শুক্রবার, ০৯ Jun ২০২৩, ০৪:৩১ অপরাহ্ন

দমদমা ব্রীজ বধ্যভূমি : আজও কান পাতলে যেন শোনা যায় অজস্র আত্মার করুণ আহাজারি-শাহ্‌ রিয়াদ আনোয়ার শুভ

দমদমা ব্রীজ বধ্যভূমি : আজও কান পাতলে যেন শোনা যায় অজস্র আত্মার করুণ আহাজারি-শাহ্‌ রিয়াদ আনোয়ার শুভ

দমদমা ব্রীজ বধ্যভূমি : আজও কান পাতলে যেন শোনা যায় অজস্র আত্মার করুণ আহাজারি
শাহ্‌ রিয়াদ আনোয়ার শুভ

আজ ৩০ এপ্রিল, রংপুরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক বেদনা বিধুর দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক বাহিনী কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাস থেকে চার সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষক ও এক শিক্ষকের সহধর্মিনীকে দমদমা ব্রীজ সংলগ্ন বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডে পাক বাহিনীকে শিক্ষকদের বাড়ি চিনিয়ে দেয় কুখ্যাত আল-বদর বাহিনীর রংপুর শাখার কমান্ডার ও ইসলামী ছাত্র সংঘের (বর্তমানে ছাত্রশিবির) রংপুর জেলা কমিটির তৎকালীন সভাপতি জামাত নেতা ও যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসীর দণ্ডপ্রাপ্ত নরঘাতক এটিএম আজহারুল ইসলাম।

দমদমা ব্রীজ বধ্যভূমি : ৩০ এপ্রিল ১৯৭১। মধ্যরাতে কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাসে অতর্কিতে ঢুকে পড়লো পাক হানাদার বাহিনীর কনভয়। গভীর রাতে গাড়ির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া ক্যাম্পাসের শিক্ষক কোয়ার্টার্স গুলোর বাসিন্দারা ভীত সন্ত্রস্ত। কোথাও কোন শব্দ নেই। গভীর রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে শঙ্কিত ক্যাম্পাস বাসী শুনতে পারলো হানাদার বাহিনীর বুটের শব্দ। গাড়ি থেকে নেমে মুখ বাঁধা কয়েকজন অবাঙ্গালী চিনিয়ে দিলো হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষকদের কে কোন বাসায় থাকেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই এক এক করে ধরে নিয়ে আসা হলো অধ্যাপক সুনীল বরণ চক্রবর্তী, অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী, অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন রায় এবং অধ্যাপক কালাচাঁদ রায়কে। শুরু হলো রাইফেলের বাট দিয়ে বেধড়ক পিটুনি। অধ্যাপক কালাচাঁদ রায়ের সহধর্মিণী মঞ্জুশ্রী রায় সহ্য করতে পারলেন না তাঁর পতিসহ অন্যান্য শিক্ষকদের উপরে এমন অমানুষিক নির্যাতন। এক ছুটে তিনি বেরিয়ে আসলেন এবং সাথে সাথে ঘাতকের দল তাঁকেও রেহাই দিলো না। রাইফেলের বাট দিয়ে মারধোর, বুট পড়া পায়ের লাথি মারতে মারতে সবাইকে টেনে হিঁচড়ে তোলা হলো গাড়িতে।
রাতের নিস্তব্ধতায় আবারও গাড়ির ইঞ্জিন চালুর শব্দ ভেসে আসতে লাগলো। এবং এক সময় সেই শব্দ আর শোনা গেলো না। পাক হানাদার বাহিনীর কনভয় ক্যাম্পাস ত্যাগ করেছে। এদিকে শিক্ষকদের বাড়িগুলো থেকে ভেসে আসতে থাকলো মরা কান্না। আস্তে আস্তে এক জন এক জন করে বের হয়ে আসলো ঐ সব বাসার বাসিন্দারা। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আবারও কান্না। যেন একজন আর একজন সাহস দিয়ে যাচ্ছেন।
কারমাইকেল কলেজের ক্যাম্পাস থেকে মিলিটারিদের গাড়ির কনভয় বের হয়ে এগিয়ে চললো রংপুর-বগুড়া মহাসড়ক ধরে। প্রায় দেড় মাইল যাওয়ার পরে দমদমা ব্রীজ এর কাছে গিয়ে হানাদারদের কনভয় থামলো। রাস্তা সংলগ্ন একটি বাঁশের ঝাঁরে নিয়ে যাওয়া হলো হাত পিছ মোরা করে বাঁধা শিক্ষকদের। দাড় করিয়ে দেওয়া হলো সারিবদ্ধভাবে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই গর্জে উঠলো হানাদারদের রাইফেল। মুহূর্তের মধ্যে লুটিয়ে পড়লেন কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক সুনীল বরণ চক্রবর্তী, অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী, অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন রায়, অধ্যাপক কালাচাঁদ রায় এবং তাঁর সহধর্মিণী মঞ্জুশ্রী রায়। মৃতদেহগুলি সেখানেই রেখে চলে গেলো পাক বাহিনীর গাড়ি বহর।
এলাকার লোকজন যারা গুলির শব্দ শোনার পর সারা রাত অজানা আশংকায় ভীত সন্ত্রস্ত বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন, পরদিন সকালে তাঁরা বাইরে বেরিয়ে আসলেন। বাঁশের ঝাড়ের কাছে গিয়েই থমকে দাঁড়ালেন তাঁরা। একজনের উপরে আর একজন এমনভাবে পড়ে রয়েছে কয়েকটি লাশ। কারোরই আর বুঝতে বাকি থাকলো না, দেশের শিক্ষিত কোন বাঙ্গালীকেই রেহাই দেবে না হানাদারের দল। সবাই বুঝতে পারলেন মানুষ হত্যার নেশায় উন্মত্ত পাকিস্তানীরা আর মানুষ নেই। খুনের নেশায় তারা হয়ে গেছে হিংস্র হায়েনা। নিজ বাসাতেই যেন অবরুদ্ধ হয়ে পড়লো ঐ অঞ্চলের দেহাতী মানুষগুলো। প্রকৃতির নিয়ম মেনে দিন আসে, দিন যায়। প্রতিটি রাত শঙ্কিত মানুষজনের কাটতে থাকলো আধো ঘুম আধো জাগরণে। এই বুঝি আবারও এলো হিংস্র হায়েনার দল। কেবলই আশংকা এই রাতই কি জীবনের শেষ রাত? আর কি দেখা হবে না আগামীকালের সূর্যোদয়?
সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ৭ জুন তারিখে ঐ এলাকার মানুষ আবারও রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে হটাত করে শুনতে পারলেন গুলির শব্দ। একটি দুইটি নয়, থেমে থেমে সারা রাত ধরেই শোনা গেলো গুলির শব্দ এবং মৃত্যুর মুখে দাঁড়ানো একদল মানুষের আহাজারি। কয়েকজন দুঃসাহসী মানুষ চুপি চুপি ঝোপ জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থেকে দেখলেন পাক হানাদারদের কনভয়ের সাথে তিনটি ট্রাক এসে থামলো দমদমা ব্রীজের পশ্চিম পাশে। ট্রাকগুলো থেকে নামিয়ে আনা হলো দুই শতাধিক সাধারণ মানুষকে। লাইন করিয়ে দাঁড় করিয়ে খুনের নেশার অমানুষ বনে যাওয়া পাক হানাদার বাহিনীর হাতের অস্ত্রগুলো গর্জে উঠলো। অজস্র মানুষের আহাজারি এবং গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢলে পরা। এমন করে প্রায় দেড় ঘণ্টা ব্যাপী চললো নির্মম ও বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ। অবশেষে চলতে শুরু করলো মিলিটারিদের গাড়িগুলো। একদল নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে হত্যা করে যেন বিজয়ী বীরের বেশে ফিরে গেলো হানাদারেরা। চোখে মুখে তাদের পৈশাচিক উল্লাস।
স্থানীয় লোকজনের কাছে পরে জানা যায়, যাদের হত্যা করা হয়েছে তাঁরা কেউই ঐ অঞ্চলের বাসিন্দা না। ধারণা করা হয় বাহিরের থেকে তিনটি ট্রাক ভর্তি বাঙ্গালীকে এই নির্জন এলাকায় এনে হত্যা করা হয়। এই শহীদদের সম্পর্কে পরে বিস্তারিত কোন তথ্যই সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার বেশ কিছুদিন পরে ঐ বাঁশ ঝাড় সংলগ্ন একটি পার্কের মতো করা হয়েছিল। নব্বই এর দশকের মাঝের দিকে এসে ঐ পার্ক ভেঙ্গে ফেলা হয়।
রংপুরের অসংখ্য বধ্যভূমির মধ্যে রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের দমদমা ব্রীজ সংলগ্ন এই বধ্যভূমিতে কয়েক বছর আগে একটি স্মৃতি ফলক নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু অবহেলায় অযত্নে এখনও সার্বজনীন হয়ে উঠতে পারেনি এই বধ্যভূমি। মূলত কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক শিক্ষার্থীরাই ১৪ ডিসেম্বর বা অন্য কোন জাতীয় দিবসে নাম না জানা শত শহীদদের শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে আসেন এখানে। এখন অবশ্য বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকেও দমদমা বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। স্থানীয়রা শ্রদ্ধা জানাতে ভুল করেননা যদিও। এছাড়া সম্প্রতি কারমাইকেল কলেজে শহীদ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের স্মরণে তাঁদের নাম উল্লেখ করে একটি স্মৃতি ফলক নির্মাণ করা হয়েছে।
আজকের দিনে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আমাদের প্রিয় শিক্ষকসহ মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ ও সম্রমহানির শিকার নারীদের। পাশাপাশি মানবরূপী দানব কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী এটিএম আজহারুলের ফাঁসীর দাবী জানাচ্ছি।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge