হাট্টিমাটিমটিম-
রেজাউল করিম মুকুল
‘হাট্টিমাটিম টিম’। তারা মাঠে পাড়ে ডিম, তাদের খাড়া দুটো শিং, তারা হাট্টিমাটিম টিম এই ছড়াটি রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই এর লেখা একটি ৫২ লাইনের সম্পূর্ণ ছড়া । কেউ কেউ বলেছেন হাট্টিমাটিম টিম হচ্ছে এক ধরনের অতিথি পাখি, হাঁস। শীতের সময় আমাদের দেশের বিভিন্ন জলাশয় এবং মাঠে আশ্রয় নেয় যেসব অতিথি পাখি তাদেরই কেউ ছড়াকারের কল্পনার হাঁস এই হাট্টিমাটিম টিম। সেখানেই তারা ডিম পাড়ে। সেখান থেকে বাচ্চা হয়। সেই বাচ্চাগুলো আবার বড় হয়। এরপর পাখা হলে তারা আবার উড়ে চলে যায় নিজ দেশে। তবে ছড়াকার রোকনুজ্জামান খান হাট্টিমাটিম টিম ছড়ার গল্পটা কিছুটা ছন্দ আর মনের মাধুরী মিশিয়ে শিশুদের কৌতুহলোদ্দীপক করেই তাদের খাড়া দুটো শিং লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সে কারণেই মনে হয় ছড়াটির মতো করে অংকিত ছবিটি হোয়ে উঠে কাল্পনিক একটি প্রাণিতে হাটট্টিমাটিম টিম।
গত ৯ এপ্রিল ছিলো কালজয়ী শিশুসাহিত্যিক ও সংগঠক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের জন্মদিন। তিনি গোটা দেশজুড়ে দাদাভাই নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। তিনি আমৃত্যু দৈনিক ইত্তেফাকের কচিকাঁচার আসর বিভাগের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সে সুবাদে আসরের সদস্য আমরা সবাই ওনাকে দাদাভাই ডাকতাম। ইত্তেফাকের পাতায় ছাপা একটি কুপণ পূরণ করে দিলেই সদস্য হওয়া যায়। সদস্য হলেই পরের আসরে দাদাভাইয়ের চিঠি। সে সময় আমরা পাঁচ পয়সা দামের পোষ্টকার্ডে দাদাভাইকে চিঠি লিখতাম। মজার ব্যাপার হলো দাদাভাই প্রত্যেকের চিঠির জবাব দিতেন যে যেমনটা জানতে চায়। যার লেখা ছড়া, গান, কিংবা গল্প ভালো হতো সে সময়ের বহুল সমাদৃত দৈনিক ইত্তেফাকে সেটি ছাপাও হতো। নিজের হাতে আঁকা ছবি এবং নাম ছাপার অক্ষরে ইত্তেফাকের মতো কাগজে দেখতে পাওয়া যে কত বড় একটা সৌভাগ্য ছিলো তা সেদিনের মতো আজও সমান আনন্দের। দাদাভাই সাহিত্য রচনা ও শিশু সংগঠক হিসাবে অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে পেয়েছেন নানা পুরস্কার ও সম্মাননা। ১৯২৫ সালের এই দিনে রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার এক সংস্কৃতমনা পরিবারে জন্ম রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের। তার সম্পাদনায় ইত্তেফাকের শিশুপাতায় একসময় সুফিয়া কামাল, আব্দুল্লাহ আল মুতি শরফুদ্দিন, শওকত ওসমান, আহসান হাবীব, ফয়েজ আহমেদ, হোসনে আরা, নাসির আলী, হাবীবুর রহমানের মতো বিখ্যাত কবি ও লেখকদের লেখা প্রকাশিত হয়। ১৯৫৬ সালে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিশু-কিশোর সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই। তার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এর শাখা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এর মূল কেন্দ্র ঢাকায়। তার প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্যে হাট্টিমাটিম (১৯৬২), খোকন খোকন ডাক পাড়ি, আজব হলেও গুজব নয় প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সৃজনশীল শিশুসাহিত্য ও শিশু সংগঠনে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসাবে রোকনুজ্জামান খান বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৮), শিশু একাডেমি পুরস্কার (১৯৯৪), জসিমউদ্দীন স্বর্ণপদক, একুশে পদক (১৯৯৮) ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৯) পেয়েছেন। রোকনুজ্জামান খান ১৯৫২ সালে বিয়ে করেন সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের কন্যা নূরজাহান বেগমকে। নূরজাহান ছিলেন দেশের ঐতিহ্যবাহী সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বেগম’য়ের সম্পাদক। ১৯৯৯ সালের ৩ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। এই মনীষীর ৯৭তম জন্মবার্ষিকীতে অশেষ শ্রদ্ধা ও অভিবাদন প্রিয় শিশু সাহিত্যিক ও সংগঠক রোকনুজ্জামান খান, আমাদের প্রিয় দাদাভাই। শিশু কিশোর মানস গঠনে ও নির্মল সাহসী শিশু চরিত্র বিনির্মানে সেদিনের সেসব শিশু সংগঠন ও পরিচালক দাদাভাইয়ের ভূমিকা দেশ ও জাতি গঠনে কি অবদান রেখেছে তা আজকের বিপথগামী শিশু কিশোরদের অপরাধ প্রবনতা দেখেই বলা যায় It is better to imagine than describe.
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক।
Leave a Reply