বুধবার, ০৭ Jun ২০২৩, ০৯:১৬ অপরাহ্ন

একেএম শহীদুর রহমান বিশু স্মরণ সংখ্যা

একেএম শহীদুর রহমান বিশু স্মরণ সংখ্যা

বিশু ভাই-বিশু দা নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন প্রবীন শিশু সাহিত্যিক ও সাদা মনের মানুষ এ.কে.এম শহিদুর রহমান। ৯ আগষ্ট ২০২০ ভোর বেলায় নীরবে-নির্ভিত্তে প্রায় ৭৯ বছর বয়সে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। এসময় তার দুই ছেলে পাশের কক্ষে ঘুমিয়েছিলেন কিন্তু তারাও বুঝতে পারেননি কখন তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
বিশু ভাইকে আমি জানি ৬৭-৬৮ সাল থেকেই। তিনি কখনই কাউকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন না বরং কাউকে সহযোগিতা করার সুযোগ পেলে গর্ব অনুভব করতেন। অনেকেই লেখা সংশোধনের জন্য বিশেষত ছড়ার ছন্দ মিলাতে তার সাহায্য নিতেন। তিনি হাসি মুখে তা করে দিতেন। বিশেষ করে নতুন লেখকদের প্রতি উৎসাহ যোগাতেন।
তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকুরীর সুবাদে সেখানকার প্রকৌশলীদের অনেকের স্ত্রী বা স্বজনদের কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনার ক্ষেত্রে সহযোগিতা দান করেছেন যা অনেকের বইয়ে স্বীকারোক্তি করেছে। এখান থেকে বেশ কয়েকজন লেখক পরবর্তীতে জাতীয় পর্যায়ে স্থান করে নিতে পেরেছেন। এই মুহূর্তে মনে আসছে লায়লা রশীদ ও দিলারা মেজবা এর নাম। তারা বিশু ভাইকে গভীর শ্রদ্ধা করতেন। তাকে আর্থিক সহায়তা দিতে চাইতেন। কিন্তু বিশু ভাই এতটাই আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন ছিলেন যে, সহায়তা গ্রহণ তো দূরের কথা হেসে উড়িয়ে দিতেন। অফিসের কাজেও তার বিভাগে উপরি গ্রহণের যথেষ্ঠ সুযোগ ছিলো। কেবল মৌন সম্মতি জ্ঞাপন করলেই অন্যদের মত রংপুর শহরে তার একটি নিজস্ব বাড়ি অবশ্যই হতো। কিন্তু তাতো হয়ইনি উল্টো স্ত্রীর চিকিৎসা ও পারিবারিক ঝামেলামুক্ত থাকার জন্য পৈত্রিক সুত্রে প্রাপ্ত মুন্সীপাড়ার তার অংশটি ভাইদের কাছে নামমাত্র মূল্যে হস্তান্তর করে দেন। পরে তিনি পাক পাড়ায় একটি ভাড়া বাসায় ছিলেন যেখানে জীবনের সমাপ্তি টানেন।
বিশু ভাই’র একটি ব্যক্তিগত ঘটনা অনেকের কাছেই অজানা। তার স্ত্রী দীর্ঘ কয়েক বছর যাবত অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় ছিলেন। এক দিকে তাকে ম্যানেজ করে রাখা, অন্যদিকে রান্না-বান্না, ধোয়া-মোছা, ঝাড়ু দেয়া থেকে শুরু করে সংসারের সব কাজ শেষ করে স্ত্রীকে খাইয়ে এরপর বাসা থেকে বাইরে আসতেন। তাকে ফিটফাট দেখে অনুমান করা যেতো না যে, এতো কিছু কাজ তিনি বছরের পর বছর ধরে করে এসেছেন। তার স্ত্রী যখন রংপুর মেডিকেলে ভর্তি ছিলেন ঘটনাক্রমে ওই সময় মাস খানেকের জন্য আমিও পাশের একটি ক্যাবিনে ছিলাম। আমি দেখেছি নার্সরা যে কাজগুলো করতে অনীহা করতেন বিশুভাই আন্তরিকভাবে সেটা করতেন। বিশু ভাইকে তার সাহিত্য কর্মের চেয়ে মানবিক গুনাবলীর জন্য আমি সব সময় গভীর শ্রদ্ধা করতাম। অবশ্য তিনিও আমাকে বয়সে ছোট হলেও কেবলমাত্র মুক্তিযোদ্ধা হবার কারণে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতেন। তিনি সব সময় আমাকে একটি কথাই বলতেন মুকুল (মুজিব বাহিনীর উত্তরাঞ্চলীয় কমান্ডার বর্ণসজ্জার মালিক মুকুল মোস্তাফিজুর রহমান) চলে যাবার পর এখন আপনি ভরসা। “আপনারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান-এটা আমি মনে প্রাণে শ্রদ্ধা করি।”
তার অনেক ছড়া পত্রিকায় কিংবা বেতারে দেবার আগে আমাকে পড়ে শোনাতেন। আমি কোন লাইন বা শব্দ সংশোধনের জন্য যুক্তি দেখালে তিনি অবলীলায় মেনে নিতেন। তিনি এতো বড় মাপের একজন সাহিত্যিক হয়েও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমার পরামর্শ গ্রহণ করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। এতে আমি এক ধরনের গর্ববোধ করলেও কোনদিন কোথাও বলতে চাইনি। আজ আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি অধ্যাপক নুরুল ইসলাম স্যারের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন এ,কে,এম শহিদুর রহমান যিনি যে কোনো বিষয় ভিত্তিক গীতি নকশা বা গীতিকাব্য দ্রুত সময়ে লিখে দিতে সক্ষম ছিলেন। বিশেষ করে বাংলাদেশ বেতারের জন্য এ ধরনের ফরমায়েসী লেখার জন্য তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন।
এখন রংপুরে লেখক কবি সাহিত্যিক সাংবাদিকের সংখ্যা অনেক। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর সময়ে এ সংখ্যা ছিলো হাতে গোনা। বিশু ভাই তখন ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক। তিনি অভিযাত্রিক এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে এই সংগঠনটিকে প্রাণাধিক ভাল বাসতেন। অনেককে হাতে কলমে লেখক হিসেবে তৈরি করেছেন। এক পর্যায়ে তার প্রতি ভীষন অবিচার করা হয়। তার হাতে গড়া অভিযাত্রিক হাতছাড়া হয়ে যায়। সংকীর্ন মানসিকতার ব্যক্তিবর্গ প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের যথাযথ সম্মানটুকু দেখাননি বলে মাঝে মধ্যেই হতাশা ব্যক্ত করতেন। অবশ্য বর্তমান সময়ে যে কয়টি সাহিত্য সংস্কৃতি সংগঠন সক্রিয় রয়েছে তাদের সকলেই বিশু ভাইকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের আসনে রেখেছিলেন। এজন্য তিনি অনেকটা প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছিলেন। এবারে করোনাকালীন সময়ে তিনি প্রায় প্রত্যেকের খোঁজ-খবর রাখতেন। ফোন করে বলতেন সাবধানে চলাফেরা কবরবেন। এই সাবধানী মানুষটি আকস্মিক চলে যাবেন তেমন কোনো লক্ষণ ঘুর্ণাক্ষরেও টের পাওয়া যায়নি।
বিশু ভাই’র জন্য আমার হৃদয়ের কোনায় একটা কষ্ট সবসময় থেকে গেছে একারণে যে, তিনি এতো কষ্ট কীভাবে সহ্য করে এসেছেন। আমার চোখে এমন দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি আর দেখিনি। দুঃখ একটাই থেকে গেলো তিনি যেমনটি চেয়েছিলেন তার ছোট দুই ছেলের সম্মানজনক পুর্নবাসন। সেটা আর দেখে যেতে পারলেন না। এখন বিশু ভাই’র অনেক শুভাকাংখীদের মধ্যে কেউ না কেউ তার স্বপ্ন পূরনে নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবেন যা দেখে হয়তো তিনি শান্তিতে থাকবেন। নিশ্চয়ই মহান সৃষ্টিকর্তা এই সাদা মনের মানুষটিকে তার কুদরতী রহমত থেকে বঞ্চিত করবেন না ॥ আমীন, ছুম্মা আমীন॥

সেই সত্তুর আশির দশকে কারমাইকেল কলেজে পড়ার সময়ে কবি হিসেবে কলেজের কবি-মহলেই সীমাবদ্ধ ছিল আমার নাম। তিরাশীতে রংপুর থেকে পুরো বিচ্ছিন্ন হতে হয় কর্মজীবনে প্রবেশের কারণে। তারপরে ময়মনসিংহের প্রবাদ ‘চাকুরি কুকুরি পেশা/ ঘুরি দেশে দেশে..’-এর চরম বাস্তবতার মত সরকারি চাকুরির নিয়মে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে একসময়ে বদলিজনিত কারণে সেই স্মৃতিময় রংপুরে ফিরি প্রায় সাতাশ-আঠাশ বছর পরে ২০১০ এর জুলাইয়ে।
আর ‘পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে’র মত পড়লাম চাকুরিতে ‘দাসখত দেয়া’ এমন এক বসের কাছে, ঢাকায় পরিবার রেখে মফঃস্বলে চাকুরি করা যে অদ্ভুদ বস এই কর কমিশনার মহোদয় সময় কাটাতে অফিস করেন রাত দশ-এগারো এমন কি রাত বারোটা পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, ‘একা রামে রক্ষা নেই/ সুগ্রীব দোসর’-এর মত কর কমিশনার মহোদয়ের সঙ্গী আর এক অতিরিক্ত কমিশনার, যিনিও ‘ব্যাচেলারের’ মত তার বস এই কমিশনারের উপযুক্ত সঙ্গী!
কদিন না বলে চুপচাপ অফিস ছেড়ে সন্ধ্যার পরে চলে যাবার পরে সম্ভবত কমিশনার সাহেবের পরামর্শে এই অতিরিক্ত কমিশনার আমাকে পাকড়াও করলেন একদিন! সার্কেলের উপ কর কমিশনার হিসেবে তিনি আমার সরাসরি বস। আবার ‘হেড কোয়ার্টার, এডমিন’ হিসেবে কমিশনারও আমার সরাসরি বস। অতিরিক্ত কমিশনার আমাকে বোঝালেন যে, চাকুরিতে বস যতক্ষণ অফিসে থাকেন, ততক্ষণ অধঃস্তনকে অফিসেই থাকা অলিখিত নিয়ম। বস মাইন্ড করে বসলে চাকুরির ক্যারিয়ারে সমস্যা হয়। আর তিনি অতিরিক্ত কমিশনার হয়ে তার বস কমিশনারের সাথে রাত পর্যন্ত যেহেতু থাকেন, সেহেতু আমারও সন্ধ্যার পর পরই চলে না গিয়ে আমার এই দুই বসের সাথে রাত পর্যন্ত সঙ্গ দেয়া উচিৎ, যেহেতু আমিও তাদের দুজনের মতই রংপুরে পরিবার ছাড়া একা ‘ব্যাচেলার’ হয়েই অবস্থান করি…!
ফলে আমাকেও অফিস করতে হয় ‘হেড-কোয়ার্টার’ হিসেবে কমিশনার মহোদয়ের সাথে রাতে তার অফিসে ঐ অবস্থান করা সময় পর্যন্ত। ফলশ্রুতিতে রংপুরে পূর্বপরিচিত কবি, বন্ধুবান্ধব এমন কি আত্মীয়স্বজনদের কারো সাথে দেখা করারও সুযোগ হয় না আমার!
এরই মধ্যেই তবু কেমন করে যেন কবি ও সাংবাদিক বন্ধু মাহবুবুল ইসলাম খবর পেয়ে আমাকে এক সাহিত্য সভায় আমন্ত্রণ জানালেন এবং সেখানেই জ্যেষ্ঠ কবি ও ছড়াকার শহীদুর রহমান বিশুদার সাথে কয়েক যুগ পর আবার দেখা হয়ে যায়। সেই থেকে বিশুদার সাথে পূণঃযোগাযোগের শুরু!
বিশুদা আমার রাত্রিকালীন সময়েও অফিস করতে বাধ্য হওয়া বিষয়ক সমস্যার কথা জানতে পারেন, তাই তিনি সময় পেলে নিজেই আমার অফিসে এসে হাজির হন। সপ্তাহে কয়েকদিন আসেন তিনি নিয়ম করে। আর বাইরের পরিবর্তে আমার অফিসেই আড্ডা সেরে নিই আমরা।
এর মধ্যেই বিশুদা অবিরাম তাড়ায় আমার সেই কলেজ জীবনে লেখা কবিতাগুলো ঢাকার বাসা থেকে রংপুরে নিতে বাধ্য হই। তিনি এক সময় কবিতাগুলো সংগ্রহ করে নেন, বাছাই করেন। এরপর বাছাইকৃত কবিতাগুলো টাইপ করিয়ে নেন এবং ঢাকায় কবি আসাদ চৌধুরীর কাছে পাঠিয়ে দেন।
একদিন দেখি, আমার কবিতাগুলোর উপরে কবি আসাদ চৌধুরীর হাতে লেখা একটি মতামত নিয়ে আমার অফিসে হাজির দারুণ উৎফুল্ল বিশুদা- ‘আপনি তো বলেন আপনার কবিতা গ্রন্থাকারে প্রকাশের মত মানসম্মত নয়! এই দেখেন কবি আসাদ চৌধুরী কি লিখে পাঠিয়েছেন আপনার কবিতা সম্পর্কে..!’
আসাদ চৌধুরীর মতামত পড়ে আমি হতভম্ভ হয়ে পড়ি! তিনি আমাকে ‘কবি’ শিরোপা পরিয়ে দিয়ে অভাবনীয় এক ভূমিকা লিখে পাঠিয়েছেন বিশুদার কাছে। আর কী খুশি বিশুদা! যেন বিশ্ব জয় করে ফেলেছেন। এ যেন আমার নয়, তার বিশ্ব জয় করে ফেলা! আর বিশুদার উৎসাহ এবং প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জীবন সংক্রান্ত শব্দ’ প্রকাশ পেল আমাকে কবি হিসেবে পরিচিতি দিয়ে। সেই আমার কবি হিসেবে বাইরে আত্মপ্রকাশ বিশুদার হাত ধরে!

হঠাৎ বাজলো বিদায়ের বাঁশি। এমন করে চলে যাওয়া যায় ভাবতে পারিনি। এই তো সাতই আগস্ট বিকেলে কথা হলো ফোনে। বললেন- খুশীর কথা, বললেন- ভাই মনে থাকবে ভালো কাজগুলো। তারপর কী এমন হলো, চির প্রস্থান! জানার সুযোগ হয়নি ঘুনপোকা কতটা ক্ষয়ে দিয়েছিল শরীরবৃত্ত। বিশুদা আপনি তো শুনিয়েছেন বরাভয় বাণী- করোনা সময়ে প্রায়ই ফোনে বলতেন-‘ভাই সাবধানে থাকবেন। আপনি বিজ্ঞ মানুষ, সাহিত্য নিয়ে অনেক কাজ করতে হবে, গবেষণামূলক কাজগুলোতে হাত দিতে হবে।’ বিশুদা আমি আমরা তো মন্দ নেই, আপনার শুভতার আশার চেরাগ এখনও জ্বলছে। তা হলে হঠাৎ কেনো আঁধারের পথ ধরে আপনি অন্য ভুবনে। কেউই তো বললো না, আপনার জরাব্যাধির কথা। হঠাৎ নিঃশব্দে প্রস্থান। আমাদের সাহিত্যের পথপ্রদর্শক আপনি। কত কথা কত স্মৃতি। অভিযাত্রিক ছিল আপনার প্রাণের সংগঠন। ছাত্র জীবনে আমারাও অনেকেই সঙ্গী হয়েছি আপনার। কত গান, কথকতা, হাসি আনন্দ। সাংগঠনিক কর্মধারায় যে বেদনা, সেও তো জীবনেরই অনুসঙ্গ।
বিশুদা সংসার জীবনে আাপনি নীলকণ্ঠ, যাতনার ছিটেফোঁটা বাইরে প্রকাশিত হতে দেখিনি কোনোদিনই। এত হাসির, খুশির ঝর্ণা আপনার মন-পাহাড় থেকে কেমন করে ঝরত সে দীক্ষা নেয়া হয়নি জন্য যাতনা জাগছে।
আপনার কাছে আমার ঋণের বোঝা অনেক ভারী। সাহিত্যিক হবার যে বাসনা সে কি আপনার প্রেরণায় প্রতিদিন সজীব হয়নি! আমার প্রথম গল্পের বই ‘বৈরী বাতাসে স্বপ্নেরা’ সে শুধু আপনার নিত্য তাগিদের ফসল। আমার কৃতিত্ব তাতে নগন্য। প্রায় প্রতিদিন আমার বাসায় আসতেন, আর লিখবার তাগাদা দিতেন। ‘লেখেন, কাজে লাগবে।’ তারপর নিজ দায়িত্বেই গ্রন্থটি প্রকাশের দায়িত্ব নিয়ে আলোর মুখ দেখিয়েছেন সে তো আপনিই। তারপর কারমাইকেল কলেজের বাংলা বিভাগের উদ্যোগে প্রকাশনা উৎসব আয়োজনে কত কাজ, কত পরিকল্পনা।
মনে পড়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে আপনার লেখা নাট্যালেখ্য ‘নইওরী’ রেকর্ডিং হবে। টেলিভিশন থেকে কর্মকর্তাগণ এলেন, মহড়া চলছে। আপনি নিজেই দেখাচ্ছেন কেমন ভঙ্গিতে নাচ হবে, অভিনয় কেমন হবে। আর ওই যে আপনার গান- ‘ আহা কি সুন্দর ফুইটাছে ফুল বাগানে /সেই বাগান বানাইছে বিধি এইখানে’। আমারা দিনরাত থেকে শেষে সম্পন্ন হয়েছে রেকর্ডিং। আপনার সেকি আনন্দ। আর আপনার স্বভাবসুলভ ধন্যবাদ। বিশুদা বলুন তো কেমন করে অকাতরে মানুষের প্রশংসা করা যায়? আপনার চেয়ে আমরা অনেকেই ছোট। কিন্তু আপনি তো কখনো সম্মান দিতে কুণ্ঠিত ছিলেন না। আমাকে ডাকতেন আলম ভাই বলে। নাম ধরে ডাকলেই তো চলতো। তবু আপনার পক্ষেই সম্ভব সম্মান জানানো।
বিশুদা আর আপনার ফোন পাব না, জানতে চাইবেন না, বানানটা শুদ্ধ কী না, গ্রন্থটির নাম কী দেয়া যায়, ছন্দময়তা বিষয়ে কথা হবে না।
বিশুদা আপনি নীরব হলেও কর্ম তো সরব। আপনার সান্নিধ্য আমাদের অগ্রগামী করেছে, সজীব করেছে। ধূপের মতো পুড়ে আপনি বিলিয়েছেন সাহিত্য সুবাস। ছড়ার ছন্দের প্রতি আপনার সজাগতা আমাকে দারুণ ভাবাতো। এত গভীর নিষ্ঠা নিয়ে লেখার প্রয়াসের পাতা তো বন্ধ হলো, আমরা কী সে পাতা খুলতে পারবো। আপনার ছড়ার পাতা থেকে ছড়ার চরণ তুলে ধরার লোভ বাঁধ মানছে না। ‘গোলকধাঁধা’ ছড়ার বইটি তো পুরোটাই শিশু মনের খোরাক। বড়রাও মুখ ঘুরিয়ে নেবে তা বললে অপরাধ হবে আমার। আপনি অসাধারন যত্নে লিখেছেন শরৎ, চৈত্র, বৈশাখী মেলা, শীত কাতরতা নিয়ে। আপনার চিত্রায়নে বৈশাখী মেলা যেনো জীবন্ত-
‘ঢাক বাজে গো শাখ বাজে গো
আশপড়শি ঐ ডাকে
কী যে মায়ায় বটের ছায়ায়
বছর শুরু বৈশাখে।..
সোলার পাখি বলছে ডাকি
দেখ-রে চড়ুই-টুনটুনি
বোশেখ মেলায় রঙের খেলায়
খুড়োর হাতের ঝুনঝুনি।
এতে বোধকরি নিজের বাল্য স্মৃতির রোন্থন আছে। শিশুদের মতো হয়ে তাদের মনের আকাক্সক্ষা কতটা সজীবতা দিয়েছেন তা বুঝি নিজেও আন্দাজ করতে পারেননি। তবে আমরা বুঝেছি আপনি যথার্থই বুঝেছিলেন শিশুদের মনের ভাষা। ঈদে নতুন জামা দেরিতে পাওয়ায় শিশুদের গোমরা মুখ, কারিগরি শিক্ষার সুফল, দাাঁতাল দৈত্য, ভূত, প্রেত, ভয়, শঙ্কা,পরির সাথে কথকতা শিশুর যে নিত্য ভাবনার বিষয়। সে ভাবনাগুলো কেমন করে লালন করেছেন বিস্মিত হয়ে ভাবি। ছন্দের অসাধারণ দোলা সেও তো কম অবাক করে না। ‘গোলক ধাঁধা’ ছড়াটা পড়লেই ছন্দের সাথে ছোটা ছড়া কোনো গত্যন্তর থাকে না।
‘ধন্দ ধাঁধার
ছন্দ ধাঁধার
মজার খেলা।
দেখেন দাদা
গোলক ধাঁধা
ধাঁধার মেলা।..
যারে ছক্কা
টরে টক্কা
টক্কা টরে।
দ্যাখেন দাদা
গোলক ধাঁধা
তো-পান্তরে।’
এমন উদাহরণ কী দু‘একটি? না। তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে বিশুদা। আপনার নামের শেষে ‘বিশু’ প্রসঙ্গ আসলে আমার খুব মনে পড়ে নজরুলের কাণ্ডারী হুঁশিয়ার কবিতার চরণ-‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন/ কাণ্ডারী বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মেরার মার।’ এ কে এম শহিদুর রহমানে কোনো গোল নেই, যখনই বিশু, বিশুদা তখনই মানুষের প্রশ্ন উনি কী হিন্দু। আমরা এমন কতবার মানুষকে বুঝিয়েছি না উনি মুসলিম।
বিশুদা বই মেলায়, সাহিত্য উৎসবে, চায়ের আড্ডায় আপনার সরবতা আমাদের ভুলিয়ে দিয়েছে আপনি আশির কোঠা অতিক্রম করেছেন। আপনার সাংগঠনিক কর্মধারার স্রোত স্নিগ্ধ করেছে আমাদের। উপদেশগুলো মনে থাকবে পরমভাবে। আপনার শোকসভায় অনেক মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করেছে আপনার প্রিয়তার কথা। সবাই যোগ দিয়েছেন করোনা কালের বাধা ডিঙিয়ে। সে শুধু আপনার প্রতি অনুরাগের জন্য সম্ভব হয়েছে। আপনার প্রিয় জোট ‘সম্মিলিত লেখক সমাজ’ এর উদ্যোগেই ১২আগস্ট-২০ হয়েছে শোকসভা ও দোয়া মাহফিল। চোখের জল ঝরেছে অনেকের। সবার বুকেই বেদনার ভার, মুখে ভালোবাসার কথা। এমনটা সবার ভাগ্যে জোটে না বিশুদা।
নজরুল বলেছেন ‘ওগো যাবে যাও মিছে ব্যথা পেয়ে যেও না’,- বিশুদা আপনিও অভিমান করে ব্যথা নিয়ে থাকবেন না। আপনার যোগ্য সম্মান দেবার যোগ্য হতে হয় তো পারিনি। তা বলে চেষ্টা ছিল না সে তো নয়। অভাব, পত্নী বিয়োগ যাতনা, সন্তানের চাকরি নেই সে উৎকণ্ঠা, নিজের মধ্যে নানা দোলাচল খুব কষ্ট দিয়েছে বুঝি। আমরা তখন পারি নি, এখন তো দায় আমাদের। শোকসভায় আপনার পরিবারের জন্য ভালো কিছু করার প্রতিশ্রুতি এসেছে। হয় তো ভালো কিছু হবে।
শেষ জীবনে রবীন্দ্র চর্চা করতেন। ফোনে রবীন্দ্র সাহিত্যের নানা দিক জানতে চেয়েছেন। আপনি বোধকরি জেনেছেন রবীন্দ্র ভাষ্য- ‘কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধনমান’। তাই বুঝি আমাদের ছেড়ে এমন সমর্পণ।
নতুনদের বোঝাবার, সাহিত্য সারথি হবার প্রেরণা দেবার একজন মানুষ বেঁচে থাকা খুবই জরুরী ছিল। তা হলো না। আপনি ছড়াকার, গীতিকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, উত্তরমেঘ সম্পাদক, বেতার ব্যক্তিত্ব, দক্ষ সংগঠক, অভিনেতা, সর্বোপরি ভালোমানুষ। অনেক লেখককে সফল্যের পথ দেখিয়ে আপনি গুরুর আসনে আসীন হয়েছেন। তাঁরা শ্রদ্ধায় অবনত, তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত আপনারই গুণগাথা।
আপনি সান্নিধ্য পেয়েছেন ছান্দসিক কবি কাজী কাদের নেওয়াজ, পল্লীকবি জসিমউদ্দীনের। বিশিষ্ট সাহিত্যিক জহির রায়হান, কবি বেনজির আহমেদের সাথেও ছিল আত্মিক সম্পর্ক। আমরা পেয়েছি, এ প্রজন্মের অনেকেই পেয়েছে আপনার সান্নিধ্য। আপনি যেমন আনন্দ পেয়েছেন আপনাকে পেয়ে আমাদের আনন্দ ও আশার পালে বিপুল হাওয়া লেগেছিল। এখন পাল আছে হাওয়াটাই হাওয়া হয়ে গেল। এমন বেদনা কোথায় রাখব জানি না। যাতনাঘেরা হৃদয়ে সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা পারলৌকিক সময়গুলো যোনো স্বস্তিময় হয়। ভালো থাকুন বিশুদা, আপনার অনেক আলোর ঝলকানি মেখে আমরাও আপনারই আদর্শের পথ চলতে চাই।

“আপনার আম্মা কেমন আছে? আপনি খুব ভাগ্যবান। আপনার আম্মা আপনার সাথে আছেন। মায়ের যত্ন নিবেন। আপনাকে আমার খুব ভাল লাগে। আরেকজন আরডি ছিলেন। খুরশিদ আলম চৌধুরী। তাকেও আমার খুব ভাল লাগতো।”এই কথাগুলো যিনি বলতেন তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। ৮০ বছরের এক তরুন যুবা যেন আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিল। বয়স ৮০ হলেও মন মানসিকতা আর চিন্তা ভাবনায় তিনি ছিলেন ২৫ বছরের বলিষ্ঠ যুবক। বলছিলাম, বিশিষ্ট বেতার ব্যক্তিত্ব, নাট্যকার, গীতিকার, ছড়াকার, সাহিত্যিক, সংগঠকসহ বহুগুণে গুণান্বিত আমাদের সকলের প্রিয় শহীদুর রহমান বিশু ভাইয়ের কথা।
এই আগষ্ট মাসেই তার সাথে আমার বেশ কয়েকটি কাজ করার কথা ছিল। তিনি রাগ প্রধান গান রচনা করছেন, এগুলো রাজশাহীর এক নজরুল শিল্পীকে দিয়ে করাবেন। বাংলা গজল লিখেছেন, কাওয়ালী শিল্পী দিয়ে করাবেন। এমনই কথা ছিল। বলেছিলাম, “ঈদের পর পরই আমরা আগের মতো পুরো প্রোগ্রামে যাচ্ছি তখন এগুলো করা যাবে। আর হ্যাঁ, আপনি আমাকে নাটক দিন, নাটক করবো।” নাটক ও তিনি লিখছিলেন। কিন্তু সেটা আর হলোনা। সবাইকে কাঁদিয়ে এভাবেই তিনি আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিলেন।
জীবনে অনেক কিছুই করেছেন বিশু ভাই। এমনকি অভিনয় করেও প্রশংসা পেয়েছেন। ‘হারানো দিন’ ছায়াছবির বিখ্যাত অভিনেতা নায়ক রহমান তার অভিনয়শৈলীতে মুগ্ধ হয়েছিলেন। মিলন ছবিতে তার সাথে অভিনয়ও করেছেন। একথা তিনি মাঝে মাঝেই বলতেন।বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ লাখী আকন্দের সাথে ছিল তার বেশ ভাল সম্পর্ক। রংপুর বেতারে পোস্টিংকালীন একসাথে গান করেছেন। লাখী আখন্দ তার বাসায় থেকেছেন, খেয়েছেন।
রেডিওর সাথে ছিল তার আজীবনের সম্পর্ক। ১৯৬৬ সালে শুরু। রাজশাহী বেতারে, তালিকাভুক্ত গীতিকারের মধ্যে দিয়ে। তারপর বেতারের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করেছেন সদর্পে। কথিকা, গান, গীতিনকশার পাণ্ডুলিপি, নাটকে অভিনয়, নাটক লেখা, কবিতা, ছড়া, ছোটদের অনুষ্ঠানের পাণ্ডুলিপি কত কি। তার ছিল শিশুর মত মন। তাইতো শিশুদের নিয়ে কত ছড়া লিখছেন। আমার বাচ্চাদের দিয়েছেন।
কত গল্প হতো আমাদের মাঝে। পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করতেন তিনি। সে চাকরির কথা, পরহেজগার বাবার কথা, তার উপদেশের কথা, আধ্যাত্মিক কিছু ক্ষমতার কথা, স্ত্রী, ছেলে, ভাইয়ের কত কথাই না তিনি বলতেন। সব চোখের সামনে ভাসছে। ইসলামি গান, গজল নিয়ে তার বেশ আগ্রহ ছিল। একবার শাকিল কাওয়ালের এক দলকে ধরে নিয়ে আসলেন এক সন্ধ্যায়। আমরা বেতার পরিবার শাকিল কাওয়ালের পরিবেশনায় তার লেখা ইসলামি গান ও কাওয়ালী উপভোগ করলাম। সবই এখন স্মৃতি। আর কে এভাবে গান শোনাবে?
তিনি সৃষ্টিশীল লোক ছিলেন। সৃষ্টি নিয়ে নানা ভাবনা ছিল তার। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় ছিল অবাধ বিচরণ। উপন্যাস লিখেছেন, আমাকে দিয়েছেন, উৎসাহিত করেছেন পড়তে। এমনকি পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে এসেও আমাকে পড়তে দিয়েছেন। ইতিহাস নিয়েও তার কৌতুহলের শেষ ছিলনা। গল্প করতেন জমিদারদের কথা। একবারতো তার কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাথে সায়থে বেড়িয়ে পড়েছিলাম প্রাচীন জমিদারবাড়ি দেখতে শ্যামপুরে। সাথে নিয়েছিলাম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. শফিক আশরাফকে। দুই ভাই -বন্ধুর সেদিনের ভ্রমনের কথা বারবারই মনে পড়ছে এ অনুক্ষণে।
তিনি খুব যত্ন করে স্ক্রিপ্ট লিখতেন। যে কথিকাই দেয়া হোক না কেন, সেটা নিয়ে পড়াশোনা করে তারপর লিখতেন, বর্তমানে যার বেশ অভাব। হাতের লেখাও ছিল চমৎকার। ঈদের পরে রাগ প্রধান গানগুলো করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা আর হলো কই? কষ্টই রয়ে গেল শুধু।
তিনি নবীন লেখকদের উৎসাহিত করতেন। অনেককে সাথে করে নিয়ে এসেছেন আমার কাছে। এই আমাকেও তিনি লেখার জগতে নিয়ে আসার কত চেষ্টা করেছেন। আমার চায়না ভ্রমন নিয়ে শহীদুর রহমান ভাইয়ের ছিল দারুন আগ্রহ। লিখতেই হবে ভ্রমন কাহিনী। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ পড়তে দিয়েছেন। তবু আমাকে লিখতে হবে। চীন ভ্রমনের সময় ডায়রি লিখেছিলাম। ভাবছি ভাইয়ের কথা রক্ষার্থেও আমাকে কাজটি সম্পন্ন করতে হবে।
সামাজিক এই মানুষটি করোনার দুঃসময়েও খোঁজ নিয়েছেন আমাদের। আমার ফোন করার আগে তিনিই করতেন। লজ্জায় ফেলে দিতেন।
শহীদুর রহমান ভাইয়ের স্ত্রী মারা যাবার আগে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ছিলেন। খুব সেবা যত্ন করেছেন স্ত্রীর । যৎকিঞ্চিত সাহায্য করেছি, কিন্তু বিনয়ের বাড়াবাড়ি ছিল। সৎ জীবন যাপন করতেন তিনি। নিজে রান্না বান্না করতেন। ছেলের লেখাপড়া, কেরিয়ার নিয়ে চিন্তা করতেন তবে হতাশ ছিলেন না কখনো।
মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মে। তার কর্মের ব্যাপ্তি অনেক/বিশাল। সাহিত্যের প্রতিটি স্তরে তার ছোঁয়া রয়েছে। তার লেখা গান যুগ যুগ ধরে গাইবে শিল্পীরা। তার লেখা নাটক শ্রুত হবে শ্রোতার মাঝে। সাহিত্য পঠিত হবে পাঠকের মাঝে। এভাবেই তিনি বেঁচে রইবেন আমাদের মাঝে।

ছড়াশিল্পী একেএম শহীদুর রহমান বিশু আর নেই। ২০২০ সালের ৯ আগস্ট সকালে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। খবরটা পেলাম কবি আবুবকর সালেহ’র ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে। পরে ফোনে কথা বলে বিস্তারিত শুনলাম। কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়েছিলাম। তবুও মহান আল্লাহর নিয়ম মেনেই নিতে হবে। সত্যিকার অর্থে আজ পতন হলো এই সময়ের ছড়া সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের। তাঁর সাথে আমার বেশ কিছু স্মৃতি বেদনার জন্ম দিচ্ছে। মহান আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করুন এবং জান্নাত নসিব করুন। আমিন।
উল্লেখ্য, একেএম শহীদুর রহমান বিশু ছিলেন একাধারে কবি ছড়াকার গীতিকার নাট্যকার ও নাট্য শিল্পী। তিনি ১৯৪১ সালের ১৯ জানুয়ারি রংপুরের মুন্সীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মুহাম্মদ নছিমুদ্দিন আহম্মেদ ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। তিনিও ছিলেন গীতিকার, সুরকার ও সংগীত শিল্পী। মাতা সাহেরা খাতুন ছিলেন গৃহিনী। বাবা মায়ের তৃতীয় সন্তান বিশু। বাবার হাত ধরে সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে প্রবেশ করেন তিনি। ১৯৫১ সালে ৫ম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় বাবার চাকরিসূত্রে বগুড়ার নন্দীগ্রামে কবিতায় হাতেখড়ি। প্রথম কবিতায় তিনি লেখেন- ‘হে বিশ্বচালক তুমি হে মহান/ তোমারই কাছে সকলের সম্মান’। সেই থেকেই তাঁর লেখালেখি চলমান। ১৯৫৮ সালে বগুড়ার গাবতলী হাইস্কুলে ছাত্রাবস্থায় তার প্রথম ছড়ার বই ‘অর্পণ’ প্রকাশিত হয়। ষাট দশকের প্রথম দিকে দিনাজপুর জেলা স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক কবি কাজী কাদের নেওয়াজ ও নাজিমুদ্দীন হলের প্রতিষ্ঠাতা হেমায়েত আলীর আহবানে প্রতি শুক্রবার নওরোজ সাপ্তাহিত সাহিত্য আসরে কবিতা পড়তে উপস্থিত হতেন।
১৯৬৩ সালে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘অপেক্ষা’ প্রকাশিত হয়। কবি জসিমউদ্দীন এই গ্রন্থের পা-ুলিপি দেখে দিয়েছিলেন এবং ভূমিকা লিখেছিলেন কবি কাজী কাদের নেওয়াজ। তিনি ছিলেন সফল অভিনেতা। ১৯৬৪ সালে চিত্রনায়ক রহমানের ‘মিলন’ ছায়াছবিতে অভিনয় করেন তিনি। চিত্রনায়ক জহির রায়হান ও কবি বেনজির আহম্মেদের ভীষণ প্রিয়ভাজন মানুষ ছিলেন তিনি। ১৯৬৬ সালে তিনি তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান রাজশাহী কেন্দ্রের অনুমোদিত গীতিকার হন। ১৯৬৭ সালে রংপুর রেডিওতে তাঁর ঈদের গান শিল্পী খাদেমুল ইসলাম বসুনিয়ার কণ্ঠে প্রচারিত হয়। রংপুর ও রাজশাহী রেডিওর জন্য তিনি অসংখ্য ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতি, আধুনিক, বাউল, ইসলামী, ভাটিয়ালী, ঠুমরি, বাংলা রাগ-প্রধান, কাওয়ালী ও গজলসহ নানা ধরনের গান, গীতি-নকশা ও নাটক লেখেন। তাঁর গান বিটিভিসহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছে। তাঁর গ্রন্থনা ও পরিচালনায় ‘রংপুরের জারী, ‘নাইওরী’ গীতিআলেখ্য ১৯৮৪-৮৬ পর্যন্ত এবং ২০১৬ সালে গবেষণামূলক অনুষ্ঠান ‘আলোকিত রংপুর’ বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়।
সাহিত্যচর্চার সবুজ মাঠ হিসেবে তিনি ১৯৭৮ সালের ৫ মে প্রতিষ্ঠা করেন অভিযাত্রিক সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংসদ। ২০০৩ সাল পর্যন্ত এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি অভিযাত্রিক সাহিত্য সংকলনের সম্পাদক এবং রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকার সহসম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০-৯৬ পর্যন্ত দেনিক যুগের আলো পত্রিকার সাহিত্য পাতার দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ তিনি ‘উত্তরমেঘ’ মাসিক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন।
একেএম শহিদুর রহমানের শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ ‘ছবি ও ছড়ায় ছয় ঋতু’। ২০১৭ সালে রংপুরের পাতা প্রকাশ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে। এছাড়াও ২০১৭ সালের বই মেলায় তাঁর ‘গোলক ধাঁধাঁ’ ‘চম্পাকলি ও রাজকন্যা’ নামে আরো দুটিগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ২০১৮ সালের বইমেলায় ছোটদের গুণিজন জীবনী গ্রন্থ ও উপন্যাস ‘স্পর্শ’ প্রকাশিত হয়। ‘ছবি ও ছড়ায় ছয় ঋতু’ গ্রন্থে ছড়ায় ছড়ায় শিশুদের সামনে বাংলাদেশের ছয়টি ঋতুকে দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। বৈশাখ ও জৈষ্ঠমাস ছড়ায় তিনি বলেন-
গ্রীস্মের খরতাপ রোদ্দুর
জনহীন জলাশয়/ পথঘাট ধুলিময়
ওই দূর দেখা যায়- যদ্দূর।
ধূ-ধূ মাঠ প্রান্তর/ পুড়ে যায় অন্তর
ঘাম ঝরে দিনভর-তেষ্টায়
যায় বুঝি যায় প্রাণ শেষটায়।
ছড়াশিল্পী একেএম শহিদুর রহমানের অনবদ্য ছড়াগ্রন্থ ‘চম্পাকলি ও রাজকন্যা’। ছড়াগল্পে শিশুদের মাতিয়ে রাখার মতো একটা ছড়ার বই এটি। বিশ্বায়নের এ খরস্রােতা সময়ে আমাদের শিশুরা যখন ভার্চুয়্যাল জগতে উড়াল দিতে ব্যস্ত তখন ছড়ার আমেজে গল্প আসরে ফিরিয়ে আনতে সফল প্রয়াস চালিয়েছেন এ প্রবীণ ছড়াকার। ২০১৭ সালের বইমেলায় তাঁর গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন অনুজপ্রতীম শিশুসাহিত্যিক ও ছড়াকার কাদের বাবু ‘বাবুই প্রকাশনী, ঢাকা থেকে। ছড়ার সূচনাটা করেছেন অসাধারণ আবহে। তারপর চম্পাকলি পরীর নামকরণ এবং চেহারা বিবরণসহ বিভিন্ন লঙ্কাকা-ের বিবরণ দিয়েছেন। চম্পার পরিচয়ে তিনি বলেন-
এবার বলি/ চম্পাকলি
নাম ছিলো সে পরির
জোসনা মাখা শরির।
কাঁদলে পরে/ মুক্তো ঝরে
হাসলে চোখে পানি
পান্না ঝরে জানি।
শেষপর্বে এসে দারুণ চমক দিয়েছেন কবি একেএম শহিদুর রহমান। নানাবিধ বিড়ম্বনার পওে হলেও তিনি নায়ক-নায়িকার মিলন ঘটিয়েছেন নাটকীয় ঢঙে। তিনি শেষঅংশে উল্লেখ করেনÑ
দোলায় চড়ে/ শা-নজরে
চম্পাকলি হাসে/ কুমার তাহার পাশে
অই সে দূরে/ পালকি উড়ে
যাচ্ছে হাওয়ায় ভেসে
অচিন রাজার দেশে।
শিশুতোষ ছড়ায় যেমন তিনি নতুন স্বপ্নের বীজ বুনে দেন শিশুদের সামনে তেমনি সামাজিক অসঙ্গতিকে ছড়ার চাবুকে শায়েস্তা করতেও পটু তিনি। ২০১৫ সালের ১৮ এপ্রিল দৈনিক সমকালে প্রকাশিত হয় তেমনি একটি চাবুকছড়া। দখল নামে প্রকাশিত সেই ছড়ায় তিনি সাহসের সাথে উচ্চারণ করেন সমস্ত অবৈধ দখলদারিত্বের প্রতিবাদে। তিনি লেখেনÑ
দখল দখল/ জমি দখল/ পাড়ায় পাড়ায়
দখল এবার/ চেয়ার দখল/ মানুষ হারায়
আগুন আগুন/ জ্বলছে আগুন/ কৃষ্ণচূড়ায়
দেখছে লোকে/ কেমন শোকে
ঝরছে পানি/ ‘নিরো’ও চোখে/ প্রসাদ চূড়ায়।
লেখক এবং সংগঠক হিসেবে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেও মূল্যায়নের খাতা তাঁর সমৃদ্ধ নয়। আমরা কেউ তাঁকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারিনি। করতে পারেনি দেশের কর্তাব্যক্তিগণ। করতে পারিনি আমরা যারা সাধারণ মানুষ। তবু তিনি যোগ্যতা বলে নিজেকে প্রশস্ত করে গেছেন। তিনি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা সংগঠন কর্তৃক পদকপ্রাপ্ত হয়েছেন। দেশের বাইরে ভারতের শিলিগুড়ি, আসাম, গৌরীপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলেও সংবর্ধিত হয়েছে সাহিত্যেও গুণিমানুষ হিসেবে। ২০১১ সালে তিনি রংপুর পৌরসভার সিনিয়র সিটিজেন এওয়ার্ড এবং ২০১৫ সালে ‘রঙধনু ছড়াকার সম্মাননা’ ও সম্মিলিত লেখক সমাজ রংপুরের বইমেলায় গুণী সাহিত্যিক হিসেবে সম্মাননা পান। এছাড়া পল্লীকবি জসিম উদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার ও ২০১৭ সালে ছড়া সংসদ থেকে বিশিষ্ট ছড়াকার সম্মাননা, ২০১৮ সালে রফিকুল হক দাদু মৌচাক ছড়া সাহিত্য সম্মাননাসহ বিভিন্ন সম্মানে ভূষিত হন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই কন্যা ও তিন পুত্রের জনক। তাঁর ছড়া সাহিত্য অত্যন্ত উঁচু মানের। তাঁর মৃত্যুতে সাহিত্য অঙ্গণের অনেক বড় ক্ষতি সাধিত হলো।

একজন জীবন সংগ্রামী মানুষ তিনি। জীবনের একটা কষ্ট তাঁকে তাড়িত করে চলছে সারাজীবন। চাকরিজীবী পিতার অসুস্থতার কারণে এক সময় তাঁদের সংসারে নেমে আসে তীব্র অর্থ সংকট। তাঁর এসএসসির ফরম পূরণ চলছিল। টাকার প্রয়োজন। পিতা ফরম ফিলাপের টাকা দিতে পারেন না। অগত্যা উপায় অন্ত না পেয়ে তিনি হাত পাতেন একে একে আত্মীয় স্বজন ও পরিচিতদের কাছে। প্রয়োজন তখনকার দিনের মাত্র আশি টাকা। কিন্তু এই আশি টাকা আর পাওয়া যায় না। টাকার অভাবে এসএসসির ফরম ফিলাপ আর করতে পারেন না। অংশ নিতে পারেননি শুধু কয়েকটা টাকার জন্য এসএসসি পরীক্ষায় মেধাবি এক ছাত্র। এখনো এ কথা সবসময় হৃদয়ে খোঁচা মারে। যন্ত্রণায় দগ্ধ করে। ঝরায় চোখের পানি। তিনি এ কথা বলতে বলতে আর আবেগ, কষ্ট ধরে রাখতে পারেন না। ঝরঝর করে ঝরতে থাকে চোখের পানি।
বলছিলাম বিশিষ্ট সংগঠক, ছড়াকার, লেখক ও অভিনয় শিল্পী একেএম শহীদুর রহমান বিশুর কথা। জনাব বিশু রংপুরের সাহিত্য ও সাহিত্যি অঙ্গনে এক ছায়াবৃক্ষ। একজন আলোকিত সাদা মনের মানুষ।
১৯৪১ সালে রংপুর শহরের মুন্সীপাড়ায় জন্ম শহীদুর রহমান বিশুর। পিতা নছিমুদ্দিন আহম্মেদ ও মাতা সাবেরা খাতুন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন অনেকদিন আগে। বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিতে। চাকরির পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন সংগীতমনা মানুষ। গায়কির পাশাপাশি গীতিকার ও সুরকার হিসেবে বাবার পরিচিতি ছিলো বেশ। আর তাই সংস্কৃতি ছোটবেলা থেকেই উদ্বুদ্ধ করেছিল জনাব বিশুকে। প্রাথমিক শিক্ষাটা মুন্সীপাড়া প্রাইমারি স্কুলে শুরু করেন। কৈলাশ রঞ্জন হাই স্কুলেও ছিলেন কিছুদিন। এরপর পিতার বদলি কারণে একসময় বগুড়ায় কিছুদিন পড়াশুনা করতে হয়। কিন্তু পিতার অসুস্থতার কারণে অর্থাভাবে ফরম ফিলাপ করতে না পারার কারণে তার ম্যাট্রিকুলেশন দেয়া হয় না। পরবর্তীতে ৭২-এ প্রাইভেটে এসএসসি এবং নাইট কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। তাঁর জীবনে সাহিত্যের একটা বড় ভূমিকা আছে। ১৯৫১ সালে পিতার চাকরিসূত্রে বগুড়ার নন্দীগ্রামে তখন থাকতেন। পঞ্চম শ্রেণীতে থাকতেই একদিন লিখে ফেললেন একটি কবিতা। ৫৮ সালে বগুড়ার গাবতলীতে থাকতে হাইস্কুলের ছাত্রাবস্থায় প্রকাশিত হয় তাঁর ছড়ার বই ‘অর্পন’। এরপর লেখা নিয়ে ঘটে তাঁর জীবনে এক আশ্চর্য ঘটনা। ৬৩ সালের দিকে। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় তাঁর একটা কবিতা প্রকাশিত হয়। সে কবিতাটা পায় বেশ পাঠকপ্রিয়তা। একদিন রংপুর শহরের তাঁর পরিচিত একজনের দোকানে এই কবিতাটা নিয়ে কথা হচ্ছিল। এ সময় এক ব্যক্তি( গোলাম রব্বানি। উনি সংগীত শিল্পী এবং পাউবোর হেড ক্লার্ক ছিলেন) তা আগ্রহ নিয়ে দেখে প্রশংসা করেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, তোমার হাতের লেখা সুন্দর তুমি চাকরি করবে? অবাক হয়ে যান জনাব বিশু। চাকরিটা তখন খুব প্রয়োজন ছিল। তিনি রাজি হলেন। পেলেন যোগদান পত্র। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তিস্তা প্রজেক্টের ডালিয়া অফিসে যোগদান করতে বলা হয়েছে। এখানেও বাঁধলো সমস্যা। ডালিয়া যাবেন ও থাকবেন সেই খরচের টাকাও সাথে নেই। এই সমস্যার কথা জেনে তখন রংপুর জিলা স্কুলের আলিমুদ্দিন নামের এক পিওন ওনাকে বুদ্ধি দিলেন, স্কুলের বেঞ্চে জঔঝ লিখে দিলে কিছু টাকা পাবেন। একেক লেখা দুই আনা। রং কিনবেন সেই টাকাও নেই। একজনের সহায়তায় এক দোকান থেকে বাকিতে রং এনে বেঞ্চে লেখার কাজটা করলেন। বিল পেলেন ১১০ টাকা। ৬৩ সালে এ টাকা অবশ্য বেশ কাজের ছিল। বাসায় খরচের জন্য কিছু টাকা দিয়ে তিনি গেলেন চাকরি জীবন শুরু করতে। নব্বইয়ের দশকে এই তিস্তা প্রজেক্ট থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। চাকরিতে শেষ পর্যন্ত পদোন্নতি পেয়ে এস্টিমেটর হয়েছিলেন। অত্যন্ত সততার সাথে কেটেছে তাঁর চাকরি জীবন। এখনো আছেন ভাড়া চালা বাড়িতে। পড়াশুনার সময় কিছুদিন জায়গীর পর্যন্ত থাকতে হয়েছিল।
লেখালেখি চলছিল সেই স্কুল জীবন থেকেই। ৬৩ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘অপেক্ষা ‘ কাব্যগ্রন্থ পল্লী কবি জসীমউদ্দীন একটু সম্পাদনা করে দিয়েছিলেন। তিনি সংস্পর্শে এসেছিলেন অনেক গুণী মানুষের। কবি বেনজীর আহমেদ ও কবি কাদের নেওয়াজ তাঁকে ছন্দ বিষয়ক শিক্ষা দেন। সাহিত্যের প্রতি ছিল অমোঘ টান। রংপুর থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার রাতের ট্রেনে যেতেন দিনাজপুর। উদ্দেশ্য থাকতো শুক্রবারের নওরোজ সাহিত্য আসরে অংশ গ্রহণ এবং নিজের লেখা পাঠ করা ও সমালোচনা শোনা। কি অসম্ভব ধৈর্য ও একাগ্রতা ভাবলেই অবাক হতে হয়। ৬৫ পাক- ভারত যুদ্ধ নিয়ে তাঁর লেখা কবিতা সে সময় দারুণ আলোড়ন তুলেছিল। নওরোজ সাহিত্য আসর তাঁকে অনুপ্রাণিত করছিল এ রকম কিছু একটা রংপুরে করার। কবি কাদের নেওয়াজ এ ব্যাপারে তাঁকে পদক্ষেপ নিতে বলেন। জনাব শহীদুর রহমান বিশু উদ্যোগ নেন রংপুরে একটা সাহিত্য সংগঠন করার যেখানে থাকবে নিয়মিত সাপ্তাহিক সাহিত্য আসর। অভিযাত্রিক সাহিত্য সংসদ নাম নিয়ে শুরু হয় একটি সাহিত্য সংগঠনের। ১৯৭৮ সালের ৫ মে এই সংগঠনের প্রথম সাপ্তাহিক সাহিত্য আসর বসে। এর জন্যে জনাব বিশুকে তখনকার লিখিয়েদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সদস্য সংগ্রহ করতে হয়েছিল।প্রথম সাহিত্য আসরটি অর্থাৎ প্রথম দিকে অভিযাত্রিকের ঠিকানা ছিল শহরের দেওয়ান বাড়ি রোডের হাড়িপট্টি এলাকায় বর্তমান টাইম হাউসের পাশের একটি কাঠের দোতলায়। বিশিষ্ট সংস্কৃতিমোদি শামসুল হক লালকে সভাপতি ও শহীদুর রহমান বিশুকে প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক করে অভিযাত্রিকের কমিটি গঠন করা হয়। অভিযাত্রিকের প্রথম আসরে যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন তাঁরা হচ্ছেন, সর্বশ্রদ্ধেয় কবি রোমেনা চৌধুরী, নুরুল ইসলাম কাব্যবিনোদ, হামিদা বানু, আকলিমা খন্দকার, বিনু সরকার, তাজুন নাহার, দ্বিগেন বর্মণ, মনসুর আলী বাবলু, গৌরী রায়, মোহাম্মদ সিদ্দিক, আবু বকর সিদ্দিক, মোহাম্মদ নূর ইসলাম, ইলা নিয়োগী, প্রদীপ বিকাশ চৌধুরী প্রমুখ। সেই বছর আগস্ট মাসে কারমাইকেল কলেজে যোগদান করেন লেখক ও গবেষক মোতাহার হোসেন সুফী। ওনাকে পেয়ে আসরে আমন্ত্রণ জানানো হয়। উনি সাদরে সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করে অভিযাত্রিকের সাহিত্য আসরে আসেন। এ সময় আর এক ঘটনা ঘটে। উদার মনের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শামসুল হক লাল ওনার সভাপতির পদটি ছেড়ে দিয়ে মোতাহার হোসেন সুফী স্যারেকে তা গ্রহণের অনুরোধ করেন। সুফী স্যার সেই অনুরোধ রেখে অভিযাত্রিকের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। উপস্থিত লেখক, কবি সহ শহরের বহু মানুষ জনাব শামসুল হক লালের এই সাংগঠনিক ত্যাগের বিপুল প্রশংসা করেন। তাঁকে সহ-সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। সেই থেকে অভিযাত্রিকের নিয়মিত সাহিত্য আসর চলে আসছে। পরে অভিযাত্রিক টাউন হলের পেছনে শিখা সংসদের পাশে জায়গা বরাদ্দ পেয়ে চলে আসে এবং এখনো এখানেই আছে। ২০০৩ সালে শহীদুর রহমান বিশু অভিযাত্রিক থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর আর তিনি কোন সংগঠনের সাথে যুক্ত হন না। আমি একজন অভিযাত্রিক সদস্য হিসেবে বিপুল গর্ব অনুভব করি। কবি কিংবা সাহিত্যিক কোন ব্যক্তি বা সংগঠন তৈরি করতে পারে না কিন্তু দিকনির্দেশনা ও ভুল ত্রুটি সম্পর্কে ধারণা দিয়ে সঠিক রাস্তা দেখাতে পারে। অভিযাত্রিকের আলোকিত অঙ্গনে এসে অনেক অনেক কবি ও লেখক দেশ – বিদেশে সুনাম অর্জন করেছেন। প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন সাহিত্যাঙ্গনে। জনাব বিশু এরপর থেকে পড়ছেন আর লিখছেন। ইতিমধ্যে তাঁর ছড়া,গান, কবিতা, গল্প ও উপন্যাস মিলিয়ে প্রায় ২৩ টা পাণ্ডুলিপি প্রকাশের জন্য সম্পূর্ণ তৈরি। আগ্রহী প্রকাশনী সংস্থাকে তিনি এসব প্রকাশ করতে দেবেন।
সাহিত্য চর্চা ছাড়াও গান ও অভিনয়ের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। করেছেন মঞ্চ কাঁপানো জনপ্রিয় বহু নাটক। অভিজ্ঞ ও জনপ্রিয় অভিনেতাদের সঙ্গে ছিল তাঁর পথচলা। শতাধিক নাটক মঞ্চায়নের রয়েছে তাঁর অভিজ্ঞতা। ছিলেন নাট্য পরিচালকও। অভিনয় করেছেন চলচ্চিত্রে। নায়ক রহমানের সাথে সহ শিল্পী হিসেবে সুযোগ হয়েছিল অভিনয়ের। তাঁর অভিনয়ে ভীষণ খুশি হয়ে প্রখ্যাত অভিনেতা ও পরিচালক খান আতা তাঁর অভিনয় অংশ বৃদ্ধি করে দিয়েছিলেন। জনাব বিশু একজন বেতার গীতিকার। রাজশাহী ও রংপুর বেতারে তিনি তালিকাভুক্ত। আধুনিক, পল্লীগীতি,ভাওয়াইয়া ,জারি, বাউল, ইসলামী, ভাটিয়ালি, ঠুমরি, কাওয়ালি ও গজল গান লেখেন তিনি। নাটক ও গীতি নকশা লিখছেন। প্রখ্যাত সুরকার ও শিল্পী লাকী আখন্দ তাঁর গান সুরারোপ করেছিলেন।
তাঁর লেখা রংপুরের জারি ও নাইওরি গীতি আলেখ্য বাংলাদেশ টেলিভিশনে ৮৪-৮৬ তে প্রচারিত হয়। ২০১৬ তে প্রচারিত হয় গবেষণা মূলক অনুষ্ঠান’ আলোকিত রংপুর ‘। তিনি অভিযাত্রিক সাহিত্য পত্রিকা, দৈনিক যুগের আলোর সাহিত্য বিভাগ ও যৌথ ভাবে রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষদের পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন । বর্তমানে অনিয়মিত ছোট কাগজ ‘উত্তরমেঘ’- এর সম্পাদক ও প্রকাশক। ২০১৭ সালের গ্রন্থমেলায় ‘ ছবি ও ছড়ায় ছয় ঋতু’ ‘ গোলক ধাঁধা ‘এবং ‘চম্পাকলি ও রাজকন্যা ‘ প্রকাশিত হয়। ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাস ‘স্পর্শ ‘।
ভারতের শিলিগুড়ি, আসাম এবং গৌরিপুর থেকে তিনি সন্মাননা পেয়েছেন। রংপুর পৌরসভা থেকে সিনিয়র সিটিজেন এওয়ার্ড, ঢাকায় পল্লী কবি জসীম উদ্দিন সাহিত্য পুরস্কার, পাবনা ও রানীগঞ্জ থেকে সন্মাননা লাভ করেন। নাট্যজন হিসেবে রংপুর নাগরিক নাট্যগোষ্ঠী পদক এবং ছড়ায় বিশেষ অবদানের জন্য রংপুর ছড়া পরিষদ ও রংধনু, ছড়া সংসদ থেকে বিশিষ্ট ছড়াকার সন্মাননা এবং মৌচাক সাহিত্য সন্মাননা লাভ করেন। তিনি রংপুর গ্রন্থমেলা থেকে দুই বার সন্মাননা পান।
সহধর্মিণী রোকেয়া বেগম গত হয়েছেন। তিন ছেলে ও দুই মেয়ের জনক তিনি। ছেলে খালেদ আহমেদ সুখু দৈনিক ইত্তেফাকের সাব এডিটর। তিনি সাহিত্য চর্চা করেন। তিনটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। দ্বিতীয় পুত্র ওয়াহেদ আহমেদ শুভ এমএ সম্পন্ন করেছেন। আর ছোট ছেলে ওয়াজেদ আহমেদ সুপ্ত এমএ দিচ্ছেন। দুই মেয়ে শাহিদা বেগম মনি ও শামিমা বেগম সুখি স্বামী সংসারে আছেন।
জনাব বিশু সুস্থ ধারার সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সাহিত্য করতে হলে পড়ার কোন বিকল্প নেই।
তথ্যসূত্রঃ লেখকের সাথে সরাসরি সাক্ষাৎকার। এই লেখাটা খসড়া হিসেবে ফেসবুকে প্রকাশিত হলো। প্রয়োজনে যে কোন তথ্য সংযোজন কিংবা বিয়োজন করা হবে। এই লেখার সিরিয়াল নম্বর কোন মূল্যায়ন সিরিয়াল নম্বর নয়।

বিশুদাটাও অবশেষে চলে গেলেন।তবে এতটা সহজেই আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন তিনি, তা ভাবিনি কখনোই। আসলেই কার গাড়ি যে কখন বন্ধ হবে এর নিশ্চয়তা দেয়ার মত কেউতো নেই এই ভূবনে। কাজেই বিস্মিত আর বিচলিত হবারই বা কী!
বিশুদা, মানে এ.কে.এম শহীদুর রহমান বিশু। যাঁর পরিচয় একাধারে সাহিত্যিক, কবি, ছড়াকার, গীতিকার, নাট্যকার, নাট্যশিল্পী সংগঠক এবং আরো অনেক বিশেষনেই ভূষিত করা যায় তাঁকে। গতকালের শেষ দিনটা পর্যন্তও তিনি ডুবেছিলেন সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভূবনেই।৭০ দশকে রংপুরের প্রাচীণ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংগঠন ‘অভিযাত্রিক’ এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। সে সময় সংগঠনটির কার্যালয় ছিল নগরীর বর্তমান টাইম হাউস এর পেছনে একটি কাঠের দোতলায়।যতদুর মনে পড়ে সেই দোতলাতেই ৭৯ সালে কোন এক সাহিত্য আসরেই তারঁ সাথে প্রথম পরিচয় আমার। আশির দশকেতো কঠিন অন্তরঙ্গতা। অভিযাত্রিক এর সাহিত্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে অনেক পুরস্কার আর তাঁর স্বাক্ষরিত একাধিক সার্টিফিকেট এখনো সংরক্ষণ আছে আমার। মাঝখানে পেশাগত ছাড়াও নানা কারণে একটা দুরত্ম তৈরি হয় বৈকি। তাই বলে কুশলাদি বিনিময় বন্ধ হয়নি কখনই।দেখা হলেই শ্রদ্ধাবনত একটা সালাম ছিল তাঁর প্রাপ্তি। সাহিত্য সংস্কৃতি এবং সাংবাদিকতা বিষয়ে যথেষ্ট উৎসাহ দানের পাশাপাশি শিখিয়েছেনও অনেকটাই।দিয়ে গেছেন অনেক, পারিনি দিতে কিছই।
এইতো মাত্র ক’দিন আগের কথা। দুপুরে আমি তখন প্রেসক্লাবের চার তলার অফিস কক্ষে। জানতে পেলাম, বিশুদা নিচের কোন একটি দোকানে বসা। আমার কাছে তাঁর একটি প্রাপ্য উপহার ছিল। নিচে তাঁর উপস্থিতির সংবাদ পেয়ে ওই উপহারের প্যাকেটটি নিয়ে নিচে নেমে আসলাম।পরম শ্রদ্ধাভরে নিজহাতে তুলে দিলাম সেই উপহারের প্যাকেটটি। স্বভাব সুলভ হাসিমাখা মুখে তা গ্রহণ করে সহসাই বল্লেন, এটার কী দরকার ছিল মানিক ? আমি বললাম, দিয়েছেনতো অনেক, কি দিতে পেরেছি আমি ? তারপর এ কথা সে কথায় রিকশায় তুলে দিলাম ৭৯ বছরের তরুণ সেই সাহিত্যের সেবককে। সেদিনই ছিল তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা, শেষ কথা। সকালে বিছানা ছেড়ে নামার আগেই প্রিয় বন্ধু আশাফা সেলিম ফোনে জানালো বিশুদা’র চলে যাবার এই দু:সংবাদটি। কিন্তু দুর্ভাগা, তাঁকে আর শেষ দেখা হয়নি। দীর্ঘ এ সময়েও করতে পারিনি কোন স্মৃতিচারণ। ওপারে ভাল থাকেন বিশুদা। ক্ষমা করে দিয়েন অজান্তে করে থাকা কোন অসম্মানকর কিছু।

বিশুদা শুদ্ধতার এক অনন্য প্রতিভা। আপাদমস্তক কবি সাহিত্যক ছড়াকার। নাট্যকার নাট্যাভিনেতা, গীতিকার। পুরা নাম এ কে এম শহীদুর রহমান। যখন কবি সাহিত্যকদের নিয়ে ব্যাঙ্গ করতো। কাঁধে চটের ব্যাগ আর খদ্দরের পাঞ্জাবী আর পাজামা পড়ে হেটে গেলেই কবি বলে সম্বোধন। কবি সাহিত্যক মানেই অভাব অনাটনের মানুষ। বিশুদা তাঁর কৈশোর থেকেই ছড়া কবিতা গল্প লিখতেন। যৌবনে এসে গান নাটক আর গল্প লিখতে শুরু করেন। তাঁর রক্তের শিরা উপশিরায় সাহিত্য সংস্কৃতি। তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি শুধু জাতীয় মানের নয় এই ভারতের বাংলাভাষাভাষিদের কাছেও সমাদৃত হয়েছে। তিনি ছড়া লেখার ধারায় নতুনমাত্রা যোগ করেছেন। ছড়া ভেঙ্গে অসাধারণ এক রূপ রস সৃষ্টি করেছেন।
তিনি ছিলেন ভেতরে বাইরে পরিস্কার একজন উদার ভদ্র মানুষ। আধুনিকতার সাথে ছিলেন মৃত্যুর দিন পর্যন্ত। চমৎকার ব্যক্তিত্ব আর বন্ধসুলভ স্মার্ট একজন চিরতরুণ মানুষ। বিশুদার পরিচয় ছিলো ছড়াকার কবি। রংপুরের আপামর জনসাধারণের প্রিয় মানুষ ছিলেন বিশুদা। তাঁর ছিলো নাড়িরটান। তাই রংপুরের বাইরে কখনো যাননি। বৃহৎ পরিসরে তাঁর কর্মগুলো নিতে বললে বলতেন লেখার কাজ যেকো জায়গা থেকেই সম্ভব। অনুভব আর অনুভূতির নান্দনিক প্রকাশই কবি সাহিত্যকের কাজ। তিনি প্রকাশকদের দ্বারেদ্বারে তাঁর লেখা নিয়ে কখোনোই ছুটে বেড়াননি। তিনি তার প্রজ্ঞা ভাবনা আর অনুভব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন অসাধারণ ছড়া, কবিতা, ছোট গল্প, উপন্যাস, গান, নাটক। সমসাময়িক প্রসঙ্গ নিয়েও লিখতেন। অত্যন্ত সচেতন স্বাধীনতা প্রিয় একজন মানুষ বিশুদা ছিলেন আমাদের আত্মার আত্মীয়। তাঁর সংস্পর্শে এসে মুগ্ধ হয়েছি।
তিনি ছিলেন দক্ষ সংগঠক। তিনি সাহিত্য সংস্কৃতির সংগঠন গড়ে তুলতে ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। সাহিত্য আসরে কবিতা পাঠ করতেন। রংপুরের অভিযাত্রিক সাহিত্য সংগঠন গড়ে তুলে নিয়মিত সাপ্তাহিক সাহিত্য আসর করে সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ আর ভালোবাসা সৃষ্টিতে নবীনদের উদ্ধুদ্ধ করতেন। তাঁর লেখার যে উচ্চাতা সত্যিই তা এদেশে হাতে গোনা কয়েকজনের আছে।
তিনি মানবিক গুণের নীরিহ সহজ সরল একজন সুদর্শন মানুষ ছিলেন। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা…..।
বিশুদা ছিলেন মঞ্চের ভালো অভিনেতা। মঞ্চ নাটকে অনেক অভিনয় করেছেন। বেতার নাটকে প্রায় ৫০ বছর অভিনয় করেছেন। বেতারের একজন ভালো নাট্যকার তিনি। গান লিখতে চমৎকার! তাঁর গান বেতারের অনেক বরেণ্য সুরকার সুর করেছেন প্রথিতযশা শিল্পীরা গেয়েছেন।
বিশুদার হঠাৎ চলে যাওয়ায় বুকের ভেতর প্রচন্ড ধাক্কা লেগেছে। দেশের সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমেছে।
তিনি সাহিত্য সংস্কৃতির সাথে নিজের জীবন বেঁধে আর্থিক কষ্ট শেষ সময়ে পেয়েছেন কিন্তু তাঁর চলনে-বলনে কখনো তা প্রকাশ করতেন না। শত দুঃখ কষ্টেও মুখে হাসি লেগে থাকতো।
শুদ্ধ ভাষায় গুছিয়ে কথা বলার বিশুদা চলে যাবেন বুঝতেই পারিনি। তাঁর সৃষ্টি আনাদের দেশের সাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। আমরা পেয়েছি উন্নত ছড়া কবিতা উপন্যাস গল্প। পেয়েছি হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া গান। মনে গেঁথে থাকার মতো নাটক। তিনি ছিলেন জিনিয়াস। তাঁর মতো লেখকের শুন্যস্থান পূরণে কতো সময় লাগবে জানিনা। আদৌ হবে কিনা সন্দেহ আছে।
সবাইকেই যেতে হবে এটা অনিবার্য। তাই তাঁর চলে যাওয়ায় প্রার্থনা ওপারে ভালো থাকুন বিশুদা।

উচ্চতর লেখাপড়া এবং চাকরি দুটোর কারণেই আড়াই দশকের বেশি সময় প্রিয় রংপুরের বাইরে। নানা উৎসব পার্বণে কিংবা ছুটিছাটায় রংপুর এলে প্রবল নেশায় ছুটে যেতাম সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোতে। কখন যে তাঁর সাথে পরিচয়টা ঘটে গেল আজ স্পষ্ট মনেও নেই। তবে হৃদ্যতাটা বেড়েছিল ১০ বছর আগে আমাদের পুত্র রাইয়ান রাফাত করিমের জন্মকে কেন্দ্র করে পাওয়া অভিনন্দন বার্তা নিয়ে ব্যতিক্রমধর্মী মুঠোফোন সংকলন ‘সোনামণি রাইয়ান’-এর প্রকাশনার কাজটি করতে গিয়ে।
প্রায়ই কাজটির অগ্রগতি নিয়ে মুঠোফোনে আলাপ হতো। আমিও যোগাযোগ করতাম। বইটিতে সংযোজনের জন্য শিশুদের জন্য রচিত কালজয়ী বেশকিছু ছড়াও সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। আমাদের দেখা হতো টাউন হল চত্বরে, কখনো প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে, কখনো লাকী মসজিদের নিচে ডাক্স টেইলার্সে (এখন বোধকরি বিলুপ্ত), পায়রা চত্বরে, নেহাল মিয়ার পুরির দোকানে, কখনোবা ছান্দসিকের আসরে। কথা দিয়ে কথা রাখার অসাধারণ গুণ ছিল তাঁর।
আমার মরহুম পিতা অভিযাত্রিকের গোড়ার দিকে আসরে যেতেন যেটা তার মুথ থেকে শোনা। কৈলাশ রঞ্জন হাই স্কুলে সহপাঠী ছিলেন তাঁরা। একসাথে পাবলিক লাইব্রেরিতে পড়েছেন দলবেঁধে শেষ বিকেলে। এখন যে চর্চাটির জায়গা দখল করে নিয়েছে অন্তর্জাল।
শোকের মাস আগস্ট। ২০১৬ সালের ২০ আগস্ট হারিয়েছি আমার পিতাকে। পিতার মৃত্যুর পর স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়। পিতার রক্তে ছিল সাহিত্য। হয়তো কালজয়ী লেখক হতে পারতেন যেটি তিনি বলে গেছেন। কী কারণে পিতা লেখালেখিটা ছেড়ে দিলেন সেটি বিশু চাচাকে বিস্মিত করেছিল। অনেক কষ্ট করে পিতার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সোনালি দিন আর রংপুরের সাহিত্যের সেকাল-একাল আর যারা নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন, এখনো আছেন অকপটে তাদের কথা লিখে গেছেন। স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশের পথে। দুর্ভাগ্য তাঁর হাতে তুলে দেয়া হলো না।
প্রকৃতি শূন্যতা পছন্দ করে না। তবে একজন নিবেদিতপ্রাণ সংগঠককে হারালাম ৯ আগস্ট অনেকের ঘুম ভাঙার আগে। পিতার মতো তিনিও জীবনের ওইপারের স্টেশনে চিরনিদ্রায় মুন্সিপাড়া কবরস্থানে। কোরআনের একটি বাণী মনে পড়ছে-
‘কেহই জানে না কাল
কী উপার্জন
কোথায় কখন হবে
কাহার মরণ’
জীবনের শেষবেলায় এসে অনেক কষ্ট করেছেন, কষ্ট মনে চেপে রেখেছিলেন। চেষ্টা করেছি আমার দিক থেকে তাঁর মুখে হাসি ফোটাতে। পিতার বন্ধুতো পিতাই। এই করোনাকালে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে। ভীষণ পরিপাটি আর স্মার্ট মানুষটি যে কারো আদর্শ হতেই পারে।
সময় চলে যাবে। ভুলে যাব তাঁকে খুব দ্রুত। এটাই জগতের নিয়ম। তাঁর লেখা সাহিত্যকর্ম বিশেষ করে ছড়া পাঠে তাঁকে জানতে হবে। আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে তাঁর লেখাগুলো বই আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া উচিত। শেষ কথাটি বলে শেষ করি-মানুষ মরে গেলে পচে যায় আর বেঁচে থাকলে ক্ষণে ক্ষণে বদলায়।
বিশু চাচার মহাজাগতিক সফর সুন্দর হোক।

মাত্র কয়েকদিন আগে শহিদুর রহমান বিশুদা কাউকে কিছু না বলে চলে গেলেন না ফেরার দেশে তাই শুরুতেই তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। মহান আল্লাহতালা তাকে জান্নাতি করুন।
যিনি চলে যান তখন হয়তো তাকে নিয়ে বিভিন্ন কথা- বিভিন্ন আলোচনা অর্থ্যাৎ তার কিছু সততাপুষ্ট সৃষ্টি সম্ভার নিয়ে কথা বলি বা লিখি আর এটাই নিয়ম। আমারো লিখতে ইচ্ছে করলো স্বত:স্ফূর্ত এক আন্তরিক ইচ্ছেবোধ থেকে। নাহ্ তেমন কিছু লিখার জ্ঞান ভান্ডার আমার নেই তবে বিশুদাকে চিনি আমি অভিযাত্রিক সাহিত্য সংগঠন থেকে। দারুণ আন্তরিক ও সহযোগি মনের মানুষ। সেই সময় দেখতাম একটি সংগঠনকেও মানুষ কতোটা ভালোবাসতে পারে। নিরলস কাজ করার অদম্য স্পৃহা তার ভিতরে ছিল। সুফী মোতাহার হোসেন স্যারের নিবীড় ভালোবাসার ছত্রছায়া যেনো ছিল আমাদের সকলের পাঠশালা। সাহিত্য আলোচনা, লিখা নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলতো পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে। আমি বলতেই পারি, সেখান থেকেই আমার লিখার কিছুটা হলেও গতি ধারায় পক্কতা এসেছিল। বিশুদা ছড়া লিখতেন তুখোর। ছড়ার সৌন্দর্য-ছন্দ-মাত্রা এগুলো নিয়েই তার ব্যাকরণবিধির চিন্তা ভাবনা ছিল সবসময়। হাত বাড়িয়ে টেনে তোলার একটা স্বভাবটান তার ভিতরে সব সময় দেখা যেতো। আমার মনে হয়-আজকের তরুন লিখিয়েরা অনেকেই এই কথাটি স্বীকার করবে।
আমরা যতোটা সহজ কথা বলি না কেনো, যে কোনো জায়গা বা ক্ষেত্রে মানুষের মানবতা সংর্কীনতা লালন করেই। সেদিক দিয়ে বিশুদার মূল্যায়নটি ছিল কম আর তিনি সব সময় পেছনে থাকা বা সরে যাওয়া একজন মানুষ। নিজেকে প্রকাশ করতেন কম। লিখার জগতে মনে হয় যতোটা মূল্যায়ন তার দরকার ছিল ততোটা তিনি পান নি। কেনো যেনো মনে হয় একজন বিস্মৃত অথচ প্রকৃত ছড়াকার বিভিন্ন কারনে লীয়মান হতে হতে শেষের দিকে এসে কিছুটা সমাদর পেয়েছেন বা সমাদৃত হয়েছেন। বাস্তবতার কঠিন পরাকাষ্ঠে এমন অনেকৃ অনেক লেখক আছেন সারা বাংলাদেশ জুড়ে যারা নীরব বেদনা থেকে বেদনার গভীরে লুকিয়ে থাকেন। মৃত্যুর পর কিছু আলোচনা-সমালোচনা-উদ্ধৃতিময় হন আবার কালের গর্ভে হারিয়ে যান একটা সময়-এটাই চিরায়ত নিয়ম।
বিশুদার ভিতরে যেনো ছিল অখন্ড দাহময় যন্ত্রনা। মাঝে উত্তর মেঘ-একটি পত্রিকা বেড় করে ছিলেন। সব দিক থেকেই যেনো তিনি আশাহীন পথযাত্রার পথিক ছিলেন। কিন্তু হৃদয়ের গভীরে ভাষার অলংকৃত ইন্দ্রজালে নিজেকে ভরিয়ে রাখতেন। অন্যেকে লিখার প্রেরণা দিতেন হৃদয়িক অনুভূতি থেকে আর নিজেও অদম্য অধ্যাবসায়-চর্চা আর মানসিক শক্তির মননে-চিন্তনে লিখে যেতেন আপন মনে। শব্দ নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা একজন খুব সাধারণ মানুষ। যা আজকের সচেতন মানুষেরা আর থাকেন না কারন গৃহস্হালী দায়-দায়িত্ব অস্বীকার করা যায় না। বিশুদা স্বভাবতই উদাস মনের সাহিত্যপ্রেমী ছিলেন। সংসার পরিক্রমার জীবন বিন্যাসে কিছু শব্দের আকরে দেশ-সমাজ-প্রকৃতি আর পরিশেষে নিজেকে গেঁথে গেছেন যা আজ স্মৃতির পাতা।
উদাসী স্বভাবের বিশুদার সাহিত্যের প্রতি দারুণ অনুরাগ ছিল আর ছিল সংসার পরিক্রমায় জীবন গুছানোর প্রতি উদাসীনতা। বিশুদার যে বইগুলো প্রকাশিত হয়েছে তার প্রতিটি কবিতায় তিনি জীবন-জীবনের জরাজীর্ণতা-সংসারের বাস্তবতা সব সবকিছুকে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সুদক্ষ নিপুন কাব্যিকতার মুগ্ধময় ভাষার মাধুর্যতায় কারন তিনি আর লিখবেন না বলে… তিনি আজ শুধুই স্মৃতি…।

আমার কাছে ব্যক্তি ও সাহিত্য জীবনে অনুপ্রেরণার নাম একেএম শহীদুর রহমান বিশু। আমার সাহিত্যের অভিভাবক ছিলেন। যিনি সবসময় সাহিত্যের উন্নয়নে আমাকে সম্পৃক্ত দেখতে চেয়েছিলেন। আমিও চেষ্টা করতাম উনার কথা রাখার। রংপুর শহরে আমরা কয়েকজন তরুণ সাহিত্যের উন্নয়নে সকল ভেদাভেদ ভুলে এক হয়ে কাজ করার পরিবেশ তৈরি করতে যখন কাজ শুরু করি তখন আমাদের সাথে যোগ হয় গুটি কয়েক সিনিয়র সাহিত্যিক। তার মধ্যে বিশু ভাই অন্যতম। ৮০ বছরের একজন বৃদ্ধ সাহিত্যে উজ্জীবিত থেকে তরুণদের সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ করা সহজ ছিল না কিন্তু বিশুভাই সেটি করে প্রমাণ করেছেন ইচ্ছা শক্তি থাকলে মানুষ অনেক কিছু করতে পারে। কয়েকজন তরুণের প্রচেষ্টায় রংপুরে গঠন হয় সম্মিলিত লেখক সমাজ। সম্মিলিত লেখক সমাজ এর ব্যানারে বইমেলা করার উদ্যোগে তিনি উদ্যোক্তা তরুণদের সাথে সমানতালে সময় দিয়েছেন। বইমেলার প্রতিটি কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত ছিলেন। বইমেলা আয়োজক বিশুভাইকে সম্মিলিত লেখক সমাজ রংপুর এর পক্ষ থেকে প্রবীণ সাহিত্যিক হিসেবে বইমেলা সম্মাননা স্মারক তুলে দেন। প্রথম বইমেলা আয়োজনে সভাপতিত্ব করেছিলেন বিশুভাই।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশুভাই ছড়াকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। ছড়া নিয়ে সবসময় কাজ করতেন। ছড়া লেখা নিয়ে গবেষণা করতেন। ছড়াকে কতভাবে দেখতেন, তা ছড়ার পর্ব ভাঙা ও নতুন নতুন শব্দ প্রয়োগ, ছড়ার গতি দেখলেই বোঝা যেত। আমার ছড়া বিশুভাই পছন্দ করতেন, এজন্য তিনি আমাকে ছড়া লেখায় সবসময় উৎসাহ দিতেন। বিশু ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় আমার সাহিত্য জীবনের প্রথম ছড়ার বই “ছড়াগুলো টুনটুনির” ২০১৮ সালে প্রকাশ হয়েছিল। তাঁর একটি ছড়ার বই আমাকে উৎসর্গ করেছিলেন। ছড়া নিয়ে রংপুর কে তিনি দেশের মধ্যে অনন্য উচ্চতায় দেখতে চেয়েছিলেন। এজন্য ছড়া সংসদ রংপুর গঠনের পর থেকে তিনি আমাদের উৎসাহ দিয়ে ছড়ার উন্নয়নে কাজ করাতেন। আমি ছড়া সংসদ রংপুর এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে বিশুভাইয়ের পরামর্শ নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করতাম। দেশের মধ্যে ছড়া সংসদ রংপুর এর পক্ষ থেকে প্রথম আন্তর্জাতিক ছড়াকার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০১৮ সালে। তিনি আমাদের উৎসাহ দিয়েছিলেন সর্বাত্বকভাবে। সাংগঠনিক কাজে তাঁর পরামর্শ নিতাম সবসময়। কেননা উনাকে সাহিত্য সংগঠক হিসেবে গুরুজন মানতাম। তিনি ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রংপুরের সাহিত্য সংগঠন অভিযাত্রিক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সাহিত্যের উন্নয়নে কাজ করতে গিয়ে সংসার জীবনে আর্থিক উন্নয়নতো দূরের কথা চরম ক্ষতির মুখে পরেছিলেন। যার খেসারত তিনি শেষ বয়সে এসে দিয়ে গেলেন।
আমরা ছড়া সংসদ রংপুর বিশুভাই কে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ছড়াকার রফিকুল হক দাদুভাই ছড়া সম্মাননা ২০১৯ প্রদান করেছি। সম্মাননাটি নিজ হাতে তুলে দিয়েছিলেন রফিকুল হক দাদুভাই। সম্মাননা ক্রেষ্টের সাথে নগদ ১০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়। এর দুই বছর আগে ২০১৭ সালে সাহিত্যের কাগজ মৌচাক এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে রফিকুল হক দাদুভাই এর নামে সম্মাননা ও নগদ ১০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছিল। সেটিও রফিকুল হক দাদুভাই নিজ হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
আমার লেখা গান শুনে তিনি বেতারে তালিকাভুক্ত গীতিকার হওয়ার জন্য গান জমা দিতে বলতেন। প্রায় দিন খবর নিতেন। যদিও আমার অলসতা আর উদাসীনতায় আজ কাল করেও সম্ভব হয়নি গান জমা দেয়া।
সাহিত্যের পাশাপাশি বিশুভাইয়ের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। যা আজও আছে। সবসময় ফোন দিয়ে বাবা, বউ ও আমার ছেলের খোঁজখবর নিতেন। একদিন কথা না হলে মন খারাপ করতেন। আমিও বিশুভাই ও তাঁর পরিবারের পাশে থেকেছি। আগামীতেও থাকার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। আমার জন্মদিনে তিনি কিছু দিতে পারেননি এজন্য কত আফসোস করতেন। পরবর্তীতে ভারত থেকে নিজের জন্য নিয়ে আসা মুজিব কোর্ট আমাকে জোর করে দিলেন, নিতে অস্বীকৃতি জানালে তিনি মন খারাপ করেন। পরে সানন্দে গ্রহন করি। সেই মুজিব কোর্ট এখন পরে বেড়ানো আমার জন্য খুবই কষ্টকর।
বিশুভাই অনেক পরিছন্ন ও স্মার্ট এবং সদাহাস্যজ্বল ব্যক্তি ছিলেন। ব্যক্তিত্ব নিয়ে পথ চলতেন। বাহিরে কখনও অগোছালো দেখিনি। সবসময় পরিস্কার কাপড় পরে, ক্লিন সেভ করে বের হতেন। নিয়ম করে খেতেন এবং চলাফেরা করতেন। তিনি তরুনদের কাছে মডেল ছিলেন।
বিশুভাই এর ১৯৫৮ সালে ছাত্রাবস্থায় প্রথম ছড়ার বই ‘অর্পণ’ প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৬৩ সালে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘অপেক্ষা’ প্রকাশিত হয়। পরে দীর্ঘ বিরতির পর সম্প্রতি কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি বই তাঁর প্রকাশিত হয়। তিনি বেঁচে থাকলে আরো প্রকাশ হতো।
জানা মতে তাঁর ২২ টি পান্ডুলিপি তৈরি আছে। আমরা যদি চেষ্টা করি সেগুলো প্রকাশ করা সম্ভব।
বিশুভাই নাটক লিখতেন, নাটক করতেন, সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন। তিনি বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার, কথিকা লিখতেন। কবিতা-গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন। সাহিত্য পত্রিকা “উত্তরের মেঘ” সম্পাদনা করেছেন।
ব্যক্তি জীবনে ও সাহিত্যজীবনে অনেক অপ্রাপ্তি ছিল বিশুভাইয়ের। সবকিছুকে ছাপিয়ে তিনি আমাদের সাহিত্য পরিমন্ডলে এক অনন্য নাম। এক অনুপ্রেরণার নাম। সাদা মনের মানুষ বিশুভাই বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টিশীল সাহিত্য কর্মের মাঝে।
আমরা চেষ্টা করবো তাঁর রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজগুলি করবার। হে আল্লাহ বিশুভাই কে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমীন।

তখন ২০১৫ সালের শেষ আর্ধের কথা। আমি বেশ পাথুরে একটা সময় পাড় করছি। মনে হয়, ভাগ্য দেবতা আমাকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড থেকে তুলে সবে মাত্র মাটির পাত্রে রেখেছে। ক্ষতগুলোর তখনও কাঁচা। কাছে গেলে আচ পাওয়া যায়। সারা রাত জেগেজেগে নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছি। ঘড়ির কাঁটার সাথে পাল্লা দিয়ে কলম চলতে থাকে বেগতিক নিয়মে।
শীতের শুরু। রংপুর বেতপট্টি রোডের পশ্চিম মুখে আমার খালুর দোকান, জড়োয়া জুয়েলার্স। জন্মের পর থেকেই খালুকে সব সময় হাসতে দেখেছিলাম। তাঁর নাম ছিল আব্দুস সবুর খান। যেমন রসিক তেমন রঙিন মানুষ ছিলেন। গান, আঁকাআকি, আলপনা, যন্ত্রশিল্পী হিসেবে শহরের প্রবীণ সমাজে সে ছিল বেশ আলোকিত মানুষ। সনদবিহীন মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীন বাংলা বেতারের একজন শিল্পী ও ভাওয়াইয়া একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে তাঁর অবদান স্মরণীয়।
একদিন হঠাৎ আমার সাথে দেখা করে টেনে নিয়ে গেলেন তাঁর দোকানে। নানান প্রশ্ন, কি করছি আজকাল? অগোছালো লক্ষ্য কেন? কি করব? কি করতে হবে? ভবিষ্যতে উঠে দাঁড়াব কি করে? সর্বশেষ আমার উত্তর ছিল এই বই পড়ে যাচ্ছি আর কিছু লেখালেখি। কিছুক্ষন চুপ থেকে পরের দিন আমাকে লেখার পান্ডুলিপি সমেত আবার ডাকলেন। আমি কয়েকটি লেখা যেমন-তেমন ভাবে নিয়ে যথারীতি উপস্থিত হলাম। সোফায় একজন বসে আছেন। চুপচাপ। সমস্ত চুল পেকে গেছে। চেহারায় বয়সের ছাপ। নাকখানা আদিম। বেশ ফিটফাট পোষাক। আর চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা।
খালু লেখা গুলো পড়ে বললেন, “আরও পালিশ প্রয়োজন”। এই বলে লেখার কাগজটি সোফায় বসা মানুষটিকে দিয়ে বললেন, “দেখুন তো। কি করা যায়?”
ভদ্রলোক লেখাগুলো নিয়ে একনাগারে পড়ে গেলেন। তারপর বললেন, “কিচ্ছু হয়নি”।
ভদ্রলোকের কথা শুনে মেজাজটা তড়িৎ গতিতে গরমে টগবগ করতে লাগল। মনে মনে যা ইচ্ছে তাই আওড়ালাম। সবুর খালু আমাকে তাঁর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, ” ইনি শহীদুর রহমান বিশু। আমাদের বিশু দা। একজন ছড়াকার, লেখক মানুষ”
শুনে মুখ হা হয়ে গেল। তৎক্ষনাৎ নমনীয় ভাবে তাঁর সাথে করমর্দন শেষে মুচকি হাসলাম।
বিশু দা বললেন, “তুমি লিখছ এটা বেশ বড় ব্যাপার। কিন্তু শুধু লিখলেই হবে না, পড়তেও হবে। ছড়া, কবিতা, উপন্যাস, গল্প পড়তে হবে। লেখার ধরন জানতে হবে। কবিতা লেখায় ছন্দ, মাত্রা, বৃত্ত, উপমা, রস নানান কিছু জিনিস মাথায় রেখে কাজ করতে হয়। তুমি বসতে পারো৷ আমি তোমাকে দেখিয়ে দেব।”
সেদিনের পর আমার লেখার দুনিয়া পুরোপুরি পাল্টে গেল। বিশু দা, যা যা বললেন তা যেন না চাইতে অনেক বড় পাওয়া। পড়ে একের পর এক দেখিয়ে দিতে লাগলেন লেখার নানান কৌশল আর লাল কালি দিয়ে দাগ দিয়ে দিয়ে ধরিয়ে দিলেন ভুল।
একদিন তো রাগ হয়ে বললেন, “তোমার বিরামচিহ্নের ব্যবহার ঠিক নেই”।
পরে প্রায়শই ফোন দিয়ে খোঁজ নিতেন। ডেকে পরিচয় করিয়ে দিলেন রংপুর লেখক সমাজের সদস্যদের সাথে। সেই থেকে সবার সাথে আন্তরিকতা জমে গেল।
একদিন দৈনিক যুগের আলো অফিসে ডেকে নিয়ে গেলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন সাহিত্য সম্পাদক নজরুল মৃধার সাথে। বললেন, ” তোমার লেখা নজরুলকে এসে দিয়ে যেও”।
দৈনিক যুগের আলো পত্রিকার সেই লেখাটা আমার জীবনের প্রথম প্রকাশিত কবিতা ছিল। শুধুই কি তাই। বিভাগীয় লেখক পরিষদের সাহিত্য সম্মেলনে সেবার আসলেন দেশবরেণ্য সাহিত্যিক কবি আসাদ চৌধুরী। অনুষ্ঠান শেষ করে আমাকে নিয়ে সার্কিট হাউজে গেলেন এবং পরিচয় করিয়ে দিলেন সে নিজেই। কদিন বাদে হারিয়ে গেলেন সবুর খালু। সেথেকে আর সাহিত্য আড্ডা জমেনি। মহাকবি কালিদাস এর সে কথা আজও মনে আছে, খালু আমার কবিতা পড়ে বললেন –
“শুন তোকে বলি –
অনেককাল আগে, যখন সংস্কৃত ভাষা প্রচলিত ছিল তখন। মান্যবর সঞ্চালক, কয়েকজন কবিদের নিয়ে বসে কাব্যিক আলোচলা করছিলেন। পন্ডিত কালিদাস সেখানে ছিলেন। সভার সামনে একটা গাছের কাঠ পরেছিল। মান্যবর সঞ্চালক এক কবিকে উদ্দেশ্য করে একটা কাব্যিক অনুভুতি ব্যাক্ত করতে বললেন –
তখন কবি বললেন,
“শুষ্কং কাস্ঠং,
তেস্ঠতি অগ্রে”
তখন মান্যবর সঞ্চালক, পণ্ডিত কালিদাস কে বললেন তুমি বলতো –
কবি কালিদাস তাঁর মধুর ভাষার গাথুনি দিয়ে বলছেন-
“নিরস তরুবর,
পুরতো ভাগে”
আমার গুরু মশাই আমাকে বললেন, তোর কোনটা মনে ধরল? কোনটা ভাল লাগল?
আমি লজ্জিত হয়ে হেসে বললাম, নিঃসন্দেহ পণ্ডিত কালিদাস এরটাই।
তোর কবিতাচয়ন গুলো প্রথম কবির মত, “শুষ্কং কাস্ঠং”। তোরটা অনেকটা গদ্যময় হয়েছে।
সাব্বির, শুন – তোকে একটু রস ঢালতে হবে। তোর কবিতায় কাব্যিক ছন্দের বিশেষ প্রয়োজন।
কবিতার হিসাবগুলো হল অনেকটা এরকম। বুঝেছিস বাবা।”
তারপরে বিশু দা আবৃত্তি করলেন রবী ঠাকুরের কবিতা “দুই বিঘে জমি”। আলোচনা করলেন “মংপুতে রবীন্দ্রনাথ” আর “নহন্যতে” ও “লা নুই বেঙ্গলি” নিয়ে।
এরকম একের পর এক দৃষ্টান্তমূলক স্মৃতি আমার জীবনে গেঁথে দিয়ে চলে গেলেন ওপারে বিশু দা। আর ফোন বাজবেনা। আর কেউ তাঁরমত করে ডাকবে না।
লেখক কিংবা কবি হিসেবে আজ যারা আমাকে চিনেন, জানেন তাদের উদ্দেশ্যে আমি অকপটে স্বীকার করে বলছি, এই দুজন মানুষ আমাকে অন্ধকার ঘর থেকে আলোতে টেনে নিয়ে এসেছিলেন। আজ দুজনেই ওপারে। আর এমন সাদা মনের মানুষ কবে দেখা পাবো জানি না। বিশু দা বলতেন, “যাহা আমি বরাবরি বলে থাকি আমার কাছের মানুষদের-
সৃষ্টির মূল হচ্ছে ভালবাসা,
বেদনা ছাড়া সৃষ্টির কোন মূল্য নাই।”

কলেজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ফোনটা ভেজে উঠল,ভাবলাম সকালের ক্লাসটা হবে না আজ। ফোনের স্কিনে তাকিয়ে চিন্তিত হলাম এতো সকালে এনার কল দেবার কথা না। ফোনটা রিসিভ করতেই,’সাইফুল্লাহ্ ভালো আছ?’ সেই চিরচেনা কন্ঠস্বর। তারপর যা বললেন তাতে তার অসহায়ত্ব টের পেলাম।রিক্সা নিয়ে সরাসরি ওনার বাসায় চলে গেলাম। বললেন, ছেলেটা কালকে রাত থেকে অসুস্থ! মান্টু ভাইয়ের (সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও চিকিৎসক ডা. মফিজুল ইসলাম মান্টু) দেওয়া ঔষধগুলো খাওয়া কয়েকদিন ঠিকই ছিলো। কিন্তু এখন হসপিটালে না নিলেই নয়। আমার তো আশেপাশে পরিচিত কেউ নেই।তুমি একটু সাথে থাকলে সাহস পাবো,বুঝলা?’ আমি আশ্বস্ত করে বললাম।সমস্যা নেই,আল্লাহ ভরসা!
বলছিলাম বিশুদার কথা। একেএম শহীদুর রহমান বিশু। সাহিত্যিক,নাট্যকার এবং সংগঠক হিসেবে যাকে সবাই একনামে চিনে। কিন্তু আমি সেদিন একজন অসহায় বাবাকে দেখেছিলাম। আশি ছুঁইছুঁই বয়স কিন্তু সন্তানের প্রতি বাবার দায়িত্ব যেন একটুও কমেনি।তার বৃদ্ধ ঘাড়ে চেপে হাসপাতালের করিডরে হাঁটছিলো শুভ (বিশুদার মেজো ছেলে)। এই দৃশ্য আমার কাছে নজির হয়ে থাকবে সারাজীবন। শুভর জ্ঞান হারিয়ে ফেলার সময় কিংবা তার ছটফট করার সময় সন্তানের প্রতি তার ভালোবাসা,স্নেহ,মমতাবোধ আমাকে নিবিড়ভাবে স্পর্শ করেছিলো সেদিন।
হাসপাতালে নিয়মিত যেতাম খোঁজখবর নিতে।একদিন তিনি জোর করেই ২০ টাকার একটা নোট দিয়ে বললেন, তুমি ছাত্র মানুষ।অটোভাড়া নেও। এরকম ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ কয়জনের মাঝে আছে?
বিশুদার শেষ কয়েক বছর এরকমই নিবিড়ভাবে কেটেছে আমার সাথে। সংগঠনের প্রতি ভালোবাসা, ছড়ার প্রতি তার ভালোবাসা ছিলো প্রচুর। অভিযাত্রিক প্রতিষ্ঠার গল্প,অভিযাত্রিকের সোনালী অতীত নিয়ে সবসময় স্মৃতিরোমন্থন করতেন।আক্ষেপের কথাও কম বলেননি।তাই ছড়া সংসদ নিয়ে তার স্বপ্নটা একটু বেশীই ছিলো।একটা ঘরের আফসোস ছিলো তার।এজন্য তিনি নিজে থেকেই দৌড়াদৌড়ি করতেন আমাদের সাথে। প্রতিদিন সবার আগে এসে ফোন দিতেন,সাইফুল্লাহ্ মৌচাকের চাবি তোমার কাছে? এখনও কানে বাজতেছে মৌচাকের টেবিলে আঙুল দিয়ে শব্দ করে ছড়ার ছন্দ মেলানোর দৃশ্যটা। সবসময় দেখতাম পকেটে ঝকঝকে হাতের লেখা তার কবিতার মূল কপি। বৈঠকে কেউ যদি ফোন ব্যবহার করতো বা অন্যমনস্ক থাকতো তিনি মুখের উপরেই নিষেধ করতেন। সাহিত্যের প্রতি নিষ্ঠাবান ছিলেন বলেই প্রতিটি বিষয়ে খুঁতখুঁতে ছিলেন।
করোনার সময়ও তিনি থেমে ছিলেন না। সপ্তাহে দুই তিনদিন কল দিয়ে খোঁজ নিতেন। সবাইকে ফোন দিয়ে খোঁজ নেয়া একমাত্র ব্যক্তি তিনি। আর্থিক সংকটে থাকার পরেও তিনি একজন প্রকৃত নেতা ও অভিভাবকের মতো তার দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন।
এখনও মাঝে মাঝে মনে হয় বিশুদা কল দিয়ে বলবেন, সাইফুল্লাহ্ ভালো আছ? তোমার বাবা মা ভালো আছে? লেখালেখির খবর কী? টাউনহলের দিকে আসো না?
কিন্তু বিশুদা আর কল দিবেন না।দিবেনই বা কি করে? তিনি তো কালো ব্যানারে বন্দি হয়ে গেছেন। বিশুদা বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টিতে,তার আত্মত্যাগে। এমনকি আফসোস হবে তাকে নিয়ে। আহা! যদি প্রকৃত সম্মান দিতে পারতাম তাকে।

‘দুয়ার’ সাহিত্য কাগজে প্রকাশের জন্য সম্পাদক সাথী বেগমের অনুরোধে সংক্ষিপ্ত জীবন কথা লিখতে বসে কেনো জানি আজ আমার মনে হচ্ছে যে, পাহাড় সমান কঠিনতর কাজ নিজের কথা লেখা। এমনিতেই মনের অজান্তে একজন লেখকের না-বলা অনেক কথাই চলে আসে তার লিখনীতে। কিন্তু, বাস্তবতার আলোকে নিজের কথা লিখতে চাইলেও সহজে তা সাহ্যিকারের লেখা হয়ে ওঠে না। কারো কারো জীবনে আবার এমন কিছু গোপন কথা থাকে; যা সে কোনদিনও কারো কাছে প্রকাশ করতে পারে না। প্রাণপণ চেষ্টায় দু’হাত দিয়ে তা ঢেকে রাখে।
যা হোক। জীবনের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার অনেক কথাই বাদ দিয়ে লিখছি, আমার কথা। প্রখ্যাত সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী লাকী আখন্দের গাওয়া আমার লেখা একটি গানের অন্তরাটুকু দিয়ে শুরু করছি- ‘‘কখনো মধুর হয় কিছু কিছু ভুল / হৃদয়ে সুরভি ছড়ায় স্মৃতির বকুল ॥’’
মা সেকালের হলেও গীতিকার, সুরকার, সংগীত-শিল্পী ও দক্ষ ফুটবল খেলোয়ার বাবার হাত ধরে সংস্কৃতি জগতে আমার প্রবেশ। সয়মটা ১৯৫০ সাল। বেশ মনে আছে, সে বছর ডিসেম্বর মাসে মায়ের মৃত্যু। ৫১-তে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন বগুড়ায়। তখন আমি বগুড়া নন্দীগ্রাম প্রাইমারী স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। একদিন মধ্যরাতে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে দু’লাইন কবিতা লিখলাম। ‘হে বিশ্বচালক তুমি হে মহান/তোমারই কাছে সকলে সমান’। এই আমার লেখা প্রথম কবিতা।
ছোট বেলায় বাবার লেখা গানের খাতা চুরি করে পড়তাম। মাঝে মধ্যে বাবার সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে গান গাইতাম। তখন ষষ্ঠ শ্রেণি পাশ করেছি। আর্থিক অস্বচ্ছলতার জন্য আমার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর, আমি গাবতলী হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে, লজিং থেকে অন্য ছাত্র পড়িয়ে নিজের পড়ার খরচ চালিয়েছি।
সে সময় বগুড়া আজিজুল হক কলেজের বাংলার অধ্যাপক ও মাসিক ‘অতএব’ সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক মোহসিন আলি দেওয়ান ও অধ্যাপক মোহাম্মদ মোবারক আলি স্যারের অনুপ্রেরনায় এবং তরণীকান্ত রায়ের আর্থিক সহযোগিতায় আমার প্রথম ছড়ার বই ‘অর্পণ’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে। সেই বছরেই রংপুর টাউন হল মঞ্চে ‘সংকামারির ঘাট’ নাটকে প্রথম অভিনয়। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছি ২০০০ সাল পর্যন্ত। নাট্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, ময়মনসিংহ ও ঢাকা মঞ্চে। বর্তমানে বেতারে অভিনয় করছি। মাঝে মধ্যে টেলিভিশনেও। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় আমার লেখা ‘লুবনা’ ছড়াটি ছাপা হয় ৬১ সালে। সেই সুবাদে রংপুর তিস্তা প্রজেক্টে অনিয়মিত নকশানবিশ পদে চাকুরীতে যোগদান। রোজগারের প্রথম টাকা বাবার হাতে তুলে দিয়ে তাঁর অফুরন্ত দোয়া পেয়েছি। যা আমার আগামী দিনের পাথেয়। বাবার অবসর জীবন। সংসারের দায়ভার আমার কাঁধে আসে। পরবর্তীতে, প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে এস,এস,সি ও এইচ,এস,সি পাশ।
সে সময় দিনাজপুর জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছান্দসিক কবি কাজী কাদের নেওয়াজ ও দিনাজপুর ‘নাজিমুদ্দিন হল’ এর প্রতিষ্ঠাতা হেমায়েত আলি সাহেবের আহবানে আমি রংপুর থেকে প্রতি শুক্রবার নিয়মিত লেখা নিয়ে দিনাজপুর নওরোজ সাহিত্য আসরে গিয়ে উপস্থিত হতাম। পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের সংশোধন করে দেওয়া কবিতাগুলো কবি কাদের নেওয়াজের লেখা ভূমিকা দিয়ে আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘অপেক্ষা’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। বইটি প্রকাশ করায়, সে সময় আমার কিছু আর্থিক স্বচ্ছলতা ও কবি পরিচিতি আসে।
১৯৬৪ সালে চিত্রনায়ক রহমানের ‘মিলন’ ছায়াছবিতে অভিনয়। তখনকার চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব খান আতউর রহমান, জাহির রায়হান, কাজী খালেক, সুভাসদত্ত, আবুল বজল তুলিপ, আব্দুল মজিদ, মোহাম্মদ আনসার ও পশ্চিম পাকিস্তানের নায়িকা দিবা, ক্যামেরাম্যান নাসের, আফজাল চৌধুরী প্রমূখ গুণিন মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি।
১৯৬৫ সালে রংপুরে ‘সুর-সংলাপ’ নামে সংগীতের আসর প্রতিষ্ঠা করে বন্ধু জওহর আলির অনুপ্রেরণায় সংগীত চর্চা করেছি, তিন বছর। একান্ত ঘরোয়া পরিবেশে মাঝেমধ্যে নজরুল সংগীত পরিবেশন করতাম।
সংগীত চর্চা ও মঞ্চ নাটকের পাশাপাশি আমার গান লেখার চাহিদা বেড়ে যায়। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান রাজশাহী থেকে অনুমোদিত গীতিকার হিসেবে আমি তালিকাভূক্ত হই। এবং ১৯৬৭ সালে স্থাপিত রংপুর রেডিও থেকে বন্ধু খাদেমুল ইসলাম বসুনিয়ার সুর ও কণ্ঠে প্রথম সম্প্রচার হয় আমার লেখা ঈদের গান- ‘আজকে ঈদের খুশির দিনে খোশ দিলেতে হাত মিলাই/ঈদ-মোবারক, ঈদ মোবারক সবাইকে সালাম জানাই ॥’ সেসময় রংপুর ও রাজশাহী রেডিওর জন্য পল্লীগীতি , ভাওয়াইয়া, ভার্টিয়ালী, আধুনিক, বাউল, গজল, ইসলামী, ঠুমরী ও বাংলা রাগ প্রধান গান, গীতি-নকশা, জীবন্তিকা ও নাটক সব রকম লেখা নিয়মিত লিখতে হতো আমাকে। ৬৮ তে বাবার মৃত্যুর পর গান গাওয়া ছেড়ে দেই।
ছান্দসিক কবি কাদের নেওয়াজের অনুপ্রেরণায় সৎসাহিত্য ও সুষ্ঠু সংস্কৃতি চর্চার লক্ষে ১৯৭৮ সালের ৫ মে তারিখে আমি রংপুরের নবীন ও প্রবীন লিখিয়েদের আহবান করে প্রতিষ্ঠা করি, অভিযাত্রিক সাহিত্য ও সং®কৃতি সংসদ। ৭৮ এর ৫ মে তারিখে দেওয়ান বাড়ী সড়কে (টাইম হাউসের পিছনে ভাঙ্গা কাঠের দোতলায়, এখন নেই) বিকেল ৩ টায় অনুষ্ঠিত হয় অভিযাত্রিকের প্রথম সাপ্তাহিক সাহিত্য আসর। এতে সভাপতিত্ব করেন সভাপতি শামসুল হক লাল।
পরবর্তী সময়ে সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন অধ্যাপক সুফি মোতাহার হোসেন। সম্ভবতঃ অভিযাত্রিকেই রংপুরে প্রথম নিয়মিত সাপ্তাহিক সাহিত্য আসর প্রচলন করে। অভিযাত্রিক প্রতিষ্ঠাকাল থেকে আমি প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি ২০০৩ সাল পর্যন্ত। আমার ব্যক্তিগত প্রচেষ্ঠা ও আর্থিক সহযোগিতায় নতুন লিখিয়েদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য ‘অভিযাত্রিক প্রকাশনী’ থেকে অভিযাত্রিক সদস্যদের পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছি। উল্লেখ্য যে, অভিযাত্রিকের প্রথম সভাপতি শামসুল হক লাল, পরে সুফি মোতাহার হোসেন, মোয়াজ্জেম হোসেন তাব্বাসি, আব্দুল আলিম, এম আইনুজ্জামান এবং বর্তমানে সভাপতি এ্যাড. এমএ বাশার। সাধারণ সম্পাদক সাঈদ সাঈদুল ইসলাম। ০৭ অক্টোবর ২০১৬ শুক্রবারে অনুষ্ঠিত হয়েছে অভিযাত্রিক এর ১৯৭৯ তম সাপ্তাহিক সাহিত্য আসর ।
সে সময় অভিযাত্রিকে যাঁরা সক্রিয় ছিলেন, তাদের মধ্যে কবি নুরুল ইসলাম কাব্য বিনোদ, রোমেনা চৌধুরী, হামিদা সরকার, বেগম তাজুন্নাহার, ইলা নিয়োগী, কবি মনোমোহন বর্মণ, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, মতিউর রহমান বাস্নিয়া, মোয়াজ্জেম হোসেন তাব্বাসি, অধ্যাপক আলিম উদ্দিন, বাদল রহমান, বিনু সরকার, আকলিমা খন্দকার, আজাহার আলী মন্টু, আব্দুস সাত্তার মন্টু, গৌরী রায়, মনসুর আলী বাবলু, আব্দুল গফুর সরকার, দ্বীগেন বর্মন, অধ্যাপক প্রদীপ বিকাশ চৌধুরী, তৈয়বুর রহমান বাবু, এ্যাড. এমএ বাশার টিপু, ব্রজ গোপাল রায়, আব্দুল আলীম, আফতাব উদ্দিন, মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম, এ্যাড. সালাউদ্দিন কাদেরী, সাংবাদিক মাহবুবুল ইসলাম, কল্লোল আহম্মদ, আফতাব হোসেন, রুহী জাকিয়া, তাসকিন পারুল, হেলেন আরা সিডনী, জয়তুন্নাহার, অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহ আলম, সোহরাব দুলাল, আনোয়ারুল ইসলাম রাজু, আজমল হক রাজু, মমতাজুর রহমান বাবু, ডা. মফিজুল ইসলাম মান্টু, মনোয়ারা বেগম, নজরুল মৃধা, শ্বাশত ভট্টচার্য্য, মুকুল রায়, আব্দুল হাই সিকদার, কালিরঞ্জন বর্মন, সাংবাদিক আনিসুল হক, খন্দকার সাইদুর রহমান, জাফরী জোবায়ের (লন্ডন), ড. মনিরুজ্জামান, ড. নাসিমা আখতার, লায়লা রশিদ, দিলারা মেসবাহ, দিলরুবা শাহাদৎ , লীনা, রওশন আরা রুবি, জবা রায়, জিহাদী, সাঈদ সাঈদুল ইসলাম, জাহিদ হোসেন, এড. আবুল কালাম, আজাহার আলি সরকার সহ আরও অনেকে।
অভিযাত্রিক সাহিত্য সংকলন সম্পাদনা ও প্রকাশনা ছাড়াও আমার যৌথ সম্পাদনায় রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষদের ত্রৈমাসিক সাহিত্য সংকলন প্রকাশ হয়েছে। ১৯৯৪-৯৬ সাল পর্যন্ত আমি দৈনিক যুগের আলো পত্রিকার সাপ্তাহিক সাহিত্যপাতা সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছি। বর্তমানে আমি ‘উত্তরমেঘ’ নামে একটি অনিয়মিত সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক।
১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে প্রচার হয়েছে আমার লেখা ও পরিচালনায় আঞ্চলিক গীতিনৃত্য ‘রংপুরের জারি’। এবং ৮৬ তে প্রচার হয়েছে গীতিনাট্য ‘নাইওরী’। জুন, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ বেতার রংপুর কেন্দ্র থেকে প্রচার হয়েছে শিশু কিশোরদের বিশেষ অনুষ্ঠান ‘ধাঁধার আসর’ ও ডিসেম্বর মাসে প্রচার হয়েছে রংপুরের ইতিহাস ঐতিহ্য, স্থাপত্য শিল্প ও গুনিন মানুষদের নিয়ে গবেষণা মূলক অনুষ্ঠান ‘আলোকিত রংপুর’। বাংলাদেশ টেলিভিশনে আলোকিত রংপুর প্রচার হয়েছে ১৪ মার্চ, ২০১৬ সালে। এছাড়াও আমার লেখা ছড়া, কবিতা, দেশ ও দেশের বাইরের পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশ হয়ে আসছে।
বিভিন্ন সময়ে আমি যাঁদের সান্মিধ্যে এসেছি তাঁরা হলেন, সাহিত্য: পল্লীকবি জসিম উদ্দিন, ছান্দসিক কবি কাদের নেওয়াজ, কবি বে-নজির আহমেদ, সব্যসাচী লেখক সামসুল হক, কবি কায়সুল হক, কবি আসাদ চৌধুরী, ড. রেজাউল হক, কিংবদন্তী ছড়াকার রফিকুল হক, ছড়াকার লুৎফর রহমান লিটন, মৌলভী খেরাজ আলি, হায়দার আলি চৌধুরী, কবি নুরুল হুদা, কবি নাসির আহমেদ, কবি রাজু আলীম, সাংবাদিক আনিসুল হক, চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন। ভারতের দীলিপ চক্রবর্তী, কাশেমা খাতুন, গীতা দাস ও জলপাইগুড়ির এ্যাড. আকরাম হোসেন।
সংগীতেঃ ওস্তাদ হরিপদ দাস, আব্দুল জোব্বার, বশির আহমেদ, সাজেদার রহমান, অজিত রায়, মহেশ রায়, সাজু মিয়া, জওহর আলি, কছিমুদ্দিন, মোহাম্মদ কচি, যোগন বাবু, মিনা ভট্টচার্য, হাসানাত তালুকদার, রেহেনা বেগম, শরীফা রাণী, বেবী নাজনীন, বেগম সুরাইয়া, ইউসুফ আলি, সেতার বাদক নবদ্বীপ লাহিড়ি, আজমল হোসেন চানু, গীটারে বিনয় বণিক, দোতরা বাদক নমুরুদ্দীন, কুতুবউদ্দিন, বংশিবাদক মুনসুর আলি, আব্দুস সবুর, তবলায় সন্টু, রোস্তম আলি এবং কণ্ঠশিল্পী খুরশীদ আনোয়ার ও শামীম আহমেদ।
নাটকেঃ কাজী মোহম্মদ ইলিয়াছ, তিতু মুনসী, কাজী ইয়াহিয়া, গিরিন ঘোষ, ডাঃ জুন, বিমল ভট্টচার্য্য, মকসুদুল হক, মকসুদ হোসেন, প্রফেসর আব্দুল হাদী, আশুতোষ দত্ত, আব্দুস সবুর, দিলোয়ার হোসেন, মনোয়ার হোসেন, সবিতা সেন, বেণী মাধব বণিক, নগেণ বর্মন, আতোয়ারুজ্জামান লাঞ্চু, কামাল মজিদ রাঙ্গা, খন্দকার আবুল মাহমুদ, সামসুজ্জোহা বাবলু, বিপ্লব প্রসাদ, সেকেন্দার রহমান দুদু, রাজ্জাক মুরাদ, ইফতেখারুল ইসলাম রাজ, মাখন বণিক, নাট্যকার আদম হোসেন ও আব্দুল খালেক জোয়ারদার।
নাট্যজন হিসেবে আমি ভারতের ‘শিলিগুড়ির দিনবন্ধু মঞ্চে’ সংবর্ধিত হয়েছি ২০০০ সালে। সাহিত্যিক হিসাবে আসামে ২০১০ সালে। রংপুর পৌরসভা, রংপুর কর্তৃক সিনিয়র সিটিজেন এ্যাওয়ার্ড পেয়েছি ২০১১ সালে। লোকসংগীত, ভাওয়াইয়া বিষয় আলোচনার জন্য ভারতের গৌরীপুরে গিয়েছি ২০১৩ সালে। ঢাকা থেকে পল্লীকবি ‘জসিম উদ্দিন সাহিত্য পুরস্কার’ পেয়েছি ২০১৫ সালে। এছাড়াও রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, রাজশাহী ও ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সম্মাননা পেয়েছি বিভিন্ন সময়ে।
বর্তমানে রংপুর সাহিত্য অঙ্গনকে যারা আলোকিত করছেন তাদের মধ্যে রঙ্গঁপুর সাহিত্য পরিষদ সচিব মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন, আলহাজ কাজী মো: জুন্নুন, অধ্যপক রমজান আলী, রাকিবুল হাসান বুলবুল, জোবায়ের আলী জুয়েল, রেজাউল করিম মুকুল, সাংবাদিক জাকির আহমদ, রেজাউল করিম জীবন, শ্রাবণ বাঙ্গালী, সমকালীন ছড়াকার আশাফা সেলিম, এটিএম মোর্শেদ, সাঈদ সাঈদুল ইসলাম, মতিয়ার রহমান, কামরুজ্জামান দিশারী, এস.এম শহীদুল আলম, আহসান হাবিব রবু, বজলুর রশিদ, গল্পকার ও কবি এসএম সাথী বেগম, কামরুন নাহার রেনু, মনজিল মুরাদ লাভলু, সাদ্দাম হোসেন, আদিল ফকির, সাকিল আহমেদ, সামসুজ্জামান সোহাগ, দৈনিক যুগের আলো সিনিয়র ফটো সাংবাদিক মো: আসাদুজ্জামান আফজাল ও রনজিত দাস। এরমধ্যে আমি দিনাজপুর ও সৈয়দপুরের ক’জন কবি ও ছড়াকারের উষ্ণ সানিধ্যে এসেছি তাঁদের মধ্যে লুৎফর রহমান, আবু বকর মুহাম্মদ সালেহ, সোহেল করিম দিপু ও অনন্য আমিনুল।
১৯ জানুয়ারি ১৯৪১ সালে রংপুরের মুন্সিপাড়ায় আমার জন্ম। পিতা-মরহুম নসিম উদ্দিন আহমেদ, মাতা- মরহুমা সাহেরা খাতুন। আমি মা-বাবার তৃতীয় সন্তান। সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠা। মুন্সিপাড়া প্রাইমারি স্কুলে লেখাপড়া শুরু। সরকারি কর্মকর্তা বাবার চাকরির সুবাদে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় অস্থায়ী বসবাস। বিভিন্ন মানুষের সাথে পরিচয় ও বিভিন্ন স্কুলে লেখাপড়া করার বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন। পরিশেষে, আমার লেখা ‘অসমাপ্ত গল্প’ কবিতাটি লিখে সমাপ্তি টানছি।
একদিন এক হস্তরেখাবিদ আমার হাত দেখে বলেছিলেন,
আমি নাকি ভাগ্যবান, প্রেমিক পুরুষ।
মস্ত বড়লোক হবো, বাড়ি হবে, গাড়ি হবে ইত্যাদি ইত্যাদি
চল্লিশোর্ধ বয়স হলো- এখন সে সব কথা স্বপ্নের ফানুষ।
পৈতৃক ভিটা ছিল- একটি টিনের ঘর এক চিল্তে উঠোন,
ছিল সহোদর, লালসার বিকৃত মুখ।
তারপর, ভিটে গেল, ঘর গেল, পর-গৃহে বসবাস এখন
সাত-পুরুষের রক্তদহের বিলে হলো না পদ্ম তোলার সুখ।
মা বলতেন- “বাবা, তুই বামুন পৈতে ছেলে, সুখি হবি,”
শৈশবে মাকে হারালাম, বাবাকেও একদিন।
দু’টি উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন হ’লো আমার জীবন থেকে
চোখে ছানি পড়লো, সুখ পাখি দেখা হবে না কোনোদিন।
সত্যিকার ভালোবেসে বুকের চন্দনঘ্রান যাকে দিয়েছিলাম,
সে এখন কার্তিকের মরা জোছনায়,
একদিন নন্দিতাও তার একান্ত ভালোবাসার গল্প বলেছিল,
অসমাপ্ত গল্প; তারপর, জানিনা সে এখন কোথায়!

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge