এই মহামারি সহজে যাবে না, অনেকদিন ধরে চলবে
জসিম মল্লিক
১
এই মহামারি সহজে যাবে না, অনেকদিন ধরে চলবে, বলেছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থ্যা। পরিস্থিতি সত্যি ভয়াবহ। কানাডায় তৃতীয় ওয়েভ চলছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। কোভিডের নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে। অন্টারিও প্রভিন্সে প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। নতুন প্রজেকশন অনুযায়ী আগামী মে মাস নাগাদ প্রতিদিন বিশ হাজার হতে পারে আক্রান্তের সংখ্যা। চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। আইসিউতে জায়গা খালি নাই। ভ্যাকসিন রোল আউট চললেও আক্রন্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিশ্বজুড়ে ভ্যাকসিনের অর্পাযপ্ততা রয়েছে। এ পর্যন্ত কানাডায় আক্রন্তের সংখ্যা বারো লাখেরও বেশি, মৃত্যু প্রায় ২৪ হাজার। অন্টারিও প্রভিন্সে আক্রান্ত ৪ লাখের অধিক, মৃত্যু প্রায় ৮ হাজার। সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছে ১৩ কোটি ৯৬ লাখ ৭০ হাজার ৮০০ জন এবং মারা গেছে ৩০ লাখের বেশি। বিশ্বে করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে সুস্থ হয়েছে ১১ কোটি ৮৭ লাখ ১৯ হাজার ৫৬ জন এবং বর্তমানে আক্রান্ত অবস্থায় রয়েছে এক কোটি ৭৯ লাখ ১৫ হাজার ৭৮৬ জন।
সারা বিশ্বে করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে সুস্থ হওয়ার হার ৯৮ শতাংশ এবং মারা যাওয়ার হার দুই শতাংশ। বিশ্বে বর্তমানে করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে গুরুতর অবস্থায় রয়েছে এক লাখ ছয় হাজার ৮৭৬ জন এবং বাকিদের অবস্থা স্থিতিশীল। বিশ্বে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় সবার ওপরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সে দেশে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছে তিন কোটি ২২ লাখ ২৪ হাজার ১৩৯ জন এবং মারা গেছে পাঁচ লাখ ৭৮ হাজার ৯৯৩ জন । বিশ্বে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের পর যথাক্রমে রয়েছে- ভারত, ব্রাজিল, ফ্রান্স, রাশিয়া, ব্রিটেন, তুরস্ক, ইতালি, স্পেন ও জার্মানি। ভারতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা এক কোটি ৪২ লাখ ৮৭ হাজার ৭৪০ জন এবং মারা গেছে এক লাখ ৭৪ হাজার ৩৩৫ জন। ব্রাজিলে আক্রান্ত হয়েছে এক কোটি ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯৩ জন এবং মারা গেছে তিন লাখ ৬৫ হাজার ৯৫৪ জন।
২
চীনের উহান থেকে বিশ্বজুড়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ছড়িয়ে পড়ে মহামারি করোনা ভাইরাস। এক বছরের বেশি সময় ধরে পুরো বিশ্ব তছনছ করে ফেলেছে এই ভাইরাসটি। টিকা প্রয়োগ শুরু হলেও ভাইরাসটির প্রকোপ দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, শিগগিরই এই ভাইরাস চলে যাবে, এমন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। মাঝখানে প্রকোপ কিছুটা কমলেও আবার পুরোদমে জেঁকে বসার আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস আধানম গ্রেব্রেসুস বলেছেন, সারাবিশ্বে ৭৮ কোটি ডোজ কভিড টিকা দেওয়া হয়েছে। মহামারিটি কখন শেষ হবে বলা কঠিন। তবে এটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। আশা করি, কয়েক মাসের মধ্যে আমরা তা পারব। গত জানুয়ারি ফেব্রুয়ারিতে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে সংক্রমেণের নিম্ন গতি দেখা গিয়েছিল। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তা আবার বাড়তে শুরু করেছে। একই সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুহারও।
এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার প্রধান বলেছেন, ‘এ বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সারা বিশ্বে টানা ৬ সপ্তাহ সংক্রমণের হার কমেছিল। এখন সাত সপ্তাহ ধরে ফের সংক্রমণের উর্ধগতি দেখা যাচ্ছে। গত চার সপ্তাহ ধরে টানা বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও।’ তিনি আরো বলেন, এশিয়া ও মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোতে সংক্রমণের প্রকোপ বাড়ছে। টেড্রোস বলেন, মহামারি সহজে যাবে না, অনেকদিন ধরে চলবে। তবে এই পরিস্থিতিতে সবাইকে মাস্ক পরতে হবে এবং অবশ্যই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। তবে তিনি সবাইকে এই বলেও আশ্বাস দেন, ‘মহামারিটি অনেক দিন ধরে চললেও আমাদের অনেক আশা রয়েছে। কারণ, প্রথম দু’মাসে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার অনেক কমেছে। এতেই স্পষ্ট যে, এই ভাইরাসকে রোধ করা সম্ভব। আমরা এই পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারি।’
এদিকে ফাইজারের প্রধান নির্বাহী অ্যালবার্ট বোরলা বলেছেন, টিকা নেওয়ার পরে ১২ মাসের মধ্যে তৃতীয় বুস্টার ডোজ প্রয়োজন হতে পারে। গত ১৫ এপ্রিল সিএনবিসিতে সম্প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন তিনি। ১ এপ্রিল সাক্ষাৎকারটি রেকর্ড করা হয়। প্রাথমিক গবেষণা বলছে, মডার্না, ফাইজার ও বায়োএনটেকের টিকার কার্যকারিতা কমপক্ষে ছয় মাস পর্যন্ত থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা ছয় মাসের বেশি সময় পর্যন্ত সুরক্ষা দিতে পারলেও করোনার নতুন নতুন ধরনের কারণে নিয়মিত বুস্টার ডোজ নেওয়া প্রয়োজন হতে পারে। সিইও বোরলা বলেন, বুস্টার ডোজ নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে পরিকল্পনা করছে। হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা এমন তথ্য জানিয়েছেন। কংগ্রেস কমিটির বৈঠকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কোভিড-১৯ রেসপন্স টাস্কফোর্সের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডেভিড কেসলার বলেছেন, টিকা নেওয়ার পর রোগ প্রতিরোধক্ষমতার স্থায়িত্ব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, টিকার বুস্টার ডোজ প্রয়োজন হতে পারে। তিনি বলেন, যাঁরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, তাঁদের প্রথমে টিকার এই বুস্টার ডোজ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
৩
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস অব ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ট প্রিভেনশনের পরিচালক রোসে ওয়ালেনস্কি হাউস সাবকমিটিতে বলেন, টিকা নেওয়ার পরও যাঁরা করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন, তাঁদের নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়ালেনস্কি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে দশ কোটির বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৫ হাজার ৮০০ জন টিকা নেওয়ার পরও সংক্রমণ হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, এর মধ্যে ৩৯৬ জনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে হয়েছে। ৭৪ জন মারা গেছেন। ওয়ালেনস্কি আরও বলেছেন, টিকা নেওয়ার পর অনেকের প্রতিরোধক্ষমতা শক্তিশালী না হওয়ায় এ ধরনের সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, কিছু ক্ষেত্রে করোনার আরও বেশি সংক্রামক ধরনে অনেকে সংক্রমিত হয়েছেন। ফাইজার ও বায়োএনটেক বলেছে, করোনা প্রতিরোধে তাদের টিকা ৯১ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর। ট্রায়ালের তথ্যের ভিত্তিতে ফাইজার ও বায়োএনটেক জানিয়েছে, ১২ হাজারের বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। এটি কমপক্ষে ছয় মাস তাঁদের সুরক্ষা দেবে।
বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে শঙ্কা দিন দিন গভীর হচ্ছে। গত বছরের ৮ মার্চে আক্রান্ত ও ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর খবরের পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে করোনায় ১০ হাজার ৮১ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে মহামারি করোনা। এই মৃত্যুর মিছিলে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি চিকিৎসক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সেনা সদস্য, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, সাবেক মন্ত্রী ও সাংবাদিক রয়েছেন। দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৩৯ জন চিকিৎসক ও ৩৪ জন সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন। ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএর) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত দেশে ২ হাজার ৯১০ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আর ১ হাজার ৯৯৮ নার্স এবং ৩ হাজার ২৯৫ স্বাস্থ্যকর্মীও আক্রান্ত হয়েছেন এই সময়ের মধ্যে।
