মঙ্গলবার, ০৬ Jun ২০২৩, ০১:১৪ পূর্বাহ্ন

তিস্তার জলধারা মানে না সীমান্তের জলবাধ-রেজাউল করিম মুকুল

তিস্তার জলধারা মানে না সীমান্তের জলবাধ-রেজাউল করিম মুকুল

তিস্তার জলধারা মানে না সীমান্তের জলবাধ
রেজাউল করিম মুকুল

যিষুখ্রীষ্টের জন্মের দেড় হাজার বছর পূর্বে সিন্ধুনদের তীরবর্তি এলাকা থেকে আর্যগন ভারতে ছড়িয়ে পড়লেও বংগীয় এলাকায় প্রবেশ করতে পেরেছিলো যিষুর মৃত্যুর কয়েক যুগ পরে। তারপরেও বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য্ ও দ্রাবিড় নিষাদ রাক্ষসরুপী মানুষের সাথে যুদ্ধে পেরে উঠেনি অনেকদিন। ইত্যবসরে ইরান হয়ে এদেশে আসে সুফি সাধক, পীর, দরবেশগন আরবীয় বনিকদের সাথে, চট্টগ্রাম ও আরাকান হয়ে এই বংগভূমিতে ইসলামের আদর্শ নিয়ে। এ সময় বাংলাদেশের তাম্রবর্নের রাক্ষসরুপি বনজ মানুষদের তেমন কোন ধর্মই ছিলো না। উত্তরাঞ্চলের খরস্রোতা ত্রিস্রোতা তিস্তা নদীর দুইকুলে বাস ছিলো কোচ, মেচ ও রাজবংশী জাতের মানুষের। রাজবংশীরা নীলফামারী এলাকায় বসত গড়েছিলো। প্রাচীনকালে তিস্তা নদী জলপাইগুড়ির নিকট দিয়ে দক্ষিনে অগ্রসর হয়ে পরে করতোয়া, পূনর্ভবা ও আত্রেয়ী এই তিনটি স্রোতে তিনটি নদী হয়ে বয়ে যায় নিরবধি। করতোয়া সে সময় ছিলো খুব বড় একটি নদী যা গ্রীক যাযক টলেমীর লেখায়ও এসেছে। এই করতোয়া নদীপারের জনগনকেই বলা হতো কিরাত। এরই তীরে গড়ে উঠেছিলো সম্রাট অশোকের পুন্ড্রবর্ধন নগরী, সুলতান, মোগল আর বৃটিশদের দূর্গ, সেনানিবাস ও জনপদ। কর্নেল ডল্টন ও বুকানন সাহেব লিখেছেন কোচরা যাযাবর অরণ্যচারী হলেও তিস্তা অববাহিকায় মৎসজীবী হয়ে স্হায়ীভাবে বসতি গড়ে তোলে। এরা কাঁকড়া, শামুক , কচ্ছপ, কুচিয়া ,বাইম মাছ পছন্দ করতো। এদের গায়ের রং কলো, বেটে, কোকড়া চুল ও সুঠাম দেহ হতো। মক্কায় হযরত ওমরের খেলাফতের সময়কাল থেকে মুসলমান ধর্ম প্রচারকরা চারদিকে ছড়িয়ে পরে। এরই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রাম, আরাকান হয়ে এ অঞ্চলগুলোতে আসেন হযরত মামুন , হযরত মুহাইমিন, হযরত হামেদ উদ্দিন, হযরত হোসেন উদ্দিন , হযরত মুরতাজা, হযরত আবু তালিবসহ সুলতান মাহমুদ মাহীসওয়ার মহাস্হান গড়ে, চতুর্দশ শতকে মখদুম শাহ রাজশাহীতে, জালালউদ্দিন জাঁহাগাসত বোখারী রংপুরের মাহিগঞ্জে, পঞ্চদশ শতকে শাহ ইসমাইল গাজী রংপুরের কাটাদুয়ারে ও মাহিগঞ্জে এবং ষোড়শ শতকে শাহ মুরাদ কামাল ও সৈয়দ গোলাম মোহাম্মদ তিস্তা সংলগ্ন অঞ্চলগুলোতে এসেছিলেন। এনাদের হাতে হাজার হাজার ধর্মহীন কোচ মেচ জাতির মানুষ ইসলাম ধর্মের দীক্ষা গ্রহন করেন। এ সময়কালে সুদূর কর্ণাটক থেকে আসা বল্লাল সেন, লক্ষন সেন গৌড়ের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থাকলেও প্রজারা ছিলো অচ্ছুত দাস সেবক মাত্র যাদের ধর্ম কর্মের কোন প্রয়োজন ছিলো না। সেবা করাই ছিলো প্রজাদের প্রধান কাজ। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের ফলে এদেশে আসতে থাকেন সুদূর আরব , তুরস্ক , আবিসিনিয়া , আফগানিস্হান , ইরানের ব্যবসায়ী ও ইসলাম ধর্ম প্রচারক পীর, ফকির , আউলিয়া , দরবেশ ও ভাগ্যান্বেষী মানুষ । এ সময় এদেশে কোন আর্য্ , ধর্ম নষ্ট হওয়ার ভয়ে আসতো না। তবে প্রচীনকাল থেকে রঙ্গপুরে তথা তিস্তা উপকুলীয় অঞ্চলে ফসলের দেবতা হিসাবে গ্রাম্য দেবতা শিব উপাসক ও নাথ যোগী সম্প্রদায়ের বাস ছিলো। ১৮৪৮ খ্রিঃ ড. গিয়ার্সন রঙ্গপুরের তিস্তা অববাহিকা অঞ্চল ভ্রমন করে গোপী চন্দ্রের গান , মানিক রাজার গান যোগী ভিক্ষুকদের মুখ থেকে সংগ্রহ করে এসিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে প্রকাশ করেন। গানগুলো তিস্তাপারের মানুষের মুখের ভাষায় রচিত। পরবর্তিকালে দীর্ঘসময় সুলতানী ও মুঘোল আমলে এদেশে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এদের সবারই লক্ষ্য ছিলো কামতা রাজ্য ( কুচবেহার ) দখল করে নেয়া । শাহ ইসমাইল গাজী , হুসেন শাহ , তবারক খাঁ , সোলেমান কররানী , রাজা মানসিংহ , ইবাদত খাঁ, মির্জা সাঈদ, কোচবিহার আক্রমন হেতু তিস্তা অঞ্চলগুলোর উপর দিয়ে যান। একারনে রংপুর ছিলো অনেকটা যুদ্ধক্ষেত্রের মতো। করতোয়ার তীরবর্তি ঘোড়াঘাট ছিলো মুঘোলদের সেনানিবাস, বৃটিশদের জেলা বা সরকার। সুবেদার মীর জুমলা কোচবিহার ও আসাম অভিযানকালে রংপুরের সৈনিকদের সুপেয় পানির জন্য যে স্হানে একটি পুকুর খনন করেন তার পানি এতই মিঠা ছিলো যে স্হানটির নাম হয়ে যায় মিঠাপুকুর , আর এর অদূরে যে স্হানে সৈনিকরা দম নিয়েছিলো সেটির নাম হয়ে যায় দমদমা । রাজা মানসিংহ রংপুরের পালিচরায় সবেমাত্র যে পুষ্করিনিটি খনন করেন সেটিকে লোকে বলতে শরু করে সদ্যঃপুষ্করিনি ।
সেই ত্রিস্রোতা তিস্তার কুলে গড়ে উঠা জনবসতি, জনপদগুলো কতবার ভাঙলো আবার গড়লো সে হিসাব কেউই রাখেনি। যুগে যুগে প্রাচিন সভ্যতাগুলো তিস্তা গর্ভে হারিয়ে গেলো আবার জন্ম নিলো নুতন আরো একটা । প্রকৃতির নদী তিস্তা অতিতে মানে নাই শাসন , আজও মানে না রুখে দেয়া কোন জলবাধ । রাষ্ট্রগুলো তিস্তাকে বাধতে চায়, প্রকৃতি হাসে তা কি করে হয়। গতিপথ রুদ্ধ করে খরায় শুকিয়ে দেয় তিস্তার জলধারা । সেটিতো সাময়িক । আষাঢ়ে কে রুখবে তাকে , আছে কার সাধ্য তেমন । আমরা তিস্তাকে নিয়ন্ত্রন করতে পারবো কিছুটা সময়, কিন্তু পরাজিত করতে পারবো না কখনোই। তিস্তা যে প্রকৃতির বরপূত্র । আর প্রকৃতি, সেতো অনন্ত অসীম।

বৈশ্বিক কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগ-সেতু হিসেবে বিবেচিত হয়। এশিয়ার দুই বৃহৎ দেশের মধ্যখানে বাংলাদেশের অবস্থান, যার একটি উদীয়মান ভারত। অন্যটি হলো চিন, যা ইতিমধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
তিস্তা নদীর পানি সংরক্ষণ ও ব্যবস্হাপনা বিষয়ক ৯টি প্রোজেক্টে বাংলাদেশ চিনের কাজ থেকে ৬.৪ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন পেতে যাচ্ছে বলে শোনা যায়। তাছাড়া পায়রা সমুদ্রবন্দর, বরিশাল-ভোলা মহাসড়ক ও সেতু এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পার্ক নির্মানে চিনের সহযোগীতা উল্লেখযোগ্য। হিমালয়ের চুনথাং থেকে উৎপন্ন হোয়ে সিকিম এবং উত্তরে পশ্চিমবঙ্গের আধা ডজন জেলা অতিক্রম করে বাংলাদেশে ২৮০০ বর্গ কিমি স্হান দখলে রেখেছে তিস্তা। এ বছর সিকিম এর বর্ডার রোডস সংস্হা ৩৬০ মিটার দীর্ঘ বেইলি ব্রিজ নির্মান করেছে তিস্তার উপর।
তিস্তা রিভার কম্প্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট এনড রেসটোরেসন প্রোজেক্ট এর জন্য মোট ব্যয় ধরা হোয়েছে ৯৮৩.২৭ মিলিয়ন ডলার, চিন দেবে ৮৫৩.০৫মিলিয়ন ইউএস ডলার ঋণ সহায়তা। বাকিটা বাংলাদেশ সরকার বহন করবেন। কাজটি সম্পন্ন করবেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। ৩১৫ কিমি দীর্ঘ তিস্তার ১১৩ কিমি প্রবাহিত হয় বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে যা কোথাও .৭০ কোথাওবা ৫.৫ কিমিঃ চওড়া আর এর গড় গভিরতা ৩.১ কিমি। বাংলাদেশের মাননীয প্রধানমন্ত্রী গত ২০১৯খ্রিঃ জুলাইতে চিন সফরকালে টিআরসিএমআর প্রোজেক্টটির জন্য চিনা অর্থায়নের প্রস্তাব করেন। বর্ষা ও খরা মৌসুমে তিস্তাকে পানি ধারনে সক্ষম করাই এ প্রেজেক্টের লক্ষ্য। বাংলাদেশ ১৯৯৬ খ্রিঃ ভারতের সাথে চুক্তির আলোকে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্সা না পেয়ে চিনের সহায়তায় এই মেগা প্রকল্পের পরিকল্পনা করেছে। সে সময় চিনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ঝিজিনপিং অত্যন্ত সাদরে তা গ্রহন করেন এবং অনুমোদনের আশ্বাস দেন, এটা সেটাই।

ভারতের সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক আগের মতোই বিদ্যমান। প্রতি বছর ১৫-২০ লক্ষ বাংলাদেশী রোগী ভারতে যান চিকিৎসা করাতে। গত বছর ভারত বাংলাদেশ ব্যবসা হোয়েছে ৯.২১ বিলিয়ন। আবার বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে ভারতীয় নাগরিকরা চাকুরি করেন এবং ভারতে রেমিট্যান্স পাঠান। ভারতের পূর্ব ও উত্তরের বিচ্ছিন্নতাবাদি উপদ্রুত জেলাগুলোতে শান্তি প্রতিষ্টায় বাংলাদেশের সহযোগিতা ও অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবেই খুবই মজবুত ও বুনিয়াদী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা ভারতের একাত্তরের সরকারের সাহায্য ও সহায়তা এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির আন্তরিক প্রচেষ্টা এত দ্রুত সম্ভব করে তুলেছিলো।

বুড়ি তিস্তা বা মরা তিস্তা যেটাই বলুন, তিস্তাতো একটা নদী , জর্ডানের একেবারে পশ্চিমে ৪৬ মাইল লম্বা , ১০ মাইল প্রশস্ত একটি সাগর শুকিয়ে এখন কাদা কাদা। এটার নাম এখন মরা সাগর। নদীর পানি ভাগ বাটোয়ারার অবনিবনা সালিস মিমাংসা ছাড়া কার কিবা করার আছে ? ধনী-গরীব, সবল-দূর্বল দ্বন্দ্ব ছিলো না কোন কালে? এই পানি পান করা নিয়ে নেকড়ে আর মেষশাবক এর গল্পটা ভেবে দেখুনতো। ২৬ মার্চ। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকা অবস্হান করছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পরের দিন ২৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে হরিচাঁদ ঠাকুরবাড়ি সফর করবেন তিনি। এবছর হরিচাঁদ ঠাকুরের ২১০ তম আবির্ভাব দিবস। এ উপলক্ষে আগামী ৯ এপ্রিল ওড়াকান্দি ঠাকুরবাড়িতে অনুষ্ঠিত হবে স্নানোৎসব ও মেলা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের মন্দিরে পূঁজা করবেন। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের জনগণ, ইন্দিরা গান্ধি ও সে সময়কার সরকারের অবদান চিরস্মরণীয়। ভারতের জনগণের আশ্রয় ও সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জণ আদৌ সম্ভব ছিলো না। প্রধানমন্ত্রী মোদী সেই ভারতের প্রতিনিধি হোয়ে আজ ঢাকায়। সামনে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচণ, তাই তিস্তা কিংবা সীমান্ত কোন বিষয়েই কোন কথা হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রক। লেখক প্রাবন্ধিক ও প্রাবন্ধিক।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge