নেতার বিড়ম্বনা
আব্দুল খালেক ফারুক
এক.
‘নামো। আর কতক্ষণ ওটে বসি থাকপেন। অনেক রাইত হইছে।’
স্ত্রী মর্জিনার হাকডাক শুনেও নিশ্চল-নিশ্চুপ মহাব্বত আলী। মৃদু লয়ে নাসিকার গর্জন আপ ডাউন করে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। গাছের উপর এভাবে ঘুমানো বিপদজনক। হাড়গোড় ভেঙে পঙ্গু হলে কোন বিপদে পড়েন-এটা ভেবেই শঙ্কিত মর্জিনা আবার হাঁক ছাড়েন।
‘আরে নামো!এই মানুষটার আক্কেল জ্ঞান দেখলে মুই টাসকি খাং। চান্দার ভয়োতে গাছোত উঠি বসি আছে। ক্যা, তোমাক তখনে কং নাই, নেতা হবার দরকার নাই। তা তখনতো দাঁত কিরমির করি মোরে উপরা গরম দেখান। এলা দেখোতো এই পুষ মাসি জারের দিনোত সারো পাখির মতোন গাছোত উঠি থাকা নাগে!’
মর্জিনা বেগমের বকর বকর শুনে ঘুমের ভাবটা কেটে গেলো মহাব্বত আলীর। খানিকটা ধাতস্ত হয়ে বুঝতে পারলেন তিনি বাড়ির পেছনে একটি আম গাছের উপর বসে আছেন। গাছের মাঝামাঝি আড়াআড়ি হয়ে থাকা ডালের উপর ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিয়ে রাতভারি হবার অপেক্ষায় ছিলেন। ঘুম ঘুম ভাবটা অনেকটা স্বস্তি এনে দিয়েছিলো। এ সময় মর্জিনা বেগমের বাগড়া।
‘রাইত কয়টা বাজে মর্জিনা বিবি?’
‘কয়টা আরো, বারোটা পার হইছে।’
‘বাড়ির বাইরা আরো কাইয়ো আছে নাকি?’
‘না। এতো রাইতে কায় আইসে?’
‘ওদের কী রাইত বিরাইত আছে? শালারা আমার জীবনটা শ্যাষ করি দিলো।’
মহাব্বত আলীর গেটআপটা আজ ভিন্ন প্রকৃতির। মাথার উপর একটি কালো মাঙ্কি টুপি। শুধু চোখ দুটো খোলা। পুরাতন জিন্সের প্যান্টের সাথে রাশিয়ান মোটা সোয়েটার। সেকেন্ড হ্যান্ড হবার চান্স বেশি। হাঁটুর নিচে সোয়েটারের নিম্নাংশ ঝুলছে। পায়ে মোজা পড়েছেন ডাবল।
স্ত্রীকে ইশারা দিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে বাড়ির পেছন দরজা পেরিয়ে এখানে এসেছেন। তারপর রাত ১১টার দিকে এই গাছে আসন নিয়েছেন। কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলবে-ভেবে আতংকিত মহাব্বত আলী।
দুই.
মহাব্বত আলী উঠতি নেতা। কড়ি ও তেল মেখে পার্টির একটা মাঝারি মানের পদ বাগিয়েছেন। আশা করছেন সামনে বড় পদে আসীন হবার পাশাপাশি যদি ভাগ্যের সিঁকে ছেড়ে তাহলে তো ভোটেও দাঁড়াতে পারবেন। আর ভোটে পাশ করলে মাশাল্লাহ্ গাড়ি বাড়ির মালিক হওয়া কোন ব্যাপার না।
ডানে বায়ে কিছু ছেলে ছোকরা নিয়ে মহাব্বত আলী যখন পথ হাঁটেন, সালামের জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত হতে হয়। পাড়ার বয়স্করা বেশ সমীহ করেন। মুরুব্বিরা আবদার করেন, স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতির পদটি যেন তিনি অনুগ্রহ করে অলংকৃত করেন। তিনি না করেননি। না করবেনইবা কেন? এসবইতো রাজনীতির উপভোগ্য বিষয়। নেতারা এতে দারুণভাবে পুলকিত হন।
কিন্তু গত কদিন ধরে যে উৎপাত শুরু হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে রাজনীতি ছেড়ে আবার তাঁর পুরোনো ভাঙারি ব্যবসায় ফেরত যাবেন।
শীতের সময় ঘরে ঘরে ওয়াজের একটা প্রবণতা গত কয়েক বছরে বেশ জেঁকে বসেছে। তার উপর উচ্চস্বরে ‘ডিজে গান’ বাজিয়ে পাড়ায় পাড়ায় চলছে পিকনিকের মহোৎসব। চল্লিশা, মেয়ের বিয়ে, অসুখ বিসুখের চিকিৎসার জন্য হাতপাতাতো নিত্যকার বিষয়!শুধু কি তাই? হা-ডু-ডু, ব্যাডমিন্টন, ফুটবল, ঘোড়দৌড়, নৌকা বাইচ-কোনটা কি বাকি আছে? মনে হয় করোনার কল্যাণে আবারও জেগেছে বাংলা। তা বাংলা জাগুক, তারতো ক্ষতি নেই। কিন্তু সব কারবারে তাকে চাঁদা দিতে হবে কেন? সবাই তার বাসায় চাঁদার জন্য এভাবে হামলে পড়বে কেন? পাঁচশ থেকে ইদানিং দুশতে নেমেও স্বস্তি নেই। খুচরা না থাকলে ডাইনে বায়ে থাকা কারো কাছ থেকে দুশ-তিনশ নিয়ে চান্দা পার্টিকে বিদায় করেন। নেতার অনুগামী হওয়াও বিপদ।
গত কালকের কথায় ধরা যাক। সকালেই কয়েকজন সাহায্য প্রার্থীকে বিদায় করতে হাজার পাঁচেক টাকা কোনদিকে যে হাওয়া হয়ে গেলো!
পার্টির কাজ সেরে সন্ধ্যায় বাড়ি আসার পর শুরু হলো উৎপাত। পহেলা এলো দক্ষিণপাড়ার যুব সমাজ। তারা ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করেছেন এলাকায়। বক্তা একজন নও মুসলিম। হাস্যরসেও নাকি ভানুর প্রায় কাছাকাছি। বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে লাফ দিয়ে চেয়ারের উপর আসীন হন। দারুণ ব্যাপার!
এই বাৎসরিক ইছালে ছওয়াবে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করে ১০ হাজার টাকা চাঁদা দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হলো মহাব্বত আলীকে। এই বেমক্কা প্রস্তাবে তার প্রস্রাবের বেগ কোন ফাঁকে যে গায়েব হয়ে গেলো, টের পেলেন না। তারপরেও তিনি ঠোঁটে মধুর হাসিটা অটুট রাখার চেষ্টা করলেন। তবে পার্টির কাজে ব্যস্ত থাকার অজুহাত দেখিয়ে ৫০০ টাকা দিয়ে বিদায় করলেন তৌহিদী যুবসমাজকে।
আধাঘণ্টার মধ্যে আর এক পার্টি এসে হাজির। জনাদশেক স্কুল কলেজের বাচ্চা বাচ্চা ছেলে। চলতি ফ্যাশান হিসেবে কয়েকজনের মুখভর্তি দাড়ি। এদেরই একজন লিডার। লম্বা সালাম দিয়ে পিকনিক আয়োজনের ফিরিস্তি তুলে ধরলেন। আমন্ত্রণ জানালেন মহাব্বত আলীকেও। পেটের গন্ডোগোলের অজুহাত দেখিয়ে ৫০০ টাকায় এই পার্টিকেও কোনমতে পগার পার করে দিলেন। কিন্তু মিনিট দশেক পর এক যুবনেতা বিরাট সাইজের এক মোটর সাইকেল নিয়ে নেতার ডেরায় হাজির। তার অনুসারীরা ব্যাডমিন্টন টুর্নামন্টের আয়োজন করেছেন। সেখানে বড় ধরণের একটা ডোনেশনের আবদার ফেঁদে বসলেন যুবসমাজের আইডল এই যুব নেতা।
এবার একটু বেকায়দা পড়লেন এবার মহাব্বত আলী। এসব যুবনেতাদের চটালে রাজনীতিতে ঠিকে থাকা কঠিন হয়-বুঝতে পারেন মহাব্বত আলী। এরা গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হয়ে নিজেদের জাত চেনাতে তৎপর। নেতা হতে গেলে এদের উপেক্ষা করা কঠিন। আর খাতির টাতির রাখতে গেলে বিরাট যন্ত্রণা চেপে বসে। প্রচুর খরচাপাতি করতে হয়। পদ নিতে ক্যাসিও পাড়ায় যেমন লাখ লাখ টাকার ভেট দিতে হয়, তেমনি পদ ধরে রাখতেও কড়ি ফেরতে হয় কাড়ি কাড়ি। আবার সেন্ট্রাল নেতাদের মেজাজ মর্জিমত তোয়াজের তেল নিয়ে হাজির থাকতে হয়। কী বিচিত্র রাজনীতি!
মহাব্বত আলী এক হাজার টাকা হাতে ধরিয়ে মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে অতিরিক্ত বিনয়ে বিগলিত হলেন। যুবনেতা মনে হয় তাতে খুব একটা খুশি হলেন না। চোখ দুটো হঠাৎ রক্তিম হয়ে উঠলো। চোয়ালে ক্রোধ যেন ঝিলিক মারছে। ছোট করে সালাম দিয়ে নিষ্ক্রান্ত হলেন সেই যুবনেতা।
অন্দরে ঢুকে স্ত্রী মর্জিনা বিবিকে নাস্তা দেয়ার হুকুম জারি করে হাত মুখ ধুতে গেলেন। এসময় মোবাইল ফোনটা তারস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপারে এক ছাত্রনেতার কণ্ঠ।
‘লিডার, আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। কী খবর ড্যানি? ভালো আছো? তোমার দেখাই পাওয়া যায়না! কোন দ্যাশে থাকো? একটু দেখাটেখা করিও।’
‘দেখা করার জন্যইতো এসেছি লিডার।’
‘কোথায়?’
‘আপনার বাড়ির বৈঠকখানায়। একটু কথা ছিলো।’
‘ঠিক আছে বসো।’
মনটা বিষন্ন হয়ে গেলো মহাব্বত আলীর। তিনি ধরেই নিলেন এই ছাত্রনেতাও কোন আবদার নিয়ে এসেছেন। হতে পারে কোন খেলা কিংবা পিকনিক।
‘শালারা আমাকে শ্যাষ করি দিবে। খালি চান্দা আর চান্দা। আমি অধম বান্দা। ’
‘ক্যা এলা বিরক্ত হন ক্যা?যখন লিডার লিডার কয়য়া মুখোত ফেনা তোলে, তখন খুব ভাল্নাগে, না?সংসারের কোন খবর নাই। সারাদিন রাজনীতি। দ্যাশের চৌদ্দগুষ্টি উনি উদ্ধার করেন! এদোন করি চললে মুই কিন্তু বাপের বাড়ি চলি যাইম। তোমরা বিরাট ন্যাতা হয়া একলায় সংসার করো। ছওয়াপোয়াক সামলান।’
‘আহারে বোকা মেয়েছেলে!রাজনীতি মানে টাকার গাছ। একটা ব্যবসা। ঠিকমত ব্যবসাটা করব্যার পাইলে তোর গলা সোনা দিয়া মোড়ে দিবার পাইম। সেটা বুছিস?’
‘হইছে,আর লোভ না দেখান! বিয়ার বারো বছরে কত সোনা দিলেন। বুড়া হয়া মুই সোনা দিয়া কী করিম?’
‘আরে ভাঙারি ব্যবসায় ইনকাম কম দেখিতো আমি রাজনীতি ব্যবসায় যোগ দিছি। একটু সবুর করো। সবুরে মেওয়া ফলে।’
‘হইছে। উগলা আশা না দ্যান। চান্দা পাট্টির হাত থাকি জীবনটা আগোত বাঁচান। তোমার রাজনীতি করার স্বাদটা মিটি যাউক।’
‘আইজ মেজাজটা খুব খারাপ। বেশি তেড়িবেড়ি করিওনা। আমি বাস্ট হইলে তোমার বিপদ!’
‘ভয় না দেখান। আইজ পাকসাকও বন্ধ। দেখি কী খান!’
খিচড়ে যাওয়া মেজাজটা বাগে আনার কোশেশ করতেই মোবাইলের রিমাইন্ডার।
‘আসছি’ বলেবৈঠকখানার দিকে রওনা হলেন। গিয়ে দেখলেন ছাত্রনেতা ড্যানি কয়েকজন সাগরেদ নিয়ে অপেক্ষমান।
‘কী ব্যাপার ড্যানি? খবর কী কও।’
‘লিডার, এই ছেলেরা সবাই মিলে পাড়ায় একটা ব্যাডমিন্টন খেলার আয়োজন করেছে। আপনাকেও অতিথি রাখা হয়েছে। এই নেন কার্ড।’
কার্ডে এক পলক চোখ বুলিয়ে মেজাজটা আবার খিচড়ে গেলো। তবে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে কার্ড ফেরত দিলেন মহাব্বত আলী।
‘শোনো আমার একটা জরুরি মিটিং আছে। আমি ওই সময় ব্যস্ত থাকবো। তোমরা অনুষ্ঠান করে নিও। আমার দোয়া রইল।’
আসলে কার্ডে থরে থরে সাজানো১৬ অতিথির মধ্যে নিচের দিকে নামটা দেখে গররাজী হলেন মহাব্বত আলী। সৌদি ফেরত এক জুনিয়ার ব্যবসায়ীকে তার নামের উপরে রাখায় এদের আক্কেল জ্ঞান নিয়ে সন্দেহটা ঘনীভূত হলো। প্রটোকল বলে একটা কথা আছে না? কে কাকে বোঝায়! আজকাল রাজনীতি কোন আদর্শের ব্যাপার নয়। গ্রুপ ভারি করে ব্যবসাটা জারি রাখাই মুখ্য উদ্দেশ্যে। এই ছাত্রনেতাও আগামীদিনে জেলা সভাপতির রেসে আছেন। তাই তাকে কিছু জ্ঞান আর নীতিকথা উগরে দিয়ে পাঁচশ টাকায় বিদায় করলেন।
বেডরুমে গিয়ে স্ত্রীকে বললেন, ‘কেউ খুঁজলে বলবে- বাসায় নাই! দান খয়রাত করতে করতে আমি ফতুর হয়া গেলাম।’
মহাব্বত আলী ডাবল লেপ গায়ে দিয়ে একটা সুখের ঘুম দেয়ার মনস্থির করে লেপের নিচে মুখ লুকালেন।
রাত ১০টার দিকে আর ছাত্রনেতা ইদ্রিছ আলী ফোন করলেন-‘লিডার একটু দেখা করতে চাই। জরুরি কথা আছে।’
‘গ্রুপিং ট্রুপিংয়ে আমি নাই।
‘না-না গ্রুপিং না। অন্য ব্যাপার।
‘কাল দেখা করো। আজ একটু অসুস্থ?’
‘আমিতো আপনার বাসার সামনে। আসবো?’
‘না-না। আমি বাসায় নাই। কাল আইসো।’-মহাব্বত আলীর কণ্ঠে আতংকের সুর। এবার ফোনটাও বন্ধ করে অনেকটা নিশ্চিত হলেন।
ছাত্রনেতাও ত্যাদর। তিনি দেখা করার জন্য বাসার বৈঠকখানায় ঘাপটি মেরে বসে থাকলেন দুই অনুসারীসহ। মহাব্বত আলীর সাত বছরের ছেলের রাত জাগার স্বভাব। রাত দুটোর আগে তার চক্ষু বন্ধ হয়না। এঘর ওঘর করে দাপিয়ে বেড়ান। বৈঠকখানায় গিয়ে তিনটা ছেলেকে বসে থাকতে দেখে বলেন-
‘কী চান আঙ্কেল?’
‘তোমার বাবার দেখা করবো। তোমার বাবা যখন বাসায় আসবেন-দেখা করেই চলে যাবো।’
‘বাবাতো বাসায়। বেডরুমে। দেখা করবে? আসো আসো।’-অনেকটা জোর করে অবুঝ ছেলেটা ছাত্রনেতা ইদ্রিছ আলীকে নিয়ে গেলেন রেডরুমে। মহাব্বত আলী লাজবাব। কী করবেন-ভেবে পাচ্ছেননা। ভাগ্য সহায়, মর্জিনা বেগম তখন রান্নায় ব্যস্ত।
‘লিডার আমাদের গ্রুপের প্রায় দেড়শ ছেলেকে নিয়ে কলেজমাঠে পিকনিকের আয়োজন করেছি। আপনার দাওয়াত থাকলো। আর যদি একটু শরিক হতেন-আমরা খুশি হতাম।’
‘ঠিক আছে। সবাই যখন পিকনিক করছে। তোমরা বাদ যাবে কেন? এই দুইশ টাকা নাও। আজ হাত খালি।’
‘কাল না হও দেখা করবো লিডার। আপনি রেস্ট করেন।’
‘আরে না কাল সুন্দরবন যাবো। দেখা পাইবা না। নাও। পরের প্রোগ্রামে দেখা যাবে।’
ছাত্রনেতা ইদ্রিছ আলীর জিহাদী জোস উস্কে উঠলো। বড় বড় চুলে ভরা মাথাটা বিচিত্র ভঙ্গিতে ঝাঁকা দিয়ে একশ টাকার দু’নোট মেঝেতে ছুঁটে ফেলে দিয়ে বীরদর্পে বেড়িয়ে গেলেন। এই ক্রোশ না থাকলে ছাত্রনেতা হওয়া কী মানায়!
মহাব্বত আলী আর রিস্ক নেয়া সমীচীন মনে করলেন না। এই বাসায় রাত কাটানোটাও খুব রিস্কি। বাধ্য হয়ে নিশিশয্যা পাতলেন বাড়ির পেছনের আমগাছে। রাতটা কাটানো গেলে তারপর চিন্তা করবেন।
তিন
মিছিলের সামনে মহাব্বত আলী। পেছনে কম বয়সী বেশ কিছু ছেলে। শ্লোগানে শ্লোগানে রাজপথ উত্তপ্ত। কেউ কেউ ছবি তুলে ফেসবুকে তাৎক্ষণিক আপলোড করছে। কেউবা ফেসবুক লাইভে মিছিল সরাসরি সম্প্রচার করছে। তাই মহাব্বত আলীকে অতিকষ্টে মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখতে হচ্ছে সারাক্ষণ।
তার দলের দুই নেতার মধ্যে গ্রুপিং তুঙ্গে। পাল্টাপাল্টি সমাবেশ-মিছিল আর শোডাউনে উজ্জীবিত সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা। মহাব্বত আলী আসলে কোন গ্রুপে যেতে চাননি। কিন্তু বিধির বিধান বলে কথা! তিনিও বলি হয়েছেন গ্রুপিংয়ের। মিছিলে লোকবল বেশি আনার প্রতিযোগিতায় তাকেও পড়তে হয়েছে। তা মিছিলে দলভারি করাতো চাট্রিখানি কথা নয়। বেকার-ভবঘুরে আর বিড়িখোরদের টানতে নগদ গুণতে হয়। ওরা হালখাতায় বিশ্বাসী নয়।
সমাবেশে মহাব্বত আলী একখানা জ্বালাময়ী বক্তব্য দিলেন। তার বক্তব্যে মোট পাঁচবার হাততালি আর তিনবারশ্লোগান গর্জে উঠেছিলো। এরকম অবস্থায় নেতা হবার বিড়ম্বনাটুকু ভুলেই যান তিনি। শরীরে একটা গায়েবী শক্তি আসে। লোম শিউরে যায়।
কিন্তু সমাবেশ শেষ হবার পর সেই পুরোনো চিত্র।
মহাব্বত আলী যেখানেই যাচ্ছেন সেখানেই জটলা। কম বয়সী বিড়িখোরদের দৌরাত্মে অতিষ্ট তিনি। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবির পকেট প্রায় ফাঁক হয়ে উঠলো। মহাব্বত আলী রণেভঙ্গ দিয়ে মোটর সাইকেল স্ট্রার্ট দিয়ে বাড়িমুখো হন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সেখানেও সমর্থক-ভক্তদের ঢল নামে। সবাই টাকা চায়। দুপুরের খাবার-যাতায়াত-পান বিড়ি, এমনকি গাঁজা খাওয়ার ধান্ধাও করছে কেউ কেউ।
বাসার সামনে এসে নানা কথায় আপ্লুত করে ভক্তদের বিদায় দিতে গলদঘর্ম তিনি। এসময় একটি মিশকিনের দল সেখানে যায়। তারা সমস্বরে গান ধরে-
আমার দয়াল বাবা কেবলা কাবা
আয়নার কারিগর
আয়না বসাইয়া দেমোর
কলবের ভেতর।
কলেমা পার্টি। দলনেতা ফয়জুদ্দি ভিড় ঠেলে নেতার মুখোমুখি। ফয়জুদ্দির কাঁধে ঝুলছে শান্তি নিকেতনি ঝোলা ব্যাগ। হাতে মোবাইল ফোন। স্মার্ট ফকির। অল টাইম বিজি। তিন দিন, সাতদিন, চল্লিশায় কন্ট্রাকে যান।
‘ভাই কলেমা পড়তে হবে নাকি? যদি বলেন শুরু করি।’
‘আমার চল্লিশার দিন পড়িও। বেআক্কেল কোথাকার।’
‘ভাই সাহেব। আজনীতি করেন। বিপদ-আপদ-ফাঁড়াতো নাগি থাকে। তা দোয়া ইউনুছ পড়ার দরকার হইলে ডাকান। হামরা চাইরজন। বেশি নোয়ায় দুই হাজার টাকা নিমো। আর ভর প্যাট খোয়াইলে চলবে।’
‘এয় চল। তাড়াতাড়ি হাটো।’ ফয়জুদ্দি দলের সদস্যদের তাড়া দিয়ে অন্য রাস্তা ধরে। যাবার সময় সেই গান ধরে উচ্চম্বরে।
দয়ালবাবা কেবলা কাবা
আয়নার কারিগর…
মহাব্বত আলী ভাবছেন রাজনীতির ফাঁড়া কাটাতে এই কলেমা পার্টিকে দিয়ে অবিলম্বে দোয়া ইউনুছ পড়িয়ে নিবেন।
Leave a Reply