সুশিক্ষায় গ্রন্থাগার: প্রসঙ্গ উচ্চ শিক্ষা পর্যায়ে
সৈয়দ মাহবুবার রহমান সোহেল
সহস্র বছরের পথ পরিক্রমায় মানুষের অসংখ্য অমর কীর্তির মধ্যে গ্রন্থাগার নিজ মহিমায় নিজের স্থান করে নিয়েছে। সুমেরীয়-অ্যাসিরীয়- ব্যাবিলনীয় সভ্যতা থেকে শুরু করে আধুনিক সভ্যতায়ও জ্ঞান চর্চার শ্রেষ্ঠতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রন্থাগারের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
মানব সভ্যতার ইতিহাসের যাবতীয় উত্থান-পতন আর ঘটন-অঘটনের ডামাডোলে অপরিবর্তিত থেকে গেছে গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার তথা জ্ঞানের প্রতি মানুষের ভালোবাসা।
মানবজাতির প্রয়োজনে সর্বপ্রকার জ্ঞানকে একত্রিত করে স্থায়ীত্ব দানের অভিপ্রায়ে গ্রন্থাগারের সৃষ্টি। ইহা জ্ঞান সংরক্ষণের মূলপ্রাণ কেন্দ্র। সর্বস্তরের মানুষের সেবা ও সুশিক্ষার জন্য জ্ঞান অর্জনের সকল শাখা যেখানে সুষ্টুভাবে প্রয়োজনীয় পুস্তক/পুস্তিকা ও অন্যান্য নন-বুক সামগ্রী সংগ্রহ, সংরক্ষন এবং বিতরনের কাজ করে থাকে, তার সমষ্টিকে গ্রন্থাগার বলা হয়। আমরা সকলে জানি, পৃথিবীতে গ্রন্থাগার ৪ (চার) প্রকার। যথা- (i) Academic Library (ii) Public Library (iii) National Library (iv) Special Library. একাডেমিক লাইব্রেরি বলতে মূলত আমরা স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারকে বুঝে থাকি। ও একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঠিক শিক্ষা, গবেষণা কার্যক্রমকে সফল করে তুলতে হলে এ ধরনের গ্রন্থাগারের উপস্থিতি প্রয়োজন। Harrod’s Librarians Glossary অনুসারে, “Academic Libraries are those of Universities, Polytechnics, Colleges, School and all other institution forming past of or associated with educational institution.”
সুতরাং, বলা হয়, সকল শিক্ষার্থী ও গবেষকদের বিভিন্ন মুখী তথ্য চাহিদা পূরণের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে ইহা সমগ্র দেশের শিক্ষার পাশাপাশি সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক তথা উন্নয়নে সহায়তা করে। এজন্য বলা হয়- “Library is the heart of academic institute.”
যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগার যত সমৃদ্ধ সে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান ও তত ভালো। সর্ব ক্ষেত্রেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারগুলোকে শিক্ষা কর্মসূচীর সঙ্গে শিক্ষাদান ও শিখন পদ্ধতির (Teaching and learning mathods) যোগসূত্র স্থাপন করে শিক্ষার গুনগত মান সুনিশ্চিত করা হয়। উচ্চ শিক্ষার প্রাথমিক স্থর হলো কলেজ। উচ্চ শিক্ষার উন্নয়নে বিভিন্ন সেক্টর ও সাব সেক্টরের জন্য বিশেষজ্ঞ, যোগ্য নেতৃত্ব ও গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি করা। আর এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও তথ্য সেবার মাধ্যমে গ্রন্থাগার অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। উচ্চ শিক্ষার গুনগত মান অর্জন, আধুনিক ও সমৃদ্ধশালী গ্রন্থাগার ছাড়া সম্ভব নয়। একারণে বলা হয়, যদি সত্যিকার অর্থে আধনিক গ্রন্থাগার সেবা নিশ্চিত করা না যায়, নতুন কোন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা সমীচীন নয়। একটি নতুন বিভাগ স্থাপন না করলে শিক্ষা কার্যক্রমের কোনই ক্ষতি হবেনা; কিন্তু ক্ষতি হবে যদি গ্রন্থাগার সেবা কিংবা গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনাকে অবহেলা করা বা কম গুরুত্ব দেওয়া হয়।
একজন ছাত্র তার শিক্ষা, তথ্য বিনোদন ও অনুপ্রেরণার জন্য গ্রন্থাগার ব্যবহার করে থাকে। তাছাড়া শিক্ষক কর্তৃক দেয় Assignment প্রস্তুত করার জন্য গ্রন্থাগার ব্যবহার করতে হয়। বিভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণসহ Extra-curriculum কার্যক্রম করার জন্য গ্রন্থাগার ব্যবহার করা জরুরী। একজন ছাত্রের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য ক্লাশ-রুম যেমন জরুরী তেমনি উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার (Informal education) জন্য গ্রন্থাগার ব্যবহার করা অত্যাবশ্যক।
কলেজের পাঠ্য বইয়ে যেটুকু শিক্ষণীয় বিষয় থাকে তা অত্যন্ত সীমিত আর এই সীমিত বিষয়গুলিই মুখস্থ করা ছাড়া প্রকৃত অর্থে যদি হৃদয়ঙ্গম করতে হয় তাহলে আনুসঙ্গিক আরো কিছু বিষয়াদি জানার প্রয়োজন পড়ে। সে জন্য পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বই ও পড়তে হয়। তাছাড়া শিক্ষার্থীরা জ্ঞানের দিগন্তকে প্রসারিত করা এবং তার মধ্যকার সৃজনশীলতার দীপকে প্রজ্বলিত করার জন্য এবং মানবিক গুনাবলী গঠন ও বিকাশের জন্য বেশি বেশি করে বিভিন্ন ধরনের বই পড়ার কোন বিকল্প নেই।
প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে মানবিকতা শেখায়, মনস্কতা বৃদ্ধি করে, প্রকৃত শিক্ষার জন্য গুনগত শিক্ষা আবশ্যক। আর গুনগত শিক্ষার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হলো গ্রন্থাগার ও গ্রন্থাগার পেশা। শিক্ষার উপজীব্য বিষয়বস্তু নিহীত থাকে গ্রন্থাবলীতে আর এই গ্রন্থাবলীর ধারক ও বাহক হলো গ্রন্থাগার। জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ গঠন সময়ের চাহিদা। যুগোপযোগী গ্রন্থাগার জ্ঞানের আলো ছড়ায়। অতীত, বর্তমান ভবিষ্যতের মধ্যে সেতু বন্ধনকারী বাহন।
লেখক : প্রভাষক-গ্রন্থাগার, রংপুর মডেল কলেজ, রংপুর ও সভাপতি, রংপুর বিভাগ, বাংলাদেশ গ্রন্থাগার সমিতি (ল্যাব)
Leave a Reply