স্মৃতি ও অন্যান্য
উমর ফারুক
ফুটফুটে তন্বী একটি মেয়ে। ষোড়শী। ভালোবাসতো চঞ্চল একটি ছেলেকে। প্রেমের বয়স বাড়তে বাড়তে ওরা বিয়ের বয়সে গিয়ে গড়ায়। আমাদের সমাজে অধিকাংশ বাবা-মায়ের ধারণা তার মেয়ের ছেলেবন্ধুটি সবচেয়ে বখাটে, উড়নচণ্ডি। চালচুলো নেই। জাত-পাতও খুব একটা যুতসই নয়। এই মেয়েটার কপালেও তাই জুটলো। তার জন্য বড় ঘর দেখা হলো। দো-তলা বাড়ি, প্রকাণ্ড প্রাচীর। ছেলেটা বড় ব্যবসায়ী। লবণের ব্যবসায়ী। এইসব আর কী! মানে দু-চার গাঁয়ে নাম-ডাক আছে বলা যায়!
খুব ধুমধাম করে বিয়ে হলো মেয়েটার। শ্বশুর বাড়িতে কোনো কিছুর অভাব নেই তার। সব আছে। দাস-দাসী, গা ভর্তি গহনা, টাকা-কড়ি, সব। কিন্তু কোনোকিছুতেই মেয়েটার মন বসে না। স্বামী সেই সকালে গঞ্জে যায়, ফেরে গভীর রাতে। টাকা-পয়সার হিসেবই তার সব। বাড়িতে ফিরে গো-গ্রাসে ঘুমোয়। মনের কথা বলার লোকের বড্ড অভাব পড়লো মেয়েটার। কালক্রমে ওই বখাটে, উড়নচণ্ডি ছেলেটা তার মনে আরও গেঁথে গেলো। সংসারে কাজের কোনো চাপ না থাকায় মেয়েটা একসময় কবিতা লিখতে শুরু করলো।
কোনো এক বন্ধের দিন, তার স্বামী ডায়েরি খুলে দেখলেন অসাধারণ সব কবিতা। খুব খুশি হলেন তিনি। স্ত্রীর প্রতি অনন্য এক ভালোবাসা জন্মালো। সেই কবিতা দিয়ে তিনি নিজের নামে একখানা বই ছাপালেন। বইটা খুব জনপ্রিয় হলো। দেশজুড়ে পরিচিতি বাড়লো। ধারাটা চলতে থাকলো, আর স্ত্রীর প্রতি লবণ ব্যবসায়ী স্বামীর ভালোবাসাও বাড়তে থাকলো। একদিন তিনি স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে গেলেন তার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে। বিশাল কারখানা ঘুরে ঘুরে দেখাতে লাগলেন। হঠাৎ একটা লবণের বস্তা বউয়ের গায়ের উপর এসে পড়লো। মারা গেলো বউটা। কবিতাও বন্ধ হলো।
দিন যায়, কিন্তু লবণের ব্যবসায়ীর নতুন কোনো বই আর প্রকাশিত হয় না। একদিন সাংবাদিকরা এলেন তার বাড়িতে। নানান প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন। কেন আপনার নতুন কোনো বই বাজারে আসছে না? আরও কত কী! লবণের ব্যবসায়ী চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘আমার কবিতা লবণের বস্তার নিচে চাপা পড়ে মারা গেছে।’
প্রতিটি লেখার একটি নেপথ্য থাকে, প্রেরণা থাকে, গল্প থাকে। গবেষণা বলছে, মোটাদাগে ২৯টি উপজীব্য বিষয়কে কেন্দ্র করে নির্মিত হয় লেখা। কারও কারও কাছে প্রেম ও বিরহ এই যাত্রায় সবচেয়ে বেশি অগ্রগামী।
সেদিন আমার এক ছাত্র জানতে চাইছিলো, স্যার আপনি কী লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছেন? লবণের ব্যবসায়ীর মতো আমিও ক্ষণকাল চুপ করে রইলাম। তারপর প্রচলিত গল্পের সুরে বললাম, ‘আমার কবিতাও লবণের বস্তার নিচে চাপা পড়ে মারা গেছে।’
লেখাটা বউকে শুনিয়ে আরেক বিপদে পড়লাম। বউ জানতে চাইছে, কে লবণের বস্তার নিচে চাপা পড়ে মারা গেছে? কই একথা তো আমাকে কখনো বলো নি!
Leave a Reply