গত বছরের ১৫ এপ্রিল করোনায় দেশে প্রথম একজন চিকিৎসক মারা যান। তিনি সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মঈন উদ্দীন আহমদ (৪৭)। তার মৃত্যুর খবর চিকিৎসক সমাজসহ সব শ্রেণিপেশা ও সাধারণ মানুষের হৃদয় নাড়া দেয়, নেমে আসে শোকের ছায়া। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয় এই ‘মানবিক ও গরিবের ডাক্তার’ খ্যাত এই চিকিৎসকের মৃত্যুতে। এরপর থেকে করোনায় চিকিৎসকদের মৃত্যুর তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে। বিএমএর তথ্য বলছে, গত বছরের জুন মাসে মোট ৪৫ জন চিকিৎসক করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন। ওই মাসের ৪ তারিখ সবচেয়ে বেশি চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। ওই দিন পাঁচজন চিকিৎসক মৃত্যুবরণ করেছিলেন। যা ছিল সর্বোচ্চসংখ্যক চিকিৎসকের এক দিনে মৃত্যু। এদিকে সাংবাদিকদের ফেসবুকভিত্তিক গ্রুপ আমাদের গণমাধ্যম, আমাদের অধিকার’-এর তথ্য অনুযায়ী, করোনায় দেশে এ পর্যন্ত ৩৪ জন সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন।
৪
ব্রাজিলের করোনার ধরন আরও ভয়ংকর রূপ নিতে পারে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশটিতে করোনা সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এ তথ্য জানা গেছে। বলা হচ্ছে, ব্রাজিলে পাওয়া করোনাভাইরাসের ধরনটি ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এটি আরও ভয়ংকর রূপ নিতে পারে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, ব্রাজিলের মানাউস শহরের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (ফিওক্রুজ) সম্প্রতি এ গবেষণা চালিয়েছে। দেশটিতে পাওয়া করোনার ধরনটির নাম হলো ‘পি১’। গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ব্রাজিলে ইদানীংকালে করোনার সংক্রমণের হারে বড় ধরনের উল্লম্ফন দেখা দিয়েছে। দেখা গেছে যে পি১ ধরনটি ক্রমাগত পরিবর্তিত (মিউটেশন) হচ্ছে। এর ফলে ভাইরাসটি আরও ভয়ানক হওয়ার আশঙ্কা আছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই পরিবর্তনের কারণে করোনার ওই ধরনটি টিকাপ্রতিরোধী হয়ে উঠতে পারে। গবেষণাপত্রের অন্যতম লেখক ফেলিপে নাভেচা বলেন, ‘আমরা মনে করছি, এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ভাইরাসটি অ্যান্টিবডির প্রতিক্রিয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করছে।’ তিনি আরও বলেন, দক্ষিল আফ্রিকায় পাওয়া করোনার ধরনটির মতোই মিউটেশন লক্ষ করা যাচ্ছে পি১ ধরনটিতে। দক্ষিণ আফ্রিকায় পাওয়া করোনাভাইরাসের ধরনটির ক্ষেত্রে বেশ কিছু টিকা কম কার্যকর বলে আলোচনা আছে। ফেলিপে নাভেচা বলেছেন, টিকার কার্যকারিতা কমে যায় কি না, সে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। কারণ, ভাইরাসটির ‘পি১’ নামের ধরনটি খুব দ্রুত বিবর্তিত হচ্ছে এবং এই প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে।
এই গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ভাইরাসের ‘পি১’ ধরনটি প্রকৃত ধরনটির তুলনায় আড়াই গুণ বেশি ছোঁয়াচে। অর্থাৎ ব্রাজিলে পাওয়া করোনার ধরনটি দ্রুত ছড়াতে সক্ষম এবং একই সঙ্গে অ্যান্টিবডির বিরুদ্ধে এর সহনশীলতাও বেশি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বর্তমানে টালমাটাল ব্রাজিল। দেশটিতে করোনাভাইরাসে মোট মৃত্যুর সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ ছাড়িয়ে গেছে। করোনায় বেশি মৃত্যুর দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পরই আছে দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশ। ব্রাজিলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সবচেয়ে ভীতিকর দিক হচ্ছে, এখন অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। আবার এ বয়সীদের শারীরিক অবস্থা নাজুক হয়ে যাচ্ছে। গত মার্চ মাসের উপাত্ত বলছে, আইসিইউতে থাকা রোগীদের মধ্যে অর্ধেক ৪০ বা এর কম বয়সী।
Leave a Reply