দেখার চেষ্টা চক্ষু খুলিয়া- ১৭
মো. শওকত আলী
রুপবান লোককাহিনীর কথা বাঙালি মাত্রই কমবেশি জানে। শিক্ষিত -অশিক্ষিত বলে কথা নেই। পুরানো আমলের গ্রাম্য যাত্রাপালা থেকে শুরু করে শহুরে মানুষের বিনোদনের জন্য সেলুলয়েড এর ফিতায় এ কাহিনী বন্দী হয়েছে বহুবার। বারো বছরের রুপবান তার বারো দিনের স্বামী রহিমকে নিয়ে বনবাসে গিয়েছিল নিয়তির অমোঘ পরিণতিতে। সে কাহিনী নানা ঘটনার ঘনঘটায় দর্শক হৃদয়কে আপ্লুত করেছে বারবার। হাল আমলে শহুরে সমাজে এ কাহিনী তেমন পরিচিত না হলেও গ্রামবাংলার নাট্য কিম্বা যাত্রাদলগুলো এ অ্যাখ্যাননির্ভর পালা এখনও পরিবেশন করে থাকে।
কিন্ত্ত সেই ‘রুপবান’ কিভাবে আমাদের অতীত যুগের বৌদ্ধ বিহারে আশ্রয় পেল সেটি আমার বোধের বাইরে। যে রুপবান লোককাহিনীর পাত্র -পাত্রীর প্রায় সকলই মুসলিম প্রতিনিধিত্বশীল সে লোককাহিনীর মূখ্য নারী চরিত্রের নামের অনুকরণে কুমিল্লার শালবন বিহার এবং ইটাখোলা মুড়ার নিকটবর্তী যে আর একটি বৌদ্ধ বিহার রয়েছে সেটির নাম হলো কি করে? এ নামের ইতিহাস কেউ খোঁজ করেছে কিনা কে জানে? তবে প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের অন্তত কেউ এ বিষয়ে কোন তথ্য দিতে পারলেন না।
‘রুপবান মুড়া’প্রত্নস্হাপনাটি কুমিল্লায় বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড) এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর মধ্যবর্তী স্হানে সমতল থেকে কিছুটা উঁচুতে অবস্থিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জরিপকালে তৎকালীন ভারতবর্ষের টি এন রামচন্দ্র নামক একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ এই প্রত্নস্হাপনাটি চিহ্নিত করেন। এরপর ইতিহাসের পালাবদল ঘটেছে। বৃটিশ আমল পেরিয়ে এসেছিল পাকিস্তান আমল তারপর বাংলাদেশ। সময় পেরিয়েছে প্রায় সার্ধশত বছর। অবশেষে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বৃটিশ আমলের জরিপের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন করে। তারা এখানে ক্রুশাকৃতির একটি মন্দির, একটি বিহার এবং দুটি নিবেদন স্তুুপার ধ্বংসাবশেষ মাটিচাপা অবস্থা থেকে অনাবৃত করে। তিনটি বসতি আমলে এ মন্দির আর বিহার ব্যবহারের প্রমাণ পেয়েছে বিশেষজ্ঞরা। প্রথম আমলে ক্রুশাকার আকৃতির ভিতের উপর মন্দিরটি নির্মাণ করা হলেও দ্বিতীয় বসতি আমলে মন্দিরটির পরিসর বাড়ানো হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। মন্দিরের ক্রুশাকৃতির একটি বাহু ছাড়া অন্য বাহুগুলির দু’টি করে অংশ রয়েছে। সামনের অংশটি মন্ডপ এবং পিছনের অংশটি মূর্তিকোঠা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। প্রতিটি মূর্তিকোঠায় একটি করে বেদি রয়েছে। বেদিগুলোতে কি ছিল তা জানা সম্ভব হয়নি।তবে পূর্বদিকের মূর্তিকোঠাটিতে তিনটি প্রকোষ্ঠ ছিল যার মধ্যে একটি প্রকোষ্ঠ হতে একটি দণ্ডায়মান বৌদ্ধ মূর্তি উদ্ধার করে ময়নামতি জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে। অন্য প্রকোষ্ঠ দুটিতে ব্রোঞ্জের কিছু ভাংগা টুকরা পাওয়া গিয়াছিল বলে জানা যায়। প্রকোষ্ঠের ভিতরের নির্মাণ অলংকরণ এখনও পর্যটকদের মুগ্ধ করে। মন্দিরটিকে পরিবেষ্টিত করে একটা হাটা পথ ছিল যার কিয়দংশ এখনও বিদ্যমান । দ্বিতীয় বসতি আমলে মন্দিরটির পরিসর বর্ধিত করা ছাড়াও মেঝে কিছুটা উঁচু করা হয়েছিল বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন। খননকালে যেসব পুরাবস্ত্ত পাওয়া যায় সেগুলো ময়নামতি প্রত্নজাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে। যেমন,পাথরের শিলানোড়া, পোড়ামাটির চিত্রফলক, কারুকার্যময় ইট, খাদমিশ্রিত সোনার তৈরি গুপ্ত অনুকৃত মুদ্রা ইত্যাদি।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো এখানে যে আকারের বিহারের সন্ধান পাওয়া গেছে সেখানে প্রচলিত বিহারের মতো পড়াশোনা করানোর কোন সুযোগ ছিল বলে মনে হয় না। কেবলমাত্র ভিক্ষুদের আবাস হিসেবে হয়তো বা ব্যবহার করা হতো। যেমনটি মনে করা ইটাখোলা মুড়ার ক্ষেত্রেও। নির্মাণ রীতিবৈশিষ্ট্য দেখে এটিকেও সাত থেকে দশ শতকের বলে অনুমান করা হয়।
Leave a Reply