রবিবার, ২৮ মে ২০২৩, ০৫:৪৮ পূর্বাহ্ন

দেখার চেষ্টা চক্ষু খুলিয়া : ১৮-মো. শওকত আলী

দেখার চেষ্টা চক্ষু খুলিয়া : ১৮-মো. শওকত আলী

দেখার চেষ্টা চক্ষু খুলিয়া-১৮
মো. শওকত আলী

কুমিল্লা মূল শহরের কাছাকাছি কোটবাড়ি এলাকার দক্ষিণে প্রায় ১.৫ কি.মি. দূরে শালিমান গ্রাম। এখানেই দেশ-বিদেশে খ্যাত শালবন বিহার অবস্হিত। তবে শালবন বিহার নামের সংগে শালবনের কোন সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। কেননা এখানে কোনকালে শালবন ছিল বলে জানা যায়নি। তবে নামকরণের একটা হেতু আছে বৈকি। দেশের অধিকাংশ বৌদ্ধ বিহারগুলোর নামকরণে যেমন স্হানীয় কোন না কোন মীথ বা কারণ রয়েছে এটিও তার ব্যতিক্রম নয়। কারো কারো মতে গ্রামের শালমান নাম অনুসারে এটিকে শালবন বিহার বলা হয়। তবে ১৯৫৫ সালে উৎখনন শুরুর আগে অবশ্য এটি ‘শালিবাহন রাজার বাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। কখনও কখনও আন্চলিক ভাষায় শালবন মূড়াও বলা হতো।

কুমিল্লা অন্চলে যতগুলো বৌদ্ধ বিহার বা বৌদ্ধ প্রত্নস্হাপনা আবিষ্কৃত হয়েছে ব্যাপকতার দিক থেকে শালবান বিহার সবথেকে আকর্ষণীয়। ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত কয়েক দফায় খনন করা হয় এখানকার ঢিবিটি। খননের ফলে বিহারের যেসব ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয় তা’তে ধারণা করা হয় ছয়টি বসতি আমলে( বসতি আমল সাধারণ অর্থে এক একটি শাসন আমল বা যুগ) এ বিহারটি ব্যবহৃত হতো। ১৬৭.৬ বর্গমিটার বর্গাকার আকৃতির সুবিন্যস্ত বিহারটির কাঠামো। কেন্দ্রিয় মঠটির চারদিকে ক্রুশাকৃতির চারটি বাহুর পরিকল্পনায় ভিক্ষুদের থাকার জন্য সারিবদ্ধ কক্ষ, ভোজনালয়, স্তুপা, নিরাপত্তা এবং সুরক্ষার জন্য তোরণ, প্রহরী কক্ষ সবই ছিল এখানে। এ বিহারের মূল প্রবেশপথ ছিল একটি যেটির অবস্হান ছিল উত্তরদিকের মধ্যবর্তী স্হানে।

বিহারটির প্রথম ব্যবহারকাল (বসতি কাল) খড়গ ও রাত শাসনামলের বলে ধারণা করা হয়। খড়গ রাজা দেব খড়গ রাত রাজা শ্রীধারণ রাতকে বড় কামতা(বর্তমান কুমিল্লার অংশ) থেকে উচ্ছেদ করে বংগ থেকে সমতট পর্যন্ত তার ক্ষমতা সম্প্রসারণ করেছিলেন। এতে করে কুমিল্লা অন্চল তার শাসনাধীন হয়। তবে উচ্ছেদের মাধ্যমে তার ঐ বিজয়কে সম্ভবত: ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্হাপন কিম্বা এর পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে বৈধ করে নিতে হয়েছিল। হয়তো সে কারণে তিনি সে যুগের প্রচলিত নিয়মে বৌদ্ধ মঠ নির্মাণের জন্য ভূমি দান করতে বাধ্য হন। এভাবেই হয়তো শালবন- ময়নামতি অন্চলে শালবন বিহার, আনন্দ বিহার, ভোজ বিহার, কুটিলা মূড়া, ইটাখোলা মূড়া, রুপবান মূড়া, ইত্যাদি বৌদ্ধ বিহার সম্বলিত পবিত্র ভূমি হয়ে উঠে। এটি এক ধরনের মতামত।

শালবন বৌদ্ধ বিহারটি ভবদেব মহাবিহার নামেও পরিচিত ছিল। কোন কোন বিশেষজ্ঞের মতে সপ্তম শতাব্দীর শেষভাগ থেকে অষ্টম শতকের প্রথম ভাগে দেববংশের রাজা শ্রীভবদেব এ বিহারটি নির্মাণ করেন।
দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বসতি আমলে পর্যায়ক্রমে বিহারের মেঝে উঁচু করা হয় এবং এর আওতা সম্প্রসারণ করা হয়। চতুর্থ বসতি আমলে এসে সংস্কার করে পুরানো আমলের দরজা, মেঝে ও কুলঙ্গিগুলো ঢেকে দিয়ে নতুন মেঝে ও দরজা তৈরি করা হয়। এমনকি ব্যক্তিগত পূজাঅর্চনার জন্য পাকা বেদীসহ ছাদে উঠার সিঁড়িও নির্মাণ করা হয় ঐ সময়। পন্চম বসতি আমলেও এর বিকাশ ঘটে তবে শেষদিকে এসে (আনুমানিক দশ-এগার শতক) পুরো স্হাপনাটি ক্রমান্বয়ে ধ্বংস হতে শুরু করে। এ অবস্হাতেই সম্ভবতঃ ষষ্ঠ বসতি আমল অতিবাহিত হয়।

একটি বিষয় স্পষ্ট যে কেন্দ্রিয় মন্ডপের যে কাঠামো রয়েছে সেগুলো সবমিলিয়ে একক কাঠামো ছিল না। বিভিন্ন আমলে বিভিন্ন সময়ে ঐ স্হানে কাঠামোগুলি নির্মিত হয়েছে। তবে এর আকর্শনীয় দিক হচ্ছে শুরুতে মন্ডপ তৈরির স্হাপত্যরীতিতে ক্রুশাকৃতির মডেল ব্যবহারের যে নমুনা এখানে দেখা যায় পরবর্তীতে পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, ভারতের বিক্রমশীলা বিহার এমনকি মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়ার বৌদ্ধ বিহারেও একই স্হাপত্যরীতির মডেল অনুসৃত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার শালবন বৌদ্ধবিহারের প্রায় একশত বছর পর তৈরি করা হয়েছিল বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন।
উৎখননকালে এখানে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, টেরাকোটা নিদর্শন, পোড়ামাটির সিলমোহর, ব্রোঞ্জ এবং টেরাকোটার মূর্তি, ভাস্কর্যসহ আরও অনেক নিদর্শন পাওয়া গেছে যেগুলি ময়নামতি প্রত্নজাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

লালমাই -ময়নামতি অন্চল বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে আছে। লালমাই -ময়নামতি নামটিও হয়েছে প্রাচীন চন্দ্রলিপিতে উৎকীর্ণ লালম্বী বন এবং স্হানীয় লোকগাঁথা চন্দ্রবংশের এক রাজার মা বা রানীর ময়নামতি নামের অনুসরণে।
ধারণা করা হয় এ অন্চলে ৫০টিরও অধিক বৌদ্ধ বসতি গড়ে উঠেছিল এবং সে সময় এ অন্চলটি ছিল প্রাচীন বংগ এবং সমতটের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এ অন্চলের পুরাকীর্তি আবিষ্কারের একটি ঘটনা রয়েছে। এ অন্চলের মধ্য দিয়ে দিয়ে যে রাস্তা ছিল ১৮৭৫ সালে সে রাস্তা পুনঃনির্মাণ করতে গিয়ে শ্রমিকরা কিছু ধ্বংসাবশেষ এর দেখা পায়। তখন এটিকে দুর্গ বলে মনে করা হয়েছিল। কারণ শালবন বিহারের চতুর্দিকে ইটের তৈরি বিশাল দেওয়াল ছিল।সে আমলে এ ধরণের ধর্মীয় কেন্দ্রগুলি সামাজিকভাবে খুবই প্রভাবশালী হয়ে উঠায় তাদের বিত্তবৈভব বৃদ্ধি পাচ্ছিল।যেকারণে সেগুলির নিরাপত্তা জোরদার করা প্রয়োজন ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাছাউনি স্হাপনকালেও এমন কিছু নিদর্শন উদঘাটন হওয়ায় সরকার তাৎক্ষণিকভাবে ১৮টি স্হাপনা চিহ্নিত করে সংরক্ষণের ব্যবস্হা করে। পরবর্তীতে ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত পদ্ধতিগত পন্হা অবলম্বন করে জরীপ করা হয়। এখনও পুরোপুরি উৎখনন কার্যক্রম শেষ হয়নি। আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য এর অনেক কিছু হয়তো বা এখনও অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। তবে ক্যান্টনমেন্ট তৈরিকালে কিছু নিদর্শন নষ্ট হবার কথা শোনা যায় ওখানে।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge