বুধবার, ০৭ Jun ২০২৩, ০৯:১৬ অপরাহ্ন

দেখার চেষ্টা চক্ষু খুলিয়া-১৬ : মো. শওকত আলী

দেখার চেষ্টা চক্ষু খুলিয়া-১৬ : মো. শওকত আলী

দেখার চেষ্টা চক্ষু খুলিয়া-১৬
মো. শওকত আলী

পূর্ব প্রজন্মদের কীর্তি, জীবনাচার তো আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাসেরই অংশ। ইতিহাস নাকি কথা বলে? কিন্তু সে ইতিহাস যদি মাটিচাপা অবস্থায় পড়ে থাকে তাহলে সে কি ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে? মাটিচাপা থাকলেও হয়তো ইতিহাস একসময় জেগে উঠতে পারে। কিন্তু ইতিহাস যদি চুরি হয়ে যায় তাহলে তাকে কি ফিরে পাওয়া সম্ভব? হয়তো বা একেবারেই অসম্ভব নয় কিন্তু কঠিন তো বটেই। বলছিলাম ময়নামতি বৌদ্ধ বিহার এর নিকটবর্তী একটি বৌদ্ধ মন্দির ও বিহারের কথা। প্রত্নস্হাপনাটির নাম ‘ইটাখোলা মুড়া’। ‘মুড়া’ শব্দটি কথ্য ভাষা হতে পারে যার অর্থ উঁচু ঢিবি। কিন্তু ইটাখোলা কেন? ইটাখোলা তো বলা হয় ইট তৈরির কারখানাকে। তাহলে প্রত্নস্হাপনাটির নাম ইটাখোলা কেন হলো? ঐতিহাসিক সূত্র থেকে এ নামের কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে উঁচুভূমিতে অবস্থিত প্রত্নস্হাপনাটির ইটের নিদর্শন দূর থেকে কারখানার ইটের স্তুূপের মতো দেখা যেতো বলে স্হানীয়ভাবে এর নাম ইটাখোলা মুড়া হয়েছে। যে নামটি আবার প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরও ব্যবহার করছে । শুধু তাই নয়,ইটের প্রাচীন কারখানা ভেবে এখান থেকে ‘ইট সরানো’র কাজটিও অবাধে চলতো। তাই বলছি, এক সময় ‘ইটের মওজুদ’ যদি শেষ(?) হয়ে যেতো তাহলে ইতিহাস- ঐতিহ্যের অন্বেষণ কি করা যেতো এখানে?

ধারণা করা হয় বৃহত্তর কুমিল্লা অন্চলে প্রায় ত্রিশটির মতো প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার রয়েছে। এর মধ্যে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বিশটির মতো বৌদ্ধবিহার সনাক্ত করে ওগুলোকে সংরক্ষণ করতে পেরেছে। ইটাখোলা মুড়া তারমধ্যে একটি। এটি কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাস এলাকা সংলগ্ন। পার্শ্ববর্তী সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৭০-৮০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এটি। একটি ছোট বিহার এবং একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে এখানে। নির্মাণরীতি দেখে এগুলো আনুমানিক ৭-৮ শতকের নির্মিত বলে অনুমান করা হয়।
পুরাকীর্তি স্হাপনাটি পরিত্যক্ত হবার আগে পাঁচটি সাংস্কৃতিক স্তর (বসতি আমল) পার করেছে বলে ধারণা করা হয়। তবে প্রথম তিন সময়কালের নিদর্শন পরবর্তী দুই সময়কালের ধ্বংসাবশেষের নীচে চাপা পড়ে গেছে। স্তূপা, পীঠস্থান, ভজনালয় সবই ছিল সেখানে। ছোট পরিসরে হলেও এখানকার পীঠস্থানের অবস্থানস্হলে চুন-সুরকির নির্মিত বুদ্ধ অক্ষোভ্যের ক্ষতিগ্রস্হ ( আবক্ষ অংশ ব্যতীত) মূর্তি পাওয়া গিয়াছে।
বুদ্ধ অক্ষোভ্য সম্পর্কে সামান্য কিছু কথা বলতেই হয়। বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস খৃস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দী হতে হাল আমল পর্যন্ত বিস্তৃত। এ ধর্মমত প্রাচীন ভারতের পূর্বান্চলের মগধ রাজ্য (বর্তমানে ভারতের বিহার রাজ্য)থেকে সূচিত হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে এ ধর্মমতকে ঘিরে নানারকম ভাববাদি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল যেমন- থেরবাদ, মহাযান, বজ্রযান। এসবসহ নানা শাখা প্রশাখার উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে এ ধর্মমত বিস্তার লাভ করে।
অক্ষোভ্য হচ্ছেন বজ্রযান বৌদ্ধ ধর্মমতের পাঁচ ধ্যানী বুদ্ধের একজন যিনি বৌদ্ধ কিংবদন্তি অনুসারে বজ্রধাতু নামক আধ্যাত্মিক স্হানের পূর্বদিকে অভিরতি নামক পবিত্র স্হানের অধিষ্ঠাতা দেবতা। ১৪৭ খ্রিষ্টাব্দে রচিত অক্ষোভ্য তথাগতস্য বূহ্য সূত্র গ্রন্থে অক্ষোভ্যের বর্ণনা পাওয়া যায়। এই গ্রন্থানুসারে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী অভিরতি নামক পবিত্র স্হানে ধর্মলাভের উদ্দেশ্যে শপথ করেন যে তিঁনি বুদ্ধত্ব লাভ না করা পর্যন্ত কোন জীবের প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করবেন না। এ কারণে তিঁনি স্হির থেকে একসময় অক্ষোভ্য বুদ্ধে পরিণত হন। অক্ষোভ্য ধ্যানীবুদ্ধের উৎপত্তি বিজ্ঞান-স্কন্ধ থেকে। ‘বজ্রধৃক’ মন্ত্রপদ থেকে তাঁর আবির্ভাব। তাঁর বর্ণ নীল এবং ধ্যান মুদ্রা ভূমিস্পর্শ। তাঁর বাহন দুটি হস্তী এবং প্রতীক বজ্র।

প্রত্নস্হাপনাটি খননকালে একটি হরিকেল মুদ্রা পাওয়া যায় সেখানে। মুদ্রাটি সপ্তম থেকে নবম শতকের কোন এক সময়ের বলে ধারণা করা হয়। এর একদিকে উৎকীর্ণ রয়েছে ত্রিশূল অন্যদিকে ষাঁড় নন্দী। হরিকেল প্রাচীন বংগের একটি রাজ্য ছিল। যদিও এর প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে তবুও সেটি সমতটের নিকটবর্তী অন্চলে ছিল বলে ধারণা করা হয়। সেকারণে কুমিল্লা এবং কুমিল্লার পূর্বে চট্টগ্রামের দিকে এর অবস্থান ছিল বলে কোন কোন বিশেষজ্ঞের ধারণা।
মন্দিরের সম্মুখভাগে স্তূপ বা স্তূপার চিহ্ন রয়েছে। স্তূপ বা স্তূপা অর্থ কোন উঁচু ঢিবি। বাংলা ভাষার প্রচলিত স্তূপ শব্দটি পালি ভাষা থেকে এসেছে। স্তূপা সংস্কৃত শব্দ। উভয়ের অর্থ একই। বৌদ্ধ বিহার বা মন্দিরের সংগে এই স্তূপ বা স্তূপা বিষয়টা খুবই প্রাসঙ্গিক।
আদিতে ঠিক কি কারণে স্তূপ নির্মাণ শুরু হয় সে বিষয়ে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। তবে কালের বিবর্তনে স্তূপ বা স্তূপা কেবলমাত্র বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় এবংবৌদ্ধ সমাজে পূজিত হতে থাকে। বৌদ্ধ ঐতিহ্যে স্তূপাকে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে –
১. শরীর ধাতু স্তূপা বা শারীরিক স্তূপা। এ শ্রেণির স্তূপে বুদ্ধদেবের এবং তাঁর অনুগামী ও শিষ্যদের শরীরাবশেষ রক্ষিত ও পূজিত হতো।
২. পারিভৌগিক ধাতু স্তূপ বা পারিভৌগিক স্তূপ। এ শ্রেণির স্তূপে বুদ্ধদেব কর্তৃক ব্যবহৃত দ্রবাদি রক্ষিত ও পূজিত হতো।
৩. নির্দেশিক বা উদ্দেশিক স্তূপ বা স্তূপা। বুদ্ধ ও বুদ্ধধর্মের সংগে সম্পৃক্ত কোন স্হান বা ঘটনাকে উদ্দেশ্য করে বা চিহ্নিত করার জন্য নির্মিত স্তূপ বা স্তূপা।

পুরাকীর্তি স্হলের বিহারটি তুলনামূলকভাবে ছোট হলেও এর চার বাহুতে একসারি করে ভিক্ষুকোঠা ও মাঝখানে একটি খোলা চত্বর রয়েছে।
মন্দিরের অংশে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্হা যথেষ্ট উন্নত ছিল যার প্রমাণ এখনও রয়ে গেছে।
গত ১৯ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে কুমিল্লায় একটি দাপ্তরিক কাজ সেরে ফেরার পথে এ পুরাকীর্তি স্হাপনাটি ঘুড়ে দেখেছিলাম।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge