মিশরের হারিয়ে যাওয়া সোনালী শহর
রেজাউল করিম মুকুল
মিশরের মরুভূমিতে সম্প্রতি আবিষ্কৃত হোয়েছে এখন থেকে তিনহাজার বছর আগের প্রাচিণ আ্যাটেন নগর, গবেষণা মিশন প্রধান ড. জাহি হাওয়াস এটির নাম দিয়েছেন, “lost golden city’, মিশর উপত্যাকার রাজপ্রাসাদ লুক্সর এর সন্নিকটে এযাবত আবিষ্কৃত সবচেয়ে প্রাচিণ ও বড় শহর। এটার গ্রহনযোগ্যতা হলো এই নগরীতে পাওয়া গেলো খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৬৩ থেকে ১৩৫২ সময়ের ফারাও টুটানখামুন এর সামাধিক্ষেত্র। সম্রাট আমেনহোটেপ-৩ এর রাজত্বকালের সিলমোহরকৃত ইট, মাটির পাত্র, বাজুবন্ধ, কোমরের বিছা জাতিয় অলংকার পাওয়া গেছে কবরে। এবারে ধান ভানতে খানিকটা শিবের গীত গাঁইতে চাই।
পাঁচ হাজার বছরেরও বেশী প্রাচীন আজকের এই মিশরের রয়েছে সভ্যতার উত্থান পতনের, ভাঙ্গা গড়ার আর দখল বেদখলের বিচিত্র অভিজ্ঞতার ইতিহাস। মিশর ছিলো হাত বদলের একটি বিশাল ভূখন্ড। দেশী বিদেশীরা ইচ্ছেমত দখল করেছে, শাসণ করেছে আবার বেদখলও হোয়েছে । মিশরের ইতিহাস আজও সে কথাই বলে । পূর্ব আফ্রিকার উত্তর পূর্ব কোণে লিবিয়া আর জর্ডানের মাঝে ভূমধ্যসাগরের তীরঘেষা আফ্রিকার তথা গোটা বিশ্বের প্রাচীণতম জনপদ মিশর। দেশটির দক্ষিণে রয়েছে পূর্ব-আফ্রিকার আরো ০৮টি স্বাধীন ছোটবড় ধণী গরীব দেশ। এগুলো হোচে্ছ সুদান, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া জিবাউটি, কেনিয়া, উগান্ডা ও তানজানিয়া। মিশরকে নীলনদের আশির্বাদ বলা হয়। উগান্ডা, কেনিয়া ও তানজানিয়ার মাঝখানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ লেক ভিক্টোরিয়া থেকে নীলনদের জন্ম যা উত্তরে উগান্ডা, সুদান হয়ে মিশরের বুক চিরে ভূমধ্যসাগরে পড়েছে। ২৬,৫৬০ বর্গমাইলের লেক ভিক্টোরিয়া থেকে উৎপন্ন নীলনদের দৈর্ঘ্য ৪১৬০ মাইল। এছাড়াও মিশরের রয়েছে একক মালিকানার সুয়েজ ক্যানাল যা ১৮৬৯ সালে ফরাসি প্রকৌশলীরা লোহিত সাগর থেকে মিশরের হুরঘাডা, হেলওয়ান, সুয়েজ, ইসমাইলিয়া, ও সাইদ বন্দর দিয়ে ১২০ মাইল দীর্ঘ একটি সোজা নৌপথের সৃষ্টি করেছে। সোজা সাপ্টা এপথে বছরে ২০-৩০ হাজার মালবাহী জাহাজ অতিক্রম করে আর মিশরের ঘরে আসে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। ১৯৫৩ সাল পযন্ত ফরাসি ও ব্রিটিশরা এটি তাদের দখলে রেখেছিলো । বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় সাত গুণ বড় ৩,৮৬,৬৬০ বর্গমাইল আয়তনের মিশরের জনসংখ্যা প্রায় সাত কোটি, যার ৮০ লক্ষ বাস করে রাজধানী কায়রোতে। কায়রোর পুরাতন অংশে আছে এক হাজার মসজিদ আর নুতন আধুনিক অংশে আছে কয়েক হাজার মদ, জুয়া, আর দেশী-বিদেশী ধণবান নারী পুরুষের অবাধ পদচারনায় মূখরিত অভিজাত হোটেল, মোটেল, রেসটাউরেন্ট ও ক্যাসিনো।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৫০ সময়কালকে মিশরীয় সভ্যতার শুরু ধরা হয়। এসময় মিশরে উচ্চভূমি ও নিম্নভূমিতে দুটি রাজ্য ছিলো। নারমার শাসকরা দুটিকে একিভুত করে একক রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৫০এ সাককারায় জোসারের সমাধিতে নির্মিত হয় সিড়ি পিড়ামিড যা ছিলো বড় বড় পাথরের তৈরী বিশ্বের প্রথম পিড়ামিড। খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ অব্দে মিশরের গিজায় নির্মিত হয় সবচেয়ে বড় পিড়ামিড রাজা খুফু এর সমাধিতে । খ্রিষ্টপূর্ব ২১৬০ থেকে ২১০০ বছরকে বলা হয় মাধ্যমিক সময়কাল। এসময়ে মৃতদের সমাধিস্হ করার প্রথা সাধারন জনগনের মধ্যেও চালু হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ২১০০ থেকে ১৭৮৬ পযর্ন্ত মেনটুহোটেপ রাজারা শাসন করতেন। খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৮৬ থেকে ১৫৫০ হাইকসোস এবং ১৫৫০ থেকে ১০৫০ পাঁচশত বছর আমেনহোটেপ প্রথম, রাণী হাটসেপসুট, থুটমোস তৃতিয়, টুটানখামুন এবং রামসেস দ্বিতীয় শাসন করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৭৯ থেকে ১৩৬৩ সময়ের ফারাও বা রাজা আখিনাটেন ও তার রাণী নেফারটিটি সূর্য্ ছাড়া অন্য দেবতাদের পুঁজা বন্ধ করে দেন। খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৬৩ থেকে ১৩৫২ সময়ের ফারাও টুটানখামুন সব দেবতার পুঁজা পুনরায় চালু করেন। ফারাও রামসেস তার শাসনামলে আবু সিমবেল এর সমাধিতে পিড়ামিড নির্মাণ করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৫০ থেকে ৬৬৭ মিশরে ছিলো নিউবিয়ান শাসণ। খ্রিষ্টপূর্ব ৬৬৪ থেকে ৩৩৩ সময়কালে মিশর চলে যায় পারস্য সেনাপতি দারিয়ুস তৃতীয় এর হাতে । খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২ অব্দে বিখ্যাত ইসুজ এর যুদ্ধে গোটা পারস্য সহ মিশর এবারে চলে যায় গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের দখলে । পরের বছর ৩২১ অব্দে আলেকজান্ডার সমুদয় পারস্য সম্রাজ্য ধ্বংস করেন নিয়েছিলেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০ অব্দে মিশর রোমানদের দখলে চলে যায়। এ সময় মিশরের রাণী ছিলেন ক্লিওপেট্রা সপ্তম। অন্যদিকে রোমে জেনারেল পমপেই রাজা জুলিয়াস সিজারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ব্যর্থ হয়ে পালিয়ে আসে মিশরে । সিজার জেনারেল পমপেইকে ধরতে মিশর অবধি অনুসরণ করেন এবং সেখানে পলাতক পমপেই এর মৃত্যু হলে সিজার রাণী ক্লিওপেট্রার প্রাসাদেই থাকেন এবং তাকে সহ রোমে ফিরে আসেন। রোমের রাজ প্রাসাদে সিজার নিহত হলে মিশরের রাণী রোমের সেনাপতি এনটোনিও এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং তাদের দুটি সন্তান থাকে। কিন্তু ততোদিনে হতভাগ্য মিশর রোমান সম্রাজ্যভূক্ত হেয়ে যায় বিনা যুদ্ধে। ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রোমের পতন হলে মিশর সেবারে হাত বদল হয়ে যায় আরব মুসলমানদের দখলে ৬৪১ খ্রিষ্টাব্দে। দূর্গম সাহারা মরুভূমি অতিক্রম করে আরব বণিকরা ইসলামের পতাকা হাতে প্রথম আফ্রিকার ছোট বড় দেশগুলো একে একে দখলে নেয়। ১১৬৯ খ্রি্ষ্টাব্দে মিশরের ক্ষমতা গ্রহণ করেন বাদশাহ সালাহউদ্দিন। এ সময় তিনি সিরিয়া ও প্যালেস্টাইনের (ইসরাইল) এর শাসনকর্তা ছিলেন।
