মঙ্গলবার, ০৬ Jun ২০২৩, ০৩:১৭ পূর্বাহ্ন

জীবন এখানে যেমন-মোশফিকুর রহমান

জীবন এখানে যেমন-মোশফিকুর রহমান

জীবন এখানে যেমন
মোশফিকুর রহমান

সূর্য ডুবো ডুবো করছে,একটু পরেই নেমে আসবে নিভু নিভু সন্ধ্যা! সবাই যে যার মতো আজএকটু আগেভাগেই কাজ গোছায়ে তিস্তার ওপার হতে বাড়ির দিকে ছুটে আসছে! অনেকে তো গত কয়েকদিন কাজেই যাননি! কোন জানি এক এনজিও রিলিফ নিয়ে আসবে সেই আশায়! কিন্তু আজ চন্ডিমারীর এক নম্বর ইস্পার এলাকায় থমথমে একটা ভাব লক্ষ্য করছি। এক আপায় গত কয়েকদিন ধরে এই গ্রামের বিভিন্ন পাড়ায় জরিপ করে অবশেষে আজ এই পাড়ায় জরিপ করতে এসেছে,আর পাড়ার বউ বাচ্চারা তার পিছন পিছন ঘুরছে। সবাই একটু সুযোগ খুঁজছে সে তালিকায় নিজের নাম এন্ট্রি করার। আবার অনেকে সন্দেহ পোষণ করছে,
…হামার গুলারটে থাকি টাকা পাইসা নিয়া ফির পালাইবে নাকিরে! আর একজন বলছে
এমাক বেলে কোনো টাকা দিবার নাইগ্বে না!
…না নাগালে তো ভালো! গতবার ওই নাউয়ার ব্যটাগুলা মোক গরু দিবার কথা কয়া দুই হাজার টাকা নিয়া পালাইচোলো!
হয় হয় হা,এলা বেলে বেভন্নটে নাকি এ্যানজিওর কথা কয়া টাকা নিয়া পালে যায়চে! আগত ভালো করি দেকমো,যদি কোনো কিছু দেয় তাইলে হামাও টাকা দেমো!
এই এলাকার মানুষজন একটু অলস প্রকৃতির! এরা তিস্তার উপরেই নিজেদের ভাগ্য সপে দিয়ে বসে আছে! যেই আসুক এই তিস্তার করালগ্রাসের চিত্র দেখাবে আর নিজের মাথা চাপরাবে,কিন্তু ভাগ্য পরিবর্তনের এতটুকুও চেষ্টা করবেনা! তিস্তার ছোবলে একটু ক্ষতি হলেই তাদের যেনো ভাগ্যের উন্নয়ন। কেননা তখন বিভিন্ন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিবে,আর সেটা যদি আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা হয় তাহলে তো কথায় নেই পুরো ছয়মাস বসে বসে সেই টাকাটা শেষ না হওয়া পযন্ত খাবে। এদের একটাই কাজ কখন কোন এনজিও এ এলাকায় আসবে তাদের খোঁজ করা। এখানে তো অনেকেই রিলিফ পাওয়ার আশায় চরের মধ্যে একটা করে বাড়িও বানিয়ে রেখেছেন! যখনই কোনো এনজিও আসবে,তখনই তারা সেই বাড়িতে কাথা বালিশ নিয়ে হাজির! তখন এনজিও কর্মীদের শোনাতে থাকবে তাদের হাজারো দুঃখগাথা! রিলিফ পেলে আবারও তার নিজ আবাসস্থলে ফিরে যাবে।
সেদিন দেখলাম মর্জিনা চাচি পার্শ্ববর্তী হাতিবান্ধা উপজেলা হতে তার বড় মেয়েকে নিয়ে এসেছে রিলিফের জন্য নাম লেখানোর জন্য! তিনি এনজিও কর্মীর কাছে কাঁদছেন আর বলতেছেন
ও মা তোমায় দেকো তো,মোর বেটিটার কী অবস্থা করছে গোলামের ব্যাটা,ভাত কাপড় দিবার পায়না খালি ডাঙ্গায়! দুই মাস হইল ছাওয়াটাক মোর তালাক দিয়া বাড়ি পটে দিছে!
মর্জিনা চাচির দু’চোখ বেয়ে অশ্রুর বন্যা বয়ে যাচ্ছে,পাশেই নির্বাক হয়ে দাড়িয়ে আছে দু’মাস আগে তালাক পাওয়া তার মেয়েটা! কিন্তু তার বেশভুষা ও সাজসজ্জা দেখে একটুও বিমর্ষ মনে হলোনা!
গত কিছুদিন আগেই রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি বন্যা কবলিতদের জন্য এলাকায় ঘরবাড়ি,নগদ অর্থ দিয়ে সাহায্য করল। ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশও কাজ করেছেন এ এলাকায়,এসইএলপি নামের এনজিও অনেক সাহায্য দিয়েছেন,কিন্তু কারোরই ভাগ্যের কোনো উন্নয়ন হয়নি। যারা রিলিফ পান তারাই প্রতিবারই পেয়ে থাকেন,অন্যেরা নিরব দর্শক!
ইসপারের বাসিন্দা মোর্শেদা শুনেছি তার জমাজমির অভাব নেই! আদিতমারী উপজেলা শহরেও তার গোটা তিনেক বাড়ি আছে,তারপরও সে এই চন্ডিমারীর চরের মায়া ত্যাগ করতে পারেনি,অথচ আর একটা বড় ঢেউয়ের অপেক্ষা মাত্র! হঠাৎ কোনো রাতে ইন্ডিয়ার পানি ছেড়ে দিলেই তার বসতভিটা হারিয়ে যাবে তিস্তার করালগ্রাসে। অথচ অবাক হই,এতোটা বিপদ জেনেশুনেও তিনি কেন এই জায়গাটার মায়া ত্যাগ করছেননা। খোঁজ নিয়ে জেনেছি,উনিও এখানে থাকেননা,তিনিও কয়েকদিনেরই অতিথি! রিলিফের জন্যই শুধু অপেক্ষা!
দিনের আলো নিভু নিভু করছে,এনজিও কর্মী রাশেদার তবুও দম ফেলার সময় নেই,যেভাবেই হোক আজকেরখানা জরিপ টার্গেট অর্জন করতেই হবে। একটু পরেই মাগরিবের আজান পরবে,অথচ আকাশচুম্বি টার্গেট ফিলাপ হচ্ছেনা আজও ম্যানেজারের বকা শুনতে হবে নিশ্চিত,সে চিন্তায় সে অস্থির! এমন সময় একটা করুণ আর্তি,
…ও আপা তোমা সোবারে নাওঙ নেকেছেন,খালি মোরে নাওঙই নেকেননা! তোমা আসি খালি মোর বাড়ি কোনা ঢুকি দেখি যাও!
আপা আজ আর সময় নাই,আগামীকাল আপনার বাড়ি আসব!
ওইলা কথা কননা,এ্যার আগোত নালচাঁন মার্কা এ্যানজিও আসিয়াও ওইমন কথা কয়া পালাইছে,মোর আর নাওঙ নেয় নাই। তোমা যদি মোর নাওঙ না নেন,এবার মোর ভিক্ষা করি খাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নাই! নাইতো তিস্তাত ঝাঁপ দিয়া মইরবার নাইগবে!
আপা চিন্তা করিয়েননা,আগামীকাল ঠিকই আপনার নাম নিয়ে অনলাইন পোস্টিং দিব।
এমন সময় চন্ডিমারী বড় মসজিদ হতে মাগরিবের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। ও দিকে রাশেদার স্বামীও আদিতমারীতে অপেক্ষা করছে রাশেদার জন্য,তাকে নিয়ে বাসায় ফিরবে।
কিছুদিন আগেই রাশেদা বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে,তার স্বামী এখনো বেকার! তাই সংসারের খরচ মেটানোটা একটু কষ্টকর তার জন্য,তাই অনিচ্ছাশর্তেও বউকে চাকরির অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু নতুন বউয়ের এই চাকরির সময়সূচিটা তার মোটেও পছন্দ হচ্ছেনা! দু’জনে যে পাশাপাশি বসে একটু গল্পগুজব করবে সে সুযোগও নাই। বউ সেই ভোর ছয়টায় বাসা হতে বাহির হয় আর ফেরে রাত্রি আটটা নয়টা। বাসার অন্যরাও এটা ভালো চোখে নিচ্ছেনা।
রাশেদার শাশুড়িতো সেদিন বলেই বসল,এই মোস্তফা এভাবে বউকে ঘরের বাইরে চাকরি করতে দিচ্ছিস;শেষে না আবার আমাদের মানসম্মান ডোবায় দেয়।
বাহিরের লোকজনও নানান কটু কথা শোনায় আজকাল,মেয়ে মানুষ কী এনজিওর চাকরি করে? কিন্তু রাশেদা মনকে শক্ত করে,মানুষ তো কত কথাই বলবে সেসবে কান দিয়ে আমার কী! আমার অভাবের সংসারে তো কেউ দু’পয়সা দিয়েও সাহায্য সহযোগিতা করেনা।
প্রায় দু’মাস হলো রাশেদা এনজিও জব করছে,এই জবটা তার প্রথম কোনো জব! তাই কোনটা ভালো কোনটা মন্দ সেটা বোঝার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। চারদিকে সবাই শুধু বড় রিলিফ পাওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে! শুনলাম তার এরিয়ার মানুষদের জন্য দুইশো গরুর ডোনেশন এসেছে! কিন্তু তার কাছে মানুষের তালিকা প্রায় ছয়শত। অনেকের নামই কাটা যাবে,তাই সবাই উন্মুখ হয়ে আছে সাহায্যের! যদি নামটা রাখা যায় তাইলেই পঞ্চাশ হাজার টাকা,আর ছয়মাস আরাম আয়েশে কেটে যাবে।রাশেদা আগে চাকরিটা না বুঝলেও ইদানিং বেশ বুঝে ফেলেছে,চারদিকে শুধু টাকা আর টাকা!
আজকাল ঘন রাত্রির নিঃসঙ্গতাগুলো রাশেদাকে আর পোড়ায়না! স্বামী,শশুর-শাশুড়িও তাকে বেশি গুরুত্ব দেয়! ধীরে ধীরে সবার ঘরে রিলিফ পৌঁছে যাচ্ছে! চারদিকে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে! কে রিলিফ পেল,কে পেলনা এই নিয়ে চলছে কানাঘুশা! রাশেদা তার কমিটির সাথে মিটিং এ বসে শলাপরামর্শ করছে,ও চাচা আপনার হাতে ধরি,পায়ে পরি আমারে বাঁচান। আমি শুধু একাই টাকা খাইনি,আপনাদেরও তো ভাগ দিয়েছি। ও চাচা আমি আপনাদের মেয়ের মতো,আমারে বাঁচান। সমস্যার কোনো সুরাহা হলোনা,সমস্যা বেরেই চলছে
এরই মাঝেই হেড অফিস হতে রাশেদার নামে একটা কড়া শোকজ এসেছে! তিন দিনের মধ্যেই তার জবাব দিতে হবে। গত চার-পাঁচদিন এই চরে রাশেদার আর দেখা নেই,শুনেছি কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা…!

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge