রওশন রুবীর ৫টি কবিতা
১. আমাদের আর হলোই না গান শোনা
আমাদের আর হলোই না গান শোনা ,
পাতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে নেমে যায় না বলা অভিমান ,
আয়নায় দেখে আসো ক্ষণে ক্ষণে চুরমার মুখ,
তড়িঘড়ি কথা না বলে শার্সির ওপারে দেখাও
বিকেল ক্রমাগত রাত্রির দিকে ছুটে যায়।
আমাদের দিকে হাঁটছে আমাদের চোখ,
অদ্ভুত বিষণ্নতা, প্রতিমার মতো সরল মায়া,
একাগ্র ভক্তের প্রাণ চেয়েছিল আরো কিছু শোনাও;
চুপিচুপি দিয়ে যাও গান, দিয়ে যাও গোপন অভিমান।
দাওনি! শুধু কপালের ভাঁজ জ্বলে উঠে
ঘরে ফেরা পাখিদের বুকের উল্লাস যেমন।
আর নিরবে বলো,
“আমরা যতোটা কাছের তার চেয়ে দূরত্বই হলো বেশি,
ভালো থাকার নাম করে জলে ধুয়ো না চারিদিক,
মানুষ সহমর্মী হয়ে করুণায় ঠেলে দেবে নিরর্থক মেঘ;
তুমি আর একা একা কতটুকু হবে কাতর!
তুমি তো ভালোবেসে হয়েছো আগুনের আবেগ,
ক’জন নিজেকে হারায়ে আগ্নেয়গিরি হয়?
ক’জন পুড়তে জানে এমন অন্ধ সর্বনাশে?
আমাদের আর হলোই না গান শোনা ,
ছুঁয়ে যায়, ছুঁয়ে যায়, শুধু ছুঁয়ে যায়
অভিন্ন বিষাক্ত সত্যের অনল।
যখন চিরকাল আগুনের ধর্ম পোড়ানো
তখন আমাকে পুরোপুরি পুড়িয়ে দাও
ওগো একরোখা সত্যের অনল।
২. যে ফেরার শেষ নেই চেয়ে থাকি তার পথ
ছিলাম, না থাকার মতো। তবুও ছিলাম।
খুদ-কুঁড়ো মেখে মেখে একবেলারোদ নিয়ে
চলে যাবে বুঝিনি। অঘোরের ঘুমভাঙাক্ষণ
এখনও ডাহুকের বুকে গোপনে রেখে দিয়ে
স্নিগ্ধতা ছুঁতে চাই; এমন ভেজা রঙ আগে দেখিনি।
এখনো বিকেল হয়, সন্ধ্যা হয়, নিয়ন বাতি জ্বলে উঠে,
এখনো আলপনা এঁকে হেসে খেলে চলে যায় স্মৃতি,
সবাই ফুল ছিঁড়ে, সাদা সাদা দিনের পিঠে
লিখে নিবিড়আরাম, একদিন ঘুড়িও ওড়ায়।
কেবল আকাল আমার; না পারি ভোলাতে মন,
না পারি ওড়াতে ঘুড়ি, বাহিরে ভেতরে উৎসুক নিনাদ,
চেপে রাখি পাথরে পাথর, আর কত রাখতে হবে?
যে রাখে সেই বুঝে আত্মা শুকিয়ে গেলে সর্বস্ব শুকায়।
কী পাষাণ সময় ছিল সেদিন, কী দম আটকা ভাঙন,
প্রথম খবর নিয়ে মুঠোফোন; তারপর, তারপর
সংবাদপত্রগুলো ভরে গেছে অকল্পনীয় দাবানল,
আমি পুড়েছি নরকদহনে; আজো যা নেভাতে অক্ষম।
ব্যবধান ভাঙতে পারে দূরত্বের সীমানা;
সীমানা ভাঙা দুপুর পেরোই,
ঋতুগুলো ঠিক ফিরে আসে; যে ফেরার শেষ নেই
অলিখিত আচ্ছন্নতায় আমি চেয়ে থাকি তার পথ;
না বাজে মুঠোফোন, না খোলে খিল,
এ কেমন কপাট এঁটে দেন ঈশ্বর?
সুস্বাদু দারুচিনির চা’য়ে তবু বাসালে ঠোঁট
মুখোমুখি ঠিক তুমি তুলে দাও অদ্ভুত অভুক্তআঙুল।
৩. মিঠেল পাড়ের গান
কোকিলারে আর গেওনা মিঠেল পাড়ের গান
যদি ভাসে উজান গাঙে আমার নিঠুর প্রাণ
যদি ওঠে অট্টালিকায় কষ্ট দিনের ঢেউ
যদি নাচে অবুঝ ঘাসে আপন মনে কেউ।
আমার হাতে কাজের কড়া পায়ে পথের দাগ
পার হয়ে যায় এক নিমিষে দারুণ দিনে মাঘ
কিভাবে যাই পলাশ নিতে শিমুল ঝরো ঝরো
ট্রেনের গতি থামছে না তো কাঁপছে থরোথরো।
ধুঁকছে বাহন, উদাস নদী, কেতন উড়ায় যে
হাজার পথের মানুষ পুড়ে পোড়ায়ও মন সে;
কোকিলারে তাই গেওনা তোমার ফাগুন গান
শূন্যতা ওই ভাসছে দেখ, করতে ঘাটে স্নান।
৪. কিছুই মুছি নি
বহুবার পেছনে গিয়েছি, বহুবার সামনে,
অবশিষ্ট অংশটুকু পেরুতে গিয়ে থমকে দাঁড়াই,
টের পাই ভেতরে কেউ বলছে-
ঐ নীল কৌটোয় আছে বিয়োগবোতাম, নিয়ে যাও।
ওয়াড্রবের চার নম্বর ড্রয়ারে কিছু পুরোনো স্মৃতি;
ওসব রেখে গেলে আমেনা কষ্ট পাবে।
ড্রেসিংরুমে উপস্থিত সুপেয়-গন্ধ ভারি করছে বাতাস,
ফেরাতে চেয়ে তুমুল আবেগে ভেঙেছে আয়না;
পেছনের ডাকে তুমি ফিরো না।
দরজার শেষ সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে
যে রোদটুকু হাত থেকে খসে পড়লো মাটিতে;
ওটুকু ওভাবে ফেলে রেখে গেলে-
একদিন অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে পারে;
মুছে দাও পদচিহ্নের চেয়ে দ্রুত ছায়ার অতলে।
কিছুই মুছিনি, নেই নি সাথে কিছু, লেপ্টে রইল তবু।
অবশেষে টের পাই আমি ভালোবাসি
যা কিছু বিরাজমান সত্তায়, যা আছে চোখের বাহির।
৫. আবেদন
না ওভাবে নয়, অমন করে নয়
শামসুর রাহমান, হেলাল হাফিজ
কিংবা মহাদেব সাহার কবিতার মতো
সহজ সরল মর্মস্পর্শী চোখে ওকে তুমি দেখো,
ওর সারল্য মুখে আহা কত বেদনার ছাপ
কত না বলা কথা স্ফুরিত হয় ।
ওকে পান্তা দিলে কখনো
নুন, লঙ্কার জন্য বিরক্ত করবে না,
সারাদিন নির্যাতনের পরও
চিৎকার করে প্রতিবেশীদের কাছে
তোমার সম্মানের এতটুকু হেরফের করবে না,
এমন ভালোবাসা তুমি পাবে কোথায়?
এমন নিবেদিত বন্ধু দীর্ঘদিন দেখেনি কত মানুষ।
আহা; ওরে মমতার শৃঙ্খলে বাঁধো,
আঁজলা ভরে দাও সহানুভূতি।
ওতো বেশি কিছু চায় না,
ও চায় স্নেহ মমতা সহানুভূতি
আর প্রকাশের স্বাধীনতা
দাও না, কী এমন ক্ষতি তোমার,
কিসে এতো ক্ষোভ?
কেন শেখাচ্ছো প্রতিবাদী হতে
কেন শেখাচ্ছো অবাধ্যতার শেষ কৌশল?
ও ক্ষেপে গেলে অগ্ন্যুৎপাতের চেয়ে ভয়ঙ্কর হবে,
রকেটের গতির চেয়ে দ্রুত খুলে যাবে-
বিস্ফোরণের দরজা।
তোমার ধারাপাতের ভাবনাগুলো
আদিম মানুষের মতো, ব্যাকরণও তাই।
মুখ বুজে আর কত পাঠ নেবে?
ওতো নগণ্য শিশু নয়,
ওকে স্বাধীনতা দাও ভোগ ও বিলাসের।
Leave a Reply