১০৯৬ থেকে ১২৭০ খ্রিঃ সময়কালে প্যালেস্টাইন দখলে নেয়ার জন্য খ্রিষ্টাণ ও ইহুদীরা ০৮টি ধর্মযুদ্ধ করে। ১২০২ থেকে ১২০৪ খ্রিঃ চতুর্থ ধর্মযুদ্ধে ইহুদীরা মিশর দখল করে নেয় কিন্তু ১২১৮ থেকে ১২২১খ্রিঃ পঞ্চম ধর্মযুদ্ধে মিশর দখলমুক্ত হয়। ১২৫০খ্রিঃ বিদ্রোহী মামলুক দাসগণ এবারে মিশরের দখল নেয় আর ১৫১৭ খ্রিঃ মিশর ও সিরিয়া তুরস্কের অটোমান সুলতানী শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯১৪খ্রিঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে মিশরীয়রা সুলতানী শাসনের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এবারে চুক্তিবদ্ধ হয় ব্রিটেনের সাথে এবং ১৯২১খ্রিঃ পর্য্ন্ত উপনিবেশ থাকে এবং ১৯২২খ্রিঃ ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীণতা লাভ করে। ১৯৪২ খ্রিঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের প্রাক্কালে জার্মাণ জেনারেল ফিল্ড মার্শাল রোমেল মিশর দখল নেয়ার জন্য এল-আলামেন উপস্তিত হলে ব্রিটিশ জেনারেল মন্টি বাধা দেয় এবং মিশর সে যাত্রা রক্ষা পায়। ১৯৫৩ খ্রিঃ ফ্রান্স ও ব্রিটেন সুয়েজ ক্যানালের দখল ছেড়ে দেয়। এরপর থেকে অদ্যাবধি মিশরের রাষ্ট্রিয় ক্ষমতা দখলের পালাবদল চলতে থাকলেও আর কো বহিঃশত্রুর আক্রমণ হয়নি। একেবারে শুরুতে প্রাচীন যুগে অর্থাৎ প্রায় তিন হাজার বছর আগের মিশরের রাজা প্রজারা ১৮ রকম দেব দেবীর নিয়ন্ত্রনে ছিলো। যে কোন কাজে দেবতাগনের অনুমোদন গ্রহণ কিংবা দায় দেব দেবীর উপর ন্যস্ত করা হতো। মিশরের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় এরা সবসময় কারো না কারো শাসনাধীন কিংবা নিয়ন্ত্রনাধীন ছিলো। দেব-দেবীর নিয়ন্ত্রন থেকে মুক্তি পেলেও বিদেশী দেবতারা শাসন করেছে দীর্ঘ সময় এবং মিশরীয়রা তা মেনেও নিয়েছে বারবার ।
সম্প্রতিকালের ক্ষমতার পালাবদলে মিশরীয়রা আবার দেশী বিদেশী নানাবিধ ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হয়েছে এবারে কখনো সামরিক শাসকরা, কখনো মৌলবাদী জঙ্গীরা দেশটির ভাগ্যবিধাতা হোতে চায় । ২০১১খ্রিঃ ২৫ জানুয়ারী মিশরের তাহরির স্কোয়্যারে লাখো জনতার মিলিত কন্ঠধ্বণি- মুরসি! মুরসি! হাসান আল বান্নার ব্রাদারহুডের রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধে ক্লান্ত শ্রান্ত মিশরের চতুর্থ প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারক ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলেন। বছর না ঘুরতেই ৩০ জুন মিশরের সেনাবাহিনী রাস্তায় মুরসি সমর্থকদের তাড়া করতে শুরু করলো। হটাৎ ঝলসে উঠা মুরসি ও ব্রাদারহুড মৃত্যু ও ধ্বংসের মাঝে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি সময় বুঝে মিলিটারির পোষাক খুলে ফেললেন। এরাই মিশরের নব্য ফারাও, এরাই এখন মিশরের দেবতা।
লেখক : প্রবন্ধকার ও গবেষক।
Leave a Reply