দাদু নাতির হাতি-খেলা
প্রদীপ দে
হাতি মানে একেবারে পেল্লাই হাতি। বাড়ির পোষা। আর বাড়ি মানে একেবারে জমিদারি। কেঁদুই গ্রামের জমিদার। জমিদারি ছিল বহু আগের – এখনও তার রেশ পড়ন্ত বেলার সূর্য রশ্মির মতই বিকশিত – হ্যাঁ তবে স্থিমিত বহুলাংশেই। তা হোক নামেকামে জমিদার তো বটেই। এদের একটা জ্যান্ত বিশাল হাতি থাকতেই পারে।
বর্তমান জমিদার মানে বাড়ির অগ্রজ শনিকান্ত রায়চৌধুরী উত্তরাধিকার সূত্রে এই জমিদারি এই হাতি আর বর্তমান প্রজন্ম একমাত্র নাতি কুশলের মালিক এবং রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব প্রাপ্ত বয়োজ্যেষ্ঠ পুরুষ। বয়সের হিসাব কে রাখে -তেমন কেউই জীবিত নেই — সব মরে পুড়ে ছবি হয়ে গেছে। আবার সেসব ছবিও সব অক্ষত অবস্থায় নেই – জীর্ণ ঘুণ ধরা। বুড়ো নিজেই বলেন তার বয়স আটাত্তরের কম কখনোই নয়।
পরিবার কাল ভেদে অকালে। দশবছরের নাতি এক পায়ের বেড়ি। দাদুর কাছে নাতি নাকি নাতির কাছে দাদু — কে কার পায়ের বেড়ি এই নিয়ে দুজনার কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। নাতি হৃষ্টপুষ্ট ল্যাজবিশিষ্ট গোবর গনেশ চেহারায় এবং বুদ্ধিতে। পড়াশোনার বালাই নেই। কে করাবে? নাতিকে রীতিমতো ডরায় দাদু। দশ বছরের কাছে আটাত্তরের নাস্তানাবুদ হাল! ছেড়ে দেমা কেঁদে বাঁচি। দশ বছরেই গোঁয়ার গোবিন্দ। হাতির মেজাজ অথবা শরীর আবার সাথ না দিলেই দাদুকেই হাতি বানিয়ে তার সওয়ার হওয়া তার জলভাত! দাদু অপারগ!
হাতির বয়স জানা নেই। বয়স হয়েছে নিশ্চয়ই। ভারী হয়েছে বয়সের ভারে এটা দেখলেই বোঝা যায়। হাতির পিঠে চড়ে সকালে নদীর ধারে ঘোরা নাতি কুশলের একটা অভ্যাস।
আজও সেইমতো কুশল হাতির পিঠে সওয়ারী হয়ে যখন নদীর পাড় ধরে ভ্রমণ করছিল ঠিক তখনই একদল কুকুর হাতিকে ঘেউ ঘেউ করে তাড়া করে।
হাতি দু তিনবার শুড় নাড়িয়ে গো গো করে আওয়াজ ছাড়ে – কিন্তু কুকুরগুলো বোধহয় বুঝে ফেলেছিল হাতি অকর্মর্ণ হয়ে গেছে – তার উপর তারা দলে ভারী থাকায় হাতিকে পাত্তাই দিল না। হাতি নড়েচড়ে উঠতেই পিঠ থেকে একেবারে ধপাস করে কাদা মাখা জলে গিয়ে পড়ে নাতি কুশল।
ব্যাস বাড়ি ফিরে কুশল যতো তার রাগ সব ঝেরে ফেলে দাদুর গায়। দাদু মায়ায় আর রাগে তার ঝাল ঝাড়ে হাতির গায়ে। বড় লাঠির বারি পড়ে হাতির গায়। হাতির ভিতরে ভিতরে জ্বর ছিল। দুদিন পরে মারা যায়। দাদু কেঁদে ফেরে। নাতির মনে তেমনি আঘাত লাগে না শুধু ভাবে এখন সে কার সওয়ার হবে?
দাদুকে অর্ডার করে- যাও আর একটা হাতি কিনে আনো।
শনিকান্তর শনির দশা। জন্ম থেকেই শনির কবলে সব হারিয়েছে। কে যে সব বুঝে তার নাম শনি রেখেছিল তা তার জানা নেই। এখন হাতিও তাকে ছেড়ে চলে গেল। দশ বছরের নাতিও তাকে বোঝে না!
নাতির আবদার বেড়েই চলেছে
-হাতি কিনতেই হবে।
দাদু বোঝায়- এখন এই বয়সে কি হাতি পোষা যায়? আগের হাতি বহু দিন আগের আবার পোষ মানা ছিল তাই!
নাতি নাছাড়- না কিনে আনতেই হবে।
শনি টাকা জোগাড় করে ব্যাগ বগলে হাতির খোঁজে যায়। অনেক খুঁজে এক জোগানদারের খবর মেলে। হাতির খবর পায়। বেশ কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করলে হাতি একেবারে বাড়ি চলে আসবে।
দাদু বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু গোঁয়ার নাতি ওসব কিছ বোঝে না। বাধ্য হয়ে দাদু মাঠের সব জমিজমা বেচে দেয়, শুধু পড়ে থাকে দশ কাঠা জমির স্থাবর জীর্ণ জমিদার বাড়ি।
টাকা লেনদেন হয়ে যাওয়ায় এক সপ্তাহ পর হাতি নিয়ে হাজির রুহুল্লাহ। বিরাট হাতি একেবারে কালো মিশমিশে। থব থব আওয়াজ করে মাটি থাবড়াতে লাগলো। খুব কম বয়সী নয় উপরন্তু চোখের দিকে তাকালে তেজী বলবান বলে ভয়ই লাগবে। প্রথমেই শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার পরামর্শ দিল রুহুল্লাহ। আস্তে আস্তে পোষ মানাতে হবে আর কিভাবে হবে তা বলে চলে গেল। শনিকান্তর ইচ্ছা ছিল রুহুল্লাহ আসুক রোজ যতদিন না ও পোষ মানছে।
কিন্তু নাতির ইচ্ছে আলাদা।সে নিজেই সব জানে — আমিই পারবো।
আটাত্তরের শনি দশ বছরের কুশল কে ভয় পায়। প্রতিবেশীরা অবাক হয়ে দেখে -এতো একেবারে আজব দুনিয়া! দশ বছরের দাপট এতো?
হাতি খায় না। মন মরা হয়ে থাকে। পরদিন নাতি কুশল দাদুকে সরিয়ে হাতিকে খাওয়ার ব্যবস্থা করে। হাতি গোঁ গোঁ আওয়াজ তুলে বিশাল চেহারা হেলেদুলে ওঠে। নাতি নিজেকে খাপ খাওয়াতে যায় হিতে বিপরীত হয় – হাতি মুছড়ে ওঠে বড় শরীর ঘুরিয়ে নেয় আর তার ধাক্কায় কুশল গিয়ে ছিটকে পড়ে খড়ের গাদায়। দূরে দাঁড়িয়ে ছিল দাদু, দৌড়ে আসে কিন্তু হাতিটিও ক্ষিপ্র গতিতে লাল চোখে এগোয় তার দিকে – মাত্র কিছুক্ষণের ব্যবধানে, শনিকান্ত রায়চৌধুরী কিছু বোঝার আগেই হাতি তার প্রকান্ড শুঁড়ে পেঁচিয়ে তুলে নেয় তাকে, শূন্যে তোলে আর আছড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। নিমেষেই দাদু শনিকান্তর ভবলীলা সাঙ্গ হয়। নিথর শরীর পড়ে থাকে তার সাধের বাগানে।
হাতি ক্ষেপে গেছে। প্রচন্ড রাগ নিয়ে লাল চোখে তুলকালাম বাঁধিয়ে দেয় জমিদার বাড়ি। লন্ডভন্ড করে দিতে থাকে সব কিছু। সবকিছু ভেঙে তচনচ করে দিতে থাকে। দশবছরে বিচ্ছু তাজা কুশল ভয় পেয়ে যায় সব দেখে। হাতি তার দিকে বড় বড় পায়ে এগিয়ে চলে। কুশলের মৃত্যু অনিবার্য !
অবাক করা কান্ড করে বসে রেগে যাওয়া হাতিটি – শুঁড় দিয়ে তুলে নেয় তাকে তার পিঠে। আধমরা ভয়ার্ত কুশল বাঁচার তাগিদে শুয়ে পড়ে ওর পিঠে। হাতি ছুটে চলে ক্ষেত – মাঠ পেরিয়ে একেবারে নদীর ধারে।
নদীর পাড় দিয়ে হেলেদুলে পা ফেলে হাতি আর শুঁড় দিয়ে নদীর জল তুলে ছিটিয়ে দিতে থাকে কুশলের গায়। কুশল প্রান ফিরে পায় -সতেজ হয়ে ওঠে শীতল জল সিঞ্চনে। নাতির প্রানে মলয় বাতাস বইতে থাকে। কুশল যেন কেমন হয়ে যায়। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা বালক হাত দিয়ে হাতির মাথায় আদর করে।
দূরে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামবাসী সেই বিরল দৃশ্য দেখে যারপরনাই ভয়ের শেষে আনন্দে অশ্রু বিসর্জন করতে থাকে।
Leave a Reply