স্বাভাবিক নয়। অত্যন্ত চঞ্চল গতিতে চলছে ঝাড়ুটি, যেনো নিস্তার চাইছে। আর মুখে কথার খই ফুটছে। ‘খালি আসুক ক্যানে, আসুক এইবার’। বুঝলাম এই সেই মহিলা। ঘর থেকে তার স্বামী উত্তর দিচ্ছে ‘আসপে তো’। তাদের কথার খেই ধরতে পারলাম না। ঝাড়ু দেয়া শেষ হলে মহিলা মারমুখী ভঙ্গিতে এক হাত কোমরে আর এক হাতে ঘরের দিকে কিংবা ঘরের মানুষটির দিকে শূন্যে ঝাড়ু তুলে ধরে ‘এই ঝাটার ডাং কপালোত আছে তাইলে’ বললে আমি সটান কেটে পড়ে বাথরুমে ঢুকি।
আমার এনজিও অফিস এখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরে চাপাডাঙ্গায়। কিছুদিন আগে এসে ভাড়া বাসা খুঁজবার সময় সবার সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। কিন্তু নামগুলো মনে নেই। একদিনে অবশ্য মনে রাখা সম্ভবও না। আমিসহ স্টাফ মোট ছয়জন। আমার ফিল্ড, অফিস থেকে কাছেই। আমার দায়িত্ব লিভলিহুড ইমপ্রুভ করা নিয়ে। তিন বছর থেকে এই লাইনেই আছি। অফিসের বস সৈকত দে আমাকে প্রথমদিন হিসেবে সঙ্গে নিয়ে গেলেন ফিল্ডের সদস্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। আজ কাজ অবশ্য বেশি করতে হলো না।
আসরের পর একটু ঘুম ঘুম ভাব আসলে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম। যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন পাশের বাড়ির ঝগড়ার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। তার মানে মাগরিবের ওয়াক্ত পার হয়েছে। স্বামীটি নিশ্চয় বাজার থেকে সওদা করে ফিরে ঝগড়ায় যোগান দিয়েছে। যতোদূর মনে হচ্ছে এখানে মূল ভূমিকা স্ত্রীটির। তার গলাই বেশি শোনা যায়। প্রভাবটা তারই বেশি, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
এনামুল চাচার বাড়ি থেকে রাস্তাটা বের হয়ে মিশেছে মেইন রাস্তায়। পাকা রাস্তা। রাস্তার মাথায় একটা ছোট্ট চা-বিস্কুটের দোকান। ওখানে গিয়ে চা পানের সিদ্ধান্ত নিই। কিছুটা সময়ও কাটিয়ে আসা দরকার।
দোকানের কাছে আসতেই বিদ্যুৎ চলে গেলো। আমি চারপাশটা একটু দেখে নিয়ে পাশের বাঁশ-কাঠ নির্মিত বসার জায়গাটিতে বসে পড়ি। দোকানদার তখন হারিকেন বের করে জ্বালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাকে ঠিক মতো দেখতে পায়নি বিধায় বলে বসে, ‘তোমার সাইত নাই বেহে চাচা। আসতেই ফুক্কুত করি কারেনটা গেলো।’ হারিকেনের আলোয় যখন আমাকে দেখে তার অচেনা মনে হলো তখন একটু বিব্রত হলো। ‘কায়? মনে করছিনু এলাহি চাচা।’ আমি তখন পরিচয় পেশ করি। যুবকবয়সী দোকানি তখন বলে যে, আমার কথা সে শুনেছে। ‘ও তোমায় ভাড়া নেছেন এনামুল চাচার বাড়ি? চাচা কছলো যে, ঘরটা ভাড়া দেবে। মনে করছেনো এমনি কয় বুঝি। এমন সীমার বাপ! তা খালি চাচাক তো দোষ দেয়া যায় না। বেটিটারও কি কম দোষ?’ আমি দোকানির কথার আদ্যোপান্ত কিছুই না বুঝলে সে বিস্ময় প্রকাশ করে। ‘ক্যানে তোমরা কিছুই জানেন না?’ আমার না উত্তর শুনে দোকানি কিছুটা থমকে যায়। হারিকেনের আলোয় দেখি দোকানি তার মুখ আমার দিক থেকে ফিরিয়ে নিয়ে বললো, ‘থাক তাইলে। আপনে শুনির পাইবেন। চাচা জানলে ফির গাইলাইবে। চা খাইমেন?’ আমি সায় দিলে দোকানি ফ্লাস্ক থেকে টিপে টিপে আয়রনমাখা ছোট্ট হলদেটে গ্লাসে লাল চা ঢালে। ‘চা শ্যাষ। বাড়ি থাকি আনেছোল। এক কাপ হইবে।’ দোকানি চায়ের গ্লাস বাড়িয়ে দিতেই পোলাও পাতার ঘ্রাণ পাই। সেই ঘ্রাণের ভিতরে ঢুকে যেতে যেতে দোকানির বলে যাওয়া কথাগুলো নিয়ে নিজে নিজে বিশ্লেষণ করি। এনামুল হকের তাহলে মেয়ে আছে? তাকে নিয়ে কোনো সমস্যা? আগ বাড়িয়ে জানতে চাওয়াটা ভালো দেখায় না। আর গ্রামের এসব লোক কথা পেটে রাখতে পারে না। দেখা যাবে একটু পরেই গরগর করে সব উগড়ে দিয়েছে।
চা শেষ না হতেই একজন রিকশা থামিয়ে পাশে এসে বসে। গায়ে হাফ হাতা পাতলা সাদা গেঞ্জি। ঘেমে নেয়ে একাকার। গেঞ্জিটি খুলে বাতাস করতে থাকে গায়ে। ‘সুমন পানি খাওয়াও তো একগ্লাস’। দোকানির নামটা তখন জানা হয়ে যায়। ‘কোটে গ্যাছনেন?’ প্রশ্ন করে সুমন। রিকশাওলা উত্তর দেয়, ‘আর কইস না রে। মেম্বারের বেটিক থুবার গেছনু। রাস্তা এতো খোদরা-খুদরি। তার ওপরোত ফির পোয়াল দিয়া থুইছে। জানটা শ্যাষ। আর যাবার নাও কোনোদিন। ভাড়া তো খালি ত্রিশটা টাকা দেলে।’ সুমন জগ থেকে প্লাস্টিকের গ্লাসে পানি ঢেলে দিতে দিতে মেম্বারের মেয়ের অবিবেচক মনের নিন্দা করে, ‘ওরে বাপো! মেম্বারের বেটির বাড়ি তো মেলা দূরত। চামটা। খালি ত্রিশটা টাকা দিল্? কম করি হইলেও তো একান পঞ্চাশটাকি দেয়া নাগে। বেটিটাও বাপের মতোন চামার হইছে?’ ঢক ঢক করে পুরো গ্লাস পানি গলাধকরণ করে আরো এক গ্লাস আবেদন করার ফাঁকে রিকশাওলা বলে, ‘আসির সময় যদি একটা ভাড়া পানু হ্যায়, তাও তো হইল হ্যায়।’ আরো একগ্লাস পানিতে তৃষ্ণা নিবারণ করে তবেই আমার দিকে নজর ফেরালো রিকশাওলা। কিছু বলবার আগেই সুমন পরিচয় করিয়ে দিলো, ‘এন্দা ভাই এমা এনামুল চাচার বাড়িত ভাড়া উঠছে।’
আমার ভাড়া থাকার ব্যাপারটি নিয়ে এন্দা নামের রিকশাওলাটিও একটা বিস্ময় প্রকাশ করে। ‘ও ভাড়া তাইলে দিছে-এ?’ কিন্তু এন্দা ও ব্যাপারে আর কিছু না বলে আমার ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠে। কি করি? বাড়ি কই? ভাই-বোন কয়জন? বাপে কি করে? শুধু কুড়িগ্রাম জেলার কথা বলে তাকে শান্ত করা গেলো না। কোন থানা, কোন গ্রাম, কোন পাড়া? কিন্তু আমার নামটাই জানার প্রয়োজন বোধ করলো না। থানার কথায় সে তার একজন পরিচিত তথা আত্মীয়ের উল্লেখ করলো। কিন্তু আমি তাকে চিনি না বললে সে কিছুটা ব্যথিত ও বিমর্ষ হলো। তার সেই আত্মীয়ের বিরাট বড় ধানের গুদাম আছে হাটে, চেয়ারম্যানের সাথে বিরাট খাতির। সেই ব্যক্তিকে না চেনাটা যেন আমার ধৃষ্টতা এমনটাই বোঝালো এন্দা। আরো অনেক প্রশ্নে আমাকে জর্জরিত করে শেষপর্যন্ত আমার সাথে কোনো বংশলতিকা খুঁজে না পাওয়ার বেদনা ব্যথিত করলো তাকে। তবে এর পরে সে যদি কুড়িগ্রাম যায়, তো আমাদের বাড়ি খুঁজে বের করে আমার সাথে দেখা করবেই। আমি থাকি আর না থাকি এই ব্যাপারে কিছু যায় আসে না তার। এই আশা পোষণ করে গেঞ্জিটা ঘাড়ে ফেলে রিকশা নিয়ে পাশের কাঁচা রাস্তার দিকে নেমে গেলো। অদূরেই বুঝি তার বাড়ি।
সকালে উঠে আজ তেমন কোনো শব্দ শোনা গেলো না। আজ তাহলে ঝগড়া পর্ব বন্ধ? অবশ্য এনামুল চাচা প্রত্যেক দিন কথাটা হয়তো গড়ে বলেছেন। প্রতিদিন ঝগড়া বাধা অস্বাভাবিক। ব্রাশ করতে করতে দক্ষিণ দিকের দরজাটা দিয়ে আমি বাইরে আসি। একটা ছোট মেয়েকে দেখলাম একটা গাছ ঝাকাচ্ছে। কামরাঙ্গার গাছ। কয়েকটা পাকা কামরাঙ্গা পড়লোও। দ্বিতীয়বার যখন ঝাকাতে যাবে তখন আমাকে দেখে ভোঁ দৌড়। হাঁটতে হাঁটতে পিছনের দিকে একটু এগুলাম। দেখলাম পঞ্চাশোর্ধ একজন ব্যক্তি বাঁশের কঞ্চি দিয়ে দাঁত মাজছে। মুখে কাঁচা-পাকা লম্বা চাপ দাঁড়ি। বুঝলাম পাশের জীর্ণ টিনেরচালা দেয়া বাড়িটির গালাগালি হজম করা হতভাগ্য পুরুষটি ইনি-ই। আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একনজর দেখে নিয়ে একদলা থু ফেলে জিজ্ঞাসা করলো, ‘আপনি ভাড়াটিয়া?’ আমি উত্তর দেই, হ্যাঁ। তারপর এন্দার মতো অতোটা ভিতরে না ঢুকলেও আমার থানার কিছু লোকের সাথে এর আগে কুমিল্লায় ধান কাটতে গিয়ে পরিচিত হয়েছিলো বলে জানালো। লোকটির কথাবার্তা বেশ ভদ্রগোছের মনে হলো। হয়তো ভালো বংশের লোক। ভাগ্যবিড়ম্বনায় গরিবী হাল হয়েছে।
এনামুল চাচার মুখেই একদিন শুনলাম ঝগড়া অভ্যস্ত স্ত্রীটির নাম মাজেদা আর বেচারা স্বামীর নাম শহির আলী। এনামুল চাচা না কি বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছেন শহির আলীকে অন্য কোনো জায়গায় জমি দিয়ে বাড়ি করে দিতে। কিন্তু এই বাড়ি সংলগ্ন ভিটেটুকু শহির আলী কিছুতেই ছাড়বে না। হাজারো হোক বাপ-মা এখানে ছিলো। অতীতের হিসেব অনুযায়ী জমিটুকু এনামুল চাচার পিতারই ছিলো। তিনিই দয়া করে বাড়ির পাশের জায়গাটুকু লিখে দিয়েছিলেন শহির আলীর পিতাকে। দলিল থাকায় এখন আর কিছুতেই শহির আলীকে সরানো যাচ্ছে না। আত্মীয়-স্বজন আসলে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় ভেবে সিদ্ধান্তটা নিলেও কোনো লাভ হয়নি এনামুল চাচার।
শহির আলীর সন্তানাদি সম্পর্কে একদিন জানলাম। খুব বিস্মিত হলাম সেদিন। পাঁচ মেয়ে আর চার ছেলে। তিন মেয়ে আর দুই ছেলের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বড় ছেলে বিয়ে করে অন্যত্র আলাদা থাকে। মেজ ছেলে ঢাকায় গার্মেন্টেসে চাকরি করতে গিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে আরেক গার্মেন্টসকন্যাকে। এই নিয়ে বাড়িতে বিরাট ঝামেলা পাকিয়েছে শহির আলীর স্ত্রী মাজেদা। ছেলে কেনো গার্মেন্টসের অজানা-অচেনা মেয়েকে বিয়ে করে বসলো সেটা সে মানবেই না। শহির আলী ছেলের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছে। গার্মেন্টসে চাকরি করা ছেলে আর কোন বড়লোকের মেয়েকে পাবে এমনটা বললে মাজেদা জানিয়েছে ছেলে তার বানে ভেসে আসেনি। সেই ছেলে এখন বাড়ি আসতে চাচ্ছে। গোপনে পিতার সাথে সে যোগাযোগও করছে কিন্তু মাজেদা তা জেনে যাওয়ায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে।
শহিরের সন্তানের সংখ্যাটিই আমার কাছে অবাক করা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের বিয়ের একবছর না যেতেই না কি এই ঝগড়ার শুরু। প্রতিদিন এভাবে ঝগড়া করা স্বামী-স্ত্রী কী করে রাতের বেলা এক বিছানায় শোয়? তারপর একে একে নয়জন সন্তান! মনের খেদটুকু কি দেহের তাড়নায় মিলিয়ে যায়? না কি দেহের পাশে মনটাও তাদের জাগে? ঝগড়ার উৎস কি তাদের দীনতা-ই? সংসারের দুঃখকষ্ট, জরা-ই কি ক্ষোভে-অভিমানে তাদের মুখে আনে বিশ্রী সব কথা? আরো একটি বিশ্লেষণে হাত দেই। হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানো আর কি! আমার দোষটুকু কোথায়? শুধু আমি-ই কেন ভুগবো?
প্রতিদিন না হলেও প্রায় প্রতিদিন প্রত্যুষ ও সন্ধ্যার সময়টুকু শহির আলী ও ফাতেমার ঝগড়ায় কেটে যাচ্ছিলো। একদম গা সওয়া হয়ে গেছে এখন। কোনোদিন অফিসে কাজ বেশি পড়ে গেলে রাত আটটা-নয়টা করে ফিরতে হয়। সেদিন মনে হয় কী যেন মিস করলাম। তবে তাদের ঝগড়াটা শুধু ওই কথা কাটাকাটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। মারধরের কোনো ব্যাপার নেই। আর কদাচিৎ যদি তা হতো, তবে তা শহির আলীরই প্রাপ্য বলে লোকমুখে শোনা।
সপ্তাহে তিনদিন দুপুরবেলা খাওয়ার জন্য রুমে ফিরি। সেদিন ফিরে দেখি আমার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে সজীব, এনামুল চাচার ভাতিজা। ‘কি ব্যাপার সজীব কেমন আছো?’ ‘এই তো সেলিম ভাই, ভালো। আপনি কেমন?’ নখ খুঁটতে খুঁটতে উত্তর দিলো সে। ‘আজকে আপনি আমাদের বাসায় খাবেন’। ‘তোমাদের বাসায়? বাড়ির সবার দাওয়াত না কি?’ রুমের তালা খুলতে খুলতে বললাম। সজীবকে ভিতরে আসতে বললাম। ‘না, সেরকম কিছু না’ আমার বিছানায় বসলো সে। তারপর বিস্তারিত ঘটনা জানলাম। এখানে আজ রান্না হয়নি। কারণটা বিশেষ। এর আগে এনামুল চাচার মেয়ে সম্বন্ধে লোক-মুখে টুকটাক শুনলেও আসল ঘটনা অজানাই ছিলো। আর ঘাটাতেও যাইনি আমি।
এনামুল চাচার একমাত্র মেয়ে সুমি। কারমাইকেল কলেজে অনার্স পড়তো। চার মাস আগে ওখানকারই এক ছেলেকে কাজী অফিসে বিয়ে করে। ছেলের বাড়ি থেকে না কি খুব চাপ দিচ্ছিলো বিয়ের জন্য। তাই উপায় না পেয়ে কাউকে না জানিয়েই বিয়েটা সেরে ফেলেছে দু’জনে। এনামুল চাচার খুব শখ ছিলো ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দেবেন। প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন। সুমি একদিন ফোন করে মাকে জানালো ঘটনাটা। তারপর এনামুল চাচা। কিছুতেই এনামুল চাচা তা মানতে পারলেন না। চাপা রাখতে চাইলেও পারলেন না। পাড়ার সবাই জেনে গেলো। তিনি মোবাইল ফোনে সুমিকে জানিয়ে দিলেন- সে যেনো আর এ বাড়িতে না আসে, সব দুয়ার তার জন্য বন্ধ। নিজেই যখন জীবনের এতো বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তো নিজেই পথ খুঁজে নিক।
তো আজ এনামুল চাচার মেয়ে সুমির জন্মদিন। এই দিনে এনামুল চাচা বাড়িতে মিলাদ-মাহফিলের আয়োজন করতেন। মেয়ের প্রতি দরদটুকু তো আর শেষ হয়ে যায়নি। চাচা-চাচী না কি আজ কিছু খাবেন না। সজীবের আব্বা-আম্মা অনেক চেষ্টা করে গেছে, লাভ হয়নি।
বিকালে অফিস থেকে ফেরার সময় রাস্তায় দেখা হলো এনামুল চাচার সাথে। নামাজ পড়তে যাচ্ছিলেন। তাকে দেখে আমি মটরসাইকেল একটু স্লো করলাম। তিনি আমার দিকে তাকালেন না। মাথা নিচু করেই চললেন।
তারপর প্রায় বিশদিনের মতো কেটে গেছে। ভোরবেলা কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। কোথা থেকে কান্নার শব্দ আসছিলো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। নারী কণ্ঠের কান্না। চাচী কি কাঁদছে? থিতু হতেই টের পেলাম শহিরের বাড়ির দিক থেকেই শব্দ আসছে। শহির তবে কি আজ পিটিয়েছে স্ত্রীকে? পেটাতেও পারে। কাহাতক এতো কথা সহ্য করা যায়! কিন্তু কান্নার শব্দ ক্রমশ বাড়ছিলো, সেই সাথে মানুষের শোরগোল শোনা যাচ্ছিলো। আমি তড়পড় করে উঠে জানালাটা খুলে দেখি অনেক পুরুষ-মহিলার জটলা সেখানে। বুকটা ছাৎ করে উঠলো। কিছু হলো না তো শহির আলীর? রুম থেকে বের হয়ে ঘটনা জানতে গেলাম। মাজেদাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে সবাই। মাটিতে পড়ে ডুকরে কাঁদছে। তাকে ঘিরে উদোম গায়ে থেকে থেকে কাঁদছে চারজন ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে, শহির আলীর সন্তান। মাজেদার আর্তস্বরটাই প্রধান। ‘ও ভাই রে, মোর ভাইটা কোটে গেলো?’ দু’জন মহিলা তাকে টেনে মাটি থেকে তুলতে তুলতে সান্ত¦না দিচ্ছিলো, ‘আছে, আছে, কিছু হয় নাই। ঠিকে আসপে এলা?’ সজীবকে সেখানে দেখলাম। সেই বললো। গতরাত থেকে শহির আলী বাড়ি ফেরেনি। যাক বাবা বাঁচা গেলো। আমি তো আরো ভয়ানক কিছু ভেবেছিলাম। মাজেদা সারারাত জেগে অপেক্ষা করেছে। ভোর বেলা থেকে শুরু হয়েছে কান্না। কেউ কেউ বলছিলো, হয়তো মেয়ের বাড়িতে গিয়েছে। রাতে আর ফেরেনি। আজ ফিরবে। এই নিয়ে এখুনি এতো হাউ-মাউ করার কি আছে? বিরক্ত হচ্ছিলো কেউ কেউ। কিন্তু মাজেদা বলছে শহির বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার একটা হুমকি দিয়ে আসছে গত কয়েকদিন থেকে।
অফিস থেকে ফিরে যা জানলাম তাতে বেশ খারাপ-ই লাগলো। শহির আলীকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। গতরাতে বাজারে কেউ তাকে দেখেছে বলেও বলতে পারছে না। মাজেদা বেগম বাড়ির ছোট্ট আঙ্গিনায় পড়ে কেঁদেই চলেছে। মনের দুঃখে কোথায় গেলো মানুষটা? সব দোষ তার বলে এখন স্বীকার করে নিচ্ছে।
শহির আলীই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি এই বাড়ির। ছোটো দুই মেয়ে আর দুই ছেলের বয়স ২-৮ বছরের মধ্যে। তারা কি বা করবে? বড় ছেলে প্রায় ঘরজামাই। শ্বশুরবাড়ির কাছেই থাকে। দু’বেলা খাবারের ব্যবস্থা করেই সে খালাস। এ বাড়ি-ও বাড়ি থেকে খাবার অবশ্য আসতে লাগলো। কিন্তু মাজেদা খাবার মুখে তোলে না। একমুঠ ভাত আর এক ঢোক পানি গিলেই সানকি সরিয়ে দেয়। ছোট চার ছেলে-মেয়ে সেখানে ভাগ বসায়। এই সুযোগে একদিন মেজ ছেলে গার্মেন্টসকর্মী বউকে নিয়ে হাজির। মাজেদা বেগম কিছুই বলে না তখন।
রাতের বেলা শহির আলীর ব্যাপারটিকে নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ি। কোথায় গেলো লোকটা? ইচ্ছা করেই কি তার এই অন্তর্ধান, না কি সত্যি কোনো বিপদ হয়েছে তার? মরে গেলে বা আত্মহত্যা করলে লাশ তো পাওয়া যেতো। এখন রোজ দুইবেলা ঝগড়ার শব্দ শোনা হয় না আমার। তার বদলে কানে আসে মাজেদার কান্না, যখন তখন। যে লোকটার সাথে মোটেও বনিবনা ছিলো না, প্রতিদিন ঝগড়া করতো, মাঝে মাঝে মৃত্যুও কামনা করতো যার, তার জন্য দিন-রাত এমন কান্নার আয়োজন আমাকে বিস্মিত করে, বিভ্রান্ত করে, কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারি না। এই ঘটনা আমাকে নিয়ে যায় নিকট এক অতীতে, টেনে-হিঁচড়ে। আমি নিষ্কৃতি চাই। আমি যাবো না, যাবো না। এখানেই থাকবো।
এক মাসেও শহির আলীর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। পাড়ার লোকজন আস্তে আস্তে হয়তো তার কথা ভুলে যেতে শুরু করে। ভোলে না কেবল মাজেদা। প্রতি রাতেই আমি তার কান্নার শব্দ পাই। ছেলে-মেয়েগুলিও কাঁদে, তবে মায়ের মতো নয়। মেজ ছেলেই এখন রিকশা ঠেলে সবার খাওয়া যোগাচ্ছে। মেজ বউমাও আপন হতে শুরু করেছে মাজেদার কাছে।
সেদিন বিকেলে রুমে বসে আছি। হঠাৎ এনামুল চাচার উচ্চ কণ্ঠস্বর পেলাম। ‘কেনো কথা বলছো? আমাকে জানাইছো তুমি?’ এটুকুই শুনতে পেলাম। ভাড়াটিয়া হিসেবে আগ বাড়িয়ে দেখাটা শোভা পায় না। তাই ভিতর থেকেই শুনছিলাম। ‘আমি তো মা’ চাচীর কণ্ঠ। বুঝলাম চাচা-চাচীর মধ্যেই কথা হচ্ছে। ‘তুমি মা? আর আমি বাবা না? ও কি সেটা বোঝে? বোঝে? বাপ-মার মুখে চুনকালি দিছে না? একদম কোনো যোগাযোগ করবা না। তোমারও তাইলে বাড়ি ছাড়া লাগবে।’ অতি উত্তেজনা টের পাচ্ছিলাম চাচার কথায়। তাকে বেশ শান্ত-শিষ্টই মনে হয়। আজ হঠাৎ এমন উত্তেজনার কারণটা বুঝতে আর অসুবিধা হলো না।
চার-পাঁচদিন যাবত চাচা খুব ঘন ঘন আসছেন আমার রুমে। কেমন আছি, কাজ কেমন চলছে, কি ধরনের কাজ আমরা করি, সফলতা কতোটুকু এইসব। তবে থাকা-খাওয়ার কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না এটা ঘুরে-ফিরে বারবার বলছিলেন। আমি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেই বলছিলাম, এর চেয়ে ভালো জায়গা আর হয় না। খাওয়ার তো কোনো সমস্যা নেই। বরং বাড়িতে যা খেতাম তার চেয়েও ভালো খাচ্ছি। কিন্তু তিনি জোর করেই এই সিদ্ধান্তে নিয়ে আসছিলেন যে, আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে। আর এই সমস্যার সমাধানকল্পে আমিও যেনো ভালো একটা বাসার খোঁজ এখন থেকেই করি সে ইঙ্গিতও দিচ্ছিলেন। আমার কেমন কেমন যেনো লাগছিলো। এনামুল চাচা কি আমাকে আর থাকতে দিতে চাইছেন না? কথা-বার্তায় তাই মনে হয়। যদি তারা না চান, তো জোর করে লাভ নেই। আমিও তাই ওনার কথামতো অফিসের বস সৈকত দে কে বলি আশে-পাশে একটা ভালো বাসার ব্যবস্থা করে দিতে। কিন্তু তিনি জানালেন, এদিকে ভাড়া পাওয়া মুশকিল। ভাড়া দেয়ার উদ্দেশ্যে কেউ বাড়ি করে না এখানে। তবে এখান থেকে পনেরো কি.মি দূরে এক জায়াগায় পাওয়া যেতে পারে। সে অনেক দূর। শেষমেষ বাধ্য হয়ে হয়তো তাই-ই করতে হবে।
নানা ধরনের দুশ্চিন্তার মধ্যে একটা আনন্দের খবর এলো। শহির আলী ফিরে এসেছে। কোথায় এতোদিন ছিলো, কেমন ছিলো, কি করেছে এসব নিয়ে কিছুই বলছে না সে। মুখে কুলুপ এটে আছে। তা শোনার জন্য মাজেদা বেগমের দায় না পড়লেও, খেজুরে আলাপের জোগানের খাতিরে পাড়া-প্রতিবেশিদের জন্য তা জানা ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘ক ক্যানে, শহির ভাই কোটে আছলু? কামোত গেছলু না কি?’ শহির তাতে নিরুত্তর। সঙ্গে কিছু টাকাও না কি এনেছে। তাতে বোঝা যাচ্ছে কাজ-কর্ম ঠিকই করেছে সে। নতুন বউমা আর হারিয়ে যাওয়া মানুষের ফিরে আসা নিয়ে তাদের বাড়িতে বেশ আনন্দের একটা রেশ পড়ে গেছে।
দিন কয়েক বাদে শহির আলী তার ছেলেকে আবার গার্মেন্টসে চাকুরির জন্য পাঠিয়ে দিলো। এতো মানুষের থাকার জো নেই একটা ঘরে। নতুন একটা চালা করতে হবে পাশে। ছেলে কিছু কামিয়ে নিয়ে আসুক। নতুন বউ বাড়িতেই থাক। মাজেদা এতোদিন স্বামীকে নিয়েই চিন্তিত ছিলো। অন্য কিছু ভাববার সুযোগ পায়নি। এখন মনে পড়েছে ছেলে যে তার বিয়ে করলো, যৌতুক কই? মেয়ের সম্বন্ধে যতোদূর জানা তার বাবা-মাও জিরানিতে থাকে, গার্মেন্টেসে কাজ করে। বাড়ি রংপুরের শ্যামপুরে। এখন ছেলেকে তারা বুঝিয়ে দিক যৌতুকের টাকা। ছেলে এখানে একটা দোকান দিক। শহিরের কানে কথাটা তোলে মাজেদা। শহিরেরও টনক নড়ে। ঠিক-ই তো। যৌতুক কই? নতুন বউয়ের কানেও কথাটা তোলে মাজেদা। বউয়ের কথা শুনে মুখ হা হয়ে যায় তার। তার ছেলেকে না কি শ্বশুর গুনে গুনে পঁচিশ হাজার টাকা বুঝিয়ে দিয়েছে। টাকা না কি খরচও করে ফেলেছে। মাজেদার ক্ষোভটা এবার পুরোপুরি যায় তার ছেলের দিকে। ফিরুক সে এবার বাড়ি।
নতুন বউকে তখন আর সহ্য হচ্ছিলো না মাজেদার। ছেলের রেখে যাওয়া কিছু টাকা দিয়ে শহিরের আপত্তি সত্ত্বেও ট্রেনে করে একলা বউটাকে পাঠিয়ে দিলো স্বামীর কাছে, ঢাকায়। ‘যাও, কামাই করি আইসো’। বউটাকে তাই মেনে নিতে হলো। ‘একলায় তো কোনোদিন যাই নাই’ বলেও কোনো লাভ হলো না।
শহির আলী ফেরার পর থেকে দশ-পনেরো দিনের মধ্যে আর কোনো ঝগড়ার শব্দ আমার কানে এলো না। তাদের মাঝে কি এখন খুব মিল-মহব্বত? হারিয়ে যাওয়া মানুষ ফিরে এলে তার প্রতি কি কোনো অভিযোগ থাকে না? জীবনের সব সময়-ই কি তেমন? না কি কখনো কখনো সেখানে কেবল অবিশ্বাস আর সন্দেহের বসতি? এই যে শহির আলী এতোদিন পর ফিরে এলো তাতে মাজেদার মনের অবস্থাটা কি? সেখানে কি ভালোবাসার অথৈ জোয়ার? তাই যদি না হয় তো কোথায় তাদের সেই কলহ, ঝগড়া, বিবাদ, কথা কাটাকাটি, গালি বিনিময়? শহির কি জেনেশুনেই এমনটা করেছে? না বুঝে করলেও উপকার ঠিকই পাচ্ছে। কম বড় উপশম নয় এটা। আমিও কম সময় কাটালাম না। প্রায় চার মাস হলো। ইচ্ছে করেই ফিল্ড বদলিয়ে নিয়ে এতোদূরে এলাম। আর কতো? আমি আর পারছি না। এনামুল চাচা যে আমাকে একপ্রকার তাড়াতে চাইছেন তার কারণ কি? সুমি কি ফিরছে? সুমিকে কি তারা আবার গ্রহণ করছে? খাটের ডাশায় লেখা যোগচিহ্নের দুই ধারে ইংরেজি বর্ণ দু’টির কথা মনে পড়লো। সুমি। আর সুমির স্বামীর নাম? আহা! সজীবকে জিজ্ঞেস করলেই পারতাম। যার নামের অদ্যাক্ষর সুমি লিখে রেখেছে তাকেই কি পেয়েছে? না অন্য কেউ? সাজানো কল্পনাও ভেস্তে যায়। আমার কল্পনাগুলো? থাক, সুপ্তই থাক।
আমার মাথার বায়ে একটা দেয়াল। সামান্য কিছু ফাঁকা জায়গা, তারপরে শহিরের ঘরের বেড়া, তারপর তাদের বিছানা। এই সব দেয়াল মুহূর্তে বিলীন হয়ে গেলো। আমি দেখছি পঞ্চাশোর্ধ শহির আর চল্লিশোর্ধ মাজেদা বিছানায় বসে আছে মুখোমুখি, মাজেদা নতুন বউয়ের মতো ঘোমটা দিয়ে আছে। বিছানার চাদর তাদের জীর্ণ, কিন্তু চাঁদের আলো সেখানে জোস্নার সুন্দর এক আবরণ তৈরি করেছে। শহির হাসছে, মাজেদাও হাসছে। শহিরের দাঁতগুলো বেশ কালচে, মাজেদারও। কিন্তু তা যেন হাসিতে নতুন মাত্রা জুগিয়েছে। শহির একসময় আলতো করে থুতনিটা তুলে ধরে মাজেদার। মাজেদা বেগম তখন হাতটা সরিয়ে দিয়ে নিজের দু’হাতে মুখ ঢেকে লজ্জা নিবারণ করে (বরং প্রকাশ করে)। ধুর! কি সব দৃশ্য কল্পনা করছি! রাত কতো এখন? মোবাইলের আলোতে সময় দেখি। দু’টা। এতো বেজে গেলো? কি ভাবলাম এতোক্ষণ? কখন সকাল হবে? ব্যাগ গোছাতে হবে। অকস্মাৎ আমার সিদ্ধান্ত শুনে এনামুল চাচা ভড়কেও যেতে পারেন, কিন্তু মনে মনে হয়তো তাই-ই চাইছেন। ভালোই হবে তাদের জন্য। শূন্যস্থান পূরণের খাতিরে-ই আমাকে থাকার সুযোগ দিয়েছিলেন। এতোদিন পরে মনে হয়েছে এই স্থান আমার জন্য নয়। শহির ফিরেছে, সুমিও ফিরুক। এগুলোই তো আশার সঞ্চারণ। জায়গা করে দেয়া দরকার। আবার সময় দেখি। রাত্রি কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। শহির আর মাজেদার কি খবর? জেগে আছে? আমিও জেগে আছি। বুঝি গোটা রাত-ই জাগতে হবে। স্থির-শান্তভাবে নয়, ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো তড়পাতে তড়পাতে।
Leave a Reply