ভাঙি যাকে তারও জানি কতটুকু …
দীলতাজ রহমান
শৈশব-কৈশর-যৌবনজুড়ে কখনো যার তেমন কোথাও বেড়ানো হয়নি। পৌঢ়বেলায় এসে দূরের কোনো স্থানের হাতছানি তাকে অতটা চনমনে বোধহয় আর করতে পারে না। কেননা যে নেশার সাথে যার পরিচয় নেই তা হঠাৎ তাকে তাড়িত করবে কেন? শৈশবে না বাপ কোথাও নিয়েছেন, কৈশরে না স্বামী কোথাও। বিয়ে যেহেতু কৈশরেই হয়েছিল, তাই কৈশরে বেড়াতে নেয়ার দায়টা স্বামীরই ছিল। অবশ্য আগে পেট্রোলের গন্ধে পেটের নাড়িভুড়ি ঘুলিয়ে বমি আসতো বলে এ বিষয়ে অনেকটা দোষ নিয়তি বা অভ্যাসের ওপরই রেখে দিই। যাক গে, এই বেড়াতে নেয়ার না নেয়ার সেইসব কথা কোনো না কোনোভাবে কোনোখানে লেখা হয়ে গেছে বলে মনে পড়ছে। তাই সেদিকে আর বেশি যাচ্ছি না।
এখন যে বিষয়ে লিখতে চাই, গুছিয়ে-গাছিয়ে আপাতত সেই দিকে এগোই! আর সে বিষয়টা হচ্ছে, এই বেশ ক’দিন আগে থেকে আমার বড়মেয়ে ফারহানা আর জামাই মাহফুজ আটঘাট বাঁধতেছিল তারা কোথায় কোথায় বেড়াতে যাবে। তাদের সে যাওয়া নিয়ে বয়াণের দিকে যাওয়ার আগে ইকটু জানিয়ে রাখি, ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর রওনা দিয়ে ১৭ সেপেটেম্বর অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে এসে পৌঁছেছিলাম ছেলের বাসায়। এই মেয়ে-জামাই, মানে এখন যাদের কাছে আমি ঘরশাশুড়ি পূর্ণ মর্যাদায় বহাল আছি, সেই তখন, মানে তারা হয়ত ২০১৪ সালের দিকে জাপান থেকে এসেছিল অস্ট্রেলিয়ায় সেটেল হতে। ফারহানা অবশ্য আগেই অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি করার সুবাদে পিএইচডির ওই সময়টা সে মেলবোর্নেই ছিল। কিন্তু সে সরাসরি পিএইচডি করায় বাকি সময়টা তার হাজবেণ্ড মাহফুজ চৌধুরীর কাছে চলে গিয়েছিল। মাহফুজের পিএইচডি শেষ হলে ততদিনে তারা তাদের ঘরে জন্ম নেয়ে একমাত্র কন্যা জাহরা জুহিতাকে নিয়ে ওই সময় উঠেছিল ফারহানার বড় ভাই আশিকের বাসায়। মানে আমার বড় ছেলের বাসায়। মেলবোর্ন। কিন্তু ফারহানা নিজের গরজেই তখন আমাকে দেশ থেকে আনায়। সেই থেকে এই ২০২১ পর্যন্ত আমি টানা বাংলাদেশ টু অস্ট্রেলিয়া করে যাচ্ছি। আমার এই যাতায়াতের সংখ্যা গুণে গুণে অনেকেই আমার কাছে ভ্রমণকাহিনী চান।
যারা বড় বড় ভ্রমণ কাহিনী লেখেন, তারা একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ায় পথে পথে কী এমন রসদ পান লেখার, আমি তা বুঝে উঠতে পারিনি বলে কখনো সাহস তা লেখার সাহস করিনি।
যা হোক, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের রিচমন্ড ভাইয়ের বাড়ি থেকে ফারহানা, মাহফুজ কিছুদিন পরই ওই মেলবোর্নের হ্যাম্পটন পার্কে নিজেরা বাড়ি কিনে সেখানে বসবাস করা শুরু করেছিল। বছর তিনেক সম্ভবত তারা ওই বাড়িতে ছিলও। ওখানেই তাদের ছেলে জেফানের জন্ম। কিন্তু জেফানের এক বছর না হতেই মাহফুজ যেখানে গবেষণাকর্মে নিয়োজিত ছিল, সেই সিএসআইআরও থেকে তাকে বদলি করা হয় কুইন্সল্যাণ্ড ইউনিভার্সিটিতে। সেই সূত্রে তাদের টানাটানিতে আবার আমার পঞ্চমবার আসা এই অস্ট্রেলিয়াতে। এর ভেতর তিনবার থেকে গেছি মেলবোর্ন। দুইবার কুইন্সল্যাণ্ড।
যা হোক, মেলবোর্ন-কুইন্সল্যণ্ড দু’জায়গা থাকতেই ছেলেমেয়ের সাথে কতখানে গিয়েছি, আর মনে মনে ভেবেছি, আহা ইংরেজিটা জানা থাকলে বিভিন্নস্থানে দর্শনীয় বস্তুর কাছে লেখা তথ্যগুলো টুকে নিয়ে নিয়ে এগুলো দিয়ে নিজের মতো কাহিনী বানাতে পারতাম। লেখার গতি তাতে ঘুরে যেত। লেখার গতি ঘোরা মানেই জীবনের গতি ঘোরা।
আরে, এভাবে তো কখনো ভেবে দেখিনি, একজন লেখকের জীবনের গতি ঘুরলেই তার লেখার গতি ঘুরে যায়! এক জায়গায় পড়ে পাক খাওয়া থেকে যেন ধারা নিজেই বেগবান হয়ে ছুটে আসে ফল্গু-কলমে!
যা লিখতে উপরোক্ত বাহুল্য কথাগুলোও ঝেড়ে নিলাম, তা আসলে এরকম, এই কতদিনের ভেতর ক’বারই মেয়ে-জামাইয়ের কোথাও যাওয়া নিয়ে বিভিন্নরকম পরিকল্পনা কানে এসে লাগে। কিন্তু আমি তা মাথায় ঢুকাই না। এমন কি মেয়েকে ডেকেও শুনি না, যে তোমরা কোথায় যাবে? মনেহয় যাবে সময় যাবে! আর যখন যাবে আমিও তো তাদের ছেলেমেয়ে, পোটলা-পুটুলির সাথে অগত্যা গাড়িতে উঠে পড়বো, ব্যস। কারণ না যেতে চাইলেও তো ওরা আমাকে রেখে যাবে না! না যেতে পারলে বরং অর্ধসমাপ্ত লেখাগুলো সমাপ্ত করার একটা ঢিলেঢালা চেষ্টা করা যেত।
ওই যে বলে না, এবাদতের স্বাদও ওই যৌবন পর্যন্ত। না হলে বুড়ো বয়সে গিঁটে গিঁটে ব্যথা, দাঁত শিরশিরানি, চোখে ছানি। তবু সর্বাবস্থায় বলতে হয়, আলহামদুলিল্লাহ্! আর এইসব মনে পড়ে গেল নিজের জিনিসপত্র গোছাতে গিয়ে। প্রথমেই সুটকেসে তুলতে হলো প্রেসার মাপা যন্ত্র। তারপর নেবুলাইজার। ওষুধপত্রসহ বাঁধানো একটা দাঁতও। দাঁতটা একটানা লাগিয়ে রাখতে পারি না। মাড়ি হাঁসফাঁস লাগে। আবার কদিন না লাগালে সেট করতে বেগ পেতে হয়। কারণ ওই একটা দাঁতের ফাঁকের জন্য সব দাঁত ফাঁক হয়ে আসে।
এ বয়সে দূরের নিসর্গ দেখতে অসুবিধা না হলেও কাছের জিনিস নিরিখ করতে গেলে মাথা ঘুরে ওঠে। তাই তো দূরের জিনিস যে বহাল তবিয়তে স-ব স্বচ্ছ দেখতে পারে, কাছের বইখানাতে সে চশমা ছাড়া অক্ষরগুলো সব লেপটানো কালি দেখে! ওই যে বলে না চল্লিশে দূরদর্শী হয় মানুষ। আর ওই দূরদর্শী হওয়ার খেসারত হিসাবে কাছের সব কিছু দেখার ও বোঝার নজরে ভাটা ফেলে দেন বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডের কলকাঠি নাড়নেওয়ালা! তখন খালি দূরকে নিয়ে থাকো। অদূর ভবিষ্যৎ আর সুদূর অতীত। বর্তমান কেবলি খটোমটো! এককথা দুইবার কাউকে বলতে হলে মেজাজ হয় খিটিমিটি!
না, আমার অবশ্য এখনো উপরোক্ত কোনো উপসর্গই অতটা পেয়ে বসেনি। কেবল খানিকটা দর্শন ফলাতেই ওইসব লেখা। বয়স্ক মানুষের কথার একটা আলাদা মূল্য আছে না! তাই।
তবে এই বেড়াবেড়িতে আমি তো আর লিডার নই! তার আমার নিজস্ব কোনো পরিকল্পনাও ছিল না। মূখ্য ভূমিকায় অভিনয় করা মানুষ সহসা যখন পার্শ্ব চরিত্রে অবতীর্ণ হন, তার বিড়ম্বনা কেবল সেই তিনিই বোঝেন। এককালের বাঘ অন্যকালে এসে বিলাই! অথবা নিষ্কর্মা দেবী! আর এই কালটুকু ফুরালে মনে হয় এই ছিলো প্রতাপের যৌবন কাল! যা এত ফসকা! এত ঠুনকো! এত ক্ষুদ্র! যেন দুপুরে পুকুরে গোসল করতে নেমে এক পা ওপরে তুলতে আরেক পা টেনে আনতে আনতে ভেতরের নিতাই বলে ওঠে, এই জীবন! হায় আল্লাহ্, হায়, জীবন এত ছোট কেনে?
ব্রিসবেন থেকে চারঘন্টার পথ জিরাকালা। বিজাতীয়, বিভাষীয় দেশে এসে এত স্থানে যাই, কোনো স্থানের নাম লিখে রাখি না বলে আমি তা নিয়ে আর কিছু লিখতে পারি না তা তো আগেই লিখেছি। কারণ যার কাছে শুনতে যাবো, সেই খেঁকিয়ে উঠে আমার নির্বুদ্ধিতাকে প্রকট করে আমাকেই দেখিয়ে দেবে ইংরেজিটা রপ্ত না করার জন্য। তাই এ বিষয় কিছু বুঝতে চাইলে সেই উৎকট পর্ব আগে অঙ্কিত করে তারপর দ্বিতীয় পর্বে যদি অনুবাদের বোঝাপড়া হয়!
প্রথম যেখানে গিয়ে দুই রাত থাকবো, তার নাম নাকি জিরাকালা। মেয়ে ফারহানার কাছ থেকে ঝালিয়ে জেনে নিলাম নামটা। ফারহানা যখন বললো, ‘জিরাকালা’, মনে রাখার জন্য কয়েকবার কালোজিরা শব্দটি উচ্চারণ করলাম। আর কালোজিরাকে আমরা ছোটবেলায় কালাজিরাই বলতাম। যেমন মশাকে আমাদের গোপালগঞ্জ এলাকার মানুষ মাশা বলতো। পুরনো মানুষেরা এখনো হয়তো তাই বলেন।
মেয়ে-জামাইয়ের কথার ভেতর বারবারই উচ্চারিত হত ‘ফার্ম হাউজ…।’ তাও জিজ্ঞেস করিনি, সে আবার কি! ভাবছিলাম, গেলেই তো দেখতে পাবো কিসের ফার্ম হাউজ। আর জিজ্ঞেস করবোই বা কার কাছে! তারা তো মৌমাছির মতো ব্যস্ত! তাৎক্ষণিক জরুরী বিষয়গুলোই তো ঠিক মতো বোঝার অবকাশ নেই তাদের কাছ থেকে! তাই ইনবক্সে সবক’টাকে সব কথা লিখে রাখা অভ্যাস হয়ে গেছে। উত্তর খুঁজতে গেলেও ঘাড় ঘুরিয়ে কান ধরার মতো সেই ইনবক্স খুঁজি! কিন্তু এখানে তো ও বাক্স কোনো কাজে আসে না!
নির্দিষ্ট দিনে গাড়ি গন্তব্যের দিকে যেতে পথে যেখানে যেখানে মিউজিয়াম আছে, সেটাই মেয়ে-জামাইয়ের আগে থেকে টার্গেট করা। তাই জিরাকালা যেতে পথে টাঙ্গলা মিউজিয়ামের সামনে গাড়ি ভিড়ানো হলো। নেমে দেখা গেল সেটা বন্ধ। তবে মিউজিয়ামের সামনে খোলা আকাশের নিচে বিশাল এক হরিণের মূর্তি ছিল। বন্ধ মিউজিয়ামের এপাশে- ওপাশ হেঁটে দেখে এবং বিশাল সেই হরিণের ভাস্কর্য’র সাথে-পাশে-কাছাকাছি, সেই সেখানেই আমাদের নানান রকম ছবি তুলতে ঘন্টা খানেকের বেশি সময় কেটে গেলো।
টাঙ্গলাতে আমাদের ক্ষিদেটা চাঙা হয়নি বলে, আমাদের সাথের খাবার ঢেলে সাজিয়ে খাওয়ার ব্যাবস্থা থাকা সত্ত্বেও আমরা ওখানে খাইনি। হিসেব করে দেখা গেলো সামনে কোন একটা ভাল জায়গা আছে, সেখানে গিয়ে খেলেই ঠিক সময় খাওয়া হবে।
কিন্তু সেখানে গিয়ে এ টেবিল ছেড়ে সে টেবিলে জুতমতো খাবার সাজানো হলে মাহফুজ এসে চেখে দেখলো হাঁসের মাংস ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কোলস’এর রুটি সেঁকে নেয়া হয়নি।
রুটি অবশ্য ফারহানা নিয়েছিল। সে বলেছে কোলসের রুটি সেঁকাই থাকে। আর না সেঁকলেও চলে। আমি নিলে সেঁকে পেঁচিয়ে, পলিব্যাগের ওপরে আবার ভারী টাওয়েলে জড়িয়ে নিতাম। যাতে একবেলা অন্তত গরম থাকে। ভাগ্যিস কটা পড়ে থাকা ভাত নিয়েছিলাম, ফারহানা তাই হঁসের মাংস দিয়ে খেলো। মাহফুজ খেলো শুধু কিছুটা পায়েস। আর আমি ওই না সেঁকা রুটি আর না গরম হাঁসের মাংস মজা করেই খেলাম। ঘরের খাবার পথে নিয়ে খেতে পারছি, তাই তো বেশি’ তাই মনে করে খেয়েছি। যেখানে বসে খেয়েছি, সেখানে ঢের ক’খানা ছবি তুলেছিলাম। কিন্তু আমার ছবি ভাল আসেনি বলে আমি সে সব ছবি ডিলিট করে দিয়েছি। একখানা তেলঝোল মাখা ছবি থাকলেও জায়গাটার নাম অন্তত উদ্ধার করতে পারতাম। খাবার-দাবার সাজিয়ে খেতে খেতে কোথায় এতটা সময় কাটিয়েছিলাম। আর সেই ছবিগুলো ডিলিট করার খেসারত হিসাবেই ওপরের বয়াণটুকু টানলাম, যে আসল হচ্ছে, ওইটা, কি? কোথায় তুমি গিয়েছো। কোন মাটি তোমার পা ছুঁয়ে এসেছে! নাহলে খাওয়া-দাওয়ার খবর লেখা বাহুল্যমাত্র। আমি হয়ত অনন্যোপায় হয়ে নামটা লেখতে পারলাম না, তাই বলে নানান রকম ফুলগাছ দিয়ে ঘেরা বড় বড় গাছের ছায়ায় ভেতরটা বেঞ্চসহ বড় বড় টেবিল দিয়ে সাজানো জায়গাটা তো আর মিথ্যে হয়ে যায়নি! সে তো মনের ভেতর দিব্যিই আছে তার মতো! খালি নামটা না হয় না-ই থাকল লেখা!
পড়ন্ত বেলায় খাওয়ার পর, বাচ্চা দুটোর হ্যাপা সামলে আবার সবকিছু গুছিয়ে গাড়িতে তুলে ছুটতে ছুটতে সন্ধ্যা নাগাদ বড় রাস্তা থেকে মাহফুজ ধু ধু প্রান্তরে একখানা কাঠের ঘর দেখিয়ে বললো, ওইই যে একটা একা বাড়ি দেখা যাচ্ছে, আমরা এখন ওইখানে উঠবো। ওখানেই দুই রাত থাকবো ‘ মাহফুজের এই কথাতেই তার তিন ও নয় বছরের জেফান ও জাহরা জুহিতা ছেলে-মেয়ে দুটি একসাথে তীব্র চিৎকার দিয়ে উঠলো আনন্দে। কিন্তু আমার আনন্দ হলো না মোটেও! মনে হলো অতো নির্জনতা ধুয়ে কি পানি খাবো! একেবারে কাছে না হোক কিছুটা দূরে হলেও তো অন্তত একখানা ঘর থাকতে পারতো!
সেখানে সাধু-সন্যাসী না হোক, ছিঁচকে অথবা ছেঁচকি চোর-চুন্নী অথবা ভিক্ষুক অথবা কালাপানির বিকল্প শাস্তিখানাও করেও কাউকে আশেপাশে রাখলে তাতে একটু হলেও মনে একটা দোলাচল তৈরি হতে পারতো।
মেইন রাস্তা থেকে গাড়ি যখন কাঁটাতারের সীমানার ভেতর ঢুকছিলো, বিস্তৃত প্রান্তর জুড়ে বিভিন্ন বয়সী গরু বিচরণ করছিলো। তার ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে টের পেলাম বড় গরুগুলো এত বড়, যে এত বড় গরু আমার কস্মিনকালেও দেখা হয়নি। বিভিন্নখানে যেতে রাস্তা থেকে যখন এদের দেখি, তখন দূর থেকে এদের সাইজ বোঝা যায় না। সবগুলোকে অনেক ছোট মনে হয়। তাই কাছে গিয়ে দেখেছি বলেই বড়গুলোর বড়ত্বটা এইবার ঠাহর করতে পেরেছি। এদের একটু বড় বাছুরগুলোই আমাদের বাংলাদেশের দুধেল গাভীর সমান প্রায়। আর এই গরুর ঝাঁকে সবই গাভী। বাছুরও ভবিষ্যতের গাভী। আর নিষ্ফলা ষাঁড়গুলোই নিশ্চয় চলে যায় মাংসের দোকানে। তবে বড় গাভীগুলোরও শিং নেই বলে তাদেরকে তেমন ভয় পাচ্ছিলাম না। যেটুকু ভয় পাচ্ছিলাম, তা শিংয়ের গুঁতোর না হোক, খালি মাথা দিয়ে ছোটবেলায় আমরা ভাইবোনেরাই কত গুঁতোগুঁতি খেলেছি। তেমন গুঁতোও তো দিতে পারে। দিতে পারে ঠেলা ধাক্কা। পা দিয়ে ছাটি! আর এই ছাটি ও গুঁতোর ভয়ের বিষয়টা অবশ্য পরের দিনের কথা। প্রথমবার যাওয়ার সময় তো গাড়িতে ছিলাম। বিক্ষিপ্ত তাদের অবাক চোখের সামনে দিয়ে জিপ গাড়ি গরুর গাড়ির মেজাজে হেঁটে গেছে!
ধীরে চলা গাড়িখানা যখন ফার্ম হাউজের সামনে হাজির হলো, আমার মোবাইলে মাগরিবের আজান দিল ঠিক তখনি। ছাতির তোয়াক্কা না করার মতো গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। নাতি-নাতনি দুটো হইহই করে উঠল। মাহফুজ লাফ দিয়ে নেমে রহস্যঘন, বহু কাঙ্ক্ষিত ফার্ম হাউজের দরজা খুলতে গেল। আগেই তথ্য দেয়া ছিল, দরজার সাথেই চাবি ঝোলানো থাকে। এখানে স-বই অনলাইনে। কোনো বিষয়ে কারো সাথে দেখা হওয়া দূরে থাক, ফোনেও কথা বলার অবকাশ নেই।
চারদিনের জন্য বের হয়েছি, আমার মেয়ে গাড়ি থেকে পোটলা যা নামালো, দেখলাম, অনেকখানি জায়গা ছেয়ে আছে। জামাই-মেয়ে গুণে গুণে সেগুলো ঘরে নিতে লাগল। আর আমি নাতি জেফানের হাত ধরে হিঁচড়ে টেনে সাথে নিয়ে নাতনি জাহরাকে উপদেশ দিলাম, এসব ক্ষেত্রে বড়দের সাথে কাজে হাত লাগাতে হয়। তাতে কাজও শেখা হয়। কাজ করে আনন্দও হয়।’ বলে আমি ফাঁকতালে সটকে পড়লাম। ইদানীং আমি ঝামেলা দেখলে এই করি! তা ছাড়া মনে হয়, যাদের সংসার এইসব গোছাগুছি তারাই ভাল বোঝো!
আমার গুছিয়ে দেয়ার দায়িত্ব ছিলো চাল-ডাল, মসলা-সবজি, তেল, চিনি-দুধ-চা। আর সেসব আমি পুরো দস্তুরই বেঁধে রেখে ব্যাগও চিনিয়ে দিয়েছি। আর কি…! রেঁধে নিয়েছিলাম হাঁসের সাথে স্যামন মাছও। আর এখানে তো প্রসেস করা সব খাবারই পাওয়া যায়। সেরকম কিছু নিতেও ঘাটতি রাখেনি মেয়ে-জামাই!
খোলা ধু ধু প্রান্তরের ভেতর হাউজটির ভাড়া প্রতিরাতে আড়াই শো ডলার। ছোট বড় মিলে চারটে বেডরুম। চার রুমের একটা আবার রিডিংরুম। প্রচুর বইপত্র দেখলাম। ছিল দারুণ একখানা টেবিলও। আর তা দেখে আমার হা-পিত্যেশ বেড়ে গিয়েছিল। কারণ যাওয়ার সময় আমার ল্যাপটপটি সাথে নিতে চেয়েছিলাম। কারণ, একটা গল্প লিখতেছিলাম, তার কাহিনীটা এরকম- মা মারা যাওয়ার পর বাবা কম বয়সী এক মেয়েকে বিয়ে করে রেখে গেছেন। ছেলে আমেরিকা থেকে এসে শত্রু ভাবাপন্ন সে রুচিস্নিগ্ধ সৎমার অনুরক্ত হয়ে উঠবে। তারপর ধীরে ধীরে একে অন্যের কাছাকাছি হবে। চূড়ান্ত পরিণতিতে নিয়ে যাব দু’জনকে। কিন্তু বিষয়টা গড়াতে গড়াতে আট হাজার শব্দ লিখে ফেলেছি, কিন্তু চূড়ান্ত’র জন্য ওইরকম একটা পরিবেশ ঘনিয়ে তুলতে তো পারছিই না। বরং নিজের ভেতর নিজে সিঁটিয়ে যাচ্ছি এমন একটা নাহক ঘটনা ঘটাতে। তাই ঝোলা গুড়ের মতো গল্প শুধু শব্দেই গড়িয়ে যাচ্ছে। বাসায় ফিরতে ফিরতে সে অবস্থা আরো সুদূর পরাহত। তারপর বাংলাদেশে হেফাজত নেতা আল্লামা মামুনুল হকের জান্নাত আরা ঝর্না নামের নারী ঘটিত বিষয়টির জের আমাকে আমার সে গল্প থেকে আরো বহুদূরে ছিঁটকে ফেলেছে। ছিঁটকে ফেলেছে, ওই ঘটনা নয়, তার মিথ্যে বলার ধরণ। অন্যান্য আলেমদের তার পক্ষে সাফাই গাওয়া আমাকে আরো কপালে ঘোড়ার লাথির মতো আঘাত দিয়েছে।
আমার অনুজ প্রতিম ভগ্নিপতি, করোনায় শহীদ প্রথম সাংবাদিক হুমায়ুন কবির খোকন মারা যাওয়ার পর, সেই ২৮ এপ্রিল থেকে আমি একটানা নয় মাস রোজা থেকেছি। শেষের দিকে মেলবোর্নের দিনগুলো ভিষণ বড় ও গরম ছিল। তবু কেউ আমাকে রোজা থেকে নিবৃত করতে পারেনি। সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও পড়ে চলেছি। আগে মাঝে মাঝে দুই এক ওয়াক্ত বাদ দিলেও এই বছর খানেক সময় মোটেও বাদ দিইনি। কিন্তু হেফাজত নেতার অপকর্মের চেয়ে অন্যান্যরা যে মিথ্যে সাফাই গাইল, আমি সারাক্ষণ তা যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে টের পেলাম, যে আমি এই ক’দিনে একবেলাও নামাজ পড়িনি। নামাজ পড়িনি, তা আল্লাহ্ ও তাঁর রসুলকে অস্বীকার করে নয়। ওই মিথ্যুক আলেমরা নামাজ পড়ে বলে আমি পড়িনি। আমাদের ছোটবেলার একটা প্রবাদ মনে পড়ে গেল, জোলারা যখন হার পরতে শুরু করলো, ভদ্র ঘরের বউ-ঝিরা তখন হার খোলা শুরু করলো। বিষয়টা সেরকম আর কি।
ফার্ম হাউজের ড্রয়িং ডাইনিং একসাথে। টিভি ছিলো। মাহফুজ, ফারহানা খুব খুশি। বরাবরই সবাই সবকিছু বেছে নেয়ার পর পড়ে থাকা আধাখাস্তা জিনিসটিই নিতে আমার ভাললাগে। তবু বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে কোথাও গেলে না হয় হুড়োহুড়ি করে নিজের জন্য ভালো রুমটা দখল করে ফার্স্ট হয়ে আনন্দ অর্জন করা যায়। পরে ছেড়ে দিয়ে আরো আনন্দ পাওয়া যায়। আর এখানে নিজে পরিবারের প্রধান হয়ে একার জন্য মাস্টার বেডটি কী করে দখল করি!
তাই কোনার ছোট রুমটিতে নিজের লাগেজগুলো সেঁধোতে যাচ্ছি, এর ভেতর ফারহানা সেসব টেনে বড় রুমের দিকে নিয়ে বললো, আম্মা, তুমি এখানে থাকো! আমি আর মাহফুজ সেকেণ্ড রুমে আমাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেলেছি…।’ আমার কোনায় থাকার আনন্দটা পরিহার করে অগত্যা বড় রুমটিতে ঢুকতে হলো। তবে এই ভ্রমণে আসার পথে, ছুটন্ত গাড়িতে ফারহানা মাহফুজকে বলেছিল, মাহফুজ, সামনে বাগানের কমলা আছে…।’ মাহফুজ বললো, থাক। এখন আর গাড়ি থামাতে পারবো না! আমি বললাম, কোথায় কমলা, ফারহানা বললো, ওই যে পিছনে চলে গেল!
আমি মাহফুজকে বললাম, এটা কেমন কথা! নিজেদের গাড়িতে যখন যাচ্ছি, ভ্রমণকে আনন্দদায়ক করতে পথে পথে কনোকাটা করতে হয়। বিশেষ করে খাবার জিনিস। এতে সবারই আনন্দ তো হয়ই, অভিজ্ঞতাও হয়। গাড়ি ফেরাও।
ফেরাও বললেই তো আর ফেরানো যায় না। অনেক দূর সামনে গিয়ে তারপর গাড়ি ফেরাতে হলো। আর ফিরতে ফিরতে জামাই বেটার মাথার ওপর সুপারি রেখে খড়মের বাড়ির মতো বোঝাতে লাগলাম, যে চলতে পথে অনেক সময় ফল-সবজি কম দামে পাওয়া যায়। সেরকম যখনি পাবে, বেশি করে নিয়ে পাড়া-প্রতিবেশীর ভেতর বিতরণ করবে। এতে সবার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় হয়। আর মানুষের সাথে মানুষের দৃঢ় সম্পর্কের দরকার আছে। দেখবে নিজের মনই তাতে ভরা ভরা লাগে। এমনি তো আর বাজার থেকে কিনে কাউকে কিছু দেয়া হয় না। সেটা আবার আরোপিত মনে হয়। আর আরোপিত কোনোকিছুই ভাল নয়। মাহফুজ বললো, ‘তা ঠিক!’
আমাদের দেশে রিকশাভ্যানের মতো সাইজের একটা চারচালা চাকা লাগানো টংয়ের ওপর কমলা রাখা আছে। সাথে ডলার রাখার বাক্স। কিন্তু আমাদের গাড়ি ভিড়তে দেখে বছর খানেকের শিশুকন্যা কোলে এক তরুণী পাশে এসে দাঁড়ালো। একটু পর এলো সে তরুণী মাতার মাতাও।
নেটের মাঝারি ব্যাগে টায়টায় ভরা এক ব্যাগ কমলা সাত ডলার। আর পাশে কার্টুনে তার ডাবল, দাম ১৪ ডলার। মাহফুজ সাত ডলারের ব্যাগই নেবে। আমি বললাম, যাত্রাপথে চাষীর বাগানে ফলানো এমন টাটকা এই কমলা কেনার স্মৃতি তোমার বাচ্চাদের সারাজীবন মনে থাকবে। তাই ওই কার্টুনেরগুলোই কেনো। ওদের মন বড় হবে। আর এগুলো কিনবো তো আমি! মাহফুজ বললো, মা, এত কমলা কে খাবে? আমি বললাম, টাটকা কমলা। এগুলো সহজে নষ্ট হবে না। ক’দিন পথে পথে খেতে খেতে যা থাকবে সেগুলো বাসায় নিয়ে যাবো! তাও অনেকদিন থাকবে। দেখো!
কমলা গাড়িতে তোলার পর থেকে তিন বছরের জেফানের মুখ আর বন্ধ হয়নি। তিনটা চারটা পাঁচটা খেয়ে আপাতত ক্ষ্যামা দিলেও কিছুক্ষণের ভেতর আবার দাবি তোলে। অতএব ফার্ম হাউজে অবস্থান কালেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। এটা ছিলো আমার কাছে সবচেয়ে আনন্দের। কারণ আমার তো এইটুকু ছাড়া আর কিছু করার অবকাশ আপন নাতিপুতির জন্য নেই! দেশে গেলে আমি রাজা। বাহুল্য কেনাকাটার মহাবাতিকগ্রস্ত এক মহাপ্রাণ আমি। সেই প্রাণটা বিভূঁয়ে এলে শুখিয়ে মারি। নিজের কাছে নিজেই ছিঁচকে হয়ে যাই! এতে তৃতীয় প্রজন্ম আমাকে ভাবতেই পারে, হয়তো আমাদের বোঝার ওপর উনি আপাদমস্তক একখানা আস্ত শাকের আঁটি! ১৪ ডলারের কমলা কিনতে পারার সুযোগ পেয়ে অল্প পানির মাছ বেশিতে পড়ার মতো এত খলখল করে ফেললাম, যে গলদটা নিজেই বুঝতে পারছিলাম।
যাহোক, মাহফুজ ঠান্ডা খাবার খেতে পারে না বলে দুপুরে তার তেমন খাওয়া হয়নি। এমনিতে ধারেকাছে কোথাও গেলেও ফ্লাক্সে চা নিই।
ওইদিন যাত্রাকালে অবস্থা বেশি ভজখট মনে হওয়ায় চা ‘ও নেয়া হয়নি। তাই বাড়ি থেকে বয়ে নেয়া খাবার আমি চুলোয় গরম করতে করতে ফারহানা ফ্রিজ খুলে দেখল, দুইদিনের পাঁচশো ডলারে ফার্ম হাউজটিতে আমাদের থাকতে দেয়া ছাড়া এক লিটার গরুর দুধ, কেজি দুয়েক মাংস এবং কয়েকটি টি ব্যাগ, কিছুটা চিনি আমাদের জন্য ফ্রি দিয়ে রেখেছে মালিকপক্ষ।
কিন্তু মাংস দুই কেজি শূয়োরের। ফারহানা ছিঃ ছিঃ করে উঠল। বলল, এটা আমাদের কোন কাজে লাগবে! আমাদের নাম দেখে তো এদের বোঝা উচিৎ ছিলো আমরা মুসলমান। আমরা এই মাংস খাই না!’ আমি বললাম, আমরা খাই না তো কী হয়েছে? যাওয়ার সময় ওটা নিয়ে নিও। আমাদের একান্ত প্রতিবেশী রীটাকে দিয়ে দেবো। ফারহানা তাই করেছিল।
খাবার টেবিলে দিতে না দিতে সবাই গপাগপ করে খেতে থাকলো। একফাঁকে চায়ের পানি আর দুধ বরাবরের মতো আলাদা করে দুই চুলায় চাপিয়ে রেখেছিলাম। তারপর যে চায়ের জন্য সারাদিন পিত্যেশ করে মরছিল আমার মেয়ে-জামাই, ফ্রিজের সেই দুধ ঘন করে, চা টেবিলে রাখতেই তাও প্রায় ঢকঢক করে পান করে ছুটে বাইরে গেলো অন্ধকার দেখতে। কিন্তু আকাশ মেঘলা থাকলেও কিছু টিমটিম তারা দু’জনেই দেখে অভিভূত হলো। মাহফুজ মনে করতে চেষ্টা করলো কতদিন সে এভাবে তারা দেখেনি। দেখেনি এতটা অন্ধকারও। মাহফুজ তার বাচ্চাদেরকে অনেকক্ষণ ধরে তারা চেনালো। কিন্তু বাচ্চারা ব্রিজবেন তার নানীর রুমের জানালা দিয়ে ওর চেয়ে স্পষ্ট তারা, ভরা আকাশসহ চাঁদ, ক্ষয়িষ্ণু থেকে মরা অবস্থায় কতই দেখে! অবশ্য সবাই তারা আকাশের তারার চেয়ে দূরের অন্ধকার প্রান্তরে কিছু বিচরণরত আবছা গরু দেখে বরং বেশি উল্লসিত হচ্ছিল! যেন সেগুলো আধাবাস্তব কিছু।
ছোটবেলা উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখতাম দূরের বাড়িগুলোতে টিমটিম করে আলো জ্বলছে। অবশ্য সববাড়িতে তো আর একসাথে আলো জ্বলতো না। আগের মানুষ তেল পুড়িয়ে সারারাত হারিকেন জ্বালিয়ে রাখবে, তেমন গেরস্ত কমই ছিলো। মাচায় গোলা ভরা ধান তো কি? ওই ধান বেচে যদি তেল কিনতে হয় তাহলে শুধু দরকারেই যা বাতি জ্বলতো, আর তাতেই ওই অত অত দূরের বাড়িগুলোর সাথে কেমন একটা একাত্মতা বোধ হতো। কিন্তু রাতের জিরাকালাতে যতদূর চোখ গেলো সবটুকু চেষ্টা করেও দৃষ্টির সীমানায় একটা টিমটিমে বাতিও নজরে এলো না। জোনাকি তো নয়ই, খালি বেশ একটু দূরের বড় রাস্তা দিয়ে কিছুক্ষণ পর পর শাঁ শাঁ করে ছোটা দু’চারখানা গাড়ির ক্ষিপ্র আলো ছাড়া। এর ভেতর মোবাইলে টুং করে শব্দ হওয়ার পর মাহফুজ দেখলো তার মোবাইলে একটি মেসেজ এসেছে। সে সেটি পড়ে সবাইকে শোনালো। ম্যাসেজ পাঠিয়েছে ফার্মের তত্ত্বাবধায়ক কেউ। লিখেছে, গরুগুলো মাঝে মাঝে ফার্ম হাউজের কাছে চলে আসতে পারে। হাউজটির কিছুটা দূরত্বে দুখানা করে সরু টানা কাঠের ঘের টপকে তারা ভেতরে আসতে পারবে না অবশ্য কিছুতেই। তাই আমরা যেন কেউ ভয় না পাই! মেসেটাকে সবার কাছে ওহির মতো মনে হলো। আর আমি কেবল বললাম, ফুঁ!
সবার উদ্দেশে অন্ধকারেই নিজের ওপর পাটির বামপাশের গজদন্তে ডান তর্জনি ঠেকিয়ে বললাম, এই দেখো, এই যে আমার বাম গজদন্ত, এটা বাছুরসহ আমাদের একটা গাভী ছিলো, সে গুঁতো দিয়ে ফেলেছে! সবার অভিব্যক্তি তাতে কী হলো অন্ধকারে দেখলাম না। তবু বললাম, আমার বয়স যখন জাহরার সমান। মুক্তিযুদ্ধের আগের বছরের ঘটনা। আমি আমাদের গাভীটিকে ভয় পেতাম বলে মা বললো, গরুকে যে ভয় পায়, তাকেই গুঁতোয়।
তাই একদিন সকালে পায়ে পায়ে গরুর মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, সে আস্তে করে একটা গুঁতো বসিয়ে দিলো আমার মুখে। টের পেলাম রক্তের ধারা ছুটছে। ভয়ে পুকুরে গেলাম কুলি করতে। কুলি করতেই দাঁতটা খুলে চলে এলো। অবশ্য সেটা আগেই একটু নড়ছিল। সেদিন ঘরে এসে খোলা দাঁতটি মাকে দেখিয়ে ঘটনাটা বলতেই মা আমাকে ব্যথা পাওয়ার মতো জোরে একটা ঠোনা মেরে বললো, অত কাছে গেছিলি ক্যান?
রাতে আমি আরো কয়েকবার উঠে ফার্ম হাউজের দরজা খুলে, দরজার একটু বাইরে গিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। এই দাঁড়ানোর প্রথম কারণ, আহা মেয়ে-জামাই এতগুলো অর্থ খরচ করে এখানে এসেছে, নতুন কোনোখানে থাকতে যাওয়া মানেই তো, সেখান থেকে কিছু মগজে ভরে নেয়া। মনে মনে ভাবলাম, কোথাও যেতে যেতে দূরে যখন একটা নির্জন ঘর দেখি, তখন কত মনে হয়, যদি ওখানে গিয়ে একরাত বা কিছুটা সময় হলেও থাকতে পারতাম! তাই তো অনুভব করতে চাই, কী আছে সেই নির্জনতায়! কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে আমার মানসিক অবস্থা বিক্ষিপ্ত থাকার জন্যই সম্ভবত আমার এই নির্জনতা অহেতুক ঠেকেছে! হয়তো সতীর্থ কেউ থাকলে নির্জনতার স্বাদ জমত। ভাঙত। আর যে আছে অন্তরে, সে-ই সবগুলো লাইন উপড়ে সরিয়ে আমাকে একেবারে ঠেলে দিল এই গানের শেষ লাইনটিতে, ‘এবার ফুলের প্রফুল্ল রূপ এসো বুকের’পরে।।
সে রাতে নিরেট নির্জনতার কাছে আসলে যা চাইছিলাম, তা অন্তত এক ছিলিম ভয় পেতে। গাছ-গাছালি বা কোনো কিছুর আড়াল না-ই থাক। তবু অন্তর উৎসারিত হয়ে একটু ভয়ের উদ্রেক চাইছিলাম। তাও হলো না। হাউজটির পাশে তাজা ফুলের মতো কাপড়ের ফুলে সাজানো আধজীর্ণ একটা মণ্ডপ আছে। সেটা নাকি ল্যাণ্ডলর্ড দম্পতির বিয়ের সময় বানানো। স্মৃতি হিসাবে তারা তা অক্ষত রেখে দিয়েছেন। মাহফুজকে সন্ধ্যায় বলেছিলাম, ফার্মের মালিককে ফোন করে আসতে বলো, গল্প করি।
মাহফুজ উত্তর দিয়েছিল, মা, আপনি ভাবছেন তারা এইরকম কোনো বাড়িতে থাকে? তারা রাজকীয় স্থানে রাজকীয়ভাবে জীবন যাপন করে। এসব কিছু তাদের এজেন্ট সামলায়।
আমি বলেছিলাম, তারা এলে তো এই মণ্ডপটি নিয়ে আমি একটি গল্প লিখতে পারতাম। তাতে আমার এই বেড়াতে আসা অধিক সার্থক হতো! এ মণ্ডপ কল্পনা দিয়ে ভরাট করতে কল্পনার অত জোর আমার নেই। আর কল্পনা দিয়ে সহজে বাস্তবসম্মতভাবে তাই ভরাট করা যায়, যা লেখকের নিজস্ব সংস্কৃতির সাথে যুক্ত…।
সকালে আমার যখন ঘুম ভাঙলো, দেখলাম ফারহানা, মাহফুজ তাদের সন্তান যুগলকে নিয়ে বাইরে কোলাহল করছে। বেরিয়ে দেখলাম কিছু অনেকগুলো গরু বেষ্টনির কাছাকাছি চলে এসেছে। আর নির্জন প্রান্তরের দুইরকম বয়সের চারজন মানুষ নিরাপত্তা বেষ্টনির ভেতরে থেকে তাদের উদ্দেশে শঙ্কা মিশ্রিত আনন্দধ্বনি করে যাচ্ছে। আমি গিয়ে চারজনের উদ্দেশে বললাম, গরু তাই তোমাদের এই দশা! ওগুলো বাঘ-সিংহ হলে কী করতে?
বেষ্টনির ঝাপ খুলে আমি বাইরে যাওয়ার সময় মাহফুজ, ফারহানা আমাকে পারলে টেনে ধরে। কিন্তু আমি জাহরাকে নিয়ে সটকে পড়ি। আমার একহাতে আইপ্যাড আরেক হাতে বাংলাদেশের গামছা। যাচ্ছিলাম চত্বরজুড়ে কোনো ছোটমোট বাছুর পেলে তার পিঠে জাহরাকে চড়িয়ে ছবি তুলতে। গামছা নিয়েছিলাম, গরু গুঁতো দিতে এলে তাকে চোখের ওপর বাড়ি মারতে। কিন্তু কিছুদূর গিয়ে দেখলাম, গাভীর পালের ভেতর একটা মাঝারি এঁড়ে। চেহারা রাগী নয়। তবে ষণ্ডা মার্কা। শিং দুটো ছোট হলেও ভীষণ ধারালো মনে হলো। গাভীর পাল নির্বিকার থাকলেও ষাঁড়টি ঘাস থেকে মুখ তুলে আমার দিকে স্থির কিন্তু তীর্যক দৃষ্টিতে এমনভাবে তাকিয়ে থাকলো, যার মানে, নিজ দায়িত্বে এসেছো তো! একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলে আমার একার দোষ দিও না কিন্তু…।
ছবি তোলা মাথা থেকে উবে গেলো। মনে হলো গাভীর পাল রক্ষা করতে ভেতরে ভেতরে রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় গুণ্ডা পোষার মতো এরকম কিছু ষণ্ডা নিশ্চয় তৈরি করে রেখেছে গরুর মালিক বা গরু বিশেষজ্ঞরা। ওই পর্যন্ত যেতে আরো একটা ষাঁড় নজরে পড়েছিলো বটে। তবে তার শিং মাঝ বরাবর কাটা। আর তার মেজাজ মনে হলো আমাদের দেশের বদমাশ বুড়োদের মতো। আসল জায়গায় জোর নেই, মেয়ে দেখলে চোখে রোমান্টিক ভাব আনতে চোখ কুতকুতায়!
কাটা শিংয়ের সে ষাঁড় তেড়ে না আসাতে নির্বিঘ্নে সামনের দিকে যেতে যেতে ভেবেছিলাম, শিং থাকলেই গুঁতোতে হবে এমন তো নয়! গুঁতোনোর স্বভাব থাকলেই গুঁতোয়। কিন্তু ওই বড় ষাঁড় না গুঁতোলে তো ওর শিং কাটার অধিকার কারো ছিলো না। কেন কাটলো তবে! আর ও আমাদের দেখে তেড়ে যখন এলো না, তাহলে কি সে মনে রেখেছে, তার অস্ত্রের ধার নির্বাণ করা হয়েছে! কি জানি…।
দূর থেকেই ফারহানা খেয়াল রাখছিল, আমি তার মেয়েকে নিয়ে আমি কী করি। তাই ছবি না তুলে যেমন গিয়েছি, তেমনি ফিরে আসায় ফারহানা বললো, কী আম্মা, ফিরে এলে যে?
বললাম, একটা ষাঁড় এমনভাবে তাকালো, ভয় পেয়ে পিছিয়ে এলাম। সবখানে সবার সাথে লড়তে নেই। এটা তো তাদের বিচরণ ক্ষেত্র। আমাদের নয়। আর মনে মনে ভাবলাম, গরুর গুঁতো খেয়ে আহত বা নিহত হলে লোক জানাজানি হলে, শেষে পরিচিতরা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেবে, অকবি দীলতাজ রহমানকে একটা ষাঁড় শিং দিয়ে পেট দু’ফালা করে দিয়েছে…।’ ছি ছি! মৃত্যুর মতো পরাজয় আর আছে নাকি! আর এই সবি জেনেশুনে কবি জীবনানন্দ কি না ট্রামের নিচে পড়ে মরতে গিয়েছিলেন! আমার ছেলেমেয়েদের বলে রাখা আছে, আমি মরে গেলে আমার প্রোফাইল থেকে তো প্রশ্নই আসে না, তোমাদের কারো প্রোফাইল থেকে আমার মৃত্যুর খবর পোস্ট করা হয়েছে, এটা যদি শুনি, একেবারে ঘাড় মটকে দেবো তাকে!
আমার কথা শুনে ফারহানা বলেছিল, তাহলে মানুষকে জানাতে হবে না?
আমি মেয়েকে জানিয়েছি, মানুষ স্বাভাবিকভাবে ধীরে ধীরে জানুক…।
ফার্ম হাউজে রাতে নাকি ফারহানা ভয় পেয়েছিলো। কিসের খসখস শব্দ আসছিল বাইরে থেকে। জানালার কাছে গরু চলে এল কি না! বাইরে একটু বৃষ্টিও ছিল যদিও। আমি বললাম, গরু ঢুকলে ঢুকতো! তাতে ভয় কিসের? একই ঘরে গরু রেখে মানুষ ঘুমায় না? আর পৃথিবীর সর্বত্রই সেরকম অবস্থার মানুষও নিশ্চয় আছে। বাংলাদেশে তো আমার জানামতেই প্রচুর আছে।
মাহফুজ বললো, মা আপনি তো জানেন না। এমনও কিলার আছে। অকারণেও তারা মানুষ খুন করে আনন্দ পায়!
আমি বললাম, বেশি জানতে গেলেই ঝামেলা! আর এতকিছু দুর্ভাবনা মাথায় নিয়ে চলতে নেই!
পথে পথে গাড়ি ভিড়িয়ে দুই মার্চ ভরসন্ধ্যায় গিয়ে তিন তারিখ দিনভর আমরা ইতিউতি বেড়ালাম। বিকালে ঢুকলাম গায়েন্ধ্যা স্যাডলর মিউজিয়ামে। মিউজিয়মটি ১৯০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত। টিকেট করে ঢুকতেই গাইড বর্ষীয়সী মহিলা একটি কাঠি দিয়ে নিচের দিক থেকে দেয়ালেরে এক তৃতীয়াংশে চিহ্ন দেখিয়ে বললেন, সম্ভবত ২০০৩ সালে এই পর্যন্ত পানি উঠেছিল। যা হোক ভেতরে ঢুকে দেখলাম খান তিনেক চৌচালা ঘর। সেখানে যা যা দেখলাম, সাবেক আমলের কসাইখানা। দুধ থেকে মাখন-ঘি তোলা জিনিসপত্র। অন্যখানে হারিকেন থেকে বিভিন্ন ধরণের তৈজসপত্র। ফার্নিচার এবং বিভিন্ন দেশের পুতুল। কয়েকখানা বেবীখাট। দেয়ালের বিভিন্ন তাকে পুতুল। ভারতীয় কৃষ্টি-কালচার ধারণ করা পুতুলেরও কমতি নেই সেখানে। একটি কক্ষে সেই তেমনি দামি দামি বিভিন্ন বয়সী পাথর।
কিন্তু এই দেখাতে যে বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে, তা একটি স্কুল। পাঠদান কক্ষ হিসাবে সাজিয়ে রাখা দেয়ালের একটি ছবি দেখিয়ে ফারহানা বললো, আম্মা, দেখো, এই স্কুলটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ১৮৮৬ সালে। এখানে পাঁচজন টিচারের ছবি। এর ভেতর মহিলা টিচারের স্বামীদের পরিচয়সহ তারা কী করতেন, তাও অন্তর্ভুক্ত করা আছে। কিন্তু পুরুষদের বেলায় কিন্তু স্ত্রী’র পরিচয় নেই! মনে মনে ভাবলাম, নারীর অস্তিত্বের সংকট এখনো যে এখানে মৃদু পরিলক্ষিত হয় না, তা নয়। কিন্তু এ দেশে প্রায় দেড় শতাব্দী আগেও এতটা প্রকট ছিল, তা এভাবে চোখে আঙুল দিয়ে না দেখালে আমাদের বোঝার কথা ছিলো না। কারণ আমরা মনে কি সাদা চামড়া মানেই সব মহাভারতের যুধিষ্ঠির!
বিকেল ফার্ম হাউজে ফিরে এসে খুচরো খাচরা তরকারি আর আস্ত আস্ত ডিম, ডাল ভুনা সকালে রাইস কুকারে বসিয়ে যাওয়া টাটকা ভাতসহ খেয়ে, একেবারে শেষ বেলার আলোতে চলছিলো, আগুন জ্বালানোর আয়োজন। সকালে মাহফুজ উৎসবের জন্য কাঠ কিনতে চাইলে আমি জোরছে বাঁধা দিলাম। বললাম, সারারাস্তা ভরা শুকনো ডালপালা, বাকল ছড়িয়ে আছে, আর সেখানে তুমি ডলার দিয়ে কাঠ কিনবে?
মাহফুজ বললো, ছড়ানো-ছিঁটানো কাঠ আছে, ঠিকাছে। কিন্তু কুড়াবে কে?
আমি বললাম, আমি কুড়াবো! আমি…! জানো, আমরা যারা গ্রাম্যজীবনও যাপন করেছি, রাস্তায় ডালপালা, বাঁশ যা পেতাম সব কুড়িয়ে বাড়ি নিয়ে আসতাম। অনেক সময় অন্যান্যদের সাথে মারামারিও লেগে যেত তা নিয়ে…। কিন্তু তাতেও আমাদের আনন্দের মাত্রা কমতো না! মাহফুজ খুব আশা করে আমাদের অবার্ণ রিভার ন্যাশন্যাল পার্কে নিয়ে যাচ্ছিল, খুব ঢালু পথ বেয়ে নেমে গিয়ে দেখা গেলো আরো ঢালুতে একটা খাল সাইজের নালা আছে। শক্ত মাটির কাঁচা রাস্তা দিয়ে ওপাশে যেতে যেতে সে খালের ওপর প্রসস্ত কালভার্ট দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু তখন তার ওপর দিয়ে বেশ ছয় থেকে আট ইঞ্চি উচ্চতায় খরস্রোত বয়ে যাচ্ছে। পানির উচ্চতা না যত, তার থেকে তার চলার আওয়াজ ও বেগ বেশি। এপাশ-ওপাশ দুপাশেই জঙ্গল। তাই নির্জনতা উপভোগের জন্যও জায়গাটা মোক্ষম। আর যে বিষয়টা মাথায় রেখে এতদূর আসা, ওপাশের তা নাকি পাথরের ভেতর দিয়ে পানির প্রবাহ দেখা। কি জানি দেখতে পেলে বোঝা যেত কতটা তা অপরূপ ছিল!
পানিতে ফারহানার ভিষণ ভয়। সে মরিয়া হয়ে গাড়ি আর টানতে বাঁধা দিল। মাহফুজ বলছিল, আমি পানিতে নেমে দেখে আসি, কালভার্ট ঠিক আছে কিনা! এতদূর এসে এইটুকু পানি আমাদের ওপাশে যাওয়ার বাঁধা হবে?
আমি জানি, এর ভেতরই ওপাশে যাওয়া যেত। নাহলে এই কাঁচা রাস্তার শুরুতেই নিষেধাজ্ঞা লেখা নোটিশ থাকতো। তবু একজনকে নেমে গিয়ে দেখতে হত। আর সে কাজটি করতে পারলে জামাইয়ের এই শাশুড়িরও বর্তে যেত। কিন্তু কোনোভাবে এই নির্জন জায়গাতে গাড়িখানা বিগড়ালে কী হবে! তাই আমি আমার মেয়ের পক্ষ নিয়ে জামাইকে বললাম, কোনো গন্তব্যে না পৌঁছে শুধু এই পথ চলার আনন্দ নিয়েই এবার ফিরে চলো বাবা! এরকমও বেড়ানো হয়। শুধু ঘুরে বেড়ানো! কত বাউণ্ডুলে এই করে জীবন কাটিয়ে দেয়! আর তোমরা তো ঘোর সংসারী। একবার না হয় ভুল করে সেই স্বাদই নিলে! উদ্দেশ্যহীন ঘোরা!
মাহফুজ বললো, তাহলে আমি গাড়িতে আপনাদের রেখে একা ওই কালভার্টের কাছ থেকে একটু ঘুরে আসি!’ মহফুজ গাড়ি সাইড করে রাখল। ওপাশে যেতে না পারার অপারগতা মাহফুজ নীরব প্রাণে পানির স্রোতের সাথে বলতে বলতে আমি বিকেলের আরাধ্য আগুনের জন্য ক’খানা ডালপালা আর বেশি করে ক’খানা বাকল গুছিয়ে গাড়ির পাশে রেখে দিলাম। মাহফুজ ফিরে এলে বললাম, দেখলে, আমি তোমার যাত্রা বিফল হতে দিলাম না! কিছু জ্বালানি জোগাড় করে ফেললাম।
আলো থাকতে থাকতে আগুন বেশ ভাল করেই জ্বলে উঠলো। হাউজের সামনেই, জ্বালানো আগুনের পাশে ছিলো কিছু আমাপোড়া ভারি কখানা ডালও। আমার মেয়ের উস্কানিতে জামাতা সেগুলোও জলন্ত আগুনে গুজে দিলো। একসময় ক’জনের প্রাণে আগুন জ্বালানোর স্বাদ মরে এলেও আগুনের তখন যৌবন টগবগে। জাহরা-জেফানও দাপাদাপি করতে করতে ক্লান্ত। উচ্ছ্বাস কমে গেছে তাদেরও। মাহফুজ বলল, আগুন এমনি জ্বলুক, আমরা ঘরে যাই। কিন্তু আবার বাঁধ সাধলো অতি সাবধানী আমার মেয়ে। বলল, এমনি আগুন জ্বললে পুলিস আসতে পারে, কোনোভাবে কেউ রিপোর্ট করে দিলে।
আমি তো গরু-বাছুর ছাড়া কাউকে দেখলাম না রিপোর্ট করার। তবু বললাম, তাহলে ওই যে পাশে পানির কল। পাইপও লাগানো। পানি ঢেলে দিই!
আমার প্রস্তাবটা সবার কাছে অমানবিক মনে হলো। যেন আমি কাউকে গলা টিপে বা পানিতে চুবিয়ে মারতে বলছি! তারা দাঁড়িয়ে থেকে নীরব বন্দনার মধ্য দিয়ে আগুনকে মুমুর্ষ অবস্থায় নিতে চায়। তারপর এমনিই তা নিভুক। বিষয়টি আদিখ্যেদের আদিখ্যেতা ভেবে আমি ভেতরে চলে গেলাম। পড়ে সাড়াশব্দ পেয়ে অনেকক্ষণ পর বুঝলাম, তেনারা ঘরে ঢুকেছেন।
পরের দিন সকাল দশটার ভেতর বের হয়ে যেতে হবে। ফার্ম হাউজ গোছানো জিনিসপত্র তুলে বাবার মতো অতি সাবধানী আমার মেয়ে রাতেই ব্যাগ গোছাতে শুরু করে দিলো। সারাবাড়িজুড়ে বাচ্চা দুটির ছুটোছুটি। বাথরুমের দরজাও খোলা। মাহফুজের অস্তিত্ব টের না পেয়ে বিছানা ও উইটিউবে শোনা কল্লোলের গল্প পাঠ ছেড়ে ফারহানাকে বললাম, মাহফুজ কই?
ফারহানা বললো, আগামীকাল যে বের হবো, গাড়ির স-ব চাকা ঠিকাছে কি না তাই দেখতে গেছে।
আমি পরম আবেগে বললাম, এবার বুঝছো তো, মাহফুজ থালা-বাসন ধুতে গেলে কেন আমি তার হাতের থেকে কেড়ে নিই! কোনো বিষয়ে পুরুষমানুষের দায়িত্ব অনেক বড়। আর সেই বড় দায়িত্বের প্রতি সম্মান দেখালেই সে আরো বড় দায়িত্ব পালনে প্রাণিত ও সম্মানীত বোধ করে। আগামীকাল এতগুলো মানুষ নিয়ে সে রওনা হবে, সেটা বিষয় নয়। ড্রাইভ মেয়েরাও করতে জানে। কিন্তু সে গাড়ির অবস্থা পরখ করার কাজটি কালকের জন্য ফেলে রাখেনি। এটাই বাবা ও স্বামীর প্রকৃত দায়িত্ব। এতক্ষণ যা বলছিলাম, তা স্বগোক্তি’র মতো রয়ে গেল। আমার মেয়ে এতে সাড়া দিল না। কারণ তারা স্বামী-স্ত্রী হওয়ার আগে বুয়েটে ক্লাসমেট ছিলো। দু’জনেই সমান উন্নত দুটি দেশের সেরা দু’টি ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডিও করেছে। প্রসঙ্গত সে কথা আগেই লিখেছি যে, মাহফুজ জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটি থেকে। ফারহানা অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের মোনাস ইউনিভার্সিটি থেকে। তারওপর ফারহানা পিএইচডি করেছে সরাসরি। সাবজেক্ট যদিও দু’জনের একই। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং।
তখন মাহফুজের গাড়ির চাকা চেক করা নিয়ে আমার যা বলার, তা বলে আমি সরে গিয়ে ভাবতে লাগলাম, সেই কবে একবার বেড়াতে এসে আমার বড় ছেলে আশিকের বন্ধু সুধী তার স্ত্রী রুমার মামাতো বড়বোন, মিতুর একটি কথার উত্তরে বলেছিল, মেয়েরা পেটে বাচ্চা ধারণ করে মা হয়। আর তাদের ওই মা হওয়ার বিষয়টা যখন আসন্ন সন্তানের বাবা জ্ঞাত হন সেই মুহূর্ত থেকে সে বাবা হয়ে যায়। সন্তানের দায়িত্ব নিতে তারা নিজেতে প্রস্তুত করতে থাকে। ক্রমে সন্তানের ভাবষ্যৎ গড়ার পরিকল্পনা তৈরি হতে থাকে তার মাথায়। কিন্তু নারীরা একা তলপেটে বাচ্চা ধারণ করে বলে পুরুষের এই অন্তর্গত বিষয়টি তারা বুঝতেও পারে না। স্বীকারও করে না!’ বিষয়টা আমি বিশ্বাস করি এবং বিষয়টি গুছিয়ে ভাষায় ব্যক্ত করে মগজে তুলে দেয়ার জন্য আমি পুত্রপ্রতিম সে ছেলেটিকে সেই থেকে বিশেষভাবে গণ্য করি।
আমার জিনিসপত্র যা কিছু তা আমার ঘরেই ছিল। নামানো হয়নি বলে প্রায় সবকিছু যেমন এনেছিলাম তেমনি রয়ে গেছে। শুধু ওখানে নেয়ার পর পরা হয়ে গেছে যে পোশাকগুলো, সেগুলো আলাদা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলাম। বাসা থেকে বয়ে আনার সময় যদিও জানতাম এতকিছু আসলে লাগে না। কিন্তু যদি লাগত! এই একটা ‘যদি’ই আমাদের দিয়ে বাহুল্য কতকিছু করিয়ে নেয়! কাপড়চোপড়, প্রসাধণী সবকিছু তুলে রেখে আমার আলগা দাঁতটি সাইড টেবিলের ওপর খুঁজলাম। কিন্তু পেলাম না তো পেলামই না! মনে মনে ভাবলাম, বড় কিছু নয়, ছোট একটা জিনিস কিন্তু মূল্যটা তো ছয় হাজার টাকার মতো ছিল। বনানীর সাপেরো ক্লিনিক থেকে তিন সিটিংয়ে বানানো ছিলো। পান্থপথ থেকে বনানী, আহা, একদিন তো গাড়ি দেড়ঘন্টা এক জায়গায় জ্যামে দাঁড়ানো ছিল। প্রসঙ্গত দাঁতের বিষয়টি কবি অঞ্জনা সাহাকে বললে, তিনি বলেছিলেন, তোমার মতো আমারও তো ওই দাঁতটা নষ্ট হয়েছিল। পরে ওটা তুলে নকল দাঁত ফিক্সড করে দিয়েছে ডেন্টিস্ট! মনে মনে ভাবছিলাম, আমার দাঁতের ডাক্তার মোহাম্মদ হান্নান কেন আমার দাঁতটা ফিক্সড করে দিলেন না। তাহলে তো তা হারানোর এই বেদনা ও শূন্যতা নিয়ে আমাকে এখান থেকে যেতে হত না!
মনেহয় জেফন যে আমার কাছে কমলা নিয়ে ছুটে ছুটে যেত ছুঁলে দিতে। সে কমলার খোসা ওই টেবিলে রাখতাম। কখনো ওই খোসার সাথেই ডানপাশের ওপর পাটির দ্বিতীয় দাঁতটির বিকল্প দাঁতটি চলে গেছে!
পরদিন সকালে সব জিনিসপত্র গাড়িতে তুলে এবং আরো কিছু বাহুল্য ছবিটবি হাউজের সামনে তুলে যখন নিজেরাও উঠে বসলাম, সকাল দশটা বাজতে আরো দশ মিনিট বাকি ছিলো। মাহফুজ বিসমিল্লাহ্ বলে গ্লাডস্টোনের উদ্দেশে গাড়িতে স্টার্ট দিলো। ইতিউতি ভিড়ে ভিড়ে আগে থেকে ঠিক করে রাখা আবাসিক হোটেলে যখন পৌঁছুলাম, বিকেল পার হয়ে গেছে প্রায়। আকাশে মেঘ ছিলো বেশ। গুড়িগুড়ি বৃষ্টিও। সেই মতো অবস্থার ভেতর নেমে নিজেরা ফ্রেস হওয়ার সাথে সাথে রুম দুটিকেও ফ্রেস করতে হল। তাতে বেশ ঝক্কিও হল। রাতে মাহফুজ-ফারহানা বেরিয়ে তাদের মতো ঘোরাঘুরি করে খাবারসহ কিছু সওদা কিনে নিয়ে এল। তারপরের দিন সমুদ্রকূল দেখা ও দৃষ্টিনন্দন রকমারি নকল ফোয়ারায় জাহরা জেফান ছুটোছুটি করে স্নান করল। আর আমরা তা দেখে দেখে নয়ন জুড়ালাম। কিন্তু পরিকল্পনাহীন এই স্নানে যা হল, জেফানোর তো ন্যাপিসহ গাড়িতে কিছু পোশাক থাকে। কিন্তু জাহরা জুহিতার? তার কিচ্ছু নেই! শেষে নয় বছরের এক মেয়ে শিশুর আব্রু রক্ষার জন্য ভেজা কাপড়ে হোটেলের রুমে এসে ঢুকলে আর যদি বের হওয়া না হয়! আসন্ন দুপুরের আলস্য পেয়ে বসে! আমি তাই বললাম, আমার উত্তরীয়খানা ওকে ধুতির মতো পরিয়ে দিই! আর ওর মা তিন বছরের জেফানের একটা গেঞ্জির ভেতর ওকে ঢুকিয়ে দিল! দিব্যি সঙ্কট তো কাটলোই জাহরার একটা নতুন লুক ঝলকে উঠল। আর আমারও জিন্সের ওপর খালি পাঞ্জাবি পরে কালো রো চশমা চোখে স্মার্ট ওম্যান হয়ে ঘোরার সাধটা পূর্ণ হল।
ফারহানা বলল, আম্মা, আমাদের দেশে আদিবাসী মেয়েরা থামি পরে না। সেরকম করে ওড়নাটা জাহরাকে পরিয়ে দাও!’ আমি বললাম, কেন? মেয়েদের থামির মতো পরাব কেন? উত্তরীয়র একটা কোনা টেনে পিছনে নিয়ে গুঁজে দিলে দেখো কেমন পুরুষের মতো তেজি লাগে। ওটাই থাক! আমার মনে হল জাহরা ওতেই আনন্দ পেল। পার্কের মধ্যে সে ঢোলকের মতো কি যেন পেল, তাই তালে তালে বাজানোর মতো ঢং করতে লাগলো। আর আমি তার বেশ কিছু ঢুলীর মতো ছবিও তখন তুললাম। ফেসবুকে পোস্টও করলাম। এসব করে মনে হল, বড় কোনো আয়োজন, বা সফরের চেয়ে এই ছোট ছোট ঘটনার ভেতরই বড় আনন্দ লুকিয়ে থাকে, যা সারাজীবন জ্বলে। আলো দেয়।
সেদিন সমুদ্র পারে ওই গ্লাডস্টোন সেন্ট্রালে নানান রকমের কৃত্রিম ঝর্না ও নহরে স্নানের পর হোটেলে ফেরার পথে গাড়ি থামিয়ে দুপুরে খাবারের জন্য পিৎজা আনতে গেলো ফারহানা ও মাহফুজ। গাড়িতে দুই ক্ষুদের সাথে আমি। একটু পরই মাথার পরে তুমুল বৃষ্টি। মানে গাড়ির চালে। প্রায় দেড় ঘন্টা পর মাহফুজ, ফারহানা এল পিৎজা-ফ্রুটস্সহ একবোঝা খাবার নিয়ে। দুপুরে হোটেলে এসে খেয়ে-ঘুমিয়ে আবার সমুদ্রের কাছে কোন পার্কে যাওয়া হল। ফারহানা-মাহফুজ সে পার্কের সৌন্দর্যে অভিূভত হয়ে আলোর ছত্রচ্ছায়ায় ছায়ায় একটু ঘোরাঘুরি করলো। আমি গাড়িতে বসে ফেসবুক করাসহ অভ্যাসবসত এদিক-সেদিক তাক করে ছবিও তুলছিলাম। কিন্তু ঝাপসা ওঠার কারণে সেসব ছবি ডিলিট না করলে, অন্তত একখানা ছবি রাখলে জায়গাটার নাম লিখতে পারতাম।
তখন ফারহানা আর মাহফুজ ওই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি ও অন্ধকারে ইতিউতি করে তাদের মুগ্ধতা বেড়ে, পরে অল্পক্ষণে বেশি ঘুরতে গাড়িতে উঠে এপাশে-ওপাশে ঘোরাঘুরি করতে লাগলো। আর প্রতিজ্ঞা করলো, কাল এই শহর ছেড়ে যাওয়ার আগে এখানে না নামলেও চক্কর দিয়ে যাবে। দিনের আলোতে দেখে যাবে বেড়াতে আসা জায়গার এই অংশটি।
কিন্তু ৬ মাচ ২০২১ সকালে ঘুম থেকে উঠেই হুটোপুটি। এখান থেকেও সকাল দশটার ভেতর বের হতে হবে। তার আগে তাদের হোটেলের জিনিসপত্র যেটা যেভাবে ছিল, সেভাবে করে রেখে যেতে হবে। দেয়ালে কাগজে সাঁটা তাই লেখা ছিল। আমি বাসা থেকে সাথে করে নেয়া সব সবজির অংশবিশেষ বাসায় আর ফিরিয়ে আনতে না চেয়ে, টুকরো-টাকরা যা ছিলো, সবকিছু দিয়ে খুব ভোরে সাথে করে নেয়া সসপ্যানে খিচুড়ি রান্না করছিলাম। সে খিচুড়ির রঙ আর ঘ্রাণ আমাকে এতটাই আকৃষ্ট করল, যে আমি তখনি একটি ডিম পোচ করে এক প্লেট খেয়ে ফেললাম।
দশটা বাজতে বাজতে গাড়ি সাউথ গ্লাডস্টোনের হোটেলের গেট দিয়ে বেরোলে, আমি মাহফুজকে বললাম, আমরা এখান থেকে বেরোতে প্রথমে তো কাল রাতের পার্কে যাব, না?
মাহফুজ বললো, না মা, আর ওখানে যাচ্ছি না। আমরা সাউথ কোলান যাব। ওখানে মিস্ট্রি ক্রেটার্স মিউজিয়ামে আড়াই কোটি বছর আগের পাথর আছে। সেটা দেখতে যাব।
আমি বললাম, আড়াই কোটি বছর আগের পাথর, তা কে বলল? জানল কী করে? ফারহানা বলল, যার জমি সে চাষের জন্য খুঁড়তে গেলেই দেখে পুরোটা জুড়ে পাথর। যত খোঁড়ে পাথরই ভেঙে আসে। তারপর সে কিছু নমুনা বানডাবারগ ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে পরীক্ষা করালে দেখা গেল, ও পাথরের বয়স আড়াই কোটি বছর। যা হোক সকাল দশটায় রওনা দিয়ে আমরা বারোটার দিকে চলে এলাম সাউথ কোলান মিস্ট্রি ক্রেটার্সে। একানকার বসত বাড়ির মতোই গোটা চারেক রুম। বারান্দা। মাহফুজ টিকেট কাটতে কাটতে আমি সে সব রুমে ঢুকে পায়চারি করতে লেগে গেলাম। একেকটা তাকে ঠেসে সাজনো কতকত রকমের সব পাথর। কত লাখ লাখ বছরের ইতিহাস তাদের। এত মাথায় ঢোকাতে গেলে সাতদিনের জন্য এসে পড়ে থাকতে হবে। হাতে ক্যামেরা আছে, তাতে ভিডিও করি। ছবি তুলি। একপাশে দুইশো কেজি ওজনের এক কাছিম। পাশে বিরাট এক কাগজে কীসব লেখা, সেটা পুরোটাই পড়ে ফারহানা বললো, প্রতি এক হাজার কাছিমের ভেতর একটা কাছিমের সম্ভাবনা থাকে এত বড় হওয়ার এবং কাছিমের চোখে যদি লবণ জমে, তাহলেই কাছিম কাঁদে। নাহলে তাদের কাঁদবার আর কোনো কারণ নেই!
লাকড়ির দোকানে দেখতাম, একমন আধমন লাকড়ি কিনতে গেলে, বিরাট একখানা পাথর তুলে দিতো। মানে বাটখারা কেনার হয়ত সামর্থ কাঠ বেপারীর নেই। অথবা বাইরে রাখলে বাটখারা হারিয়ে যায়। তাই কারো আধমন, একমন, দশ সের ওজনের বাটখারার সাথে মিলিয়ে সমান ওজন দিয়ে পাথরকে বাটখারা হিসাবে ব্যবহার করা হয়। আর তা দেখতে দেখতেই এতটা বয়স হলো। তবু আড়াই কোটি বছরের পাথর বলে কথা। এখানে এমন সব জায়গায় বয়স্ক মানুষেরাই ভলেন্টিয়ার সার্ভিস দিয়ে থাকেন। বর্ষীয়সী ভলেন্টিয়ার দরজার কাছে যেনতেন প্রকারে রাখা কমবেশি পাঁচ কেজি করে ওজনের দু’খানা পাথরের কথা মাহফুজ-ফারহানাকে বলতে বুদ্ধিদীপ্ত-সফেদ মুখে তুবড়ি ছোটাচ্ছেন। আমি তাদের কথার ভেতর গিয়ে বললাম, আমি একখানা পাথর হাতে নিয়ে ছবি তুলতে চাই! ভেবেছিলাম বর্ষীয়সী আপত্তি করবেন।
আমরা প্রার্থনা অনুবাদ করে মাহফুজ অস্ট্রেলিয়ান সে বর্ষীয়সী ভলেন্টিয়ারের কাছে পৌঁছে দিতেই তিনি প্রসন্ন বদনে অনুমতি দিলেন। এতে আমার ক্ষতিই হলো। পাথরের গাম্ভীর্য আমার কাছে ক্ষুন্ন হয়ে গেল। যা দেখতে এতদূর এসেছিলাম, তা নিয়ে ছবি তোলার পর, তারপর ভবিষ্যতে ফেসবুকে তা নিয়ে একটি চমকপ্রদ স্ট্যাটাস লেখার পরিকল্পনা করা ছাড়া ওখানে আর কী কাজ থাকতে পারে, তাই মনে করে আমি জামাইবেটাকে বললাম, এবার চলো তো, বাপু!
মাহফুজ বললো, চলবো কি? আসল পাথর তো বাইরে! বলে সে তার ধস্তাধস্তিরত তিন বছরের পুত্রকে কাঁখে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। জাহরা জুহিতা আর তার মা আগেই বাইরে চলে গেছে। তাই আমি আর নাতি ও জামাইয়ের সাথে না গিয়ে করি কি! দরজার বাইরে গিয়ে দেখলাম, মিউজিয়ামের অদূরেই বেশ কিছুটা জায়গা স্টিলের রেলিং দিয়ে ঘের দিয়ে রাখা। ভেতরে খানাখন্দ। বৃষ্টির পানি জমে টইটুম্বর হয়ে আছে। একটাতে আবার শাপলা বা পদ্মের পানা। গর্তগুলো কোনটা লম্বাটে। কোনোটা গোল। আর ঘের দেয়া ওই জায়গাটুকু ভাল করে দেখার জন্য পাশেই স্টিলের মঞ্চ বানানো হয়েছে। সুইচ চাপলে পাথরের বিষয় একটি পুরুষ কন্ঠের ধারা বিবরণী শোনা যায়। ফারহানা আমাকে মঞ্চের ওপরে ডাকলে অনিচ্ছা নিয়েই গেলাম। ফারহানা বললো, ওপর থেকে দেখলে ওই গর্তের অনেকগুলো মানুষের পায়ের আকারের মতো মনে হয়। মাইকে তাই বলছে। তাই ওপর থেকে দেখার এই ব্যাবস্থা করে রাখা। তারপর নিচে নেমে মাহফুজ, ফারহানা নিবিষ্ট হয়ে সেই ঘিরে রাখা পঞ্চাশ মিটার পরিসরের প্রতিটি খানাখন্দ দেখছে আর আলোচনা করতে করতে এগোচ্ছে। এর ভেতর ফারহানা আমাকে বললো, তোমরা যে পাথর নিয়ে ছবি তুললে তা এই গর্তটার থেকে তোলা! যত খোঁড়ে, ওরকম ভেঙে ভেঙে পাথরই ওঠে। এখান থেকে দুই কিলোমিটার দূরে একটা মৃত্যু আগ্নেয়গিরি আছে…।’ আমি বললাম, এখন চলো তো। গাড়িতে উঠি।
মিস্ট্রি ক্রেটার্স থেকে বেরোতে আরেক হুজ্জোত। ফারহানা, জাহরা মা মেয়ে মিলে কিসব জিনিস পছন্দ করেছে। তাই তখন কিনবে। আমার তখন এমনিতে ঠান্ডাজনিত অসুস্থতা চলছিল, তবু একটা আইসক্রিম নিলাম। আমার সাথে হইহই করে সবাই একটা করে আইসক্রিম নিয়ে ওদের মা ও মেয়ের কেনা জিনিসের দাম মিটিয়ে গাড়িতে উঠলো।
মাহফুজ গাড়িতে স্টার্ট দেয়ার আগেই আমি বললাম, খালি খালি এই দুই টুকরা পাথর দেখতে এতটা পথ এখানে ঘুরে আসা। আর এতখানি সময় নষ্ট করা! এসব দেখার থেকে শুনে সন্তষ্ট থাকাই ভাল। কল্পনায় এমন শোনা অনেক কিছুতে মনের রঙ চড়িয়ে মনে মনেই দেখা যায়! যে পথে এসেছিলাম, সেই পথে গেলে বরং আবার কিছু টাটকা কমলা কিনতে পারতাম!
আগেই বলেছি ফারহানা তার বাবার মতো। রাগলেও গলা চড়ায় না। সে তাই না চড়ানো গলায়ই রেগে বললো, আম্মা, তুমি দেখি কিছুই বোঝোনি!
আমি বললাম, কী বুঝিনি? পাথর দুইখানা আড়াই কোটি বছর আগেরই যদি হবে, তাহলে কাচ দিয়ে ঘিরে রাখা হলো না কেন? আমার মনে হয়, ওটা সাধারণ পাথর। নাহলে হাতে হাতে ক্ষয় হয়ে যাওয়ার ভয়ে ওটার ভাব-গাম্ভীর্য বজায় রেখে সাবধানে রাখা হতো না?
ফারহানা বললো, ওই যে বাইরের ঘের দেয়া পুরো জায়গাটাই একখানা পাথর! পঞ্চাশ মিটার। তার মানে পাথরখানা পঞ্চাশ মিটার। আর ওর গভিরতা ষোল ফিট। ধারণা করা হয়, ওটা ভিন্ন গ্রহ থেকে ছিটকে এসে পড়েছে। উল্কাপিণ্ড যাকে বলে। এটা নিয়ে রহস্যের জট এখনো পুরোপুরি খোলেনি। এই জমি যার, সে যখন দেখলো, যতই খুঁড়ছে, ততই শক্ত পাথর। শাবল ঢোকানো যায় না, তখন গবেষণাগারে কিছু নমুনা নিয়ে গেলে গবেষকরা গবেষণা করে দেখলেন, এটা আড়াই কোটি বছর আগের। আর এটা আবিষ্কৃত হয় ১৯৯৯ সালে। তখন থেকে এটাকে সুরক্ষিত করে রাখা হয়। তুমি যেটা হাতে নিয়েছ, তা ওখান থেকে তোলা একটা ভাঙা খণ্ড…।
গাড়ি ছুটছে ব্রিজবেন’এর দিকে। মানে বাসার দিকে। নিজেকে খুবই ধিক্কার দিলাম। নিজের অন্ধত্ব ও বধিরতাতে আমি সারাজীবন আঁকড়ে রইলাম। কারো কোনো কথা আমি কখনো ভাল করে শুনি না। বোঝার চেষ্টা করি না। যা আমি বুঝি, তাও আমি অতটুকুই বুঝি, তা নিয়ে নিজের সাথে হয়ত কিছুটা বোঝাপড়া করতে পারি। কিন্তু কাউকে বোঝাতে পারব না! কখনোই কোনকিছু স্পস্ট করে বোঝার চেষ্টা করি না বলে।
তাই তো এমন একটি তথ্যকেন্দ্রীক লেখাতেও নিজেকে ভেঙেচুরে ভেজালের মতো মেশাতে হয়। যে নিজেকে ভাঙি। মেশাই। সেই নিজেরও অমাত্রিক আমি কতটা আর জানি! আর এখন তো এ অভ্যাস বদলানোরও সময় নেই! কারণ বদলাতে মনের যে জোর লাগে, সে জোর চিরদিন ফণা তোলা অবস্থায় থাকে না! তারও মনোযোগ অন্য আরো অনেককিছুতে ভাগ হয়ে যায়।
Leave a Reply